পাখিরা খড়কুটো সংগ্রহ করে বাসা তৈরি করে
পাখিরা খড়কুটো সংগ্রহ করে বাসা তৈরি করে। কবিরা সমাজের মানুষের মনোজগতের চেতনার অনুভূতি সংগ্রহ করে শব্দে গেঁথে গেঁথে কবিতার দেহ বির্নিমাণ করেন। যা কবিতা হয়ে আপামর মানুষের কথা বলে।
কবির অন্তর জগতের সঙ্গে বহির্জগতের দর্শনীয় বস্তুর সঙ্গে কবির অন্তরলোকে মিথস্ক্রিয়ার ফলে যে অমৃতময় বস্তুর জন্মলাভ হয়; সেটিকে আমরা কবিতা বলতে পারি।
কবিতা জীবনের কথা বলে। সমাজের কথা বলে। কবিতা কখনো রাজনীতি ও স্বাধীনতার কথা বলে। কবিতার কয়েকটি চরণ হাজার হাজার বুলেটের চেয়েও শক্তিশালী।
কবির দর্শন বাস্তব দর্শন। কবি যা দেখে-তাই লেখে। সেখানে কবির অনুভূতি অত্যন্ত প্রখর। দিবাকরের উজ্জ্বল প্রভার মতো দীপ্তিময়। কবির দর্শন কখনো ভুল হয় না। কবিতা মানে দর্শন। কবি মানে দার্শনিক।
কবি কবিতায় বাস্তব সত্যকে প্রকাশ করতে কখনো কুণ্ঠাবোধ করেন না। কবি তার উপলব্ধির দ্বারা সত্যকে জানতে পারেন। কবির চেতনায় সত্য অনুভূতি আঘাত করে বলেই কবি ছন্দে ছন্দে, শব্দে শব্দে গেঁথে ফেলেন একখানা কবিতার অবয়য়ব।
কবিতা শুধু কবির বাণী নয়। সেটি বিশ্বজনীনতার বাণী। সাম্যের বাণী জনগণমন নন্দিত বাণী, সমাজের ভূমিকার বাণী। যে বাণী কবির কলমে চেতনার অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হ’য়ে শব্দের ঝলকানিতে বারুদের মতো বিস্ফোরিত হয়! কবিতা মানে বারুদ, কবিতা মানে কবির কলমে জ্বলে ওঠা চেতনার অগ্নিমশাল!
কবিতা কবির একান্ত অনুভূতির ফসল হলেও সে অনুভূতি পৃথিবীর আপামর মানব হৃদয়ের অনুভূতির বহির্প্রকাশ। কেননা, কবিতা শুধু একজন মানব মনের কথা নয়। সে কথায় বিশ্বজনীনতার অনুভূতি লিপিবদ্ধ থাকে।
কবিতায় প্রেম থাকে, দ্রোহ থাকে। কবিতায় সমাজের সকল অবক্ষয় ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থাকে। যে কবিতায় এ সবের কিছু নেই। সে কবিতা সত্যিকার অর্থে মানব সমাজের কোনো উপকারে আসে না।
যে কবিতা দেশের, সমাজের, মানুষের কথা বলে না। যে কবিতা অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে না। সে কবিতা নিছক আবর্জনা ছাড়া আর কিছু নয়।
যে কবিতা সমাজের আনুষঙ্গিক বিষয়কে অতিক্রম করে নির্লিপ্ত ও অপ্রয়োজনীয়-অনুসন্ধিৎসা ভাব প্রকাশ করে। যে কবিতা পঠনে পাঠক দুর্বোধ্যতার সীমাহীন অতলে হাবুডুবু খায়। সে সকল কবিতা কবিত্বের দাবি রাখে না।
সত্যের সিঁড়ি বেয়ে হেঁটে যে কবিতা সমাজের সকল অন্যায়, অপরাধ, অত্যাচার, নিপীড়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ও প্রতিবাদী শব্দের উচ্চারণ করে! সে কবিতাই প্রকৃত অর্থে কবির কলমে কবিতা হয়ে ওঠে!
কবিতা শুধু কবির ভাবনার ফসল নয়। কবিতা কবির একান্ত অনুভূতির ফসল। যে অনুভূতি সমাজের সকল মানুষের অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশে যায়। সমাজের সকল মানুষ কবি নয়। কিন্তু তাদের অনুভূতিগুলো কবির কবিতার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। যে কারণে কবির কবিতা সকল মানুষের চেতনায়, মরমে অনুভূতি সঞ্চার করে। কবি সকলের কাছে সমাদৃত হন।
কবিতার কোনো জাত-পাত নেই। কবিতা মানুষে মানুষে কোনো বিভেদের দেওয়াল তৈরি করে না। কবিতার কাছে পৃথিবীর সকল মানুষ সমান। কবিতা কোনো মানুষকে ভিন্নতার চোখে দেখে না। বরং কবিতা পৃথিবীর আপামর মানুষকে ¯েœহ-মমতার একক বন্ধনে আবদ্ধ করতে চায়। কারণ কবি কোনো মানুষকে ভিন্নতার চোখে দেখেন না। কবি সকল মানুষকে সমতার চোখে দেখেন। এ জন্য তিনি কবিতায় সাম্যের কথা বলেন, মিলনের কথা বলেন। সুতরাং কবিতাই পারে, মানব সমাজের সকল বৈরিতা এবং ভিন্নতাকে সমূলে বিনাশ করতে!
বাইরের দৃশ্যমান বস্তুর সঙ্গে কবির মনোজগতে যে ভাবের আদান-প্রদান চলে। সেটি এক সময় শব্দবৃক্ষে পরিণত হয়। আর এ শব্দবৃক্ষই হলো কবিতা।
কবিতার আগুন ভয়ঙ্কর আগুন! এ আগুন হঠাৎ জ্বলে উঠে একটি দেশ-জাতি-সমাজের অবক্ষয়কে পুড়িয়ে ছারখার করতে পারে! একটি কবিতা পারে পরাধীনতার শিকল ভাঙার গান গাইতে! একটি কবিতা পারে স্বাধীনতার ডাক দিতে। একটি কবিতা জাগাতে পারে একটি দেশকে, দেশের আপামর জনতাকে। একটি কবিতা রুখে দিতে পারে সকল অন্যায়-অত্যাচাররের খড়গ কৃপানকে। একটি কবিতা গর্জে উঠলে রাজার মসনদও টলমল করে। একটি কবিতার বজ্রনিনাদে দৌড়ে পালায় হাজারো অপরাধী ভেড়ার দল!
কবিতা কারো বাধা মানে না। কবিতা কারও চোখ রাঙানির ভয় করে না। কবিতা কোনো আইন মানে না। কবিতা কোনো বন্দুক, রাইফেল কিংবা মেশিনগানের ভয়ে আড়ালে লুকিয়ে থাকে না। কবিতা প্রকাশ্য অভিমুখী। স্ববাক হয়ে-স্বপ্রণোদিত হয়ে ঘোষণা করে তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। কবিতা সকল প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে, সকল নষ্টতার বিরুদ্ধে, সকল অপবিত্রতা ও কলুষতার বিরুদ্ধে স্লোগানমুখর হয়ে গর্জে ওঠে!
কবিতা। কবির কলমে প্রসূতি মায়ের মতো প্রসবিত সন্তান। কবিতার জন্মদাতা পিতা কবি। কবিতা কবির চেতনার জল-রক্ত-মাংসে গড়া প্রতিমা। যার অবয়য়বে কবিসত্তার নির্যাস পীযুষের মতো অমৃতময় হয়ে জগতজনের মাঝে প্রকটিত হয়। কবিতা আড়মোড়া দিয়ে ফুটেওঠা প্রস্ফুটিত পুষ্প। যে পুষ্পের সুগন্ধে চারদিক সুবাসিত হয়। অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশ, জাতি, সমাজ সোনালি আলোর ঝলকানি দেখতে পায়।
কবিতা জীবন্ত বোধিবৃক্ষের মতো। আজীবন চৈতন্যসত্তায় বোধ সঞ্চার করে। বোধিবৃক্ষ কবি। আর কবিতা বোধিবৃক্ষের ফল। একজন কবি কবিতার বোধিবৃক্ষ।
কবির চিত্তগহণে যে ফুল ফোটে। সে ফুল কবিতার ফুল। কবির চিত্তবীণায় যে সুর শব্দ হয়ে ঝংকার তোলে। কবি সেই সুর-শব্দে শব্দে, ছন্দে ছন্দে, গেঁথে নির্মাণ করেন একখানা শব্দপুষ্পহার। যে হার শোভা পায় কবিতার মহাভক্ত পাঠকের গলায়।
কবিতা সময়ের প্রকোষ্ঠে- চৗকাঠের ফ্রেমে বন্দি হওয়া বস্তু নয়। কবিতা দেশ-কাল-সময়ের গ-ি পেরিয়ে মহাবিশ্বের অসীম সীমানায় মিশে যায়। সময়ের অর্গল ভেঙে সমসাময়িকতার কথা বলে।
তেমনি একজন কবি। শুধু একটি নির্দিষ্ট দেশের সম্পদ নয়, একটি জাতির সম্পদ নয়। একজন কবি। সমগ্র বিশ্বের সম্পদ, বিশ্বজনীন সম্পদ। কেননা, কবির কবিতা কোনো নির্দিষ্ট স্থানে জমাটবাঁধা আবর্জনাস্তূপের মতো জমাটবদ্ধ হয়ে স্থির থাকে না। কবির কবিতা সময়ের অলক্ষ্যে বায়ুপ্রবাহের মতো ছুটে চলে একস্থান থেকে আরেক স্থানে। দেশ থেকে অন্যদেশে। এক জাতিগোষ্ঠী থেকে আরেক জাতিগোষ্ঠীর কাছে।
কবিতা মেঘে ঢাকা তারার মতো চিরকাল সময়ের অন্তরালে আবৃত থাকে না। মেঘ অপসারিত হলে নক্ষত্ররাজি যেমন আলোকচ্ছটা বিচ্ছুরিত করে। তেমনি কবিতাকে কেউ অবলুপ্ত করতে পারে না। কবিতা স্ব-মহিমায় প্রকট হয়।
কবিতার কোনো বয়স নেই। কবিতা সব সময় চিরযৌবনা। কবিতা আমৃত্যু যৌবন রসে সিক্ত হয়ে, জগৎজনের মাঝে আত্মগৌরব নিয়ে বেঁচে থাকে। কবিতার মাঝে কবির নামও অমর রয়। কবিতা কথা কয় মহাকালের ¯্রােতে ভেসে ভেসে। কাল অতীত হয়। কিন্তু কবিতা কখনো অতীত হয় না। অতীতকে অতিক্রম করে ভবিষ্যতের ছবি আঁকে দূর-সীমানায়। কবিতা বেঁচে থাকে কালের কালান্তরে সময়ের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে। তার ব্যক্তধ্বনির লহরী তুলে। মানবের হৃদয়ে হৃদয়ে। গুপ্ত-ব্যথার মতো সঞ্চিত হয়ে!