ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

দিলরুবা শাহানা

মুক্ত গদ্য ॥ কাহিনী সামান্য

প্রকাশিত: ২১:৩৪, ২১ মে ২০২১

মুক্ত গদ্য ॥ কাহিনী সামান্য

জাফর আলীর ঘুষি ও থুতু বিষণ্ণ সন্ধ্যায় দিল্লীর নামী-দামী প্রাইভেট হসপিটালের বারান্দার কোনায় বসে অঝোরে কাঁদছে জাফর আলী। কার জন্য তার কান্না? এই হসপিটালে বাংলাদেশের তিন সন্তানের মা এইমাত্র যে তরুণী মা মারা গেছেন তার জন্য কি? সে তো তার কেউ নয়? তবুও সেই তার আশার আলোটুকু নিভিয়ে গেছে। এই তরুণী দূর বাংলাদেশ থেকে একটি কিডনি পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে এসেছিল। হসপিটালই কিডনি বেঁচতে আগ্রহী জাফর আলীকে খুঁজে বের করেছিল। এটা হসপিটালের ব্যবসার অংশ। তারাই মেয়েটির সঙ্গে জাফর আলীর কিডনি ম্যাচ বা মিল করিয়ে ছিল। বাংলাদেশের মানুষ বড় দিলের মানুষ। জাফর জানে তারা ভাল দামও দেবে। ওই মেয়েটির পরিবারের জন্য হসপিটালই সব ব্যবস্থা ঠিকঠাক করে দিল। তিন মাসের জন্য হসপিটালের কাছাকাছি বাসা ভাড়া পাওয়া গেল। স্বামী-সন্তান ও দেশ থেকে আনা কাজের মানুষ নিয়ে থাকার সুবিধাজনক ব্যবস্থা। চুক্তিমতো ঘোর করোনার ঠিক আগ মুহূর্তে ডায়ালিসিসের রোগী মেয়েটি সবাইকে নিয়ে পৌঁছাল। কথামতো মেয়েটির সপ্তাহ দশ দিন ডায়ালিসিসের পরই জাফরের একটি কিডনি কেটে নিয়ে ওই মেয়েটির শরীরে সংস্থাপনের কথা। দরিদ্র জাফরকেও হসপিটালে রেখেই জামাই আদরে যতœআত্তি করে সুস্থ সবল রাখছিল। এরই মাঝে করোনার থাবায় মেয়েটির পরিবারের কেউ কেউ সামান্য অসুস্থও হলো। তবে হসপিটাল তার হিসাবমতো এগোচ্ছিল। সমস্যা জটিল আকার নিল মেয়েটি নিজেও যখন করোনায় অসুস্থ হলো। হতভাগিনী মারাও গেল। তার মৃত্যুতে জাফর আলীই আঘাত পেল বেশি। হতদরিদ্র লোকটি কিডনি বিক্রির টাকা দিয়ে স্ত্রীর চিকিৎসা, মেয়ের বিয়ে কত কাজ করবে। সে সব আর হবে না এখন। এই মাত্র হসপিটাল থেকে বলা হয়েছে জাফর যেন বিদায় হয় এখান থেকে। এই কয়দিন হসপিটাল মহা আদরে তুলু তুলু করে তাকে রাখলেও এখন জাফরকে দিয়েছে পশ্চাতে ধাক্কা। হসপিটালও বাংলাদেশের মালদার মক্কেলের কাছে জাফরকে বেঁচে, না ঠিক ওকে নয় ওর কিডনি বেঁচে মোটা অঙ্ক লাভের আশায় ছিল। মেয়েটির মৃত্যুতে এখন জাফর আলী হয় গেছে মূল্যহীন। এই হসপিটালে তার আর কোন প্রয়োজন নেই। জাফর আলী কানছে আর ভাবছে এই করোনার মাঝে মেয়েটি কেন মরতে এখানে এসেছিল। হঠাৎ দেখে করিডরের আরেক প্রান্তে মেয়েটির স্বামীর সঙ্গে ডাক্তারের বচসা চলছে। কথাবার্তা সব ইংরেজীতে। রোগিনীর স্বামী নম্র কণ্ঠে কাকুতি মিনতি করছে। কোন কিছুই জাফরের মগজে ঢুকছে না। শুধু ডাক্তারের বলা একটা শব্দই সে বুঝল ‘ডেড বডি’, ‘ডেডবডি’। বুঝল মুর্দা নিয়ে কথা কাটাকাটি চলছে। বাংলাদেশের মানুষগুলো এই দুর্দিনে কোথায় যাবে মুর্দা নিয়ে কিছু ভেবে পেল না জাফর। দিল্লীর শ্মশান-গোরস্তান মুর্দায় মুর্দায় সয়লাব। সে একটু এগিয়ে গিয়ে কথাটা বুঝতে চাইল। ডাক্তার জাফর আলীকে দেখেই চিৎকার করে উঠল -ভাগ হিয়াসে কমবখ্ত এই কয় দিনে হসপিটালের পুষ্টিকর খাবারদাবার খেয়ে জাফরেরও শরীর স্বাস্থ্য যথেষ্ট বলবান এখন। ডাক্তারকে বিরাশি শিক্কার এক চড় দিল কষিয়ে। চড়ের ধাক্কায় তিন চক্কর খেয়ে ডাক্তার যখন মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে তখনই জাফরকে ধরতে ছুটে এলো কয়েকজন। তাদের দিকে মুখ ভর্তি থুতু ছিটিয়ে দিতে দিতে বাঘের মতো গর্জন করে জাফর বলে যেতে থাকল ‘আয়, আয় আমার কাছে, আরও কাছে আয়, আমার করোনা হয়েছে, করোনা দিয়ে যাব তোদের, করোনা, ক রো না।’ (আংশিক সত্য ঘটনা অবলম্বনে) কুসুমের জন্য ঈদ এলো না রাত তিনটা। আগামীকাল ঈদ। কুসুম চার নম্বর সড়কের বাড়ির বাইরে পা রাখল। কামিজে পুঁতি চুমকি বসানোর কাজ সারতেই রাতগভীর। সুফী ও আরজু এগিয়ে দিচ্ছে ওকে। তারপর ওরা স্বামী-স্ত্রী এই ধনী পারার বাড়ি বাড়ি গিয়ে পোশাকগুলো পৌঁছে দেবে। জরুরী কাজ রাত জেগে করায় রোজগারও বেশি। কুসুম স্মমীকে বলেছিল রাত বারোটা বাজতে পারে। এতো রাত হওয়াতে ভয় পাচ্ছে। যদিও মানুষভাল স্মমী। সেলাইয়ের কাজ করতে করতেই স্বামীর চোখ যাওয়ার পথে। এখন তাই কাজও বন্ধ। কুসুম প্রাণপণ খাটছে। আজকের রাতের উপার্জন দিয়ে স্মমীকে ভাল চোখের ডাক্তার দেখাতে পারবে। ভীষণ ক্লান্ত শ্রান্ত কুসুমকে এই ভাবনা একটু স্বস্থি দিল। বাড়ি পৌঁছে ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নিয়ে উঠেই সিঁড়ি ধুয়ে ফেলবে। নামাজে যাওয়ার আগেই সিঁড়ি সাফসুতরা থাকা চাই মালকিনের নির্দেশ। তার পর দুই বাচ্চাকে ঈদের গোসল করিয়ে নতুন জামা পরাবে। নতুন জুতা কিনতে পারেনি। নাশতা উপরতলার মালিক খালাম্মাই খাওয়াবেন। কুসুম বছরে একদিনই মাংস রান্না করে। সে এই ঈদের দিনে। আদা-রসুন খালাম্মার কাছ থেকে চেয়ে আনবে। আর গরম মসলা গরিবের জন্য নয়। এদিকে বড়বাড়ির গেটের কাছে খুপড়ি ঘরে ঘুমহীন স^ামী। রাত একটা পর্যন্ত কুসুমের জন্য দরদে বুক উথালপাথাল করেছে। তারপর একঘণ্টা দুর্ভাবনায় নির্জীব ছিল। দুই সন্তানকে ঘুমন্ত রেখে কুসুমকে আনতে যাওয়ার কোন উপায় মাথায় আসছে না। উপায় বের করতে না পেরে শান্ত ভাল মানুষটির মাথা গরম হতে শুরু করল। কুসুমের জন্য দুশ্চিন্তা বাদ। কুচিন্তা রাগের মাঝে ঘি ঢাললো। হƒদয় বলছে কুসুম খাটছে। রাতদিন অসুরের মতো। রাগের মাথা বলছে বদ ও নষ্ট মেয়েরাই কাজের বাহানায় রাত করে ঘরে ফেরে। গেটে মৃদু খুটখাট শব্দ। রাগে জ্ঞানহীন স্মামী গেট তো খুললই উপরন্তু নিচু গলায় যে অশ্লীল শব্দাবলী উগরে দিল কুসুমের কালা হয়ে যেতে ইচ্ছা হলো। কুসুমের ভাল মানুষ স্মামী আজ পাগল হয়ে গেছে। কান্না জড়ানো গলায় বার বার কাকুতি-মিনতি করল। -গেটটা খুলো না রনির বাবা! পায়ে ধরি; পায়ে ধরি গো তোমার! -বিদায় হও, কুত্তি বদমাশ মাইয়াছেলা কোনহানের -দেখ, তুমি দেখ চাইয়া কত্ত টাকা! তোমার চোখ ভাল ডাক্তাররে দেহান যাবানে রনির বাপ! -চুপ চুপ নষ্ট মাইয়াছাইলা; তোমার টাকায় আমি থুতু দেই; থুহ্ থুহ্ -চোখ ভাল হলি তুমিই কাজ করবানে; আমারে আর কাজে যাতি হবিনানে! -তোমার টাকাও চাই না তোমারেও চাইনা বুঝলা। তালাক দিলাম। তালাক তা... -দোহাই তোমার রনির বাবা থাম থাম! ওই ভোররাতে কুসুমের স্মামী থামেনি। তালাকের বজ্রাঘাতে কুসুম কি মরে গেল? ঈদের নামাজগামী মানুষ দেখল ট্রাকের তলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ দিয়েছে এক নারী। পলাতক নিউইয়র্ক শহরে সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ। ম্যানহাটানের ১১৬নং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। এখান থেকে ৭২নং ম্যানহাটানে হোটেলে ফিরতে হবে। ট্যাক্সি করে ফিরবে ভাবছে। সাউথ আফ্রিকার ফর্সা এ্যালেন, কালো সারাফিনা ও দুধ মেশানো কফিরঙ্গা অন্য আরেকজন। ট্যাক্সি দাঁড়াতেই ওরা উঠে পড়ল। কফিরঙ্গা অন্যজন ড্রাইভারের পাশের সিটে বসল। কথা হলো সামান্যই। সারাফিনারা মাঝপথেই নেমে যাবে। ‘তোমরা ট্যুরিস্ট?’ ‘আমরা বিদেশী; কনফারেন্সে এসেছি’ ‘জানি এশিয়া-আফ্রিকা-আমেরিকা সব মহাদেশ থেকেই?’ ‘কি করে জানলে?’ ‘দু’দিন ধরে যাত্রী তুলছি এখানে তাই; তা তোমরা?’ ‘আমরা সাউথ আফ্রিকা থেকে’ ‘আমি এশিয়ার বাংলাদেশ থেকে’ ‘বাংলাদেশ!’ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে বিসি¥ত চালক তার দিকে চকিতে তাকাল। ‘কেন চেনো কাউকে?’ চালকের গলায় দ্বিধা। ‘ন্ নাহ্ ঠিক তা নয়’ চালকের দিকে অন্যজন ভাল করে তাকিয়েও দেখল না। ট্যাক্সি থামল। সারাফিনা ও এ্যালেন ওদের ভাগের যা ভাড়া সে পয়সা অন্যজনের হাতে দিয়ে নেমে গেল। ট্যাক্সি চলতে শুরু করলো। কিছুদূর গিয়েই হঠাৎ আবার ট্যাক্সি থামলো। চালক দ্রুত দরজা খুলে নামতে নামতে বলল ‘Just a second, ও রিষষ নব নধপশ ংড়ড়হ’ অপেক্ষা করতে করতে সে গাড়ির ড্যাসবোর্ডে রাখা ছবিসহ চালকের পরিচিতি দেখতে পেল। ঝুঁকে পড়ে দেখল। একে কোথাও দেখেছে কি? এবার আগ্রহ নিয়ে নামটা পড়ল। ব্যথাহত মন নীরব আর্তনাদে ভেঙ্গে পড়ল ‘আরে এত সেই! আশ্চর্য কেন সে রইল না আমার জীবনে? তার সাথে প্রথম দিন স্কুলে যাওয়া হতো, কলেজে ভর্তির ফর্ম তুলতে যেতে পারত। আরও অনেক কিছু করা যেত। মায়ের ছুটি মিলত না সহজে, তাই পাশের বাড়ির পাতানো নানু ছিল আমার সাথী। একা একা কত কাজ করতে হয়েছে। সে মায়ের কাছে উধাও বাবার গল্পই শুধু শুনেছে, ছবিই দেখেছে। কেন সে চলে গেল? কি করেছিলাম আমি? কষ্ট দিয়ে কিছু কি বলেছি কখনও? আমার তো কথাই ফোটেনি তখন! কষ্ট দেব কি...’ গাড়ির জানলায় টুকা পড়তেই চমকে মুখ তুলে তাকাল। পুলিশ দাঁড়ানো। স্বাগতঃ কথন থেমে গেল। কাচ নামালো। ‘এটা গাড়ি থামানোর জায়গা নয়, নেমে আস, গাড়ি টো (Tow) করে নেবে, ’ তাড়তাড়ি গাড়ি থেকে নেমে ক্লান্ত পায়ে, ব্যথাহত চোখে ট্যাক্সিচালকের চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে রইল।
×