.
(গত সপ্তাহের পর)
আশ্রমের সামনে এসে নামলাম আমি আর সুলগ্না। এই আশ্রম গড়ে তুলেছিলেন চন্দননগরের কৃতী পুরুষ মতিলাল রায়। বিপ্লবের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রবর্তক সংঘ একসময় সারা ভারতের বিপ্লবীদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল। ২০১০ সালে গ্রেফতার এড়াতে কলকাতা থেকে গোপনে চন্দননগর চলে আসেন অরবিন্দ ঘোষÑ নৌকায় বসে ছিলেন তিনি, কোথাও আশ্রয় পাচ্ছিলেন না, মতিলাল তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। আলিপুর জেলে থাকতেই অধ্যাত্মবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন অরবিন্দ। চন্দননগরে চল্লিশ দিন আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। তারপর পন্ডিচেরি চলে যান। সেখানে সশস্ত্র বিপ্লবের পথ থেকে সরে গিয়ে আধ্যাত্মিক সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন, নির্মাণ করেন আশ্রম। বিপ্লবী অরবিন্দর নতুন পরিচয় হয় ঋষি অরবিন্দ।
পন্ডিচেরিতে অরবিন্দর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই সাক্ষাতকারের কথা স্মরণ করে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি। তাতে বলেছেন, ‘অরবিন্দকে তাঁর যৌবনের মুখে ক্ষুব্ধ আন্দোলনের মধ্যে যে তপস্যার আসনে দেখেছিলুম সেখানে তাঁকে জানিয়েছিÑ অরবিন্দ রবীন্দ্রের লহো নমস্কার। আজ তাঁকে দেখলুম তাঁর দ্বিতীয় তপস্যার আসনে, অপ্রগলভ স্তব্ধতায়Ñ আজও তাঁকে মনে মনে বললুম- অরবিন্দ রবীন্দ্রের লহো নমস্কার।’ অগ্নিযুগের পুরো সময়টায় সৃষ্টিশীলতার শীর্ষে ছিলেন বাংলার দুই শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। রবীন্দ্রনাথ অরবিন্দকে সশ্রদ্ধ নমস্কার জানিয়েছেন কবিতায়। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ব্রিটিশের দেওয়া নাইটহুড উপাধি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর গান বিপ্লবীদের সাহস দিয়েছে, প্রেরণা দিয়েছে। মৃত্যুভয় জয় করার শক্তি পেয়েছেন বিপ্লবীরা রবীন্দ্রনাথের গান থেকে। এ শুধু কথার কথা নয়, বাস্তবেও ঘটেছে এমন ঘটনা। ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’- গান গেয়ে ফাঁসির মঞ্চে গিয়েছিলেন বিপ্লবী কৃষ্ণগোপাল চৌধুরী। মেদিনিপুর জেলে ঘটেছে এই ঘটনা, ১৯৩৪ সালের ৫ জুন তারিখে। আমরা জানতে পাই তাঁর সহবন্দী সীতাংশু দত্ত রায়ের স্মৃতিচারণা থেকে। কৃষ্ণগোপালও চট্টগ্রামের ছেলে। মাত্র ষোলো বছর বয়সে তার ফাঁসি হয়।
খুদিরাম, মাখনলাল, কৃষ্ণগোপাল...এইসব বালক বীরের আলোচনায় আমার মনে পড়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের এক বালক বীরের কথা। তার নাম জানা যায় না। শুধু জানা যায় রাজশাহীর রোহনপুরে কোথাও তার বাড়ি ছিল। সেখানেই ধরা পড়েছিল এই বালক মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে। তার কথা লিখেছেন খোদ পাকিস্তানী মেজর সিদ্দিক সালেক তার Witness to Surrender বইতে। আসুন মেজরের বয়ানেই শুনি সেই ঘটনা- ‘১৯৭১ সালের জুন মাসে রোহনপুর এলাকায় (রাজশাহী জেলা) একটি বালককে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে কোম্পানি সদর দফতরে নিয়ে আসা হলো। কিন্তু কোন তথ্যই সে প্রকাশ করতে রাজি হলো না। মুখ খোলানোর সব পদ্ধতিই যখন ব্যর্থ হলো, ‘মেজর আর’ তার স্টেনগান বালকটির বুকের ওপর চেপে ধরে বললো, ‘এই-ই তোমার শেষ সুযোগ। যদি মুখ না খোলো, তাহলে বুলেট তোমার বুক চিরে বেরিয়ে যাবে।’ বালকটি সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু মুড়ে বসে মাথা নুইয়ে মাটি চুম্বন করল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি এখন প্রস্তুত। গুলি করুন। আমার রক্ত আমার দেশকে স্বাধীন করবে।’
এরপর কী ঘটেছে মেজর সিদ্দিক সালেক তা আর লেখেননি। এড়িয়ে গেছেন। যুদ্ধাপরাধী সেই মেজরের নামও (মেজর আর) তিনি গোপন করেছেন। যা এড়াতে পারেননি, তা হলো এই বালকের সাহস আর আত্মত্যাগের কথা- এটুকু লিখতে বাধ্য হয়েছেন পাকিস্তানী মেজর। এতটাই তাকে বিস্মিত করেছিল এই ঘটনা। না লিখলে আমরা জানতেও পারতাম না এই বালকের কথা। যার কাছে ব্যর্থ হয়েছিল পাকিস্তানী সৈন্যদের নির্যাতন, ব্যর্থ হয়েছিল মুখ খোলানোর সব পদ্ধতি। এই পদ্ধতি কতটা নিষ্ঠুর, কতটা নির্মম তা আমরা জানি পাকিস্তানী টর্চার সেল থেকে ফিরে আসা মানুষের মুখে। এই বালক ফিরে আসেনি। তাকে হাজার সালাম। রোহনপুরের বীর বালক! তোমার রক্তে স্বাধীন হয়েছে তোমার দেশ।
অগ্নিযুগের কথায় ফিরে যাই। কবি নজরুল জেলে গিয়েছিলেন বিপ্লব আর বিদ্রোহের সমর্থনে অগ্নিঝরা কবিতা লিখে। সেই কবিতার নাম ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২২ সালে নজরুল সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায়। এই কবিতায় ঋষি অরবিন্দর উল্লেখ আছে এভাবেÑ
‘মহেশ্বর আজ সিন্ধুতীরে যোগাসনে মগ্ন ধ্যানে
অরবিন্দ-চিত্ত তাহার ফুটবে কখন কে তা জানে?’
কবিতা প্রকাশের অল্পদিন পরে ‘ধূমকেতু’ নিষিদ্ধ হলো। বাজেয়াফত হলো কবির প্রবন্ধের বই ‘যুগবাণী’। যেদিন বাজেয়াপ্ত হলো, সেদিনই কবিকে গ্রেফতার করলো পুলিশ কুমিল্লায়। সেখান থেকে নিয়ে এলো কলকাতায়। বিচারের সময় আদালতে নজরুল যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন, নজরুল সাহিত্যে তা ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’ নামে স্মরণীয় হয়ে আছে। বিচারে কবিকে এক বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়। প্রতিবাদে জ্বলে ওঠে সারা দেশ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটক উৎসর্গ করেছিলেন বিদ্রোহী কবিকে। আলীপুর জেল থেকে হুগলি জেলে নিয়ে আসা হয় কবিকে। এখানে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে কবির পায়েও ডা-াবেড়ি পরানো হয়।
প্রতিবাদে নজরুল রচনা করেন গানÑ ‘শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল/ এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল...।’ বন্দিরা কবির সঙ্গে নেচে নেচে গান গায়, রচিত হয় কারাগারে অমর এক কোরিওগ্রাফ। শিকলের ঝঙ্কার ওঠে, বন্দির ছায়া নাচে জেলখানার দেয়ালে দেয়ালে। কিছুদিন পর বন্দিেেদর উপর নির্যাতনের প্রতিবাদে অনশন শুরু করেন নজরুল। ৩৯ দিন ধরে চলে তাঁর অনশন। আবার বিচলিত হয়ে ওঠে বাংলার সাহিত্য সমাজ। উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ শিলং থেকে পাঠিয়েছিলেন সেই বিখ্যাত টেলিগ্রাম, যাতে লেখা ছিল- ‘গিভ আপ হাঙ্গার স্ট্রাইক। আওয়ার লিটারেচার ক্লেইমস ইউ।’ এভাবে একাকার হয়ে গিয়েছিল অগ্নিযুগে বুলেট-বিপ্লব-রিভলবার আর বিদ্রোহের সঙ্গে কবিকন্ঠের গান ও প্রতিবাদের ভাষা।
আশ্রমের মাঝখানে বিরাট উঠোন। পশ্চিমের লম্বা টানা একতলা ঘরে শিশুদের বিদ্যালয়। এখন টিফিন টাইম। বারান্দায় বসে টিফিন খাচ্ছে ছেলেমেয়েরা। ছয়-সাত বছর বয়স হবে তাদের। টিফিন শেষে কেউ কেউ উঠোনে খেলছে, ছুটোছুটি করছে। উঠোন জুড়ে শিশুদের কলকণ্ঠ। দক্ষিণে উঁচু ভিটের ওপর পুরনো আমলের বিরাট একটা ঘর। ছাদ উঁচু হওয়ায় ভেতরটা বেশ ঠান্ডা আর আরামের। সেখানে বসেছি আমরা কয়েকজন।
বিপ্লবী দাদুর গল্প বলছেন শর্বরী বোস। ‘কানাইলাল দত্ত ছিলেন আমার ছোট দাদু। বাবার ছোট কাকা। এই চন্দননগরেই তাঁর জন্ম- এখানে তাঁর মামাবাড়িÑ বাড়িটা দেখেছেন?’ আমি মাথা নাড়ি, দেখেছি।
আসবার পথে অটো থেমেছিল বাড়িটার সামনে। সুলগ্না অটোতে বসেই দেখিয়ে দিয়েছেন- ‘ঐ যে লাল ইটের বাড়ি।’ যে ঘরে জন্মেছেন কানাইলাল, তার একটা জানালা ফুটপাথের দিকে। জানালা দিয়ে দেখা যায় কানাইলালের আবক্ষ মূর্তি ঘরের মাঝখানটায়- শিকের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটা ছবিও তুলে নিয়েছি মোবাইলে।
কানাইলালের ছোটবেলা কেটেছে বম্বে শহরের কাছে বাবার কর্মস্থলে। চন্দননগরে ফিরে এসে কানাই ভর্তি হয় ডুপ্লে কলেজে, যা এখন কানাইলাল বিদ্যামন্দির। কলেজের অধ্যক্ষ চারুচন্দ্র রায় ছিলেন বিপ্লবীদের সমর্থক। তাঁর প্রভাবে বিপ্লবের গোপন কাজে আকৃষ্ট হয় তরুণ কানাই। কেমন ছিলেন তখন তিনি? এমন প্রশ্নের জবাবে শর্বরী বলেন- বিনয়ী, কিছুটা লাজুক আর মৃদুভাষী। লম্বা দীর্ঘদেহী হলেও শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলেন ছোটবেলায়।
চারু রায়ের গোপন আস্তানায় নিয়মিত ব্যায়াম আর লাঠিখেলার চর্চা করে ধীরে ধীরে দেহে এবং মনে শক্তপোক্ত হয়ে উঠেছিলেন দাদু। চারু রায় তাঁকে নিজ হাতে পিস্তল-রিভলভার চালানো শিখিয়েছিলেন। এভাবে নিজের উপর আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছিল কানাইলালের। যে কোনো অন্যায় দেখে রুখে দাঁড়ানোর শিক্ষাটাও তিনি পেয়েছিলেন চারু রায়ের কাছেইÑ একদিন হাতেনাতে এর প্রমাণ হয়ে গেল।
ঘটনাটি বলেন শর্বরী বোস। সরিষাপাড়ায় যেখানে কানাইলালের মামাবাড়ি, সেখানে বাড়ি থেকে একটু দূরে রাস্তার অপর পাশে একটি পতিতালয় ছিল সেই সময়। ইংরেজ সাহেবরা আসতো নিয়মিত সন্ধ্যের পর, গভীর রাত পর্যন্ত চলতো তাদের হৈ-হল্লা, মাতলামি আর অসভ্যতা। একদিন এসব চরমে উঠলো। মাতালের চিৎকার, চ্যাঁচামেচি আর হল্লায় কান পাতা দায়। কানাই বেরিয়ে এলেন বাড়ি থেকে। এগিয়ে গিয়ে ভদ্রভাবে তাদের বললেন আপনারা এখানে এত হৈচৈ করবেন না। চলে যান। আপনাদের চিৎকারে মানুষ ঘুমাতে পারছে না। এখন তাদের ঘুমানোর সময়।
সাহেবরা তিনজন ছিল। তারা সাহেব মানুষ, ফুর্তি করছে, তার মাঝে কে এক নেটিভ এসে বাগড়া দিচ্ছেÑ এ কি সহ্য হয়? কানাইয়ের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের একটা হাসি দিল তারা। তারপর শুনিয়ে শুনিয়ে আরও বেশি চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করতে লাগলো, ভাবখানাÑ এই নে দ্যাখ, কী করবি কর, কালা নেটিভ আদমি! সেই সঙ্গে চললো অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি আর খিস্তিখেউড়।
কানাই দেখছিল নীরবে। তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে তিন সাহেবের মধ্যে যেটা সবচেয়ে শক্তিশালী, তাকেই বেছে নিল কানাই। দু’পা এগিয়ে গিয়ে ব্যায়ামের আখড়ায় শেখা প্রচন্ড এক ঘুসি বসালো লোকটার নাকের ওপর। টলে পড়ে গেল লোকটা। বাকি দু’জন পালাচ্ছিলো। কানাই তাড়া করে একটাকে ধরে তার মুখেও বসালো ঘুষি। তৃতীয়টা পগার পার।
নেটিভের কাছে মার খেয়ে লজ্জার কারণেই হোক কিংবা অন্য যে কোন কারণেÑ এই ঘটনা নিয়ে কোনো মামলা- মোকদ্দমা হয়নি। চেপে গেছে সাহেবরা। এরপর বহুদিন এ তল্লাটে তাদের আর দেখা যায়নি। যদি বা এসেছে চোরের মতো এসে সেভাবেই চলে গেছে। দম নিলেন শর্বরী। রুমালে মুখটা মুছলেন একবার। উঠোন থেকে বাচ্চাদের খেলার চিৎকার ভেসে আসছে। তাদের টিফিন টাইম এখনো শেষ হয়নি। বিপ্লবী দাদুর গল্পে ফিরে গেলেন নাতনি আবার।
বিএ পাস করে কানাইলাল চলে যায় কলকাতায়। যোগ দেয় ‘যুগান্তর’ দলের সঙ্গে। মুরারিপুকুর লেনে ছিল বিপ্লবীদের ঘাঁটি। এই সময় কিংসফোর্ডকে মারতে গিয়ে অভিযান ব্যর্থ হওয়ার ঘটনা ঘটে। খুদিরাম ধরা পড়ে যায়। ট্রেনে করে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিল প্রফুল্ল। পুলিশের দারোগা নন্দলাল ব্যানার্জি তাকে সন্দেহ করে। পুলিশের তাড়া খেয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছিল প্রফুল্ল। কোণঠাসা হয়ে গেলে আত্মহত্যাকেই সে নিয়তি বলে মেনে নেয়। তবে সত্যিই প্রফুল্ল আত্মহত্যা করেছিল নাকি পুলিশই তাকে হত্যা করে গা বাঁচানোর জন্য আত্মহত্যার কথা রটিয়েছে- এ নিয়ে বিতর্ক আছে আজও।
এই ঘটনার পর গ্রেফতার হয়ে গেলেন অরবিন্দ ঘোষ, বারিন ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, কানাইলাল দত্তসহ অনেক বিপ্লবী। শুরু হলো বিখ্যাত আলিপুর বোমা মামলা। এই মামলার অফিসিয়াল শিরোনাম ছিল ‘ব্রিটিশ রাজ বনাম অরবিন্দ ঘোষ ও অন্যান্য’। দু’বছর (১৯০৮-৯) ধরে চলে মামলার কার্যক্রম। প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে জোরালো কোনো প্রমাণ খুঁজে পাচ্ছিলো না ব্রিটিশ সরকার। তাই তারা বাঁকা পথ ধরলো।
বিপ্লবীদের মধ্যে থেকে নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী (নরেন গোঁসাই) নামে একজনকে বেছে নিয়ে রাজসাক্ষী বানালো তারা। নরেন গোঁসাই ছিল ধনীর দুলাল। পুলিশের অত্যাচার সহ্য কারা কিংবা প্রলোভন এড়ানোর মতো মনের জোর তার ছিল না। তাকে ছেড়ে দেয়া হবে এই টোপ সে গিলে নিলÑ পুলিশের সাজানো স্টেটমেন্ট অনুযায়ী স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হয়ে গেল নরেন গোঁসাই। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে যদি এই স্বীকারোক্তি আদায় করা যায়, তাহলে অরবিন্দ ঘোষসহ নেতৃস্থানীয় বিপ্লবীদের ফাঁসি কিংবা দ্বীপান্তর হয়ে যাবে নিশ্চিত।
এরকম যখন পরিস্থিতি, জেলের ভেতরে বিপ্লবীরা সিদ্ধান্ত নিলেন বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাইকে নীরব করে দিতে হবে। কাজটা করতে হবে দ্রুত। কিছুদিন পরে আবার শুনানি আছে। তার আগেই সারতে হবে কাজ। হাতে সময় খুব কম। জেলের বাইরে খবর চলে গেল- দুটো রিভলবার দরকার, সঙ্গে কিছু গুলি। খুব তাড়াতাড়ি তা চলেও এলো বিপ্লবীদের হাতে।
‘কীভাবে ঢুকলো রিভলবার জেলের ভিতরে?’
আমার প্রশ্নের উত্তরে শর্বরী বলেন, ‘এ বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায় না। কঠোর গোপনীয়তা মেনে চলতেন বিপ্লবীরা। দাদু কাউকে কিছু বলেননি।’
‘একদমই কিছু না?’ ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়েন শর্বরী।
কৌতূহলটা থেকেই গেল মনের মধ্যে। জেলের পাহারা আর কঠোর নিরাপত্তার ভিতর দিয়ে কে নিয়ে গেল রিভলবার, কীভাবে নিয়ে গেল? আজ পর্যন্ত এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর কেউ দিতে পারেননি। ফলে নানারকম অনুমান ও ধারণা তৈরি হয়েছে। একটা বিষয়ে সবাই একমত যে চন্দননগরের বিপ্লবীরা রিভলবার দুটো সরবরাহ করেছিলেন- কানাইলালের বন্ধু শ্রীশচন্দ্র ঘোষের নাম শোনা যায়।
কিন্তু কীভাবে জেলখানায় ঢুকেছিল রিভলবার, তা জানা যায় না। এমনও ধারণা আছে যে একজন মেয়ে বিপ্লবী তার খোঁপার ভেতরে লুকিয়ে রিভলবার নিয়ে গিয়েছিলেন। আত্মীয় পরিচয় দিয়ে তিনি কানাইলালের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, সেই সুযোগে অস্ত্র পাচার করে দেন।
এই ধারণা ঠিক না ভুল জানবার কোন উপায় নেই। তবে অসম্ভব নয়। খুব ছোট রিভলবার হলে খোঁপার ভিতরে লুকিয়ে রাখা হয়তো সম্ভব। রিভলবার দুটো দেখার খুব কৌতূহল হলো আমার। কিন্তু সেগুলো কী আছে কোথাও? হয়তো হারিয়ে গেছে এতদিনে। এ নিয়ে আর কোনো কথা হয়নি সেদিন।
গল্পে ফিরে গেলাম আমরা আবার। ‘রিভলবার পেলেন বিপ্লবীরা, তারপর...?’ ‘তারপর কিভাবে কাজটা করা হবে সেই প্ল্যান আঁটতে লাগলেন কানাইলাল আর তার বন্ধু সত্যেন।’ শর্বরী বলতে থাকলেন। (চলবে...)