
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের একটি হচ্ছে পৌষ সংক্রান্তি
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের একটি হচ্ছে পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি। ১২টি রাশি অনুযায়ী ১২টি সংক্রান্তি রয়েছে। বাংলা পৌষ মাসের শেষ দিন পালন করা হয় মকর সংক্রান্তি। বাংলাদেশের কোন কোন অঞ্চলে এ সংক্রান্তিকে তিল্লা সংক্রান্তিও বলা হয়। একদিকে নতুন ধান উঠার আনন্দ। অন্যদিকে মকর রাশিতে সূর্যের আগমনকে কেন্দ্র করে দিনটি মকর সংক্রান্তি নামে পরিচিত। বছরের বারোটি সংক্রান্তির মধ্যে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ মকর সংক্রান্তি। এ সময় সূর্য দক্ষিণায়ন থেকে উত্তরায়নে যায়। খাওয়া দাওয়া, ঘুড়ি উৎসবের পাশাপাশি পুণ্যস্থানের জন্যও মকর সংক্রান্তি গুরুত্বপূর্ণ।
মকর সংক্রান্তি যে মূলত বসন্তকে আহ্বান জানানো হয় তা নয়। এটা ফসল কাটার উৎসব হিসেবেও বিবেচিত হয়। ভোরের স্থান, সূর্য প্রণাম, পিঠাপুলি ও চিড়া-মুড়ির নাড়ু, তিলের নাড়ু, তিল্লা বাতাসা খাওয়া, ঘুড়ি উৎসব নিয়ে ব্যস্ত থাকে বাঙালিরা। পৌষের শেষ আর মাঘ মাসের শুরুতে যে সংক্রান্তি আসে তাই পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি। পৌষ মাস মল মাস বা অশুভ মাস হিসেবে চিহ্নিত হলেও শাস্ত্রমতে মকর সংক্রান্তি থেকেই শুরু হয় শুভক্ষণ। এই সময় সূর্য ধনু রাশি ত্যাগ করে মকর রাশিতে গমন করে। শুরু হয় সূর্যের উত্তরায়ন। তাই একে মকর সংক্রান্তি বলে। কেউ আবার এটাকে উত্তরায়ন সংক্রান্তিও বলে। ছয় মাস থাকে উত্তরায়ন আর ছয় মাস থাকে দক্ষিণায়ন।
পৌষের শেষ মুহূর্তের এই উৎসব সনাতন সংস্কৃতির এক প্রাসঙ্গিক বিষয়। পৌরাণিক মতে দেবতাদের দিন শুরু হয় উত্তরায়নের সঙ্গে সঙ্গে। দক্ষিণায়নের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় দেবতাদের রাত্রি। দীর্ঘ রাত্রি থেকে দেবতাদের দিনে প্রবেশ করার ক্ষণটিকে উৎসব আকারে পালন করে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। তবে এ উৎসব পালন নিয়ে রয়েছে নানা মত।
সনাতন ধর্মীয় বিশ্বাস মতে মকর সংক্রান্তিতে উত্তরায়নের সূচনা এবং এ উৎসব পালন করার মাধ্যমে অশুভ শক্তি নাশ হয়। পুরাণ অনুসারে মকর ক্রান্তির এই দিনে অসুরদের সঙ্গে দেবতাদের যুদ্ধের অবসান ঘটে। ওইদিন ভগবান বিষ্ণু অসুরদের বধ করে তাদের ছিন্ন মুন্ড (মাথা) মন্দিরা পর্বতে পুঁতে দেন এবং শুভ শক্তির সূচনা করেন।
মহাভারত ও কালিকাপুরাণ অনুসারে এই মকর সংক্রান্তিতে দেবতাদের আরাধনা করা হয়। আর্থিক সমৃদ্ধির জন্য এ সময় লক্ষ্মী দেবীর আরাধনাও করা হয়। মল মাসের অর্থাৎ পৌষ মাসের শেষে এই উৎসব পালনের মাধ্যমে অশুভ শক্তির ত্যাগ আর শুভ শক্তির সূচনা করা হয়। আবার কোনো কোনোমতে এই দিনে সূর্যদেব তার পুত্র মকর রাশির অধিপতি শনির উপর রাগ প্রশমিত করে তার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। এই জন্য সূর্য দেবের কাছ থেকে আশীর্বাদ পেতে সকালে সূর্যকে প্রণামের মধ্য দিয়ে মকর সংক্রান্তির উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।
চিড়া-মুড়ি-পিঠাপুলি খাওয়ার পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে ছোট ছেলে-মেয়েরা পৌষ সংক্রান্তির আগের রাতে খড় দিয়ে ছোট ঘর বানায় যাকে বলে তিল্লার ঘর। ওইদিন ছেলে-মেয়েরা বাড়ির পাশে ঘর বানিয়ে সেমাই সুজি মাংস রান্না করে চড়ুইভাতির মতো খাওয়া-দাওয়া করে এবং রাত্রি যাপন করে। খুব ভোরে উঠেই ¯œান করে তিল্লা ঘর পুড়িয়ে আগুন পোহায়। এ দৃশ্য অনেকটা কমে গেলেও গ্রামাঞ্চলে এখনো এ দৃশ্য চোখে পড়ে। পৌষ সংক্রান্তির দিন ঘুড়ি উড়ানো বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্য বাহী একটি উৎসব।
মুঘল আমল থেকে এই উৎসব পালন হয়ে আসছে। পুরান ঢাকার একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান এটি। পৌষ সংক্রান্তি বিভিন্ন দেশে এবং অঞ্চলে বিভিন্ন নামে পরিচিত। বাংলাদেশ ভারত ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ উৎসব পালন হয়ে আসছে। পশ্চিম বাংলায় পৌষ সংক্রান্তি, উড়িষ্যাতে টুসু, অসমে ভোগালি বিহু, তামিলনাড়ুতে পোঙ্গাল, মিয়ানমারে থিং ইয়ান, গুজরাটে উত্তরায়ন, কর্ণাটকে মকর সংক্রমণ, মধ্যপ্রাচ্যে সকর, ঝাড়খণ্ডে খিচরিপর্ব, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে এপি-মা-দাও।
কম্বোডিয়াতে মহাসংক্রান্ত, পাঞ্জাবে লোহরি, পুরান ঢাকায় সাকরাইন, বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে তিল্লা সংক্রান্তি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই দেশে, উৎসব পার্বণের এই দেশে আমরা সবাই মিলেমিশে চলব এই কামনা আজ পৌষ সংক্রান্তির এই দিনে। বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্য এভাবেই এগিয়ে চলুক সুন্দর আগামীর পথে, এই পৃথিবী মুক্ত হোক যুদ্ধ থেকে, মহামারি থেকে।