ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১

বাংলা কবিতায় বর্ষা

আনোয়ার কামাল

প্রকাশিত: ২১:৪৪, ২৭ জুন ২০২৪

বাংলা কবিতায় বর্ষা

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ঋতুবৈচিত্র্যময় এ দেশে প্রতিটি ঋতুরই একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। রয়েছে আলাদা আলাদা প্রভাব। এ অঞ্চলের মানুষজনের ঋতুর প্রকারভেদে জীবন যুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। কিন্তু বর্ষা, ঋতু হিসেবে তার আলাদা প্রভাব রয়েছে। বর্ষাকে আবহমানকাল ধরে কৃষকদের আশীর্বাদ হিসেবে ধরা হয়। বর্ষার অপার সৌন্দর্য যে বহুগামী বৈচিত্র্যতা; বা অন্য পাঁচটি ঋতু থেকে আলাদা আমেজের তা সহজেই অনুমেয়। বর্ষায় ভরে ওঠে মাঠ-ঘাট, নতুন করে রোপিত হয় আবাদি ফসলের।

প্রকৃতি নতুন সাজে সেজে ওঠে যেন সবুজের এক মহাসমারোহ ফেরি করে ফেরে।
এই বর্ষাকে নিয়েই কবিরা মনের মাধুরী দিয়ে নানান ভঙ্গিমায় কবিতা লিখেছেন। প্রেমিকাকে নিবেদন করেছেন প্রেমময় কবিতার পঙ্ক্তিতে। কবিতায় বর্ষার প্রভাব অনেক বেশি। প্রায় সব কবিই কোনো না কোনোভাবে বর্ষাকে বর্ণনা করেছেন তার আপন আপন ভঙ্গিমায়। কবি কালীদাসের কবিতায় পাওয়া যায় :
‘কেমনে প্রিয়তমা রাখবে প্রাণ তার অদূরে উদ্যত শ্রাবণে
যদি-না জল ধরে বাহন করে আমি পাঠাই মঙ্গলবার্তা?
যক্ষ অতএব কুড়চি ফুল দিয়ে সাজিয়ে প্রণয়ের অর্ঘ্য
স্বাগত-স্বভাষ জানালে মেঘ বরে মোহন, প্রীতি ময়বচনে।’
আবার আমরা যদি কবি অক্ষয়কুমার বড়াল এর কবিতা পাঠ করি সেখানে আমরা গ্রাম বাংলার প্রকৃতির বর্ণনা সুনিপুণভাবে পেয়ে যাই। তিনি তার বর্ষার কবিতায় গ্রাম বাংলার প্রকৃতির বর্ণনা তুলে ধরেছেন এভাবে :
‘দীঘিটি গিয়াছে ভরে, সিঁড়িটি গিয়াছে ডুবে,
কানায় কানায় কাঁপে জল;
বৃষ্টি-ভরে বায়ু-ভরে নুয়ে পড়ে বারে বারে
আধফোটা কুমুদ কমল।
তীরে নারিকেল-মূলে থল-থল করে জল,
ডাহুক ডাহুকি কূলে ডাকে;
সারি দিয়ে মরালীরা ভাসিছে তুলিয়া গ্রীবা,
লুকাইছে কভু দাম-ঝাঁকে।
ক্বচিত অশ্বথ-তলে ভিজিছে একটি গাভী,
টোকা মাথে যায় কোন চাষি;
ক্বচিত মেঘের কোলে, মুমূর্যুর হাসি সম,
চমকিছে বিজলীর হাসি। 
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কাছে বর্ষা ঋতু ছিল সবচেয়ে প্রিয়। রবীন্দ্রনাথ বর্ষাকে বিশেষ শিল্পদৃষ্টিতে উপলব্ধি করেছেন যা তাঁর ‘বর্ষামঙ্গল’ কবিতায় সেই কাব্য ভাবনার প্রকাশ দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ বর্ষার আগমনে পুলকিত হয়ে আনন্দের নির্যাসটুকু প্রকৃতির মাঝে ঢেলে দিয়ে বর্ষাকে অভিবাদন করেছেন- 
‘এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,
গগন ভরিয়া এসেছে ভুবন-ভরসা-
দুলিছে পবন সন সন বন বীথিকা,
গীতময় তরু লতিকা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত এবং পাঠ্যবইয়ে প্রচলিত সোনার তরী কবিতায়ও এঁকেছেন বর্ষার চিত্র। সেখানে লিখেছেন-

গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।

রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষরধারা
খরপরশা-
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোথাও বা বর্ষার প্রকৃতির ছবি এভাবেই এঁকেছেন। যেমন তাঁর আষাঢ় কবিতায় আমরা দেখতে পাই-
নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর
নাহিরে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের
বাহিরে।
বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর,
আউশের ক্ষেত জলে ভরভর,
কালি মাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিছে দেখ চাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের
বাহিরে।
পল্লী কবি জসীমউদ্দীনও তার কবিতায় বর্ষার রূপ বৈচিত্র্য বর্ণনা করেছেন। পল্লী কবি তার পল্লী-বর্ষা নামক কবিতায় লিখেছেনÑ
আজিকার রোদ ঘুমায়ে পড়েছে
ঘোলাটে মেঘের আড়ে,
কেয়া-বন পথে স্বপন বুনিছে
ছল ছল জলধারে।
কাহার ঝিয়ারী কদম্ব-শাখে নিঝঝুম নিরালায়
ছোট ছোট রেণু খুলিয়া দেখিছে অস্ফুট কলিকায়।
এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের মানসী কাব্যগ্রন্থে ‘বর্ষার দিনে’ শিরোনমের বর্ষা নিয়ে একটি কবিতায় তিনি বলেছেনÑ 
এমন দিনে তারে বলা যায়,
এমন ঘনঘোর বরিষায়Ñ
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।

সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
নিভৃত নির্জন চারি ধার।
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবারÑ
জগতে কেহ যেন নাহি আর।  
বাংলা কাব্য সাহিত্যে মধ্যযুগের অনেক কবির কবিতায় বর্ষার বর্ণনার উল্লেখ পাওয়া যায়। এঁদের মধ্যে অন্যতম কবি কালীদাস, চ-ীদাস, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে, বিদ্যাপতি, গোবিন্দ দাস, রায়শেখর, মনোহর দাস, বাসুদেব ঘোষ এদের প্রত্যেকের বৈষ্ণব পদাবলীতেও বর্ষার বর্ণনা রয়েছে। এছাড়াও মুকুন্দ রামচক্রবর্তী, খনার বচন, ঈশ^রচন্দ্র গুপ্ত, স্বর্ণকুমারী দেবী, অক্ষয়কুমার বড়াল, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, প্রমথনাথ রায়  চৗধুরী প্রমুখের কবিতায় বর্ষার সন্ধান পাওয়া গেছে। এঁদের হাত ধরেই বাংলা কবিতায় বর্ষার বিচিত্র রূপসৌন্দর্য ওঠে এসেছে। মেঘের সঙ্গে প্রেম আর বিরহের একটা অনড় সম্বন্ধ পাতিয়ে কবি কালীদাস তার কবিতায় এক অনবদ্য চিত্রকল্প তৈরি করেছেন।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘বর্ষাকাল’ কবিতায় বর্ষার রূপকল্প তুলে ধরেছেন অন্যভাবেÑ
গভীর গর্জন করে সদা জলধর
উথলিল নদ-নদী ধরণীর উপর রমণীর মন লয়ে
সুখে কেলি করে
দানবাদি দেব যক্ষ সুখিত অন্দরে।
একই ধারায় চ-ীদাস তাঁর প্রেম বিরহ কাতরতার কথা প্রকাশ করেন তাঁর কবিতায়Ñ
এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা
কেমনে আইল বাটে
আঙ্গিনার মাঝে বধূয়া ভিজিছে
দেখিয়া পরাণ ফাটে।  
আবার বিদ্যাপতির রচনায় বর্ষার বিরহকাতরতা আমাদের ভিন্ন আস্বাদন দেয়Ñ
এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর
এ ভরা ভাদর মাহ বাদর শূন্য মন্দির মোর।
বর্ষা ঋতুর বৈচিত্র্যতা নিয়ে লিখতে যেয়ে কেউ কারও চেয়ে কম যাননি। কবিরা প্রত্যেকেই মনের মাধুরী মিশিয়ে, প্রাণের আকুতি নিয়ে লিখেছেন। তেমনিভাবে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর কবিতায় বর্ষার সম্মোহনী রূপে রছটা পাওয়া যায়Ñ
অঝোর ধারায় বর্ষা ঝরে সঘন তিমির রাতে।
‘নিদ্রা নাহি তোমার চাহি’ আমার নয়ন-পাতে।
ভেজামাটির গন্ধ সনে
তোমার স্মৃতি আনে মনে,
বাদলী হাওয়ায় লুটিয়ে কাঁদে আঁধার আঙিনাতে।
আমরা যাঁকে নাম দিয়েছি পল্লীকবি। যিঁনি পল্লীর রূপ সৌন্দর্য অপরূপ মহিমান্বিত করে বর্ণনায় উদ্ভাসিত করেছেন তিনিও বর্ষা নিয়ে, বর্ষার রূপ-রস নিয়ে গুণকীর্তন করেছেন। পল্লীকবি জসীমউদ্দীন বর্ষা নিয়ে তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘পল্লী-বর্ষা’য় লিখেছেন-
গাঁয়ের চাষিরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়,Ñ
গল্পেগানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!
কেউ বসে বসে কাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রসি;
কেউবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাঁকা বাঁধে কচিকচি।
মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ, করুণ ভাটির সুরে
আমির সাধুর কাহিনী কহিছে সারাটি দলিজাজুড়ে।
বাহিরে নাচিছে ঝর ঝর জল, গুরু গুরু মেঘডাকে,
এসবের মাঝে রূপ-কথা যেন আর রূপ-কথা আঁকে।
উপরোক্ত কবিতাটিতে সত্যিই পল্লী বাংলার বর্ষাকালের সময়চিত্র উঠে এসেছে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জসীমউদ্দীন ছাড়াও জীবনানন্দ দাশ, সুধীনন্দ্রনাধ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু তাঁদের কবিতায়ও বর্ষার কাব্যময়তা নানান মাত্রিকতায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে এসেছে। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা তাঁর বৃষ্টিপড়ে কবিতার মাধ্যমে বর্ষার বৃষ্টিকে নানা আঙ্গিকে দেখিয়েছেন, তুলে ধরেছেন অন্য ভঙ্গিমায়। সেখানে আমরা দেখতে পাই বৃষ্টি পড়ার ছন্দময়তাÑ

বৃষ্টিপড়ে, বৃষ্টিপড়ে
মনে মনে বৃষ্টিপড়ে
বৃষ্টিপড়ে বৃষ্টিপড়ে
বনে বনে বৃষ্টিপড়ে
মনের ঘরে চরের বনে
নিখিল নিঝুম গাঁও গেরামে
বৃষ্টিপড়ে বৃষ্টিপড়ে
বৃষ্টিপড়ে বৃষ্টিপড়ে।

ঋতুপরিক্রমায় বর্ষা আমাদের মাঝে নানামাত্রিকতায় হাজির হয়। বর্ষাবরণ নিয়ে চলে নানা আয়াজন। ঋতুরানী বর্ষাতে আমরা মেতে উঠি নানান আয়োজনে। বর্ষা আমাদের যেমন অপার আনন্দ দেয়, আনন্দিত করে, আন্দোলিত করে; তেমনি আবার বর্ষার করাল গ্রাস নদী তীরবর্তী জনপদের মানুষের হৃদয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টিও করে। নদীভাঙন, বর্ষাতে নদ-নদী ভরে উপচে পড়ে দুকূল। এতে কত জীবনহানি ঘটে, কত ঘরবাড়ি, আবাদি ফসল, গবাদি পশু ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তার ইয়ত্তা নেই। বিলীন হয় কত শত জনপদ। বর্ষা শেষে নদ-নদীতে পলি জমে আবাদি জমিন উর্বরা শক্তি ফিরে পায়। অতি বর্ষণের করাল গ্রাস আমাদের আঘাত করলেও বর্ষার আগমন গ্রামীণ জনপদে আশীর্বাদ হিসেবেই ধরা হয়। তাই তো কবিরা যুগযুগ ধরে বর্ষাকে নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন। বর্ষাকে বরণ করেছেন, হৃদয়ে ধারণ করে কবিতায় নান্দনিক আবহ সৃষ্টি করেছেন।

×