তিনি ছিলেন রণাঙ্গনের একজন যোদ্ধা। রাইফেল হাতে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন মাত্র ১৮ বছর বয়সে। সেই বয়সেই ট্রেঞ্চে বসে প্রত্যক্ষ করেছেন মিত্র বাহিনীর প্রবল আক্রমণ আর সহযোদ্ধাদের মৃত্যু। নিদারুণ খাদ্যের অভাব, উর্ধতন কর্মকর্তাদের দুর্ব্যবহার এবং সামনে বিশাল এক শক্তিশালী সৈন্যবাহিনীর আক্রমণ মোকাবেলা এক কিশোরের জন্য ছিল
সত্যিই এক অনন্য অভিজ্ঞতা। জীবনে হতে চেয়েছিলেন শিক্ষক। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাসে হয়ে উঠলেন একজন যোদ্ধা। শত্রুপক্ষের গোলার আঘাতে আহত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসেন। এরপর যুদ্ধ দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন দারুণ সব উপন্যাস। ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’, ‘দ্য ড্রিম রুম’, দ্য রোড বাক’, ‘দ্য স্পার্ক অব লাইফ’, ‘এ টাইম টু লাভ এ্যান্ড এ টাইম টু ডাই’ , ‘হ্যাভেন হ্যাজ নো ফেভারিটস’, ‘ দ্য নাইট ইন লিসবন’, ‘দ্য প্রমিস ল্যান্ড’, ‘শ্যাডোস ইন প্যারাডাইস’, ‘থ্রি কমরেডস’, ‘ব্ল্যাক অবিলিস্ক’ প্রভৃতি।
১৮৯৮ সালের ২২ জুন তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন জার্মানির ওসনব্রুক শহরে। এক নিম্নবিত্ত কর্মজীবী পরিবারে। বাবা ছিলেন পিটার ফ্রানস রেমার্ক এবং মায়ের নাম আনা মারিয়া। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এরিককে বাধ্যতামূলকভাবে যুদ্ধে যোগ দিতে হয় যখন তার বয়স মাত্র ১৮ বছর। ১২ জুন, ১৯১৭ সালে তাকে বদলি করে দেয়া হয় ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টের ২য় কোম্পানিতে। ৩১ জুলাই এরিকের জীবনে এক ভয়াবহ ব্যাপার ঘটল। শত্রুপক্ষের বোমার স্পিøন্টারের আঘাত হাতে এবং কাঁধে আঘাত পেয়ে আহত হলেন। তাঁকে দ্রুতই মিলিটারি হাসপাতালে নেয়া হয়। যুদ্ধ শেষ হবার সময় পর্যন্ত তিনি সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ছিলেন। মহাসমর শেষ হলো। তিনি ফিরলেন বাড়িতে। চারদিকে ধ্বংসস্তূপ। তিনি শিক্ষকতার ট্রেনিংয়ে ফিরে এলেন। ১ আগস্ট ১৯১৯ তিনি লহনি এর একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেন। এর নানা জায়গার স্কুলে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। ২০ নবেম্বর ১৯২০ সালে তিনি স্কুলের চাকরির ইস্তফার আবেদন করেন। সারা জীবনে তিনি অনেক ধরনের পেশা গ্রহণ করেছেন জীবিকার তাগিদে। কখনও লাইব্রেরিয়ান, কখনও বা পুরোদস্তুর সাংবাদিকতা। তবে ব্যবসায়ও নাম লিখিয়েছিলেন তিনি। রেমার্কের বয়স যখন মাত্র ষোল বছর তখন থেকেই তিনি লেখালেখির চেষ্টা শুরু করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল কিছু কবিতা, গদ্য এবং ভবিষ্যত উপন্যাসের কিছু ছোট ছোট খসড়া। ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্য ড্রিম রুম’।
অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট
১৯২৭ সালে তিনি লেখেন তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’। রেমার্কের সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস হচ্ছে এই ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা। শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের জীবন তছনছ এবং স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনাই ঘুরেফিরে এসেছে।‘ কত দিন হলো আছি এখানে হিসেবও করতে পারি না। মাথার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে গেছে সব। কত দিন হবে? এক সপ্তাহ, এক মাস নাকি এক বছর? অথবা কয়েকটা দিন মাত্র। ঘণ্টা মিনিট দিয়ে আমাদের দিন হয় না। আমাদের দিন হয় মৃত্যুর সংখ্যা দিয়ে, আহতদের মৃত্যু যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে।’ - ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট
মূলত কিশোর যোদ্ধার চরিত্র এখানে শিল্পীর মমতায় তুলে এনেছেন রেমার্ক। নিজে রণাঙ্গনের যোদ্ধা ছিলেন বলেই তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তুলে আনতে পেরেছেন তিনি। ট্রেঞ্চে বসে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে ঠাট্টা তামাশা অথচ একটু পরেই হয়তো ছুটে আসবে শত্রুপক্ষের মেশিনগানের বুলেট। এর মধ্যেও আশ্চর্য রকমভাবে নিজের মানবিকতা টিকিয়ে রেখেছিল নায়ক পল ব্রেমার। তার চোখে সেই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রজাপতিদের ওড়াউড়ি যেমন চোখ এড়ায় না তেমনি বসন্তের ফুলের আগমন তাকে ভাবালু করে তোলে। দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে ফিল্ড হাসপাতালে থাকতে থাকতে মানুষকে জানতে শিখে যায় পল। সে নিজে শিক্ষক হতে চেয়েছিল অথচ যুদ্ধ তাকে বানিয়ে দিল সৈনিক।
‘ছুটছি, গুলি ছুড়ছি, গ্রেনেড ছুড়ছি, মারছি, মরছি, চলছে তো চলছেই। শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই, কিছু ভাবার ক্ষমতা নেই, মুধু জানি বেঁচে থাকতে চাই। কিন্তু অবাক হয়ে যাই, এর মধ্যে বেঁচে আছি কি করে। মৃত্যুকে আর কতবার ফাঁকি দিতে পারব?’- ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট জোসেফ, বেন, কেমারিখ, এ্যালবার্ট, ক্রপ, মুলার আর লিয়ার। সবাই দুই নম্বর কোম্পানির সহযোদ্ধা ব্রেমারের। ধীরে ধীরে মারা যায় সবাই। বেঁচে থাকে শুধু পল। টুকরো টুকরো ঘটনার মধ্য দিয়ে লেখক রেমার্ক আশ্চর্য রকমভাবে এক এক জন মানুষের মনোজগৎ তুলে এনেছেন। যুদ্ধের আগে কেউ ছিল চাষী, কেউবা ছাত্র, কেউবা শ্রমিক। কিন্তু যুদ্ধ তাদের সবাইকে পরিণত করে দিয়েছিল। পল জবানীতে উঠে এসেছে, ‘সেই কেমারিখ শুয়ে আছে এখানে, এই হাসপাতালে। দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে। হাহাকার করে উঠল বুকের মধ্যে। অসহায় ক্রোধে সব কিছু চুরমার করে ফেলতে ইচ্ছে হল। কেন, কিসের জন্য ওর এই অবস্থা? ইচ্ছে হলো চিৎকার করে সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিই, এখানে শুয়ে আছে কেমারিখ, জীবনের মাত্র সাড়ে উনিশটি বছর কাটিয়েছে ও। ও মরতে চায় না, ওকে মরতে দিও না কেউ।’
অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টের শে বাক্য কয়টি পাঠককে মোহাবিষ্ট করে রাখে। পাঠক সেই ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। ‘অসম্ভব শান্ত একটা দিন। ঝকঝকে নীল আকাশ, মাঝে মাঝে সাদার ছোপ। বাতাস বইছে মৃদুমৃদু। ঘাসের ডগার শিশির বিন্দু এখনো শুকোয়নি। লাল লাল ফুলগুলোর ওপর ছুটোছুটি করছে দুটো রঙিন প্রজাপতি। নির্মল বাতাস, বারুদের গন্ধ নেই, গোলার গর্জন নেই। চারদিকে এমন নিঃশব্দ যে একটা মাত্র লাইনে শেষ হয়েছে আর্মি রিপোর্ট : ‘পশ্চিম রণাঙ্গন সম্পূর্ণ শান্ত’ ( অষষ ছঁরবঃ ঙহ ঞযব ডবংঃবৎহ ঋৎড়হঃ) গাছটার নিচে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে পল, যেন ঘুমিয়ে আছে। ওকে যখন ওলটানো হলো, দেখা গেল মুখে তখন ও হাসি লেগে আছে এক টুকরো। যেন কোন কষ্টই পায়নি ও। যেন জেনেই গিয়েছে, সব শেষ হতে চলেছে। প্রজাপতি দুটো উড়েই চলেছে ফুলে ফুলে।’ কী অসাধারণ আর আর কাব্যিক উপসংহার। সেটা শুধু রেমার্কের কাছ থেকেই পাওয়া সম্ভব। একটি বিষয় লক্ষণীয় সেটি হচ্ছে রেমার্কের উপন্যাসের শেষটা পাঠককে অনেক বেশি আবেগ তাড়িত করে তোলে। ‘থ্রি কমরেডস’ উপন্যাসের কথা ও এখানে প্রণিধানযোগ্য। সেখানে মৃত প্রেমিকার মৃতদেহ কোলে নিয়ে বসে থাকে নায়ক। সব মিলিয়ে রেমার্ক বিশ্ব সাহিত্যে এক অনন্য নাম। এই দারুণ সুখপাঠ্য লেখকের নাম। যুদ্ধেও বিভীষিকার কথা বলে লেখক রেমার্ক আসলে শান্তির কথাই বলতে চেয়েছেন। বিশ্ব সাহিত্য সম্ভারে যে কয়জন মানবতাবাদী যুদ্ধবিরোধী লেখক রয়েছেন তাদের মধ্যে এরিখ মারিয়া রেমার্ক রয়েছেন প্রথম সারিতে।
যুদ্ধ মানুষের জীবনকে তছনছ করে দেয়। তার সহজ স্বাভাবিক জীবনকে ভেঙ্গে দেয়। রেমার্ক নিজের চোখে একজন সৈনিক হিসেবে প্রথম মহাযুদ্ধের বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাই লেখনীর মধ্য দিয়ে বারবার ঘুরেফিরে যুদ্ধ বিরোধী কথাই বলতে চেয়েছেন। রেমার্কের ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট‘ উপন্যাসে তিনি এক কিশোরে বাধ্যতামূলকভাবে যুদ্ধে যোগদান দেখিয়েছেন। যার স্বপ্ন ছিল একজন শিক্ষক হওয়া। কিন্তু যুদ্ধ সেই কিশোর পল ব্রেমারের জীবনকে তছনছ করে দেয়। আহত হয় সে। এর মাঝখানে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে তার ছুটি মেলে। বাড়িতে গিয়ে দেখে তার মা অসুস্থ। চারদিকে অভাব। যুদ্ধের গোলাবারুদ আর রক্তের বাইরে থাকতে মন চাইছিল তার। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে তাকে ফিরতেই হয়। এবার গোলার আঘাতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে ভর্তি হতে হয় হাসপাতালে। যুদ্ধের বাকিটা সময় তার সেখানেই কাটে।
দ্য রোড ব্যাক’ রেমার্কের আরেকটি অন্যতম সেরা বই। যুদ্ধফেরত সৈনিকদের নিয়ে একটি উপন্যাস এটি। এটি মূলত ‘অল কোয়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ উপন্যাসের সিকুয়্যেল।
এ টাইম টু ডাই এ্যান্ড এ টাইম টু লাভ
‘এ টাইম টু ডাই এ্যান্ড এ টাইম টু লাভ’ রেমার্কের আরেকটি ক্লাসিক্যাল উপন্যাস। যুদ্ধ এবং ভালবাসার এক করুণ পরিণতির গল্পের মূল চরিত্র আর্নেস্ট গ্রেবার। টানা দু’বছর রাশিয়ান ফ্রন্টে যুদ্ধ করার পর মাত্র তিন সপ্তাহের ছুটি মেলে তার। সেই ছুটি ও পরে স্থগিত করা হয় । কারণ সে চাইছিল না যে কারও আশা ভঙ্গ হোক।
এ টাইম টু ডাই এন্ড এ টাইম টু লাভ
‘এ টাইম টু ডাই এন্ড এ টাইম টু লাভ‘ রেমার্কের আরেকটি ক্লাসিকাল উপন্যাস। যুদ্ধ এবং ভালোবাসার এক করুন পরিনতির গল্পের মূল চরিত্র আর্নেস্ট গ্রেবার। টানা দু বছর রাশিয়ান ফ্রন্টে যুদ্ধ করার পর মাত্র তিন সপ্তাহের ছুটি মেলে তার। সেই ছুটি ও পরে স্থগিত করা হয় । কারন সে চাইছিল না যে কারো আশা ভঙ্গ হোক। অবশেষে ছুটি একদিন মেলে গ্রেবারের। কিন্তু তাঁর শহরে ফিরে গিয়ে দেখ পুরো শহর ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়েছে। তার বাড়ীটি পুরোপরি বিধ্বস্ত। তার সাথে পরিচয় হয় এক তরুনীর সাথে। সেই তরুনীর বাবা নাৎসী ক্যাম্পে বন্দী। গ্রেবার আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে । কিন্তু যুদ্ধ তার জীবনে আবার বেদনাদায়ক ফলই বয়ে নিয়ে আসে।
থ্রী কমরেডস
‘থ্রী কমরেডস’ রেমার্কের আরেকটি কালজয়ী উপন্যাস। সারা পৃথিবীতে প্রায় বিশটির বেশী ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে। এরিখ মারিয়া রেমার্কের একটি বেষ্ট সেলার এটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জার্মানীর অস্থির রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবক্ষয়ের গল্পই এই উপন্যাসের পটভূমি। তিন বন্ধু। যারা যুদ্ধের ময়দানে কাধে কাধ মিলিয়ে লড়াই করেছে তাদের গল্প। রবার্ট লোকাম্প, কোস্টার এবং অটো। যুদ্ধ থেকে ফিরে তারা একটি মোটর গ্যারেজ তৈরী করে। ভালোই কাটছিল তাদের দিন। একদিন গাড়েিত করে সান্ধ্য ভ্রমনে গিয়ে তাদের সাথে এক তরুনীর দেখা হয়। মেয়েটিকে ভালো লেগে যায় রবার্টের। দুজনের মধ্যে দারুন এক সখ্যতা গড়ে ওঠে। মেয়েটি প্রানের চেয়ে বেশি ভালোবসে ফেলে রবার্টকে। আর তরুনীটি চোখের দিকে তাকিয়ে নতুন করে বাঁচার প্রেরনা খুজে পায় যুদ্ধ ফেরত রবার্ট। কিন্তু মেয়েটি একটি দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্তঅ বৃষ্টি তার একদম সহ্য হয়না। মেয়েটিকে অনেক দূরের এক স্যানাটোরিয়ামে ভর্তি করে রবার্ট। ফিরে আসতে বুক ভেঙ্গে যায়। একদিন খবর আসে স্যানাটোরিয়াম থেকে যে মেয়েটি অসুস্থ। ছুটে যায় রবার্ট। পাশে এসে দাড়ায় আরো দুই বন্ধু। কিন্তু মেয়েটিকে তারা বাচাতে পারে না। প্রেমিকার লাশ কোলে নিয়ে সারারাত বসে থাকে রবার্ট। দিনের আলো তখন একটু একটু করে ফুটতে শুরু করেছে। এরকমই এক দূর্দান্ত উপন্যাস লিখেছেন রেমার্ক।
ব্ল্যাক অবিলিস্ক
‘ব্লাক অবিলিস্ক’ যুদ্ধের ব্যাপকতা এবং ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে রচিত এই বই। মজার ব্যাপার রেমার্কের নিজের দেশ জার্মানীতে তাঁর দুটি বই নিষিদ্ধ করা হয়। তার সবচেয়ে আলোচিত বই ‘স্বপ্ন মৃত্যু ভালোবাসা’ এবং ‘থ্রী কমরেডস’ নিষিদ্ধ করা হয় এবং সাথে লেখককেও। নাৎসী সরকারের তোপের মুখে দেশ ছাড়েন তিনি। প্রথমে সুইজারল্যান্ড এবং পরে আমেরিকায় বসবাস করতে শুরু করেন। ১৯৩১ সালে ‘দ্য রোড ব্যাক’ উপন্যাস লেখার পরে তিনি সুইজারল্যান্ডের পোর্টোরনকোতে একটি ভিলা কেনেন সেখানে বসবাসের উদ্দেশ্যে। যেই আমেরিকানদের বিরুদ্ধে এক সময় রাইফেল হাতে যুদ্ধ করেছেন সেই আমেরিকাতেই থাকতে হয় তাকে বেশ কিছুদিন। ১৯৭০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সুইজারল্যান্ডে মৃত্যুবরন করেন তিনি।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন
১৯২৫ সালে অভিনেত্রী ইলসে জুট্টা জ্যাম্বোনাকে তিনি বিয়ে করেন। তবে, এই জুটির দাম্পত্য জীবন খুব একটা সুখের ছিলনা দুই তরফ থেকেই। ১৯৩০ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তাদের। মবে, মজার ব্যাপার হচ্ছে রেমার্ক যখন নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হন অর্থাৎ ১৯৩৩ সালে ইলসে রেমার্কের সাথে সুইজারল্যান্ডে চলে যান। ১৯৩৮ সালে তারা পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৩৯ সালে তারা আমেরিকায় চলে যান। ১৯৫৭ সালের ২০ মে তারা আবার বিবাহ বিচ্ছেদ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন ইলসে মৃত্যুবরন করেন। ১৯৪০ সালের দিকে রেমার্ক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন আরেক বিখ্যাত অভিনেত্রী গ্রেটা গার্বোর সাথে। সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল ১৯৩৭ সালের সেপ্টেম্বরে যখন তারা দুজনেই ভেনিস ফিল্ম ফেষ্টিভ্যালে তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল। তবে, তাদের সাথে খুব একটা দেখা হতো না। মূলত চিঠি, টেলিফোন কল এর মাধ্যমে তারা যোগাযোগ রক্ষা করতেন। তাদের দুজনের লেখা চিঠি নিয়ে ২০০৩ সালে ‘টেল মি দ্যাট ইউ লাভ মি’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে রেমার্ক অভিনেত্রী পল্লেট্টি গদার্ডকে বিয়ে করেন। এই পল্লেট্টি এক যুগান্তকারী ব্যাপার ঘটিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়কে ২০ মিলিয়ন ডলার দান করেছিলেন ‘ইউরোপিয়ান স্টাডিজ’ নামে ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার জন্য। যেটার নামকরন করা হয়েছিল রেমার্কের নামে। ১৯৪৮ সালে রেমার্ক সুইজারল্যান্ডে ফিরে যান। সেখানেই বাকী জীবনটা কাটান। ‘আর্চ অব ট্রাম্প’ আর ‘স্পার্ক অব লাইফ’ এর মাঝখানে সাত বছরের ব্যবধান। ১৯৫৪ সালে তিনি লেখেন ‘টাইম টু লাভ এন্ড টাইম টু ডাই’। ১৯৫৮ সালে পরিচালক ডগলাস শার্ক এই উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মান করেন। এই চলচ্চিত্রে একটি অতিথী চরিত্রে অভিনয়ও করেন রেমার্ক।
জার্মান সাহিত্যিক এরিখ মারিয়া রেমার্ক তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য ব্ল্যাক অবিলিস্ক’ এ বলেছিলেন, ‘ একজন মানুষের মৃত্যু একটি ট্রাজেডি কিন্তু অসংখ্য মানুষের মৃত্যু একটি পরিসংখ্যান’। রেমার্ক ১৯৫৬ সালে বসে ১৯২০ সালের পটভুমিতে রচিত উপন্যাসে যুদ্ধেও অবস্থা বনর্না করতে গিয়ে একথাটি লিখেছিলেন। অথচ এতা বছর পরেও কথাটি নিরেট সত্য। গাজায় ইসরাইলী নিহত হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু শুধুই পরিসংখ্যান সারা পৃথিবীর কাছে।
‘তোমাকে একদিন আমার শূন্যতার গল্প শোনাবো,
তোমাকে একদিন শোনাবো আমার জলোচ্ছাস্বের স্বর
যখন নির্জীব, নিস্পন্দ বসে থাকি সেই জলোচ্ছাস্বের স্বর আচ্ছন্ন করে আমাকে,
তোমাকে একদিন ধুধু তেপান্তরের দৃশ্য দেখাবো যেখানে সারি সারি এপিটাফ, বন্ধুর কবর, ভীষন একঘেয়ে শূন্যতা খাবি খেতে খেতে কেমন গড়িয়ে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে।
তোমাকে একদিন এক রাত্রি নিবিড় অঅলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখবো অন্ধকার মুড়ে
আমার ভেতরের অন্ধকার
আমার ভেতরের ঘর
আমার ভেতরের খাদ
আমার ভেতরের শূন্যতায় আছড়ে পড়া স্মৃতির ভয়াবহ স্রোত...
যুদ্ধ এখন বিগত দিনের গল্প অথচ প্রতিটা যুদ্ধবসান নতুন যুদ্ধের শুরু
আমরা জীবনের পথে ফিরে আসছি
অপমৃত্যু আর ভুল মৃত্যুর স্মৃতি ভুলে
নারকীয় বীভৎসতার দৃশ্যগুলো গোপনে রেখেই আমরা যার যার ঘরে ফিরছি।
আমরা কেউ বাড়ীর ছোট ছেলে, কেউ বড় ভাই, কেউ মায়ের চোখের মনি
অথচ যুদ্ধক্ষেত্রে আমরা সবাই, আমরা সবাই আশ্চর্য জীবন্ত, আর অবাক করা সত্য হলো তখন আমরা সম্মিলিতভাবে শুধুমাত্র একটা আদর্শ... একটা লক্ষ্য...‘
তোমাকে ভালোবাসার আগে জানতামই না পৃথিবীতে ভয় পাবার এতো কিছু আছে’— স্বপ্ন-মৃত্যু-ভালোবাস, এরিখ মারিয়া রেমার্ক
‘জীবনে যখন আর কোন কিছু পাবার অপেক্ষা থাকে সেটির চেয়ে ভয়াবহ আর কিছু নেই’’- থ্রী কমরেডস, এরিখ মারিয়া রেমার্ক,
দ্য রোডব্যাক’ উপন্যাস গড়ে উঠেছে যুদ্ধফেরৎ সৈনিকের মনোজগৎ, যুথবদ্ধতায় গড়ে ওঠা সম্পর্ক, হেওে যাওয়া, দিগন্তের কাছে ভেঙ্গে পড়া মেঘের মত ‘শান্তি’। যুদ্ধেও প্রচন্ডতার মাঝে হঠাৎ নিশ্চল সময়, প্রায় অলৌকিক নির্লিপ্ততা, বিষাদেও ব্যাপ্তিতে থমকানো মানুষ, রক্ত মাংস চেটেপুটে মহীরুহের মত বীভৎসতা...। চরিত্রগুলো জার্মানীর খেটে খাওয়া সাধারন মানুষের প্রতিভু। আর্নেষ্ট, জাপ, ফার্দিনান্দ, ভালেণটিন,লুডভিগ চলে আসে পাঠকের একদম চোখের সামনে।
১৯৩৩ সালে ১০ মে জার্মানীতে অনেক বইয়ের সাথে রেমার্কের কিছু বই ও পোড়ানো হয়। সেদিন বার্লিনের অপেরা চত্তরে প্রায় সত্তর হাজারের মত মানুষ জড়ো হয়েছিল বই পোড়ানোর মত একটি ঘুন্য কাজে যোগ দিতে। বলা হয়েছিল, যা কিচু অ-জার্মান তা আমরা বিসর্জন দিতে এসেছি’। তবে খোদ জার্মানীতে রেমার্কের বই পুড়লে ও সারা পৃথিবীতে পাঠকের কাছে রেমার্ক হয়ে উঠেছিলেন আরো বেশী জনপ্রিয়। ১৯৩৩ সালে জানুয়ারীতে সমাজতান্ত্রিকরা ক্ষমতাসীন হবার পরে হিটলারের অধীনে শুরু হয় শুদ্ধি অভিযান। দলে দলে কবি সাহিত্যিকরা জার্মানী ত্যাগ করতে শুরু করে। এই সময় রেমার্কও দেশ ত্যাগ করেন। রেমার্কের বেশ কিছু উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৩০ সালে আমেরিকাতে মুক্তি পায় ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েষ্টার্ন ফ্রন্ট’। আমেরিকার ফিল্ম ইন্সটিউটের সর্বকালের সেরা ১০০ সিনেমার তালিকায় এটি ছিল ৫৪ নম্বরে। এটি এ্যাকাডেমী এ্য্ওায়ার্ড ও জিতে নেয়।