সদ্য প্রয়াত কবি শঙ্ক ঘোষ। তাঁর সঙ্গে সরাসরি দেখা করার অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিচারণ। সাদা পাঞ্জাবি ও ধুতি পরা কবিকে দেখে ভাবলাম এক শ্বেতশুভ্র সাধককে একেবারে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হলো। নিবিষ্ট সাধনার এক জ্ঞানাচার্যকে অতি সাধারণ মানুষের অবয়বে দেখে বিস্মিত হলাম। কথা বলার সময় এখানেও মনে হলো গলার স্বর একটু ক্ষীণÑ কিন্তু উচ্চারণ একেবারে স্পষ্ট। সাধারণের মধ্যে যে অসাধারণত্ব ক্রমেই সেটা স্পষ্ট হতে লাগল। আমাকেও সহজ আর স্বাভাবিক হতে বেশি সময় নিতে হয়নি। এরপর দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় স্মরণ চেতনায় যা স্পষ্ট হয়ে আছে বলতে লাগলেন পর্যায়ক্রমিকভাবে। আমিও বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর চেয়ে তার কাছ থেকে জানতে চেষ্টা করি। নিজেই বলে যাচ্ছিলেনÑ ১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলার মামার বাড়িতে জন্ম নেন এই কৃতীপুরুষ। পিতা মণীন্দ্র কুমার ঘোষ আর মাতা অমলা বালা ঘোষ। তবে বংশানুক্রমিকভাবে পৈত্রিক বাড়ি বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বানারিপাড়া গ্রামে। পড়াশুনা শুরু করেন পাকশীর চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠে। বাবার ছিল বদলির চাকরি। সে কারণে অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়। ’৪৭-এর দেশ বিভাগের সময় অসমের গোয়াহাটিতে ছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে এসে গেল সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে জড়ানো দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ’৪৭-এর দেশ বিভাগ। ১৫ বছরের উদীয়মান কিশোর কোনভাবেই এই অনাকাক্সিক্ষত কর্তনকে মানতে পারেননি। ’৪৭-এর দেশ বিভাগের উত্তাল সময়ের রেশ না কাটতেই শুরু হলো ’৫২ সালে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন। সেই আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে একীভূত করতে পেরেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য পত্রিকার এই ভাষা সংগ্রামের ওপর অনেক প্রবন্ধও ছাপা হতো।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গল্প, নাটক নিয়ে বাবার নাট্য নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হতো বিভিন্ন নাটক। ৯ বছরের বালক শঙ্খ ঘোষও বাবার নির্দেশনায় পরিচালিত ‘মুক্তধারা’ নাটকে অভিনয় করেন। ‘মুক্তধারা’ নাটকটি প্রদর্শিত হয়েছিল মূলত রবীন্দ্রনাথের ৮০ বছর জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বললেন, সেটাই ছিল কবির অন্তিম জন্মবর্ষ। স্মৃতিতে আছে রবীন্দ্রপ্রয়াণের সর্বশেষ যাত্রার বেদনাদায়ক অনুভব। রবীন্দ্রনাথকে জানা আর বুঝতে চাওয়ার আগ্রহ ক্রমশ বেড়েই চলে। ফলে পড়ে ফেলেন মাত্র ১২ বছর বয়সে বিখ্যাত রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ প্রমথ নাথ বিশীর ‘শান্তিনিকেতন’ বইটি। সঙ্গে সঙ্গে কাব্যিক অনুভবে নিজের শিল্পীসত্তাও অনুরণিত হতে থাকে। স্মৃতির মিনারে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে ১২ বছর বয়সে লেখা কবিতা। তবে ১৫ বছর পর্যন্ত যে ছন্দোবদ্ধ আবেগে পদ্য নির্মাণ করলেন সেগুলোকে কখনও তার কবিতা মনে হয়নি। কবি শঙ্খ ঘোষ কথাটি বলে মুচকি হাসলেন। কারণ তিনি তো আসলে কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। প্রাবন্ধিক হিসেবেও তার নান্দনিক দ্যোতনা কোন অংশে কম নয়। শব্দ চয়ন, বাক্যের কায়দা কানুন, শৈল্পিক সুষমা তার সঙ্গে ব্যাপ্তি আর গভীরতা একীভূতর যে মাত্রায় তাঁকে নিয়ে যায় সেখানে তিনি নিজেই তাঁর তুলনা। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনেও কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতার পেশায় নিজেকে সম্পৃক্ত করে বাংলা সাহিত্যের পর্যায়ক্রমিক ধারাকে শুদ্ধতার আবহে চর্চাই শুধু করেননি অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর মাঝে তা ছড়িয়ে দেয়ারও চেষ্টা করেছেন।
রবীন্দ্রভক্ত এই খ্যাতমান কবি আলাপচারিতার মাঝে বলে ফেলেন- ৩০ এর দশকের কল্লোল যুগের কবিদের রবীন্দ্রনাথকে পাশ কাটানোর কথা, প্রশ্নটা আমার তরফ থেকেও ছিল। সাবলীলভাবে উত্তর দিলেন তারা সবাই রবীন্দ্র অনুরাগী ছিলেন। হাসতে হাসতে স্মরণ করলেন কবি বুদ্ধদেব গুহ নাকি এক রাত পুরো রবীন্দ্রনাথের ‘পুরবী কাব্যগ্রন্থটি পড়ে তার পরের দিন নিমগ্ন হলেন আর পরের দিন আবারও সেই কবির বলয় থেকে বের হওয়ার চেষ্টায়। শ্রদ্ধাভরে জীবনানন্দ দাশ, কাজী নজরুল ইসলাম, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী সবার কথা বলতে লাগলেন। বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিবর্তনের ধারায় কল্লোল যুগের কবিরা নিজেদের প্রতিভাদীপ্ত মননশৌর্যের অনন্য সৃজনব্যক্তিত্ব যারা এই সমৃদ্ধ আঙিনাকে নানা মাত্রিকে ভরিয়ে তুলেছেন।
কবিতার জগতে অত্যন্ত সফলভাবে নিজেকে নিবেদন করার পুরস্কারও পেয়েছেন। এর মধ্যে বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম পুরস্কার, ভারত সরকারের পদ্মভূষণ পুরস্কার এবং ২০১৬ সালে পান জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে তার কাব্যগ্রন্থের জন্য পাওয়া এসব সম্মাননায় খুশি হলেও মূল লক্ষ্য ছিল সাহিত্য সাধনায় শৈল্পিকসত্তাকে বিকাশ করে নিজের আনন্দে শুধুই লিখে যাওয়াÑ আর কিছু নয়, অন্য কিছু নয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ভগিনী নিবেদিতার যে আলাপচারিতা, যোগাযোগ, দর্শন এবং চিঠিপত্র আদান প্রদান এসব নিয়েও কথা বলেছিলেন। রবীন্দ্রভক্ত এই বিদেশিনী কবির সৃজনশীলতায় মুগ্ধ-বিমোহিত। শুধু তাই নয় অনেক পরামর্শ, সুচিন্তিত অভিমত এবং গঠনমূলক পর্যালোচনায় কবিকে বিশেষভাবে উৎসাহিতও করতে পারতেন। শঙ্খ ঘোষ উল্লেখ করলেন ‘গোরা’ উপন্যাসের সুচরিতা এবং গোরার সম্পর্ক নিয়ে কবি যখন চিন্তিত বিশেষ করে গোরা নিজের পরিচয় জানার পর। তখন নাকি নিবেদিতার পরামর্শে কবি গোরা-সুচরিতার সম্পর্কের সুনির্দিষ্ট গন্তব্য নির্ধারণ করেন।
কবি শঙ্খ ঘোষের এক অনবদ্য রচনাশৈলী তাঁর ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ।’ দক্ষিণ আমেরিকার একটি দেশ আর্জেন্টিনার এক বিখ্যাত লেখিকা এবং রবীন্দ্রভক্ত ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়ে লেখা এই বইটি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভিক্টোরিয়ার নির্মল সম্পর্কের যে গভীর বোধ তাকে অত্যন্ত পরিশীলিতভাবে উপস্থাপন করতে গিয়ে শঙ্খ ঘোষ কবি আর বিদেশিনীর যে চিত্র এঁকেছেন তা যেমন শৈল্পিক শৌর্যে মহীয়ান একইভাবে সম্পর্কের বেড়াজালেরও এক শুদ্ধ আত্মিক মানস চেতনা। এ প্রসঙ্গে গ্রন্থকার নিজেই বলেন, বইটি আসলে অনেক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে লিখতে হয়েছে। কেবল তাই নয় নির্ভরযোগ্য সূত্রের ওপরও বিশেষ গুরুত্ব দিতে হয়। সমসাময়িক কালের ভিক্টোরিয়াও রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-চেতনা, তাদের অবস্থান, দেখা-সাক্ষাত, পত্রালাপ এমনকি রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্পী হওয়ার সম্ভাবনার প্রতি ভিক্টোরিয়ার নজর সবই অত্যন্ত সুসংবদ্ধভাবে হাজির করতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ওপর ওকাম্পোর অনুভূতিও তুলে আনতে হয়েছে। আঁন্দ্রে জিদের অনুবাদ পড়ার পর ভিক্টোরিয়ার যে আবেগাপ্লুত মনন জগত তাকেও যথার্থভাবে দেখাতে হয়েছে। সত্যের অপলাপ করার চেষ্টা করিনি। নির্মল সম্পর্কের এমন চিরস্থায়ী বোধ অত্যন্ত সযত্বে, পরিশীলিতভাবে পাঠক সমাজকে উপহার দিতে হয়েছে। এমন সাবলীল এবং অকপটে কথাগুলো বলে গেলেন মুগ্ধ বিস্ময়ে অবাক হওয়া ছাড়া আর কিছু ছিল না।
সাধারণের আড়ালে এক অসাধারণ সৃজনব্যক্তিত্বের সঙ্গে আলাপ করার সৌভাগ্য হওয়ায় বিশেষ তৃপ্তি অনুভব করলাম। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী আর জোড়া সাঁকো ঠাকুর বাড়ি ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় দর্শনে গিয়ে আর এক কৃতী মানুষের সঙ্গে সাক্ষাত পুরো ভ্রমণটিকে আনন্দে পরিপূর্ণ করে দেয়।
এই খ্যাতিমান কবি বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরম শ্রদ্ধাভরে প্রণতি জানালেন। তাঁর ভাবতে কষ্ট হলো বঙ্গবন্ধুকে তার চারপাশের মানুষরা নৃশংসভাবে পরিবারসহ খুন করে। ছোট্ট রাসেলকেও তারা রেহাই দেয়নি। শঙ্খ ঘোষের স্মৃতিতে আজও স্পষ্ট হয়ে আছে ১৯৭৫ সালের মে মাসে তিনি বাংলাদেশে আসেন। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিক্ষক মিলনায়তনে কয়েকজন শিক্ষক ও সাহিত্যিকের সঙ্গে আলাপকালে নজরে পড়ল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু পোস্টার ও দেয়ালে আপত্তিজনক কথা। দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে সেটা তার মোটেও ভাল লাগেনি। এরপর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখানেও মনে হচ্ছিল একটা চাপা ষড়যন্ত্রের মধ্যে বাংলাদেশের বিপদ ঘনিয়ে আসছে। সুতরাং ‘৭৫-এর ১৫ আগস্টের রক্ত প্লাবনে শোকাচ্ছন্ন হলেও একেবারে অবাক হননি। বাঙালি জাতির এই অকুতভয় বীরকে আজও অন্তরনিঃসৃত সমস্ত অর্ঘ্য নিবেদন করেন। এমন আপোসহীন দেশপ্রেমিক, আদর্শিক রাজনীতিজ্ঞই শুধু নয় বক্তৃতা দেয়ার অসাধারণ ক্ষমতা সত্যিই অভিভূত আর বিস্মিত হওয়ার মতোই। জোড়া সাঁকো ঠাকুর বাড়ির আঙিনায় রবীন্দ্র ভারতী জাদুঘর তৈরিতে কবি শঙ্খ ঘোষের প্রয়োজনীয় ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। রবীন্দ্রনাথকে সার্বজনীন করতে যা যা করণীয় সাধ্যতমো সবটাই করেছেন এই রবীন্দ্র বোদ্ধা। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র শতবার্ষিকীতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আর্থিক সহায়তায় এই দর্শনীয় জাদুঘরটি তৈরি করা হয়। সে মহৎ কর্মযজ্ঞে তিনিও তাঁর সমস্ত দায়বদ্ধতা পালন করেন। এ ছাড়া শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাবীন্দ্রিক অনুভবে প্রকৃতির মনোরম ছায়ায় ছাত্রছাত্রী পড়ানোর সুখময় স্মৃতি তাঁকে আজও আনন্দ দেয়, ফিরে যান সেসব মাধুর্যমাখা দিনে যা জীবনের এক উজ্জ্বলতম অধ্যায়।
(লেখাটি পুনর্মুদ্রিত হলো)