ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৩ জুলাই ২০২৪, ১৯ আষাঢ় ১৪৩১

সমরেশ বসুর ছোটগল্পে স্বাতন্ত্র্য

শৌনক দত্ত

প্রকাশিত: ২২:২৬, ২০ জুন ২০২৪

সমরেশ বসুর ছোটগল্পে স্বাতন্ত্র্য

সমরেশ বসু

সমরেশ বসু সম্পর্কে সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিতের একটি মূল্যায়ন প্রণিধানযাগ্য- ‘He had the sensibility of Bibhutibhusan, the experience of Tarasankar, the questioning attributes of Manik and the uninhibitingly isolated background that made Satinath Bhaduri different.’ অর্থাৎ ঐতিহ্যকে তিনি স্বীকার করেছেন। বিভূতিভূষণের স্থির আস্তিক্যবোধ তার ছিল না, কিন্তু অনুভূতির প্রগাঢ়তা ছিল নিঃসন্দেহে, সেই সঙ্গে ছিল মানুষের প্রতি নিবিড় ভালোবাসা।

সতীনাথ ভাদুড়ির মতো আপাত আকর্ষণহীন শিল্পাঞ্চলের মানুষকে তিনি উপন্যাসের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তারাশঙ্করের মতো গভীর অভিজ্ঞতাও তার ছিল এবং তার মতোই সেই অভিজ্ঞতার রূপায়ণ ঘটিয়েছেন দেশজ ভঙ্গিতেই। তারাশঙ্করের মতোই লোকজীবন ও লোককথাকে তিনি মিশ্রিত করেন বর্তমানের সঙ্গে। আবার বঙ্কিম যেভাবে দীনবন্ধুর প্রতিভাকে বিশ্লেষণ করেছিলেন, সেভাবে গভীর ও নিবিড় সামাজিক অভিজ্ঞতা ও সহানুভূতিও সম্ভবত সমরেশের সাহিত্য প্রতিভার উৎসস্থল।

সহানুভূতির সার্থক সংযোজন ঘটলে কোনো তুচ্ছ সাধারণ বা ঘৃণিত চরিত্রও কতখানি মানবিক আবেদন সৃষ্টি করতে পারে, তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত সমরেশ বসুর ছোটগল্পগুলো। উপন্যাস ও ছোটগল্প উভয় শাখাতেই অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখলেও মনে হয়, সমরেশের বিচিত্র জীবন-অভিজ্ঞতা এবং জীবন-পিপাসা যথার্থ ভাষারূপ পেয়েছে তার ছোটগল্পগুলোতেই।
সমরেশ বসু রূঢ় বাস্তবতার নিখুঁত কারিগর। তার শ্রেষ্ঠ গল্পগুলো মূলত সমাজের নিচের মানুষদের নিয়ে রচিত। গল্পগুলোর আখ্যানজুড়ে রয়েছে সেই মানুষদের টিকে থাকার সংগ্রাম। এই ধারার গল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– ‘বিষের ঝাড়’, ‘পার’, ‘রং’, ‘ছেঁড়া তমসুক’, ‘পসারিণী’সহ আরও অনেক। সাধারণত ছোটগল্পের মধ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যিকেরা আত্মপ্রকাশ করে থাকেন।

কেননা ছোটগল্পের সীমানা ছোট, ফলে সেখানে সংক্ষিপ্ত বিস্তারে বহু চরিত্র-রচনার দায় নেই বা জীবনের ব্যাপক অর্থ-সন্ধানের পরিশ্রম নেই। বিন্যাসগত কৌশল আয়ত্ত হওয়ার আগে তাই কথাসাহিত্যিকেরা সাধারণভাবে ছোটগল্পের জগৎকেই আত্মপ্রকাশের যোগ্য মাধ্যম হিসেবে নির্বাচন করেন। কিন্তু উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়েই সমরেশ বসুর সাহিত্য জগতে অনুপ্রবেশ। প্রথম ছোটগল্প সংকলন প্রকাশের আগেই তার তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হতে দেখি।

তার সাহিত্যিক জীবনের শুরুতেই আসে নিচুতলার মানুষজন এবং লেখকের সাম্যবাদী দর্শনের তত্ত্ব ও অভিজ্ঞতা। ছোটগল্পের ক্ষেত্রে সমরেশের প্রতিভা অনস্বীকার্য। তবে প্রথম উপন্যাসে সমরেশ যে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন, আশ্চর্যজনক হলেও প্রথম ছোটগল্প-সংকলন ‘মরশুমের একদিন’-এর কোনো কোনো গল্পে সেই দক্ষতার অভাব স্পষ্ট। পূর্বেই বলা হয়েছে, সমরেশ বসু অন্যান্য সাহিত্যিকদের মতো প্রথমে ছোটগল্পের কলমে হাত মশো করেননি। উপন্যাসের মধ্যে দিয়েই তার আবির্ভাব। কিন্তু ছোটগল্পের শিল্পকৌশলেও তিনি সমান অনায়াস। দু-একটি গল্প বাদ দিলে এই প্রথম সংকলনেই তার প্রতিভার প্রমাণ আছে।
সমরেশ বসু যথার্থ আবির্ভাব; mso-spacerun : yes'> জন্য এরা পালিয়ে একই স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। একটা ডাস্টবিনের দুদিকে এরা লুকিয়েছে।
এ গল্পে ‘প্রবল হয়েছে শ্রমজীবী মানুষের হৃদয়বান ঐক্যের প্রবণতা।’ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়ংকর নারকীয় পরিবেশে আটকে পড়া দুই শ্রমজীবী মানুষ- একজন হিন্দু সুতা-মজুর ও অন্যজন এক মুসলমান মাঝি, কেমন করে দুই ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও জীবনের প্রবল আকর্ষণে হৃদয়ের মধ্যে এক নিবিড় বন্ধন অনুভব করে, তা স্পষ্ট হয়েছে এই গল্পে। দাঙ্গাকারী ধর্মান্ধ মানুষ এবং দাঙ্গা প্রতিরোধে নিয়োজিত পুলিশবাহিনীর হৃদয়হীনতা উভয়ই অসাধারণ বর্ণনাকৌশলে ভাষা পেয়েছে এখানে।

রুদ্ধশ্বাস মৃত্যুময় অন্ধকার পরিবেশে উভয়ের এই সম্প্রীতির বন্ধন যখন পুলিশের গুলিতে হঠাৎ ছিন্ন হয়ে যায়, তখন একটি বিষাদ ঘন হয়ে উঠলেও সমগ্র গল্পে আসলে বড় হয়ে উঠেছে শ্রমজীবী মানুষের ধর্মনিরপেক্ষ জীবনলিপ্সা। তাই মাঝির মৃত্যুর পরে হিন্দু মজুরটি যথার্থই অনুভব করে তার মুসলমান সঙ্গীটির মৃত্যুকালীন বেদনাকে, ‘সুতা-মজুরের বিহুল চোখে ভেসে উঠল মাঝির বুকের রক্তে তার পোলা-মাইয়ার, তার বিবির জামা-শাড়ি রাঙা হয়ে উঠেছে। মাঝি বলছে, পারলাম না ভাই। আমার ছাওয়ালরা আর বিবি চোখের পানিতে ভাসব পরবের দিন।

দুষমনরা আমারে যাইতে দিল না তাগো কাছে।’ ‘মরশুমের একদিন’ সংকলনেই রয়েছে ‘জলসা বা ‘গম্ভব্য-এর মতো রাজনৈতিক গল্প। কত বিচিত্র মানুষ তিনি দেখেছেন, তার প্রমাণ আছে সমরেশের গল্পগুলোতে। ‘কাজ নেই গল্পের নায়ক ফটিকচাঁদের পেশা বেওয়ারিশ গরু ধরে এনে খোঁয়াড়ে পোরা, আর ‘বিষের ঝাড়’ গল্পের নায়ক হারাধন চক্রবর্তীর পেশা গণিকাপল্লিতে যৌন ব্যাধির ওষুধ দেওয়া। আশ্চর্য এই যে, বিচিত্র চরিত্র, বিচিত্র ঘটনা, বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ে গল্প লিখলেও সমরেশের সমস্ত গল্পই আসলে জীবনতৃষ্ণার গল্প। সুনিশ্চিত ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়েও তার গল্পের মানুষেরা বাঁচতে চায়।

ফটিকচাঁদ চায়, হারাধন চক্রবর্তী চায়, এমনকি ‘প্রাণ পিপাসা’ গল্পের হা-ঘরে বেশ্যা মেয়েটিও কোনোরকমে বেঁচে থাকতে চায়। এই সংকলনের শ্রেষ্ঠ গল্প সংকলনের নাম-‘মরশুমের একদিন’। নবীন হালদার অভিনেতা বা সংগীতশিল্পী হতে চেয়েছিল। কিন্তু তাকে বেছে নিতে হলে পেন্টার ও ড্রেসারের কাজ। এ সংসার কাউকে ঈপ্সিত বস্তু দেয় না, এই সত্য উচ্চারিত হয় একটি নেশাগ্রস্ত চরিত্রের মুখে- ‘ইসটেজ বেঁকে থাকলে ওতে কেস্ট ঠাকুরকেও বাঁকা দেখা যায়। এ দুনিয়া ঢেলে না বাঁধলে চলবে না, হযা।’
‘উজান’ গল্পে দেখা যায়- একজন নারাণ, যে বেচনকে অর্থাৎ তার সহকারীকে গালাগালি করছে, দুই থাপ্পড় কষে বসায়, অপরাধ তেমন কিছুই নয়, শনিবারের সন্ধে, কারখানা রবিবার ছুটি, তাই একটু গান-বাজনায় আসর জমানো, কিন্তু বেচনও তেমন তেঁদোড়, পরক্ষণে সেও মোক্ষম ঘুষি মারে নারাণের মুখে।

তখন সে বনস্পতি ঘিয়ের কারখানা থেকে চলে যায়। কারণ সে হৈ-হট্টগোলের লোকালয়ে থাকতে চায় না, মন বড় উদাসীন, এককালে বউয়ের তিন-তিনটে ছেলেমেয়ে ছিল, সেগুলো বছর ভরে ভুগলো, একটা-একটা মরলো, তারপর মানুষটা বদলে গেল, বাবুসাহেব দীনদয়ালের ধাপার মাঠে কাজ নিয়ে নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছে, জগৎ-সংসারের তাবৎ কিছু অর্থহীন, প্রকৃতির মাঝে জীবনের যত পাওয়া, অসীম দিগন্তজোড়া আকাশ-পাখপাখালি, গাছগাছালি, দিগন্ত বিস্তৃত ক্ষেত-খামার, সবুজের ভেতর, অরণ্যের ভেতর জীবনের সমস্ত চাহিদা যেন মেটে।

নারাণ নিজের হাতে শুকনো খটখটে জমির বুকে ফসল ফলায়, বাঁধাকপি-শিম-বেগুন-ঢেঁড়স-গাজরসহ বিভিন্ন সবজি সবুজ আনন্দে ভরে বুক, জীবন যেন থিতু। মানুষহীন অরণ্যের নৈঃশব্দে, এভাবেই চলছিল জীবনের ছোট নদী, কাকতালীয়ভাবে একদিন সকালবেলা নারাণ দেখল, দু’তিন বছরের বাচ্চা নিয়ে একটা মেয়ে মানুষ মাথায় শাকের চুবড়ি নিয়ে লাফ দিয়ে তার সীমানায় এসে পড়ল, নারাণ সেভাবে পাত্তা দিতে চায় না, বরং দূর-ছাই করতে লাগল, কিন্তু মেয়ে মানুষ বড় নাছোড়বান্দা, সে জানাল, এ ঘরে একদিন আমিই ছিলুম, ছিলুম আমার সোয়ামীর সঙ্গে, মানুষটা মইল, তাই; নইলে...এখন শাক বেচে, ঢেঁড়স বেচে খাই...নারাণের নৈঃশব্দের বাগানে এক বিন্দু জল দিয়ে থিতু হওয়া জীবনে আগুন ঢেলে দিল, এভাবে কেউ তার জীবনে উজান বইয়ে দেবে কখনো ভাবেনি, গল্পের শেষপ্রান্তে দেখা যায়, বাধা দেয়ায় মেয়েটি যখন আসতে পারল না, তখন একদিন নারাণ তার বাড়ি গিয়ে বলল, পারলুম না আর থাকতে, চলে এলুম...মানুষ নিঃসঙ্গ থাকতে পারে না, বেঁচে থাকে ভালোবাসায়, তিরস্কার-ভর্ৎসনা-উপেক্ষার মধ্য দিয়ে চাহিদার মৌলিকতাকে অস্বীকার করতে চায়, কিন্তু পারে না, কারণ মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কই চিরস্থায়ী, মৌল সেই ভালোবাসায় জীবনের কাছাকাছি ধাবিত করে।

সমরেশ বসু আদতে ছিলেন ছোটগল্পকার, ব্যক্তিজীবনে সমস্যা ও নাটকীয় ঘটনার তাৎপর্যজনক ঝলকই তার মধ্যে হ্রস্ব^-দীর্ঘ গল্পের জন্ম দিয়েছে, একমুখী বক্তব্যের তাগিদ এনেছে, বিচিত্র বিষয় এবং বিচিত্র ভাবনার মানুষ নিয়েই বিশ্বসংসারের মানুষ, এমন জ্যান্ত মানুষ, তার খুঁটিনাটি নড়ন-চড়ন বাংলাসাহিত্যে এর আগে আসেনি, এমন বাহুল্যহীন একরোখা গল্প প্রায় অঙ্গভঙ্গির মতো অবিচ্ছেদ্য কাটা-ছাটা দ্রুতচালের নিরলঙ্কার বর্ণনা, ছবির মতো মনের গহীনে বসে যায়, গেঁথে যায় সাবলীলভাবে।

‘গুণিন’ গল্পে দেখি হরিমতিকে ফিরে পাওয়ার জন্য নকুড় গুণিন ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার রাতে ব্যানাহাটি ও পালদীঘি গাঁয়ের সীমানায় যে গোরস্তান বিবস্ত্র হয়ে সেখানে যায়, কোদালের কোপ দিয়ে মাংস লেগে থাকা একটা কঙ্কাল তোলে, গল্পটি ভৌতিক হলেও রহস্যের ভেতর দিয়ে সমাপ্তি টেনেছেন গাল্পিক; পরদিন গুণিনের লাশ দীঘির জলে ভেসে ওঠে, সবাই দেখে অদূরে মাটি খোঁড়া কবরের পাশে পড়ে আছে কোদাল, মানুষ বুঝলো ভূত-পেতœী চুবিয়ে মেরেছে, হরিমতি জলভরা চোখে চেয়ে বলল, গুণিন তুমি হরিমতির মন বুঝলে না, আমি যে এখনো সেই তোমার আছি এবং তোমাকে নিয়ে আবার বাঁচতে চেয়েছিলাম তাও জানলে না।

গল্পের প্রথমার্ধে দেখা যায়, নকুড় একজন বেকার বাউ-েল ছেলে, কাজ-কামে মন নেই, ললিতের দিদি কান্ত খুড়োর মেয়ে হরিমতিকে ভালোবেসে ফেলে, কিন্তু আয়- রোজগার নেই, লোকে টিটকিরি মারতো, মা ধিক্কার দিত, সেই নকুড় একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। দীর্ঘকাল পরে আবার নিজ গাঁয়ে ফিরে আসে নকুড়, কিন্তু সে গুণিন হয়ে এসেছে, কবরেজি চিকিৎসাও জানে, এসে দেখে তার হরিমতির বিয়ে হলেও বিধবা হয়ে বাপ-ভাইয়ের ঘাড়ে, তারপর শুরু হয় তাকে পাওয়ার আকাক্সক্ষা, কিন্তু হরিমতি নিজেকে সমর্পণ করে দিলেও বোঝে না নকুড় নারীর মন।

অর্থাৎ যে হরিমতি একদিন প্রত্যাখ্যান করেছিল, সেই কি না তার গুণিনত্ব বা অর্থের কাছে পরাজিত হয়ে নিজেকে মেলে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু গুণিন নকুড় ওইটুকু ইঙ্গিত বোঝেনি, যার কারণে অকালেই প্রাণ দিতে হলো।
সমরেশ বসু রাজনৈতিক দিক থেকে এক সময় মার্কসবাদে বিশ্বাস করতেন। তীব্র শ্রেণিচেতনা এবং শ্রেণিসংগ্রামে তার বিশ্বাস ছিল। ‘জলসা’ ও ‘প্রতিরোধ’ গল্প দুটিতেও সমরেশ বসু মার্কসবাদী চেতনার শৈল্পিক প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ‘জলসা’ গল্পে দেখি জৌলুসময় জলসার বিপরীতে তীব্র শ্রমিক অসন্তোষ ও শ্রমিক ছাঁটাইয়ের করুণ পরিণতি। ‘প্রতিরোধ’ গল্পের পটভূমিতে রয়েছে ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনে ভূমিহারা কৃষকের অভ্যুত্থান-প্রসঙ্গ ও নির্মম নিপীড়নের কাহিনী।

তেভাগার আন্দোলনকে দমিত করতে ভয়ংকর অত্যাচার, জোতদার পীতাম্বর শাহ, সোনা মিঞা, জেহারুদ্দিন প্রমুখের পুলিশি সাহায্য নিয়ে পীড়ন, মনাই দাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রাধার বীভৎস মৃত্যু অঙ্কিত হয়েছে এই গল্পে। ‘জোয়ার ভাটা’ গল্পে দেখি বাঁচার রসদ না থাকলে কুলি-কামিনরা কেমন হিংস্র হয়ে ওঠে, আবার সেই সম্ভাবনা ফিরে পেলে কেমন করে জীবনের জোয়ার আসে তাদের জীবনে। নিম্নবিত্ত মানুষেরও আছে বেঁচে থাকার অধিকার, শ্রমের অধিকার। পরবর্তীকালে সেই অধিকার রক্ষার সংগ্রাম রূপায়িত হয়েছে তার বিখ্যাত ‘কিমলিস’ গল্পে।

বেচন নামক জেলফেরত এক শ্রমিক এই গল্পের নায়ক। দেড় বছর আগে কারখানার রেশন-হরতালে সে জড়িয়ে পড়ে। প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়ে শ্রমিকদের নেতৃত্ব দিয়ে সে কারখানা মালিকের বিষনজরে পড়ে এবং তার জেল হয়। সেই জেলজীবন কাটিয়ে সে ফিরে আসে বস্তিতে। কিন্তু তার এই ফিরে আসা তার আত্মীয়স্বজন থেকে বস্তির বাড়িওয়ালা কেউ সহজভাবে নেয় না। বস্তির বাড়িওয়ালার সন্দেহÑ বেচন কমিউনিস্ট হয়ে ফিরেছে। সমস্ত বস্তিতেই তার সম্পর্কে একটা অস্বস্তি তৈরি হয়।

চাকরি না থাকায় বেচনের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়, কিন্তু সে তখন ছাঁটাই হওয়া কারখানা শ্রমিকদের মার্কসবাদী তত্ত্ব বোঝাতে ব্যস্ত। কারখানা গেটে সে ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেয়। সে সময়েই আকস্মিক আঘাত আসে তার ওপর। কারখানার সর্বহারা শ্রমিকেরা বেচনের পাশে সমবেত হয়। তার মা-বাবাও ছেলের আদর্শের মর্ম অনুভব করে। সমস্ত গল্পে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্টদের স্বভাব-চরিত্র ও সক্রিয়তার অপূর্ব শিল্পরূপায়ণ ঘটাতে পেরেছেন সমরেশ।
সমরেশ বসুর ‘পশারিনী’ গল্পে উঠে এসেছে ট্রেন-হকারদের জীবন। ট্রেনে চানাচুর, ভিক্স ইত্যাদি বিক্রেতাদের মধ্যে এনেছেন নিম্নবিত্ত পরিবারের লাইসেন্সবিহীন নারী পুতুলের মা অর্থাৎ পুষ্পকে। পুষ্পকে পেশাগত কারণেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয় অন্যদের সঙ্গে, আসে পুলিশি হামলা। অন্য হকারদের সঙ্গে পুষ্পকেও হাজতে যেতে হয়। কিন্তু সমস্ত সংঘর্ষ, প্রতিযোগিতা, বিচ্ছিন্নতা, অশান্তি সত্ত্বেও তাদের মধ্যে জেগে থাকে এক শ্রেণিগত ও পেশাগত সহমর্মিতা।

কত বিচিত্র পেশার নিবিড় জীবনচিত্র যে রূপায়িত হয়েছে সমরেশের গল্পে, তা সত্যই বিস্ময়কর। হকার, শ্রমিক, দেহোপজীবিনী, যৌনরোগের চিকিৎসক, বহুরূপী ইত্যাদি আরো কত কী। ‘পাড়ি’ গল্পে রূপায়িত এমন পেশার মানুষ, যারা সামান্য পয়সার বিনিময়ে দায়িত্ব নিয়ে শূকর, গরু ইত্যাদি গঙ্গা পার করে দেয়।
সমরেশ বসুর গল্পের ভুবনটা একেবারে অন্য ধারার, প্রাচীন মূল্যবোধকে ধ্বংস করে ফেলার দানবীয় প্রবৃত্তি, বাস্তবতাকে মেনে নিতে না পারার দুঃখ-কষ্ট; যদিও তার গল্প চরিত্রপ্রধান, একটা চরিত্রের ভেতর দিয়ে সমাজ বা রাষ্ট্রকে দেখে, ‘সোভাবাজারের শাইলক’ গল্পে এক সুদখোর শাইলকে দেখতে পাওয়া যায়, যার প্রকৃত রাবন হালদার, যে শালিক নামেও পরিচিত, জীবনের প্রথমার্ধে সে বাঁক কাঁধে করে গঙ্গাজল সরবরাহ করতো লোকের বাড়ি, পরবর্তী সময়ে সে স্থানীয় হাইস্কুলে বেয়ারার কাজ জুটিয়ে নেয়, সুদে সে টাকা ঋণ দেয়, স্কুলের মাস্টারমশাই থেকে শোভাবাজারের নানান পেশার মানুষই হলো শাইলকের খাতক, সে টাকা দেয়, সুদ নেয়, যারা সুদে টাকা নেয় এবং যারা নেয় না তারা কখনো ওকে দেখতে পারে না, পেছনে ঘৃণা করে, স্কুলে সে বেয়ারা হিসেবে কাজ করলেও মাস্টারদের ওপরেও ক্ষমতা দেখায়, কারণ সুদে টাকা যে তারাও নিয়েছে, শুধুমাত্র হেডমাস্টারের ওপর কোনো খবরদারি করতে পারে না, কারণ সে ঋণ নেয়নি ওর কাছ থেকে।

একদিন দেখা যায়Ñ এই শাইলক হাতিবাগান বাজারের কোনো এক তরকারিওয়ালী বিধবা সুখদার ষোলো বছরের মেয়ে ময়নার বিয়ের জন্য পাঁচশ’ টাকা দেয়, পাত্র শিয়ালদহ বাজারের দোকানদার, ময়নার বিয়ের দিন সিল্কের শাড়ি দেয়, অনেক অতিথি নিমন্ত্রিত হয়, শাইলকের অনেক চেনাজানা ফড়েকেও দেখা যায়, নিমন্ত্রণ খেয়ে ফিরবার পথে অন্ধকার খালের ধারে কারা যেন শাইলকের ওপর আক্রমণ করল, প্রচণ্ড মারল, গালিগালাজ করে বলল, শালা এতদিনে বুঝেছি, কেন তুমি মাগীর পেছনে টাকা খাটাও, গরিবের টাকা মারো! গল্পে জীবনের অসাধারণ একটা অর্থকে দাঁড় করেছেন সাহিত্যিক, যার ভেতর দিয়ে মনুষ্যত্বকে দেখতে পাওয়া যায় স্পষ্টভাবে।

মানুষ কখনো-সখনো ইচ্ছে করেই প্রকৃতির মতো দিলদরিয়া হয়ে যায়, হয়তো তা স্বভাবের বাইরে, কিন্তু তারপরও নিজের তৃপ্তির জন্য যা করার তাই করে, করতে সে ভালোবাসে। তরকারিওয়ালীকে ভালোবাসে বলেই তার মেয়ে ময়নার জন্য অর্থ ব্যয় করতে কাপর্ণ্য করেনি। সমরেশের গল্পের কুশীলবরা শ্রমের স্বেদাত্ত সংগ্রামে অবতীণর্, অল্প পুঁজির দোকানদার-মজুর-কুলি-শ্মশান ডোম-বাউল-সন্ন্যাসী-বেশ্যা-জেলে-ভূমিহীন কৃষক-বেকার প্রভৃতি।
মনস্তাত্ত্বিক উপলব্ধি থেকেই ‘সোনাটর বাবু’ গল্পটি রচিত। দুর্বিষহ জীবনযন্ত্রণার ভেতর দিয়ে মানুষ অতিবাহিত হয়, তখন তার মধ্যে কোনো ক্রিয়া কাজ করে না, সব যেন অকেজো হয়ে যায়, তারপরও মানুষ বাঁচে এবং বাঁচতে হয়, হয়তো সেই বেঁচে থাকাটাই বিড়ম্বনা। বিষ্টুপদ মিউনিসিপ্যালিটির কনসারভেন্সি সুপারভাইজার, ডোম- মেথর আর ধাঙড়াধাঙড়িদের নিয়েই কাজ এবং ফ্যালা ডোম, দুজনে চাকুরে, বেঁচে থাকার তাগিদে কাজ করে আর কি! উভয়ের সংসারে অনেক দারিদ্র্যতা-অভাব নিমজ্জিত, ১নং ওয়ার্ডে বেওয়ারিশ কুকুর মারার দায়িত্ব পড়ে দুজনের ওপর, সারাদিনে বেশ কয়েকটি কুকুর মারে রসগোল্লায় বিষ ঢুকিয়ে দিয়ে, এভাবেই কুকুর নিধন চলে, প্রাণী হত্যা করেই তাদের জীবিকানির্ভার, ওদিকে দুজনের ঘরেই স্ত্রীরা সন্তানসম্ভবা, জীবন-জীবিকার কারণে প্রাণী হত্যার খেলায় মেতে ওঠে তারা, গল্পে জীবনের যে সন্ধান দেখা যায়, সেখানে মনুষ্যত্ব জেগে উঠেছে, মূল টাগের্ট যে খেপী কুকুরটা তাকে এক সময় একটা ছেলে দেখিয়ে দেয়, তখন বিষ্টু এবং ফ্যালা ধাওয়া করে, তাকে বিষ মেশানো রসগোল্লা ছুড়ে দিলেও খায় না, শুধু দৌড়ে ছুটে যায় দুধের বাঁট দুলিয়ে-দুলিয়ে, প্রায়ই নিখোঁজ থাকে আবার দেখা দেয়, এক সময় মাদী কুকুরটাকে দেখতে পায়, পুষ্ট স্তনগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে কতগুলো নধর তুলতুলে ছোট ছোট বাচ্চা, ফ্যালা ডা-াটা তুলতেই বিষ্টু নিষেধ করল, এভাবেই মানুষ নিজের মধ্যে নিজেকে দেখে, নিজেই পরাজয় মেনে নেয়, মানবিকতার কাছে হার মানা নাকি ফিরে আসা, সমরেশ বসুর গল্প বিশ্বপরিক্রমা শেষে মনে হয়, এত গ্লানি-রিক্ততা ও অন্ধকার সত্ত্বেও জীবনের মতো রহস্যময় আর কিছুই নয়।

আর বাস্তব বলতে সাধারণভাবে পরিচিত যে অভিজ্ঞতার বলয়, তার নিরেট ও একঘেয়ে উপস্থিত নিয়ে দেখা দেয়, দ্রষ্টাচক্ষুসম্পন্ন গল্পকারের কল্পনা প্রতিভা তারই মধ্যে আবিষ্কার করে একাধিক স্তর থেকে। মাটি ও মানুষ, অবলা প্রাণীর অজেয় এবং অফুরন্ত প্রাণশক্তির ওপর অগাধ আস্থা পুনর্জন্ম দান করে, সে সঙ্গে সম্ভাবনা নির্মাণ করে নতুন জন্মের, নতুন উৎস নির্মাণের। সমরেশের ভাষা-শব্দাবলী নিয়ে সচেতন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যতখানি না ধরা পড়েছে, তার চেয়ে গল্পের শরীরে জীবনের ভাবমাধুর্য ফুটে উঠেছে, তিনি জীবনের তলানিটুকু ছেঁকে-নিংড়ে গল্পের মূল্যবোধে ও নৈতিকতায় প্রতিস্থাপিত করেছেন।

জীবন ও জগৎকে দেখবার পাঠ নিতে গিয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বসাহিত্যের বরেণ্য সাহিত্যিকদের তাবৎ লেখা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছিলেন, তার মধ্যে গোর্কির সাহিত্য তাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিল, অন্তর্নিহিত ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে গোর্কির বা রাশিয়ার অন্য সাহিত্যিকদের ক্ষেত্রে তাকে উদ্বুদ্ধ করে, সমরেশ বসুর ক্ষেত্রেও দেখা যায়, দেশীয় বা বাংলাভাষী সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি কমলকুমার মজুমদার-বুদ্ধদেব বসু-জগদ্বীশ গুপ্ত-সতীনাথ ভাদুড়ি বা তিন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ খ্যাতিমান সাহিত্যিকের কথাসাহিত্য বা প্রবন্ধসাহিত্য বিশেষ করে মার্কসবাদী চিন্তাধারার রচনা পাঠের সুযোগ পেয়েছেনÑ এ কথা অনস্বীকার্র্য।

চেতনায় এবং আঙ্গিকে নিজস্ব বলয়ে থেকে মনে হয়েছে- কোথায় একটা গন্ধ, কোথায় সে প্রকরণে গ্রামীণ জীবনের ডিটেইলসে মিশে যেতে আপন অস্তিত্বে-শিল্পবোধে-চেতনায় উদ্ভাসিত হয়েছে তার গল্প। মূলত সমরেশ বসু বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন সাহিত্যের সঙ্গে, যেহেতু রাশিয়া-ইউরোপীয় এবং ল্যাতিন আমেরিকার সাহিত্য পাঠের অবাধ সুযোগ অর্জন, যথেষ্ট সুনাম ঈর্ষণীয় অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে বলা অপেক্ষা রাখে না।

×