পার্বণের রান্না
নারীর ক্ষমতায়নের গুরুত্বপূর্ণ একটি হাতিয়ার হচ্ছে রান্না। বাঙালি মেয়েদের রান্নার হাতেখড়ি হয় বেশির ভাগ মায়েদের কাছ থেকে। রান্না এখন একটি বড় শিল্প। এর অর্থনৈতিক যেমন মূল্য আছে; তেমনি আছে এর সামাজিক প্রভাব। তিন দশক ধরে দেশে রন্ধন শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। উত্তম রান্না এমন একটি প্রক্রিয়া যা দিয়ে যে কোনো লোককে খুশি করা যায়। তা যে কোনো কাজ আদায়ের ভিত্তিও।
এসব অর্থনৈতিক দর্শনকে সামনে রেখে ড. প্রতিমা পাল মজুমদারের দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘বাংলাদেশের পার্বণের রান্না’ প্রকাশিত হয়েছে বছরের শুরুতেই। প্রকাশক বেঙ্গল পাবলিকেশন্স এর স্বত্বাধিকারী আবুল খায়ের। মহানগরীর ধানম-ি থেকে প্রকাশিত গৃহস্থালীর অতি প্রয়োজনীয় সাড়ে ৮ ফর্মার অফসেট কাগজে শক্ত বাঁধাইয়ের বইটির অক্ষর বিন্যাস করেছেন আব্দুর রাজ্জাক। প্রচ্ছদ সৈয়দ ইকবাল হোসেনের। এর মূল্য ছাড় ছাড়া ৪০০ টাকা বা ১৫ মার্কিন ডলার।
লেখকের ভাষ্য- রান্নার গুণটি মাকে আমার বাবার সঙ্গে লড়ার ক্ষমতা দিয়েছিল। প্রচলিত প্রথা হিসেবে আমাদের পরিবারে পুরুষেরই ছিল সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। কারণ, পুরুষরাই আয় রোজগার করতেন আর মেয়েরা সামলাতেন ঘরের কাজ। পরিবারের সবার মুখে খাবার জোগানোর জন্য রান্নাঘর সামলানোর কাজটি করতে হতো নারীদের। কিন্তু এ কাজের কোনো আর্থিক মূল্য ছিল না। ভোর থেকে রাত অবধি নারী অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন, কিন্তু এগুলোকে কোনো ‘কাজ’ বলে মনে করা হতো না। যার কাজের কোনো অর্থমূল্য নেই, তার কোনো কথা বা মতামতও ছিল পরিবারে মূল্যহীন।
আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি, তখনই বাবা আমার বিয়ের তোড়জোড় শুরু করেন। কিন্তু আমি চাইতাম আরও লেখাপড়া করতে। মা ছিলেন আমার পক্ষে। বাবা যতবার আমার বিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন, ততবারই মা বাধা দিয়েছেন এবং সফল হয়েছেন। মাতো আয়-রোজগার করতেন না। তারপরও বাবা কেন তার কথায় প্রভাবিত হতেন?
পরিবারের কোনো বিষয়ে মতামতকে প্রভাবিত করার জন্য কোনো না কোনো ক্ষমতা থাকতে হয়। আমার মায়ের ক্ষমতা ছিল রান্না। প্রস্তর যুগে আগুন আবিষ্কারের পর থেকে রন্ধন প্রক্রিয়ার উদ্ভব হয়েছে। সেই থেকে মানুষের রসনাবিলাস প্রক্রিয়ার প্রধান কুশলী হচ্ছে নারী। বাবার রসনাবিলাস পূরণে মা সক্ষম ছিলেন বলেই তার সিদ্ধান্ত বদলে মা ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন। অল্প বয়সে আমার বিয়ে আটকে দিয়ে মা এটা প্রমাণ করেছেন, রন্ধন শিল্পও নারীর ক্ষমতায়নের হাতিয়ার হতে পারে। আর অপরিপক্ব বয়সে বিয়ে হয়নি বলে বিশ^বিদ্যালয় অবধি পড়াশোনা শেষ করে কর্মযজ্ঞে আত্মনিয়োগের সুযোগ পেয়েছি।
রান্না আজ শুধু নারীর রান্নাঘরেই সীমাবদ্ধ নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি অর্থকরী মাত্রা এবং পরিণত হয়েছে একটি ব্যবসায়ে। রান্নার ওপর পরিবারের সদস্যদের মনের আনন্দ ও সন্তুষ্টিই শুধু নির্ভর করে না, তাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তাও এর ওপর বর্তায়।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ উৎসব ও পার্বণই ঋতুভত্তিক। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উৎসব ও পার্বণ ধর্মভিত্তিক। অবশ্য বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন একটি পীঠস্থান যে, ধর্মীয় পার্বণগুলোও প্রায় সার্বজনীন হয়ে উঠেছে।
সময়ের বিবর্তনে দেশের উৎসব ও পার্বণের বৈচিত্র্যপূর্ণ সনাতনী রান্নাগুলো প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। তার একটি মূল কারণ হচ্ছে, আধুনিক সভ্যতায় বাংলাদেশের নারী আজ ঘরকন্না কাজের সঙ্গে সঙ্গে ঘরের বাইরে অর্থকরী কাজেও যোগ দিয়েছেন। ফলে তার সময় নিয়ে চলছে টানাপোড়েন। উৎসব পার্বণের বেশিরভাগ খাবারের রন্ধন প্রণালি খুব সময়ঘন, যা করার জন্য আজকের কর্মজীবী নারীদের হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকে না।
মা স্বর্গীয় পুষ্প রানী পালকে উৎসর্গকৃত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. প্রতিমা পাল মজুমদারের বাংলাদেশের পার্বণের রান্না শীর্ষক গ্রন্থটির রয়েছে সাতটি অধ্যায়। প্রায় ১০০টি পদের রান্নার বিবরণে প্রণালি এবং কি কি উপকরণ লাগে তা বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। তবে দেশের বিস্তীর্ণ জনপদে অনেক রান্নারই বইতে উল্লেখ নেই। দ্বিতীয় সংস্করণে আশা করি তা যুক্ত হবে। বইটি পাঠপ্রিয়তা পাবে সে বিশ্বাস রয়েছে।