ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১

নাটকের সংলাপ ভাবনা ও শিল্পগুণ

মোস্তাফিজুল হক

প্রকাশিত: ২২:২৭, ৪ জুলাই ২০২৪

নাটকের সংলাপ ভাবনা ও শিল্পগুণ

অন্যান্য সাহিত্য থেকে নাটকের আঙ্গিক ও গঠনকৌশল সম্পূর্ণ আলাদা

অন্যান্য সাহিত্য থেকে নাটকের আঙ্গিক ও গঠনকৌশল সম্পূর্ণ আলাদা। নাটকের সঙ্গে পাঠক বা দর্শক ও শ্রোতার সম্পর্ক সরাসরি ও প্রত্যক্ষ। ফলে নাটকের ভাষা ও ভাবনা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের দাবি রাখে। প্রতিটি নাটকে প্রধান চারটি উপাদান থাকে। এগুলো হচ্ছে- ১. কাহিনী বা বিষয়, ২. চরিত্র, ৩. সংলাপ, ৪. মঞ্চ সজ্জা বা পরিবেশ।
একজন নাট্যকারকে এ চারটি উপাদানের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রেখে নাট্যভাবনাকে এগিয়ে নিতে হয়। প্রতিটি নাটকে একটি নির্দিষ্ট কাহিনী থাকে। মানবজীবন মূল অবলম্বন হলেও মানুষের সম্পূর্ণ জীবন নাটকে উপস্থাপন করা যায় না। নাট্যকারকে সব সময় মনে রাখতে হয়, নাটক নির্দিষ্ট চরিত্রের সংলাপ বর্ণনায় বা অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে হয়।

তাই কাহিনীর মধ্যে এমন কিছু আনা যাবে না, যা মঞ্চে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। সংলাপের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ ভাষার সংযোজনেই নাটক গতিশীলতা অর্জন করে। চরিত্রের বাহুল্যদোষে সংলাপবাহুল্যের প্রবণতাকে এড়ানো যায় না- এতে নাটকের শিল্পরস আস্বাদনে ব্যাঘাত ঘটে।
উল্লিখিত প্রেক্ষিত বিবেচনায় একটি নাটকের ব্যবচ্ছেদ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে মাইকেল মধুসূদন দত্তের সার্থক ট্র্যাজেডি নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’র বিশদ বিশ্লেষণ অধিক যুক্তিযুক্ত। এর নেপথ্য কারণ হলো, এ নাটকের কাহিনী বা বিষয়বস্তু, চরিত্র চিত্রণ, সংলাপ ও নাট্যভাষা এবং মঞ্চ সজ্জা বা পরিবেশ যথেষ্ট সুসংহত ও সুপরিকল্পিত। এ কথা সত্য যে, ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে সেরকম কোনো বাহুল্যদোষ লক্ষ্য করা যায় না।
অ্যারিস্টটলের মতে, নাট্যোপাদানে বৃত্ত বা চষড়ঃ সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হয়। নাটকের ভাষা ও সংলাপকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে ‘বৃত্ত’। বৃত্ত নাটকের বিষয়বস্তুকে ধারণ করে বিভিন্ন অঙ্কে বিভক্ত হয়ে নাট্যপ্রবাহকে গতিশীলতা দান করে। বৃত্তে নাটকের মূল কাহিনীর সঙ্গে উপকাহিনীও যুক্ত হতে পারে। তবে নাটকের মূল ঘটনাকে প্রাধান্য দিতে নাট্যকারকে সচেতন থাকতে হয়। কাহিনীকে সাজাতে হলে চরিত্রের প্রয়োজন হয়।

কারণ বিশেষ বিশেষ চরিত্র ছাড়া নাটকের কাহিনী দাঁড়াবে না। তাই নাট্যকারকে প্রথমেই কিছু চরিত্র নির্বাচন করতে হয়। নাটকে একটি প্রধান চরিত্র থাকে। প্রধান চরিত্রকে কেন্দ্র করেই নাট্যঘটনা বিকশিত হয়। প্রধান চরিত্র একা একা কথা বলতে পারে না। তাই আরও কিছু চরিত্রের প্রয়োজন হয়। এরা সবাই মিলে নাটকের কাহিনীকে পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। প্রত্যেক নাটকেই দুইগুচ্ছ চরিত্র থাকে। কারণ, পৃথিবীর যেকোনো সমস্যায় কমপক্ষে দুটি পক্ষ থাকে।

একপক্ষ বিশেষ একটি কাজকে সমর্থন করে, অন্যপক্ষ তার বিরোধিতা করে। এ দ্বিপাক্ষিক দ্বন্দ্ব ও বিরোধের মধ্য দিয়েই নাট্যকাহিনীতে চরিত্র বিকশিত হয়। ট্রাজেডির চরিত্র কেমন হবে সে সম্পর্কে অ্যারিস্টটল যা বলেছেন, তা মূলত সব নাটকের চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাঁর মতে
ক. চরিত্রে ভালো-মন্দের সমাবেশ থাকবে;
খ. চরিত্র হতে হবে যথাযথ;
গ. চরিত্র হতে হবে বাস্তবসম্মত;
ঘ. নাটকের চরিত্রকে হতে হবে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
নাট্যভাবনায় মধুসূদন দত্ত নাটকের সংলাপ নির্মাণে উল্লিখিত চরিত্রগুলোর যথাযথ সন্নিবেশ ঘটাতে পেরেছেন। কেননা, নাটকের মধ্যে অনেক চরিত্র থাকতে পারে, তবে নাটকের গতি একটি কি দুটি প্রধান চরিত্রকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়। প্রধান চরিত্রের উপরই নাটকের সার্থকতা বহুলাংশে নির্ভর করে। তাই প্রধান চরিত্র রূপায়ণে নাট্যকারকে দক্ষতার পরিচয় দিতে হয়। এসব বিবেচনায় দেখা যায় যে, ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র কৃষ্ণা বা কৃষ্ণকুমারী এবং সহযোগী চরিত্রগুলো হলো : মদনিকা, ভীমসিংহ, জগৎসিংহ, ধনদাস প্রমুখ। সমগ্র নাটকটি কৃষ্ণকুমারীকে কেন্দ্র করেই এগিয়ে গেছে।
কাহিনী ও চরিত্র পাওয়া গেলেই নাটক হবে না। কারণ চরিত্রগুলোকে কথা বলাতে হবে। কথা বলানোর জন্য চাই সংলাপ। সংলাপ কাহিনী ও চরিত্রকে সুস্পষ্ট করে পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। এক চরিত্রের সঙ্গে অন্য চরিত্রের সংলাপ বিনিময়ের মাধ্যমেই কাহিনী বিকশিত হয়। সংলাপ নাটকের তিনটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে সুসম্পন্ন করে। এগুলো হচ্ছে-
ক. নাট্যকারের বক্তব্যকে প্রকাশ ও প্রমাণ করে
খ. চরিত্রসমূহের প্রকাশ ও বিকাশ ঘটায়
গ. সংলাপ নাটককে এগিয়ে নিয়ে যায়
মূলত ‘সংলাপ নাটকের প্রাণ’। সংলাপই নাট্যপরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং সংলাপ ব্যর্থ হলে, নাট্যরস ক্ষুণœ হয়। কৃষ্ণকুমারী নাটকের ভাষা ও সংলাপ ভাবনা ঐশ্বর্যের হিরণ্যদীপ্তি, মত্তমদির প্রমত্ততা, শক্তি সম্পদের প্রতি শ্লেষহীন লুব্ধতা, কুটিলতা ও যুদ্ধকেন্দ্রিক রণোন্মত্ততা, হানাহানির মাধুর্যে ব্যাপ্ত পরীক্ষিত ও কালোত্তীর্ণ এক ঐতিহাসিক নাটক। গল্প বা উপন্যাসে বর্ণনার অবকাশ থাকায় লেখক কথা বলতে পারেন। কিন্তু নাটকে সে সুযোগ না থাকায় নাট্যকারকে সংলাপের মাধ্যমেই সব কাজ করতে হয়।

ফলে মধুসূদন দত্ত তাঁর নাটকে ‘রাজস্থান’ গ্রন্থের সমুদয় কাহিনী সংলাপে ঠাঁই না দিয়ে নাট্যরস ও নাটকের শিল্পগুণকে ওজস্বিতা দিয়েছেন। তিনি সংলাপের ভাষাকে শুধু চরিত্র ও পরিবেশ অনুযায়ী তৈরি করেননি, বরং আবেগ, দ্বন্দ্ব, উৎকণ্ঠা ইত্যাদিও ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে মধুসূদন দত্তের ‘কৃষ্ণকুমারী’ চূড়ান্তরূপে সফল এবং চিন্তাশীল পাঠক বা দর্শকশ্রোতার প্রশংসার দাবিদার। বলেন্দ্রসিংহ ও তপস্বিনীর উৎকণ্ঠা ও হাহাকারের পাশাপাশি রাজ-রাজরার মতোই দ্বান্দ্বিক চরিত্রে মদনিকার উপস্থিতি নাট্যকারের আদর্শ সংলাপ ভাবনার বহিঃপ্রকাশ।

দক্ষ নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন নাটকের সংলাপে রাজা ভীম সিংহের জন্য রাজোচিত সংলাপ সংযোজন করেননি। রাজা হিসেবে ভীম সিংহের অসহায়ত্ব রাজোচিত না হলেও ঐশ্বর্যহীনতাকে যথার্থই ফুটিয়ে তুলেছেন। রানিমাতা অহল্যাদেবীর অবেগময় সংলাপ নির্মাণে স্বভাবসুলভ মাতৃত্বকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
নাটকের সংলাপের ভাষা শুধু ভাব প্রকাশেই সীমিত থাকে না, বরং ভাষার যথার্থতা নাটকের গতিসঞ্চার করে। ফলে নাট্যকারকে সংলাপের শব্দযোগ, বাক্যবিন্যাস ও বাক্যের পারস্পরিক সংযোগেও সতর্ক এবং যতœবান হতে হয়। স্নেহশীল কাকা বলেন্দ্রসিংহের কাছে নিজ জীবননাশের কারণ শোনার পর কৃষ্ণার সংলাপে: ‘কাকা, আমার পিতারও কি এই ইচ্ছা’ হৃদয়ে করুণরস ও পিতার অক্ষমতাকে আরও গভীরতর করে তোলে।
সংলাপের ভাষা অতিবাস্তব না হয়ে শৈল্পিক হতে হয়। এজন্য সংলাপের ভাষাকে সাজিয়ে গুছিয়ে বর্ণ ও সুরের সমাবেশে ফুটিয়ে তুলতে হয়। এ প্রসঙ্গে অ্যারিস্টটল মতবাদ হলো, ‘ঞযব ঢ়বৎভবপঃরড়হ ড়ভ উরপঃরড়হ রং ভড়ৎ রঃ ঃড় নব ধঃ ড়হপব পষবধৎ ধহফ হড়ঃ সবধহ.’ সাধারণ এবং অসাধারণ ভাষা ব্যবহারেই নাটকের সংলাপ নিখুঁত হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রেও মাইকেল মধুসূদন দত্ত কৃষ্ণকুমারী নাটকের নাট্যভাষা নির্মাণে সার্থক ও সফল।
নাটকের সংলাপ গদ্য বা পদ্যরীতি অবলম্বন করে তৈরি হতে পারে। তবে বিষয়বস্তু এবং নাট্যরস বিবেচনায় এর যেকোনো একটি রীতি সংলাপে ব্যবহৃত হয়। গ্রিক নাট্যভাষায় পদ্যরীতি ব্যবহৃত হয়েছে। শেক্সপিয়রের নাটকেও তাই ঘটেছে। আধুনিক নাটকের সংলাপে সাধারণত গদ্যরীতি ব্যবহৃত হয়। তবে বিষয়ের প্রয়োজনে নাটকের সংলাপে এখনো অনেকেই পদ্যরীতি ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত আধুনিকতাকে সর্বাংশে প্রাধান্য দিলেও প্রয়োজনকে এড়িয়ে যাননি।

নাট্যকাহিনি, চরিত্র এবং সংলাপকে অর্থবহ ও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে নাট্যকার পরিবেশ তৈরি করেন। নাচ, গান, শব্দ সংযোজন, আলোকবিন্যাস, কাহিনী অনুযায়ী দৃশ্য ও মঞ্চ নির্মাণের মাধ্যমে নাটকের পরিবেশ নির্মিত হয়। পরিবেশ যথার্থ না হলে নাটকের শিল্পগুণ ক্ষুণœ হয়। তাই নাট্যপরিবেশ নির্মাণে নাট্যকারকে খুবই সতর্ক থাকতে হয়। নাট্যকার এমন কোনো পরিবেশ নির্মাণ করতে পারেন না, যা মঞ্চে উপস্থাপন করা যাবে না। নাটক নির্মাতা মাইকেল মধুসূদন ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের পরিবেশ তৈরিতে এ বিষয়েও যথেষ্ট যতœবান ছিলেন।

তিনি নাটকের গান পরিবেশ উপযোগী করার ভাবনা থেকে সরাসরি অভিনয় শিল্পীর কণ্ঠে উপস্থাপনে বিরত থেকেছেন। কেননা, পাত্রপাত্রীর কণ্ঠে গান পরিবেশন হলে সংলাপের মধুমিষ্টতা গানের বেসুরো গলার কারণে বিলীন হয়ে যায়। ফলে সংলাপের মধুমিষ্টতা রক্ষার তাগিদেই নাট্যকার নেপথ্য গান সংযোজন করে স্বস্তি পেয়েছেন। সুতরাং সকল দিক বিবেচনায় কৃষ্ণকুমারী নাটকের শিল্পশৈলী, ভাষা ও সংলাপের প্রয়োগকে সাবলীল ও সার্থক বলা যায়।

×