ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০১ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১

স্বভাবকবি বিপিন সরকার

সৌরভ দুর্জয়

প্রকাশিত: ২২:২৫, ২৭ জুন ২০২৪

স্বভাবকবি বিপিন সরকার

স্বভাবকবি বিপিন সরকার

শোঁ শোঁ শব্দে বাতাস খেলা করছে শিশু ধানের কচি পাতার সঙ্গে। আকাশে অনূঢ়া সূর্য রাগে মুখ গম্ভীর করে আছে। দলে দলে বিভক্ত কৃষকদের হাতের কাস্তে যুদ্ধ করছে আগাছার সঙ্গে। তাঁদের মাথার মাথাল যেন শিরস্ত্রাণ। গায়ের ছিন্ন বস্ত্রই হলো লৌহবর্ম। বিশাল মাঠের মধ্যে এমন দৃশ্য সহজলভ্য হলেও একদল কৃষকের দৃশ্যপটে একটু ভিন্ন রকমের বাড়তি ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে। শীর্ণকায় শরীরের খর্বাকৃতির দ্রাবিড় বর্ণের একজন কৃষক; তৃষিত গলার অমৃত ঢেলে গেয়ে যাচ্ছেন গান। অন্য কৃষক দোহার হয়ে মনের সুখে ক্লান্তির ঘাম মুছে মুছে করছেন কর্ম সম্পাদন।

শুষ্ক মাঠের রুক্ষ যুদ্ধে অমৃত সুধা প্রদানকারী এই কৃষক শুধু তৃপ্তির মশক ভরার জন্য; নিজের লেখা গান গেয়ে সহকর্মীদের উৎসাহ দিচ্ছেন না। ক্ষুধার হাঁড়িতে দু’মুঠো চালের জোগানের নেপথ্যের তাড়াও আছে এই গানের মধ্যে। ভাঙা ঘরের বাঁশের খুঁটি বদলানোর জন্য। মায়ের এবং সহধর্মিণীর আব্রু ঢাকার জন্য। অভাবের দানবকে মনের খাঁচায় আটকে রেখে সুরেলা গলায় ঢেলে দিচ্ছেন অমৃত সুধা। তপ্ত রোদের তীর্যক ফলার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে কিংবা ক্ষুধার হাঁড়িতে দু’মুঠো চালের জোগান দিতে মায়াবী গলায় গান গেয়ে যাওয়া এই কোকিলকৃষক কে? যিনি দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন সুরের তীর ছুড়ে। যে তীরের আঘাতে রক্ত ঝরে না।

ঝরে প্রশান্তির বৃষ্টি। কাকে স্রষ্টা এমন শক্তি দিলেন? যিনি খর্বাকৃতির মানুষ। শীর্ণকায় শরীর। অথচ ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর ক্লান্তির দৈত্যকে পরাস্ত করার চেষ্টা করেছেন তাঁর কলম দিয়ে? মানুষের মন জয় করেছেন তাঁর কণ্ঠ দিয়ে? তিনি হলেন নড়াইলের স্বভাবকবি বিপিন সরকার।
স্বভাবকবি বলতে এমন কবিকে বোঝায়, যাঁর স্বভাব বা অভ্যাস হলো কবিতা লেখা। যেখানে ফুটে ওঠে কবির নিজস্বতা। দরকার হয় না কবিতার প্রচলিত ব্যাকরণ। তথা ছন্দ, মাত্রা, উপমা, রস, উৎপ্রেক্ষা, অনুপ্রাস, এসব ছকে ফেলে লেখা হয় না কবিতা। কবির অন্তর নিংড়ানো ছন্দে লিখে থাকেন। অনেক স্বভাবকবি নিজে লিখতেও জানেন না। নিজে বলে যান অন্য কেউ লিখে দেন। স্বভাবকবিদের কবিতা জনমনে এক অন্যরকম দোলা দিয়ে থাকে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি গোবিন্দ চন্দ্র দাস (১৬ই জানুয়ারি ১৮৫৫Ñ১লা অক্টোবর ১৯১৮)-কে স্বভাবকবি বলা হয়। যিনি জীবনে অনেক দুঃখ, কষ্ট, জরা, মরা উপেক্ষা করে লিখে গেছেন অনেক কালোত্তীর্ণ কবিতা। যিনি মানতেন কবিতার ব্যাকরণ।
নড়াইলের বিপিন সরকারও ছিলেন একজন স্বভাবকবি। দারিদ্র্যের বেড়া ঘিরে রেখেছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরজা কিংবা গুরুর ডেরা। তাই কবির ছিল না কোনো শিক্ষা সনদ। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। দারিদ্র্যের জাঁতাকলে মটর ডালের মতো পিষ্ট হয়েছেন। তবু থেমে থাকেনি তাঁর সাহিত্য চর্চা। স্বভাবকবি বিপিন সরকার কবিতায় সৃষ্টি করেছেন এক নিজস্বতা। তাঁর ‘হুজুকে বাঙ্গালী’ কবিতা নিয়ে দু-চার কথা বললেই বোঝা যাবে কত বড় মাপের স্বভাবকবি ছিলেন।  তিনি লিখেছেন :
রবিবারে হাটের দিনে/মাছ ও তরকারি কিনে/তেল লবণের দোকানে হাজির,/ খবর দিলো নব’র কাকা/ পকেট মেরে পঞ্চাশ টাকা/ নিয়ে গেছে কেরামত কাজির।/ কানো বলে ধানো হাটায় / মার দিয়েছে পকেট কাটায়/হিরে মনির চিড়ে বেচা টাহা,/গরিব মানুষ চিড়ে কুটে/ খাচ্ছিলো ভাই খেটে খুটে/আঁচল কেটে সবই নিছে আহা।/দোকান দারে মাপে তেল/দাবি করলো হাবীজেল/তেলে কেন মাথা হচ্ছে আঠা?/ উত্তর দিতে কয় দোকানী / আমরা তো বানাই না ঘানি/ শেষ করতে পারলো না কথাটা।/ হঠাৎ ভাইরে ফঠাৎ করে/ শব্দ হলো পরে/ হাটের মানুষ বেহুঁশ হয়ে গেল,/ঝপা ঝপ পড়িছে ঝাপ/ ভরা হাটে ডাকাত পড়িল।/ছোটে মানুষ বিসুদ হয়ে /চাটি পাটি মাড়াইয়ে/ পড়ায় ছড়ালো  চাল ধান,/কেহ ঢালে কেরোসিন / কারো ভালো তেলের টিন/ ছড়ালো ঝাল পিঁয়াজের দোকান।/পাল মশায়দের কপাল পোড়া/ভাঙ্গিলে আর যায় না জোড়া/ গুড়ো গাড়া অনেক হয়ে গেল,/ ধামা কাহে শ্যামা বুড়ি/ গুড়ে হাটায় গড়াগড়ি /দুই-তিন কুড়ি পাড়ায়ে চলিল।/ছালা মাথায় ছলিমদ্দি/ কলা হাতে কালাবদ্যি/ পালায় ছুটে কে করে কার খোঁজ, / গুতো খেয়ে ভুতোর পিসি/ ভাঙ্গে ভালো তেলের শিশি/কানা শশীর পায়ে ফোটে সে গোজ।/ ছুটে যেতে কুটে মোল্লা/ ঢালে গামলার রসগোল্লা /নসরুল্লা আল্লা আল্লা বলে,/বাঁচার আশায় বাসে উঠে / মরে মানুষ চাপের চোটে/ খেয়া ঘাটে ডোবায় খেয়া ডিঙ্গি,/যোয়ান মদ্দ যত ব্যক্তি / দেখাইলো দেহের শক্তি / পালাইলো ফেলে কাপড় লুঙ্গি। /সবাই বলে পালা পালা/ কি ঘটিছে যায় না বলা/ সকলেরই অন্তরে সন্দেহ, / হাট ছেড়ে সব পালাইলো/ কত কি যে হারাইলো/ আসল সত্য জানিলো না কেহ।/পরের দিনে গেলো জানা, /খুন ডাকাতি কিছুুই না/ কোনখানে হয় নাই ফায়ার,/পকেট মারা ধরতে গিয়ে/কিছু মানুষ চলে ধেয়ে/ফাটে তখন ভ্যান গাড়ির টায়ার।/দৌড় দেখে হয় দৌড়া দৌড়ি /ছেলে মেয়ে বুড়াবুড়ি /গড়াগড়ি কতো লোকে খায়,/হাজার মানুষ বাজার ভরা/ রুখে যদি দাঁড়ায় তারা/রাজার সৈন্য পিছু হটে যায়।/এইতো বাঙ্গালীর ধারা /কিছু একটা হলে তারা/ঝুঁকে পড়ে হুজুকে বাঙ্গালী, /না বুঝিয়া মূল মর্ম / আগে করে ভুল কর্ম/ বুদ্ধি দোষে হয় কাঙ্গালী।
হুজুকে বাঙ্গালী কবিতায় কবি আমাদের যাপিত জীবনে নিত্যদিন ঘটে যাওয়া গ্রাম্য হাটের কিছু ঘটনাকে উপজীব্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কিভাবে পকেটমারকারিকে তাড়া দেওয়ার সময় কাকতালীয়ভাবে একটা ভ্যানের টায়ার ফেটে যায়। গুজব রটে যায় হাটে ডাকাত পড়েছে। এবং গুলি করেছে। যে যেভাবে পারে পালাতে চেষ্টা করে। পরিণতিতে ভেঙে যায় পাল মশাইদের  হাঁড়ি, কলস। নষ্ট হয় চাল ব্যবসায়ীদের চাল।

গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায় গুড়। পরের দিন জানা গেল ডাকাতরা গুলি করেনি, আসলে ফেটেছিল ভ্যানের টায়ার। এই কবিতায় পাতিমাস্তানদের কথাও উঠে এসেছে। ব্যবহৃত হয়েছে টাহা, কাহে, গুঁড়োগাড়ার মতো আঞ্চলিক শব্দ। যাপিত জীবনের নিত্যদিনের একটা ঘটনাকে নিজস্বতার রূপ দিয়ে সৃষ্টি করছেন এক জনপ্রিয় কবিতা। এমনি ভাবে তাঁর সমস্ত কবিতা ও গান বিগলিত করে সাধারণ মানুষের প্রাণ। আর তাইতো তিনি স্বভাবকবি।
স্বভাবকবি বিপিন সরকার নড়াইল জেলার পৌর এলাকার বাহিরডাঙ্গায় ১৯২৩ সালের ২২ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০১৫ সালের ২৭ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ৮ খানা কাব্যগ্রন্থ, ২০টি অষ্টক যাত্রাপালা, ১৪টি পালাগান রচনা করেন। লিখেছেন ১ হাজার হালুই গান, ২ শতাধিক ধুয়ো ও বারাসিয়া গান। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি : নড়াইল, গ্রন্থে স্বভাবকবি বিপিন সরকারের একটা ধুয়ো গান (কর্ম সংগীত)  প্রকাশিত হয়েছে। গানটি হলো :
বিজ্ঞান বলে – ভূম-লে নিত্য নতুন আবিষ্কার /মানুষের অসাধ্য ভবে কিছু নাইরে আর/
শূন্যের পরে রকেট চলে- ছবির মানুষ কথা বলে/
টকির হলে -দেখতে পাই তা চমৎকার। / আবার নিমেষে পাই বিশ্বের খবর - থাকলে ঘরে ট্রানজিস্টার/আর এক কৃতি টেলিভিশন / মানুষের ছবি যায় সাত সাগরের পার।/ঐ---/
হয়ে রঞ্জণপতি মানব জাতি পেয়েছে বড় আরাম/ এক্সেরেতে পড়ছে ধরা শরীরের ব্যারাম/ আবার নতুন কিছু পাবার জন্যে রকেট চলে মহাশূন্যে / মাটির মানুষ পৌঁছায় গিয়ে চন্দ্রধাম/ এখন যন্ত্র বলে সবই চলে পায়ে চলা হাতের কাম/শুধু মরণ বারণ করতে পারলে/ এ ভবে কেউ নিতো আর খোদার নাম।।/ঐ---/
যত কিছু করলো নিজেদের সুখের কারণ/ এটম বোমা হলো বিশ্বের অকালে মরণ/এই এটমের বিভীষিকা হিরোশিমা নাগাশিকা/নিমেষে লক্ষ লোক হারায় জীবন/নিজেদেরই মারণ অস্ত্র তৈয়ের করছে মানবগণ/ভেবে বিপিন বলে করিস নারে- নিজেদের ধ্বংস যজ্ঞের আয়োজন /ঐ---।
এই গুণী মানুষের সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল ১৯৮৭ সালে আমার কৈশোর কালে। তারপর ঘনিষ্ঠতা। খুব অল্প দিনের জন্য। তবু মনে হয় অনেক দিনের চেনা জানা। 
১৯৮৭ সালের কথা। তখন বিপিন সরকার পেয়ে গেছেন কবিখ্যাতি। প্রকাশিত হয়েছে কবিতার বই। ঠিক তেমনি সময়ে তৎকালীন লোহাগড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আব্দুস সবুর (বর্তমানে প্রয়াত)  গঠন করেছিলেন ‘নড়াইল জেলা ইতিহাস ও কৃষ্টি পরিষদ’। সভাপতি ছিলেন শেখ আব্দুস সবুর। সাধারণ সম্পাদক কবি সৈয়দ মহসিন হোসাইন। স্বভাবকবি বিপিন সরকার ছিলেন উপদেষ্টা। আমি ছিলাম মূল কমিটির সদস্য এবং লোহাগড়া উপজেলা শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।

মাঝে-মধ্যে শেখ আব্দুস সবুর সাহেবের সরকারি বাসভবনে বসত কবিতা পাঠের আসর। চলত আলোচনা। এসব অনুষ্ঠানে আসতেন স্বভাবকবি বিপিন সরকার। আরও আসতেন কবি সৈয়দ আব্দুল মতিন (প্রয়াত)  কবি আব্দুল গফুর (প্রয়াত), কবি কাঙাল শামসুর রহমান (প্রয়াত), কবি সৈয়দ হাসমত আলীসহ নড়াইলের প্রায় ত্রিশজন কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সংগীত শিল্পী। কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে আমি সবার স্নেহের ছায়া পেতাম। সেই হিসাবে বিপিন সরকার আমার গুরুজনও বটে। তিনি সবসময় মুখস্থ স্বরচিত কবিতা পাঠ করতেন।

শুনতে অনেক ভালো লাগত এবং সবাই মনোযোগ সহকারে তাঁর কবিতা শুনতেন। তিনি নিরহংকারী ও নিরীহ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। অল্পদিনের মধ্যে অনেককিছু পেয়েছিলাম স্বভাবকবি বিপিন সরকারের কাছ থেকে। আজও মস্তিষ্কের হ্যালুসিনেসনে ভেসে ওঠে বিপিন সরকারের মুখ। কানে শুনি তাঁর কবিতা। যদিও তিনি জগতের জমিনে নেই। তবুও তাঁকে এখনো অনেক কাছে পাই।

×