ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০১ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১

রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ ও ‘জাগের গান’

প্রদীপ দত্ত

প্রকাশিত: ২২:২৩, ২৭ জুন ২০২৪

রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ ও ‘জাগের গান’

আঠারো শতকে রংপুরের রাজবংশী সম্প্রদায়ের কবি ও গায়েন রতিরাম দাস

আঠারো শতকে রংপুরের রাজবংশী সম্প্রদায়ের কবি ও গায়েন রতিরাম দাস ‘জাগের গান’ রচনা করে আমাদের লোক-উপাদানের অসীম ভা-ারকে যেমন সমৃদ্ধি দিয়ে গেছেন; তেমনই ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে রংপুরের বিখ্যাত প্রজাবিদ্রোহ তথা গণমানুষের অভ্যুত্থানকে তাঁর রচনায় স্থান করে দিয়ে এই বীরত্বপূর্ণ ইতিহাসকে অমরত্ব দান করে গেছেন। ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ রঙ্গপুর শাখা থেকে পঞ্চানন সরকার সম্পাদিত পত্রিকার দ্বিতীয় এবং চতুর্থ সংখ্যায় পণ্ডিত যাদবেশ^র তর্করত্ন সংগৃহীত রতিরাম দাসের ‘রঙ্গপুরের জাগের গান’ প্রকাশিত হয়।

জাগগান বা জাগের গান হলো কোচবিহার, অসমের কামরূপ-গোয়ালপাড়া অঞ্চল হয়ে বৃহত্তর রংপুর এমনকি চলনবিলের একাংশ জুড়ে পুরাতন কৃষিবাংলায় প্রচলিত এক ধরনের পালাগান। নিদ্রার বিপরীতে জাগরণ কিংবা মানুষের মনে চেতনা সৃষ্টি এই জাগগানের বৈশিষ্ট্য। আবার লৌকিক ভাবনায় সৃষ্টিতত্ত্বের মদনমোহন তথা কামদেবকে জাগরিত করার বন্দনা থেকে জাগের গানের সূচনা। উত্তরবঙ্গে বৌদ্ধযুগে সিদ্ধাচার্যদের সাধনতত্ত্ব নিয়ে যুগীর গান, ময়নামতির পালা-গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস,পরবর্তীকালে তন্ত্র কিংবা অনার্য দেব-দেবী যেমন- শিব, চন্ডী,শীতলা, সন্ন্যাসী, ধর্মঠাকুর, মনসা আবার শ্রীকৃষ্ণ- রাধিকা, সত্যপীর-মানিকপীর প্রভৃতির মাহাত্ম্য বিষয়ক পালাগান ভিন্ন ভিন্ন মৌসুমে রাত জেগেই গাওয়া হতো।

হেমন্তকুমার রায় বর্মা তাঁর ‘কোচবিহারের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ‘ফাল্গুনী পূর্ণিমার সময় মদনকাম পূজা হয়। তিনদিন ধরিয়া এই পূজা চলে। অনেকের বাড়িতে এই জাগগান হয়। গ্রামের জনসাধারণ তিন দিন ধরিয়া এই গান শুনিয়া আনন্দ করেন। ঐ সময় সারারাত জাগিয়া গান শোনা হয়। সেই জন্য এই গানের নাম জাগগান’। রংপুর অঞ্চলের জাগগান বিষয়ে সুখবিলাস বর্মা বলেছেন ‘মদনকাম কামের দেবতা। এই উপলক্ষে জাগগান এককালে খুব প্রসিদ্ধ ছিল। মদনকাম উপলক্ষে যে গান গেয়ে দল বেঁধে যুবকরা মাগন করে বেড়ায় তার প্রধান অঙ্গ পুরুষদের নাচ।

ঢোল, কড়কা, সানাই, এর বাজনার সঙ্গে প্রচ- পরিশ্রমযুক্ত এ নাচ পাঞ্জাবের ভাঙরার কথা মনে করিয়ে দেয়’। সংকলিত জাগের গানের রচয়িতা রতিরাম দাস। তাঁর লেখা কয়েকটি পালা উদ্ধার করে সংকলন করেছেন প-িত যাদবেশ^র তর্করতœ। যেমন রাধার শাকতোলা, কৃষ্ণের ধোরে মাছ মারা, কৃষ্ণের বড়শিতে মাছ ধরা, ইটাকুমারীর প্রজাবিদ্রোহ,্ ও প্রেমিকের রূপবর্ণনা। রতিরাম দাস তাঁর রচিত ‘ইটাকুমারীর প্রজাবিদ্রোহ’ পালার ভণিতায় আত্মপরিচয় দিয়ে গেছেন ‘ব্রাহ্মণের শ্রীপাদ পদ্মে করি

পরণাম/নিবেদন করে দাস জাতি নাম ধাম’॥ রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারী গ্রামের ফতেপুর পরগণায় তাঁর জন্ম আঠারো শতকের শেষদিকে। পূর্বে ব্রহ্মপুত্র, পশ্চিমে কুশাই গঙ্গা, উত্তরে গিরিরাজ হিমালয়, দক্ষিণে বাঙ্গালা, করতোয়া তীরবর্তী ইতিহাস প্রসিদ্ধ প্রাচীন দূর্গনগরী ঘোড়াঘাট, যা ছিল কামতাপুর রাজ্যের অন্তর্গত, পরবর্তীতে মোগল আমলে এ অঞ্চলের রাজধানী আর ইংরেজ আমলে রংপুর-দিনাজপুর এর সদর হিসেবে বিবেচিত হতো, পালাগানে এই স্থানের ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক বর্ণনা পাঠককে সেই সময়ে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।

এই একই গ্রামে জন্মেছিলেন প-িত যাদবেশ^র তর্করতœ (১৮৫০-১৯২৫) তাঁরা পুরুষানুক্রমে ইটাকুমারীর জমিদারীতে প-িত হিসেবে খ্যাত ছিলেন। এই ঠাকুরবংশের প্রশস্তি পাওয়া যায় রতিরাম দাসের বন্দনায়, ‘উত্তরে দক্ষিণে লম্বা ঠাকুরপাড়া খানি/সক্কলি প-িত তার সক্কলি বিদ্যামণি/দেখিতে সুন্দর তারা আগুনের মতো রং/ দেবতার মূর্তি তাদের মুনির মতো ঢং॥’ পুরাণকথা কিংবা লোকায়ত কাহিনী ছাড়াও সমকালীন রাজনীতি, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ এসবও কখনো জাগের গানে পাওয়া যায়।

‘ইটাকুমারীর প্রজাবিদ্রোহ’ পালায় ১৭৮৩ খ্রীস্টাব্দে রংপুর ও তৎসন্নিহিত এলাকায় সংগঠিত কৃষক বিদ্রোহ যা প্রখ্যাত মার্কসবাদী ঐতিহাসিক নরহরি কবিরাজের ‘এ পিজেন্ট আপরাইজিং ইন বেঙ্গল-সেভেনটিন এইটি ত্রি’ গ্রন্থে বিবিধ প্রামাণ্যসহ উল্লেখ আছে। সেই কৃষক বিদ্রোহের বীরত্বগাথা বর্ণনার শুরুতেই রতিরাম লিখছেন ‘কোম্পানির আমলেতে রাজা দেবীসিং/সেই সময় মুল্লুকেতে হৈল বার ঢিং॥’ আঞ্চলিক ভাষায় ঢিং শব্দের অর্থ বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট নিয়ে ১৯৮২ সালে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ কাব্যনাট্য রচনা করেছিলেন। যাতে তিনি রংপুরের এই প্রজাবিদ্রোহ ও বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক কৃষকের নেতা নবাব নূরলদীন বাকের জং, দেওয়ান দয়াশীল, কোম্পানির ইজারাদার দেবীসিংহ, কালেক্টর রিচার্ড গুডল্যাড, লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোনাল্ড প্রমুখ ঐতিহাসিক চরিত্রকে নিপুণভাবে উপস্থাপন করে গেছেন। রংপুরের এই প্রজা বিদ্রোহের কারণ খুঁজতে হলে আমাদের একটু অনতিদূর ইতিহাসের পাতা থেকে ঘুরে আসতে হবে।

পলাশীর যুদ্ধের অব্যবহিত পরে দুর্বল নবাবী শাসনের সুযোগ নিয়ে ওয়ারেন হেস্টিংস এর সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আরও শক্তি অর্জন করতে থাকে। এর ফলশ্রুতিতে ১৭৬৫ সালে কোম্পানি বাংলার রাজস্ব আদায়ের দেওয়ানী লাভ করে। ১৭৮১ সালে হররাম ও দেবী সিংহ স্থানীয় ইজারাদার হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে ভূমিব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তনে ফরমান জারি করেন। তাতে রায়ত তথা প্রজাদের খাজনা বৃদ্ধি পায়। দেবী সিংহের নতুন ভূমিব্যবস্থা জমিদারদের স্বাধীন মর্যাদায় আঘাত হানে। বর্ধিত হারে খাজনা আদায়ে অবর্ণনীয় নিপীড়ন নেমে আসে কৃষকদের ওপর।

১৭৭০ সালের সর্বগ্রাসী দুর্ভিক্ষ পরবর্তী বছরগুলোতে, মন্বন্তরে উজাড় হয়ে যাওয়া গ্রামগুলোতে কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। ঘন ঘন বন্যায় ফসলহানি ছিল নিত্যবছরের ঘটনা। ছোট ও মধ্যকৃষক থেকে সামন্ত জমিদার সকলেরই অর্থনীতি ভেঙে পড়েছিল। রতিরাম দাস এই দুরবস্থার বর্ণনায় তাঁর পালায় লিখছেন ‘বচ্ছরে বচ্ছরে এলা হইতেছে আকাল/চালে নাই খের কারো ঘরে নাই চাল/মাও ছাড়ে বাপ ছাড়ে ছাড়ে নিজের মাইয়া/বেটা ছাড়ে বেটি ছাড়ে নাই কারো মায়া।’

রতনলাল চক্রবর্তী ‘রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ’ শীর্ষক নিবন্ধে লিখছেন ‘১৭৮৩ সালের রংপুর কৃষক বিদ্রোহের কারণ ছিল কোম্পানির ভূমি রাজস্ব বন্দোবস্ত প্রসূত অসন্তোষ ও অত্যাচার। এই বিদ্রোহে কৃষক সম্প্রদায়ের সঙ্গে প্রাক্তন ও নতুন উভয় জমিদার শ্রেণি অংশগ্রহণ করেছিলেন’। সুপ্রকাশ রায়ের মতে ‘রংপুরের বিদ্রোহী বসনিয়াদের একাংশ ছিলেন প্রাক্তন জমিদার এবং দেবী সিংহের পরোক্ষভাবে ইজারাদারী গ্রহণের ফলশ্রুতিতে অধিকারচ্যুত।

এছাড়া অন্য জমিদার দল ছিলেন দেবী সিংহের রাজস্ব আদায় নীতিতে অত্যাচারিত ও উৎপীড়িত’। রতিরাম দাসের জাগের গানে ইটাকুমারীর জমিদার শিবচন্দ্র রায়ের ওপর নির্যাতন ও তাঁর বন্দিদশা থেকে মুক্তির ঘটনা বর্ণনায় আমরা পাই- ‘দেবীসিঙ্গের দরবারে শিবচন্দ্র গেল/প্রজার দুস্কের কথা কহিতে লাগিল/ রাজপুত কালাভূত দেবীসিং হয়/ চেহারায় মৈষাসুর হইল পরাজয়/শুনি চক্ষু কট্মট্ লাল হৈল রাগে/ ‘কৌন হায় কৌন হায়’ বলি দেবী হাঁকে/ শিবচন্দ্রক কয়েদ করে দিয়া পায়ে বেড়ি/ শিবচন্দ্র রাজা থাকেন কয়েদখানাত পরি/ দেওয়ান শুনিয়া পরে অনেক টাকা দিয়া/ ইটাকুমারীত আনে শিবে উদ্ধারিয়া।’ অনেক অর্থদ-, বকেয়া খাজনা পরিশোধ, নানাবিধ নিপীড়ন ও অপমান সহ্য করে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে শিবচন্দ্র পাশর্^বর্তী জমিদার ও প্রজাদের নিজ রাজবাড়ীতে ডেকে পাঠালেন।
দেবীসিংহ ও হররামের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য জমিদার ও প্রজাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানালেন। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন পাশর্^বর্তী মন্থনার জমিদার জয়দুর্গা দেবী। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র সম্ভবত এই জয়দুর্গা দেবীকেই তাঁর মানসলোকের কল্পনায় দেবী চৌধুরাণী উপন্যাসের নায়িকা হিসেবে রংপুরের প্রজাবিদ্রোহ আর তাঁর দেওয়ান ভবানি পাঠককে সন্ন্যাস বিদ্রোহের ইতিহাসে অমরত্ব দিয়ে গেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ১৭৮৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই রংপুরের কৃষকগণ বিদ্রোহের জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে থাকেন।

তাদের ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহের প্রথম প্রকাশ ঘটে বামনডাঙ্গা ও টেপা পরগনার বিদলাতুর ও কোরনার সোনা গ্রামে। এই দুই অংশের কৃষকগণ ধীরাজনারায়ণ ও কেনা সরকার নামে দুই ব্যক্তিকে তাদের নেতা তথা নবাব নির্বাচিত করে সমবেতভাবে কাইমারীর দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। বিদ্রোহী কৃষকদের একটা অংশ নূরলদীনকে নবাব নির্বাচিত করে তাঁর দেওয়ান দয়াশীল এর নেতৃত্বে শালমারী ও কাকিনার কাচারি আক্রমণ করেন সেখানে রাজস্ব প্রদানে অপারগ বন্দি কৃষকদের মুক্ত করেন।

পরবর্তী পর্যায়ে হাজার হাজার বিদ্রোহী প্রজা কাজীরহাট পরগণার কিশোরগঞ্জ কাচারি আক্রমণ করেন তারা সেখানে অত্যাচারী গোমস্তা শেখ মুহম্মদ মোল্লাকে না পেয়ে তার দুজন কর্মচারী রামকান্ত ও শ্যাম চৌধুরীকে পাকড়াও করে বন্দী কৃষক ও জমিদারদের মুক্ত করে কাচারিতে আগুন ধরিয়ে দেন। বিদ্রোহী কৃষকগণের পরবর্তী আক্রমণের লক্ষ্য ছিলো কালিকাপুরের গোবিন্দরামের কাচারি। যেখানে নৃশংস ও পৈশাচিক অত্যাচারে পারদর্শী গোমস্তা গৌরমোহন চৌধুরী অবস্থান করতেন।

এদিকে গৌরমোহন চৌধুরীর বরকন্দাজেরা বিদ্রোহী সন্দেহে পাশর্^বর্তী বাজার থেকে কয়েকজন কৃষককে আটক করে ডিমলা কাচারিতে নিয়ে যায়। এই ঘটনায় উত্তেজিত কৃষকরা ডিমলা কাচারি আক্রমণ করলে গোমস্তা গৌরমোহন চৌধুরীর বরকন্দাজেরা গুলি করে। তাতে তিনজন কৃষক নিহত ও অনেকে আহত হন। বিদ্রোহী কৃষকগণ সর্বশক্তি দিয়ে বরকন্দাজদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তারা একজন বরকন্দাজকে হত্যা করেন এরপর গোমস্তা গৌরমোহনকে গ্রেপ্তার করে তাদের নেতা নবাব ধীরাজনারায়ণের সামনে নিয়ে আসেন এরপর তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

এই পরিস্থিতিতে কৃষকগণ ভবানীগঞ্জে কোম্পানির ধানের গোলা লুট করেন (সুত্র: বাংলাদেশ নি¤œবর্গ, দ্রোহ ও সশস্ত্র প্রতিরোধ-মুনতাসির মামুন, পৃষ্ঠা-৯৬)। রতিরাম দাস তাঁর পালায় লিখছেন ‘রঙ্গপুরে যাও সবে হাজার হাজার/দেবীসিঙ্গের বাড়ি নুট বাড়ি ভাঙ্গ তার/ পারিষদবর্গসহ তারে ধরি আন/আপন হস্তেতে তার কাটিয়া দিমো কান॥ ‘ইটাকুমারীর জমিদার শিবচন্দ্রের আহ্বানে প্রজাগণ বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েন ‘নাঠি নিল খন্তি নিল, নিল কাঁচি দাও/আপত্য করিতে আর না থাকিল কাঁও/ঘাড়েতে বাঁকুয়া নিল হালের জোয়াল/জাঙ্গাল বলিয়া সব চলিল কাঙ্গাল॥’ রতিরামের বর্ণনায় আছে হাজার হাজার বিদ্রোহী কৃষক রংপুর শহরে এসে দেবীসিংহের কুঠি আক্রমণ করে। কুঠি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ভয়ে দেবীসিংহ পালিয়ে যায়। ‘খিড়কির দুয়ার দিয়া পালায় দেবীসিং/সঙ্গে সঙ্গে পালেয়া গেল সেই বার ঢিং/দেবীসিং পালাইল দিয়া গাও ঢাকা/কেউ বলে মুর্শিদাবাদ কেউ বলে ঢাকা॥’ দেবী সিংহের পালিয়ে যাবার মধ্যে দিয়ে বিদ্রোহের অবসান হতে থাকে। রংপুরের কালেক্টর রিচার্ড গুডল্যাড প্রচার করলেন যে অস্ত্র পরিত্যাগ করলে কৃষকদের আর ভয় নেই। রাজস্ব আদায়ের জন্য আর কোনো জুলুম অত্যাচার করা হবে না। খাজনা বৃদ্ধি রদ করে ১৭৮০ সালের পূর্বের হারেই তারা খাজনা দিতে পারবেন। এই বিদ্রোহের খবর কোম্পানির হেডকোয়ার্টার ফোর্ট উইলিয়ামে পৌঁছালে কোম্পানি অস্বস্তিবোধ করে। প্যাটারসনের নেতৃত্বে তদন্ত অনুষ্ঠিত হয়। প্যাটারসন লিখেছিলেন ‘খাজনা আদায়ে কৃষকদের প্রতি যে উৎপীড়ন করা হয়েছিল তাতে বিদ্রোহ করা ছাড়া তাদের কোন উপায় ছিল না। প্রজাদের নিকট থেকে যে হারে রাজকর আদায় করা হতো তা লুণ্ঠনের নামান্তর মাত্র; আনুষঙ্গিক অত্যাচার ও নির্যাতনের তো কথাই নাই।’ রংপুরের এই কৃষক বিদ্রোহ বাংলায় কোম্পানি শাসনের অবসানকে দ্রুততর করেছিল। বাংলার কৃষককে দিয়েছিল প্রতিবাদ করার সাহস। 
লোককবি রতিরাম দাসের জন্মস্থান রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ইটাকুমারীতে জমিদার শিবচন্দ্র দাসের ভগ্নপ্রায় জমিদারবাড়িটি কালের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে। এই নিবন্ধটি লেখার প্রয়োজনেই সম্প্রতি সেখানে গিয়েছিলাম। দেখে মনে হয় এ যেন ঝোপ-ঝাড় লতা-গুল্মে আচ্ছাদিত বিস্মৃত ইতিহাসের কয়েকটি পৃষ্ঠা। বার বার শিহরিত হচ্ছিলাম এই ভেবে যে আজ থেকে দুইশত চল্লিশ বছর আগে এখান থেকেই সেই গণযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছিল।

×