বার্লিন থেকে কাতালোনিয়ার পাহাড়ের দূরত্ব প্রায় এক হাজার আটশ’ কিলোমিটার
অনেক কিছুই ঘটে যায় আচম্বিতে। জীবনের পথে পথে উষ্ণ সম্ভাবনা কখনো হঠাৎ যাতায়াত করে। এবারের গ্রীষ্মে তেমনই এক সম্ভাবনা মুঠোবন্দি হয়।
কয়েক মাস আগে জানতে পারি বার্লিনের যুব অধিদপ্তর সরকারি অর্থায়নে গ্রীষ্ম কিংবা শীতের ছুটিতে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দেশ সফরে পাঠায়। এক দিক থেকে একে ‘শিক্ষা সফর’ বললে খুব ভুল করা হয় না। এই তথ্য যখন জানি, তখন কেবল স্পেন ভ্রমণের আবেদনের মেয়াদ আছে। প্রথম দফায় আবেদন গৃহীত হলে দ্বিতীয় ধাপে ছোটো একটি পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পেতে হয়। ৩০ জনের একটি দলে সুযোগ পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যের। পরীক্ষা দেওয়ার পর সে আশা প্রায় ছেড়েই রেখেছিলাম। কিন্তু অনেক কিছুই ঘটে আচম্বিতে...
জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ইমেইলের মাধ্যমে জানতে পারি আমার সুযোগ হয়েছে স্পেন সফরে। দুই সপ্তাহের সফর। কোনো বাড়ি কিংবা হোটেলে নয়, সফরজুড়ে ঘুমাতে হবে ক্যাম্পের তাঁবুতে—প্রথম সপ্তাহ স্পেনের কাতালোনিয়ার পর্বতে, দ্বিতীয় সপ্তাহ বার্সেলোনার কাছে কোস্টা ব্রাভার সমুদ্রতীরে। কাতালোনিয়ার পর্বত থেকে ভূমধ্যসাগরে। মাউন্টেন-সাইকেলে পাহাড়ে পাহড়ে ঘোরা, পাহাড়ের খাঁজে লুকানো সবুজ জলের হৃদ কিংবা নদীতে স্নান, নীল সমুদ্রতীরে ভলিবল খেলা—গরমের ছুটিতে এর থেকে ভালো আর কিছু হতে পারে কিনা সেই প্রশ্ন হাওয়ার ভেতর ছুঁড়ে দিই। ধৈর্যরা ভেঙে পড়তে চায়—ভারী আকাক্সক্ষার ভেতর তাদেরকে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
বার্লিনের জুলাই মাস। তাকে গ্রীষ্মকাল বলতে গেলে যেন জিভ আড়ষ্ট হয়ে আসে। সে কারণে জার্মানে ‘জমার’ বলে নিজেকে অহেতুক সান্ত¡না দেই। ‘গ্রীষ্ম’ শব্দের সঙ্গে বাঙালির অবচেতনে যে দৃশ্য ঘন হয়ে আছে তার সঙ্গে বার্লিনের গ্রীষ্মের কোনো মিল নেই- বরং তাকে শরৎ বলে ভ্রম হলে নিজেকে দোষ দেওয়া শক্ত। তবুও সেই ইউরোপীয় গ্রীষ্মকালীন ছুটির ভেতরে স্পেন যাত্রার দিনটি বড়ো এক ফণা তুলে এগিয়ে আসতে থাকে।
স্পেনে পৌঁছাতে আমাদের সামনে দুটি সুযোগ খোলাবাসে অথবা উড়োজাহাজে। তবে উড়তে গেলে নিজের পকেটেই হাত রাখতে হবে। চোখ বন্ধ করে সিদ্ধান্ত করি বাসে যাওয়ার— আর্থিক কারণের পাশাপাশি বাসে এতো দীর্ঘ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ঝুলিতে নেই। বার্লিন থেকে কাতালোনিয়ার পাহাড়ের দূরত্ব প্রায় এক হাজার আটশ’ কিলোমিটারের কাছে। বাসে গেলে লাগবে পঁচিশ ঘণ্টার কিছু বেশি। যেতে হবে জার্মান এবং ফরাসি দেশ পার হয়ে। সমস্ত কিছু ভাবার পর শিহরণ যেন পোষা শালিক হয়ে মাথার কাছে ওড়াউড়ি করে।
যথাদিনে বার্লিনের অস্টবানহোফে (পূর্বস্টেশনে) সবাই উপস্থিত হই। সেখান থেকেই বাস ছেড়ে যাওয়ায় কথা। সবাইকে একটি করে টি-শার্ট দেওয়া হয়। বাস দেখেই আমার চক্ষু ছানাবড়া। দশ চাকার দোতালা বাস। ভেতরে শৌচাগার, (‘প্রসাধনী’ বলা যেতে পারে তাকে) সিনেমাদেখা আর তাস খেলার জন্য বিশেষ টেবিলের ব্যবস্থা। আরোহনের পর অন্য ঘোষণার সঙ্গে স্পেনীয় বাস-চালক ভাঙা জার্মানে জানান- প্রতি দুই-তিন ঘণ্টায় ১৫-২০ মিনিটের বিরতির জন্য গাড়ি থামবে, তাই আমরা যেন শৌচাগার ও তার জল ব্যবহারে মিতব্যয়িতা করি; ময়লা যেন নির্দিষ্ট স্থানে ফেলি।
বাস চলতে শুরু করে জার্মান আউটোবান (মহাসড়ক) ধরে। ধীরে ধীরে রাস্তার ধারের গাছ ও তাদের ছায়ারা দূরে সরে যেতে শুরু করে। এসবের মধ্যে আইশে (ওক), বুখে (বীচ), আহর্ন (ম্যাপল) আর লিন্ডেন গাছের সংখ্যা সব থেকে বেশি। জার্মান মহাসড়কগুলোতে সরকার থেকে কোনো গতিসীমা নির্ধারণ করা নেই, ফলে অন্য নিয়ম মেনে যার যেমন ইচ্ছে তেমন দ্রুত চলতে পারে। আমাদের বাস চলে তুলনামূলক ধীরে। দলের মধ্যে কেবল দু’জন অন্য দেশীয়—এশিয়া থেকে আমিই একা, বাকিজন ব্রাজিলের, অন্যরা সবাই খাঁটি ডয়েচ (জার্মান) বার্লিনের।
তাস খেলা আর গল্পের ছলে তাদের সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচয় গাঢ় হয়। কেউ গান শোনায় ব্যস্ত, কেউ আড্ডায়। বার্লিনের আঞ্চলিকতা মাখানো জার্মান শব্দরা বিভিন্ন কণ্ঠ থেকে মুক্ত হয়ে কোলাহলের শরীরে বাসের ভেতর ঘোরাফেরা করে। আমি যখন জার্মান মুলুকে আসি, প্রথম দিকে এক-দুই ঘণ্টা একটানা জার্মান কথোপকথনে মস্তিষ্ক হাঁফিয়ে উঠত। অথচ মাত্র দু’বছরের পরিক্রমায় সবকিছু কেমন বদলে গেলো। এখন সারাদিন জার্মান শব্দে ডুবে থাকলেও কোনো অস্বস্তি হয় না।
চলতে চলতে এক সময় রাস্তার পাশের গাছগুলোর ভেতর কীফ্যার্ন (পাইন), ফিষটে (স্প্রুস) ও টানেন (ফার) গাছের আধিক্য দেখি। ফিষটে গাছ দেখলেই বড়ো দিনের আলোভরা ঝলমলে সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে। চলতে চলতে হঠাৎ দু-একটা বির্কেন (বার্চ) গাছ দেখি আর কেবল দেবদারু বলে ভ্রম হয়। বুঝতে বাকি থাকে না, শভার্সভাল্ড (ব্ল্যাক ফরেস্ট) এলাকায় ঢুকে গিয়েছি। এদিকে পাইন বা অন্য চিরসবুজ গাছের আধিক্য অনেক বেশি।
দূরে তাকালে দেখা যায় মেঘের সঙ্গে মিতালী করছে শভার্সভাল্ডের পাহাড়-শ্রেণি। ব্ল্যাক ফরেস্টের এই পাহাড়-শ্রেণি আরও কয়েকশ কিলোমিটার এগিয়ে আল্পস পর্বতমালার সঙ্গে গিয়ে মিশেছে। একটু দূরে ফ্রাইবুর্গ পার হলেই সুইজারল্যান্ড। এখানে ফ্রাইবুর্গের কাছাকাছি এলাকায় প্রায় মাস দশেক থেকেছি, তাই রাস্তার পাশ ধরে দ্রুত সরে যাওয়া সাইনবোর্ডে লেখা নামগুলো আমাকে পুরনো দিনের কথা মনে করায়।
এ-৫ মহাসড়ক ফ্রাইবুর্গ পার হয়ে কিছু দূরে গিয়ে দুই দিকে ভাগ হয়ে গেছে। ডানদিক গিয়েছে ফ্রান্সের মূলহাউজের দিকে, আর নাক বরাবর সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত বাসেল শহর। এই পথে বহুবার বাসেল গিয়েছি।
অবশেষে আমরা ধরলাম ফরাসি দেশের পথ।
এদিকে মানচিত্র বলে অন্য কথা—সোজাসুজি পথ ধরে সুইজারল্যান্ডের বাসেলের উপর দিয়ে এগিয়ে জেনেভা হয়ে গেলে পথ অনেক কম। কেন তাহলে ডানে ঘুরলাম? খটকা লেগে রইলো। দলের দু-তিন জন বাদে অন্য কারও এই বিষয়ে ভাবনা নেই—তারা আড্ডায় মশগুল।
জার্মান থেকে ফরাসি দেশে এবারই আমার প্রথম নয়। বাডেন-ভ্যুর্টেমব্যার্গের কেল শহর ঘেঁষা রাইন নদীর সেতু পার হয়ে ট্রামে, হেঁটে কিংবা সাইকেলে ফ্রান্সের স্ট্রার্সবুর্গ শহরে বহু বার গিয়েছি। নদীর এপারে জার্মানি, ওপারে ফ্রান্স। তখন দেখতাম, সেতুর ওপরে মাঝ-বরাবর একটি রেখা টানা, নদীর ভেতরে সীমানা নির্ধারণকারী একটি লগি-সদৃশ কিছু পোঁতা। প্রথম প্রথম দেখে খুব অবাক হতাম—এভাবেও দেশের সীমানা করা হয়! সেতুর আগে জার্মান সীমানায় ছোটো একটি পুলিশ চেক পোস্ট। চেক পোস্টের পাশ কেটে অনবরত মানুষের যাওয়া আসা, অথচ কখনোই দেখিনি কাউকে ডেকে পুলিশ কিছু জিজ্ঞেস করেছে। আর ফরাসি অংশে তো পুলিশের কোনো চিহ্নই নেই।
মহাসড়ক ধরে জার্মানি থেকে ফ্রান্সে ঢুকতে হয় বাংলাদেশের যমুনা বা পদ্মা সেতুর টোল প্লাজার মতো প্লাজা পার হয়ে। জার্মানির মহাসড়ক সবার জন্য ফ্রি, কিন্তু ফ্রান্সের মহাসড়ক ব্যবহার করতে সবাইকেই টোল পরিশোধ করতে হয়। ফ্রান্সে ঢুকতেই মহাসড়কের পাশের পথ নির্দেশক স্তম্ভ বা সাইনপোস্টের রঙ, লেখার ফন্ট বা অক্ষরের শৈলী ও ভাষা বদলে গেলো। এসব দেখেই বোধ হতে শুরু করলো ফরাসি দেশে ঢুকে পড়েছি। কিছুক্ষণ পর নামে ঝুম বৃষ্টি। জার্মান আর ফরাসি দেশের গাছ-পালা, আকাশ একই। ঝুম বৃষ্টিতে গাছদের ভিজে যাওয়া দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়ি তার খেয়াল থাকে না। ঘুম ভাঙে সহযাত্রীর ডাকে। তখন প্রায় মধ্যরাত পেরিয়ে- গাড়ি থেমেছে ভূমধ্যসাগরের কাছাকাছি ফরাসি নীম শহরের এক পেট্রোল স্টেশনে। তড়িঘড়ি করে স্টেশনের শৌচাগারে গিয়ে সতেজ হয়ে আসি। ফ্রান্স বা স্পেনের মহাসড়ক-সংলগ্ন পেট্রোল স্টেশনে এ এক সুখ-পরিষ্কার ঝকঝকে শৌচাগার ব্যবহার করা যায় বিনামূল্যে। জার্মান বা সুইচদেশে সে সুযোগ নেই। শৌচাগারের দরজায় ১ ইউরো খরচ না করলে স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলবেই না।
ফেরার সময় দেখি বাসের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আমাদের চালক মহাশয় ধূম্রপানে ব্যস্ত। আগে লেগে থাকা খটকার সমাধান সারতে তার কাছে যাই। ‘হ্যালো’ বলতেই তার চমৎকার হাসি। স্পেনীয় মানুষ, ইংরেজি-জার্মান মিশিয়েই কেবল কথার উত্তর দেন। প্রশ্ন করি, মানচিত্র বলছে সুইজারল্যান্ড হয়ে গেলে কম পথে যেতে পারতাম, তবে কেন এই ঘুরতি পথে আমরা ফরাসি দেশে?
উত্তর তার ঝরঝরে-সুইজারল্যান্ডের মহাসড়কে অনেক জায়গায় প্রতি ঘণ্টায় ৮০-১০০ কিলোমিটারের গতির ওপরে গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ। পুরো সুইচ দেশটা পাহাড়ের উপরে অবস্থিত, সেখানের আঁকাবাঁকা পথে একটানা একই গতিতে গাড়ি চালানো যায় না, আর তার সঙ্গে সমস্যা হলো, সুইজারল্যান্ড যেহেতু ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে তাই সুইস মহাসড়কের টোলের পরিমাণ অনেক বেশি। (চলবে...)