ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৮ মাঘ ১৪৩১

সাহিত্য

সাহিত্য বিভাগের সব খবর

ঈগল ও সিংহের ভয়ংকর লড়াই

ঈগল ও সিংহের ভয়ংকর লড়াই

ভারতের উত্তর প্রদেশের গহীন, গভীর ভাভর বনাঞ্চল। এ বনে একবার পশু-পাখিদের ক্রিকেট খেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। বনের রাজা সিংহের নেতৃত্বে প্রথম দলটির খেলোয়াড় ছিল সিংহ, বাঘ, জিরাফ, হাতি, বানর, খরগোশ, ভালুক ও হরিণ। পাখির রাজা ঈগলের নেতৃত্বে দ্বিতীয় দলটির খেলোয়াড় ছিল ঈগল, চিল, বাজ, শকুন, কবুতর, মাছরাঙা ও সারস। যদিও পশুদের শক্তি তুলনামূলকভাবে পাখিদের চেয়ে বেশি ছিলো, পাখিদের তীক্ষ্ম দৃষ্টিশক্তির কারণে তারা খেলায় প্রাধান্য বিস্তার করলো। প্রথমেই টসে জিতে ঈগল পাখি ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিলো। ঈগল, চিল, বাজ, শকুন প্রখর দৃষ্টি দিয়ে স্পিন বল ও পেস বল মোকাবিলা করে রানের পাহাড় গড়ে তুলল। এরপর সিংহ বাহিনী ব্যাট করে অল্প রান করেই সবাই আউট হয়ে গেল। শুধু জিরাফ একশো দুই রানের একটা সেঞ্চুরি উপহার দিয়ে খেলাটায় কিছুক্ষণের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা ফিরিয়ে এনেছিলো। যাহোক বিশাল রানের ব্যবধানে বনের রাজা সিংহের দলকে পরাজয় বরণ করতে হলো। অবশেষে মাছের রাজা ইলিশ বিজয়ী ঈগল বাহিনীর ক্যাপ্টেন ঈগল পাখির হাতে বিজয়ের ট্রফিটা তুলে দিলো। এতে বনের রাজা সিংহের খুব রাগ হলো। পরাজিত দলের ক্যাপ্টেন হিসেবে বিজয়ী দলের ক্যাপ্টেন ঈগল পাখির সাথে যখন সে হ্যান্ডশেক করতে গেলো, তখন রাগের চোটে ঈগল পাখির এক চোখ সে থাবা মেরে কানা করে দিলো। চারিদিকে হৈচৈ, বিশৃঙ্খলা লেগে গেল। পশু-পাখিরা এলোমেলো মারামারি করতে করতে দৌড়ে আর উড়ে যার যার বাসায় চলে গেলো। তবে পাখির রাজা ঈগল প্রতিজ্ঞা করলো যে, সে এই অন্যায় আঘাতের প্রতিশোধ নেবেই। বনের রাজা সিংহ ঈগলের এই প্রতিজ্ঞার কথা শুনে তার দলবল নিয়ে খুব সতর্ক রইলো। সে লম্বা গলাওয়ালা জিরাফকে প্রহরী নিযুক্ত করলো। আর বানরদেরকে নির্দেশ দিলো যাতে জিরাফ সংকেত দিলেই ওরা পাথর ছুড়ে পাখিদের তাড়িয়ে দেয়। এ কারণে পরপর কয়েকবার চেষ্টা করে পাখির রাজা ঈগল প্রতিশোধ নিতে ব্যর্থ হলো। তবু সে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। একদিন বনে ভীষণ ডেঙ্গু জ্বর ছড়িয়ে পড়লো। লম্বা গলাওয়ালা জিরাফ ডেঙ্গু জ্বরে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পশু হাসপাতালে ভর্তি হলো। এবার পাখির রাজা ঈগল সুযোগ পেলো। সে দলবল নিয়ে পশুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। কেউ তাদের আগে দেখে সতর্ক করতে পারলো না। শুরু হলো পশু ও পাখির দলের ভয়ংকর লড়াই। বাঘ, হরিণ, চিল, শকুন সবাই যুদ্ধ করতে লাগলো। পশু-পাখিদের মৃতদেহে বন ভরে গেলো। হঠাৎ ঈগল পাখি সিংহকে দেখতে পেয়ে তার দিকে প্রচণ্ড গতিতে উড়ে এলো। সিংহ শেষ মুহূর্তে তাকে দেখতে পেয়ে থাবা ঝাঁকিয়ে তার ডানায় আঘাত করলো। ঈগল পাখি একদিকে সরে গিয়ে ঝটকা মেরে ফিরে এসে বনের রাজা সিংহের বাম চোখে আঘাত হানলো। সিংহ সেই তীব্র আঘাতে কানা হয়ে গেলো। চোখ থেকে রক্ত গড়িয়ে মাটির ওপর ঝরে পড়তে লাগলো। সিংহ তখন থাবা উঁচিয়ে পাখির রাজা ঈগলকে থামতে ইঙ্গিত করে বলল, আমি তোমাকে অযথা আঘাত করে অন্যায় করেছিলাম। আজ সেই একই আঘাত পেয়ে আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আর যুদ্ধ নয়। আজ থেকে বনের পশুরা-পাখিরা সবাই মিলেমিশে থাকবো। এতেই আমাদের সবার কল্যাণ। ঈগল পাখি ও শত্রুতা ভুলে বনের রাজা সিংহকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। সেই থেকে ভাভর বনের পশু-পাখিরা খুব মিলেমিশে, পরস্পরকে ভালোবেসে শান্তিতে আছে।

বাংলা সাহিত্যের অনন্য প্রেমী

বাংলা সাহিত্যের অনন্য প্রেমী

ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে থেকে ফাদার মারিনো রিগন হয়ে উঠেছেন মনে-প্রাণে খাঁটি বাঙালি। এ দেশের সাহিত্যের প্রতি তাঁর যে ভালোলাগা তা সত্যিই অনন্য। বিশেষ করে রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রতি তাঁর যে দুর্বলতা তা মুগ্ধ করার মতো। অন্যদিকে লালনের গানের প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ আকর্ষণ। অনেক সময় গির্জায় আলোচনাতেও রবীন্দ্রনাথের কথা উল্লেখ করতেন। আবার কখনো কখনো লালনের বাণী ছিল তাঁর আলোচনার বিষয়। তিনি প্রায় বলতেনÑ ‘রবীন্দ্রনাথ আমার মগজে থাকেন, আর লালন বাস করেন আমার অন্তরে।’ ইতালি থেকে তিনি এদেশে যাজক হিসেবে এলেও জীবনের অনেকটা সময় ব্যয় করেছেন সাহিত্য চর্চার পেছনে। একই সঙ্গে তাঁর মানবিক কাজগুলোও তাকে অনন্য করে রেখেছে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশকে ভালোবেসে তিনি যেমন হয়ে উঠেছেন খাঁটি বাঙালি। তেমনি বাংলাদেশও তাঁকে আপন করে নিয়েছে। স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করে। এ ছাড়া ২০১২ সালে পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা। তাঁর জন্ম ১৯২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ইতালির পর্যটন শহর ভেনিসের নিকটবর্তী ভিল্লাভেরলা গ্রামে। এবারের ৫ ফেব্রুয়ারি ছিল তাঁর জন্মশতবর্ষ। তিনি প্রথম বাংলাদেশে আসেন ১৯৫৩ সালে। প্রথমে তিনি সুন্দরবনসংলগ্ন বাগেরহাট জেলার মোংলার শেলাবুনিয়া গ্রামে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর মিশনারি জীবন শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন মিশনারিতে ছিলেন। তবে জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি থেকেছেন সুন্দরবনঘেঁষা শেলাবুনিয়া গ্রামে। বাংলাদেশে বাংলাভাষা শিখতে গিয়ে তিনি বাংলাসাহিত্য পড়তে শুরু করেন। মূলত ভাষা শিখতে গিয়েই তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রেমে পড়েন। এরপর নিজের ভালোলাগার কথা নিজ দেশের মানুষের কাছে জানাতে অনুবাদ শুরু করেন। একে একে তিনি ইতালিয় ভাষায় অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, কবিবন্ধু জসীম উদ্দীনসহ আরও অনেকের কবিতা। শুধু রবীন্দ্রনাথেরই চল্লিশটি বই অনুবাদ করেছেন তিনি। পাশাপাশি অনুবাদ করেছেন মরমি কবি ফকির লালন সাঁইয়ের বেশ কিছু গান। এ দেশের লোকজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকেও তিনি নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি একাধিকবার বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক দল নিয়ে ইতালি ভ্রমণ করেছেন। সেখানে তুলে ধরেছেন এদেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি। এ দেশের নকশিকাঁথাকেও তিনি নিয়ে গেছেন বিশ^ দরবারে। এজন্য শেলাবুনিয়া গ্রামে গড়ে তুলেছেন সেলাই কেন্দ্র। এ কেন্দ্রে নারীদের দিয়ে তিনি নকশিকাঁথা বুনিয়ে তা বিক্রির ব্যবস্থা করেছেন ইতালির বাজারে। আর এখানকার নকশিকাঁথায় তিনি তুলে ধরেছেন বাংলাদেশের লোকজ ঐতিহ্য। বাংলা সাহিত্য অনুবাদের পাশাপাশি বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য নিয়ে নিজেও কয়েকটি মৌলিক বই লিখেছেন। এর মধ্যে শেলাবুনিয়ার রূপকথা উল্লেখযোগ্য। সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি এ দেশের শিক্ষাসেবায়ও রয়েছে তাঁর বিশেষ অবদান। তাঁর উদ্যোগে মোংলা, খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রায় ১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়াও রয়েছে তাঁর কল্যাণমুখী নানা উদ্যোগ। মুক্তিযুদ্ধে তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা, আশ্রয়, খাদ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লেখা তাঁর ডায়েরি, আলোকচিত্র ও অন্যান্য স্মৃতি স্থান পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। তাঁর নামে মোংলার হলদিবুনিয়া গ্রামে মেলার আয়োজন করে রিগন শিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। এ ছাড়া স্থানীয় সনাতনধর্মীদের পূজা-পার্বণেও অতিথি হিসেবে হাজির হয়েও রেখেছেন সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত। টানা ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে এদেশে থাকার পর ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর ৯২ বছর বয়সে তিনি ইতালির ভিচেঞ্চায় প্রয়াত হন। তবে তাঁর ইচ্ছে ছিল এদেশের মাটিতেই শায়িত হবেন। সেজন্য মৃত্যুর প্রায় এক বছর পর ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর তাঁর মরদেহ ইতালি থেকে বাংলাদেশে আনা হয় এবং শেলাবুনিয়া গ্রামে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

বিপ্লবী কবি ডাল্টনের কবিতা

বিপ্লবী কবি ডাল্টনের কবিতা

কবি রোগ ডাল্টন (১৪ মে ১৯৩৫-১০ মে ১৯৭৫) সালভাদরের একজন বিপ্লবী কবি যার জীবন এবং কাজ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাকে লাতিন আমেরিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রোগ ডাল্টন সালভাদরের কবি, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক এবং কমিউনিস্ট কর্মী। তার কবিতায় যেমন বিপ্লবের কথা এসেছে প্রাণবন্ত হয়ে তেমনই এসেছে বৈষম্য, জীবন, মৃত্যু এবং মানুষের প্রতি আপরিসীম মমতা ও ভালোবাসার কথা। কবি রোগ ডালটন বিপ্লব ও আন্দোলনের পাশাপাশি লিখেছেন কবিতা। শুকনো রোগা হাড় বের করা অথচ সদাহাস্য কবি। আর্নেস্টো কার্ডিনাল ডাল্টনের ইংরেজিতে অনুবাদ নির্বাচিত কবিতার গ্রন্থ Small Hours of the Night এর ভূমিকায় কবিকে হাসি মুখের বিপ্লবী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই বইয়ের কবিতাগুলো স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ করেছেন জোনাথন কোহেন, জেমস গ্রাহাম, রালফ নেলসন, পল পাইন্স, হার্ডি সেন্ট মার্টিন ও ডেভিড আনজার। সম্পাদনা করেছেন হার্ডি সেন্ট মার্টিন। তার মৃত্যু ছিলো দুর্ভাগ্যজনক ও মর্মন্তুদ। সতীর্থদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন তিনি। কবি রোগ ডালটন পেয়েছেন লাতিন আমেরকিরার সম্মানজনক পুরস্কার Casa Dela Americas prize of poetry। মৃত্যুর পর সালভেদর সরকার তাকে ‘হিজো মেরিটিসিমো’ (সবচেয়ে মেধাবী ছেলে) এবং ‘পোয়েটা মেরিটিসিমো’ (সবচেয়ে মেধাবী কবি) হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এল সালভেদর বিশ্ববিদ্যালয় তাকে দেয় সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি। ‘ফ্রান্সিসকো সোর্তোর জন্য গাঁথা’ কবিতায় তিনি বলেছেন কারান্তরালের একজন মানুষের কথা। ফ্রান্সিসকো সোর্তো একজন সাধারণ অপরাধী যিনি বন্দি জীবনের কারণে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। নয় নম্বর সেলে ছিলেন তিনি। এমন পাগল হয়েছিলেন যে তিনি বন্দিদের মধ্যে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াতেন আর বিকেল বেলা যখন কারাগারের আঙিনায় আবাবিল ও টিয়া পাখি এসে বসতো তখন তিনি জলভরা চোখে ফ্রান্সে জন্মগ্রহণকারী আর্জেন্টাইন সংগীত শিল্পী ও সংগীত রচয়িতা কার্লোস গার্ডেলের গান বেসুরো গলায় গাইতেন।

ওয়াহিদুল হক ॥ কঠিনেরে ভালোবাসিলাম

ওয়াহিদুল হক ॥ কঠিনেরে ভালোবাসিলাম

ওয়াহিদুল হক (জন্ম : ১৬ মার্চ, ১৯৩৩, মৃত্যু ২৭ জানুয়ারি ২০০৭), ৭৪ বছর বয়সের একজন যৌবনউদীপ্ত সংস্কৃতিকর্মীর নাম। বাঙালির আত্মপরিচয়, সংস্কৃতির বার্তা, রবীন্দ্রচেতনা নতুন প্রজন্মের কানে তুলে দেওয়ার জন্য ওই প্রৌঢ় ওয়াহিদুল হকের মধ্যে যে উন্মাদনার জোয়ার দেখেছি তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। শুধু মনের অনুভব অনুভূতির সঙ্গে গেঁথে আছে থরে থরে। দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে কাঁধে স্বদেশী থলে ঝুলিয়ে চলেছেন অবিরাম গতিতে। যেন সব মানুষকে মানুষ হিসেবে, বাঙালি হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব তাঁকে কেউ দিয়েছেন। হ্যাঁ তাঁর আদর্শ রবীন্দ্রনাথ। চলনে বলনে, পোশাক-আশাকে, কর্মে, লিখনে, বচনে, কণ্ঠস্বর সাধনে ওয়াহিদুল হক একজন আপাদমস্তক বাঙালি।     বিরামহীন গতিতে কলাম লিখছেন, সংগীত শিখাচ্ছেন, সভা সমিতি, মঞ্চে মাঠে, বক্তব্য করছেন, সুষ্ঠুধারার সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলছেন, শত অজানাকে জানিয়ে চেতনায় সুড়সুড়ি দিচ্ছেন, পথের ক্লান্তি ভুলে বিরামহীনভাবে দেশের আনাচ-কানাচ পর্যন্ত কর্মযজ্ঞে ছুটছেন। যেন মানুষ গড়ার সব দায়িত্ব তাঁর। বয়স আর শরীরের দিকে ভ্রুক্ষেপ ছিল না একবিন্দু। মাথা তাঁর মোটা ছিল, অশৈল্যে কিছু সহ্য করতে পারতেন না। যাকে দিয়ে যা করানো যায়, তাকে দিয়ে তাই করিয়ে নিতেন, আর বাকিটা নিজের বোঝা মনে করে মাথায় তুলে নিতেন! রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ নিয়ে দেশব্যাপী তাঁর কি অসাধারণ কর্মস্পন্দন! সাতক্ষীরা থেকে সিলেট বা পঞ্চগড় থেকে বান্দরবন সবখানেই তার আপনজন, সবখানেই গুটি গুটি পায়ে পদচারণ। ওই সময়ের রাজনৈতিক সংকট, বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি আগ্রাসন; তাকে মানসিকভাবে খেপিয়ে তুলেছিল। ফলে ৭১-এর ন্যায় তার মসিতে প্রতিবাদ প্রতিরোধের বারুদ ছুটেছে। অবশেষে মস্তিষ্কে রক্ত ক্ষরণ! আকস্মিকভাবে ২৭ জানুয়ারি ২০০৭ খ্রি. তিনি চিকিৎসকের সকল চেষ্টা, স্বজনদের প্রাণের আকুতি উপেক্ষা করে থেমে গেলেন! আমরা হারালাম একজন প্রকৃত মানুষ গড়া শিক্ষক, খাটি বাঙালি ওয়াহিদুল হককে। তিনি রেখে গেছেন অজস্র কর্মী, ভক্ত অনুরাগী। আজ বিনম্র শ্রদ্ধায় মহাত্মা ওয়াহিদুলকে স্মরণ করি। তিনি অভয়দাতা, আঁধারের আলো। তিনি বাঙালি সংস্কৃতি চেতনার বাতিঘর। তাঁর শিকড় ছায়ানট। রবীন্দ্রনাথ তাঁর দিকদর্শন। ওয়াহিদুল হক; একজন দুঃসাহসী বাঙালির নাম। তৎকালীন পাকজান্তা আইয়ুব খান সরকার বেতার টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাংলার প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মীগণ দেশজুড়ে নানা কর্মসূচি পালন করে। ১৯৬১ খ্রি. রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে যৌবনউদীপ্ত প্রতিবাদী শিল্পী জুটি ওয়াহিদুল হক ও সন্জীদা খাতুন সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দেশের বিভিন্ন শহরে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উৎসব পালন করেন। ‘রবীন্দ্রগীতির মুক্তি’ প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন,’ সেনা শাসনের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে, চ্যালেজ্ঞ করে ঢাকায় উদযাপিত হয় জয়ন্তী শতবার্ষিকী। এগারো দিন জুড়ে তিন’শ গান, চারটি নৃত্যনাট্য চারটি নাটক ও নানাবিধ প্রদর্শনীর সমন্বয়ে, সনজীদা ও আমি সে উপলক্ষে সম্ভবত এগারো শহরের অনুষ্ঠানে যোগ দেই’। ওই দ্রোহ থেকে জন্ম নেয় ছায়ানট। কবি বেগম সুফিয়া কামাল ছিলেন এর প্রথম সভাপতি। আর ওয়াহিদুল হক ১৯৬১ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ১৯৭১ সালে মুক্তি পাগল ওয়াহিদুল হকের প্রচেষ্টায় স্বাধীন বাংলা শিল্পী সংস্থা গড়ে ওঠে। তিনি ১৯৯৯ থেকে আমৃত্যুকাল পর্যন্ত ছিলেন ছায়ানটের সহ-সভাপতি। বহু শুভ কাজের নির্ভিক মাঝি ওয়াহিদুল হক। ছায়ানটের ছত্রছায়ায় দেশে বর্ষবরণ, পিঠা উৎসব, নবান্ন উৎসবসহ বাঙালি সংস্কৃতির নানা বিষয় জেগেছে। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, কণ্ঠশীলন, আনন্দধ্বনি, মুকুল ফৌজ, বাংলাদেশ ব্রতচারী সমিতি সহ-সুষ্ঠুধারার সাংস্কৃতিক সংগঠন ওয়াহিদুল হকের হাত ধরে মুখরিত হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্র নজরুলের জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকীসহ কবি শিল্পী সাহিত্যিকদের জীবনকর্ম নিয়ে উৎসব, মেলা, পিঠা-পুলি পালাপার্বণ পালন, এবং ঈদ-পূজাসহ ধর্মীয় নানা অনুষ্ঠান বারো মাসে তেরো পার্বণের এই বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতি এখন শহরকেন্দ্রিক জীবনেও নবজাগরণ সৃষ্টি করেছে। এগুলো বাঙালি সংস্কৃতির শিকড়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই’। ১৯৬১ তে বাধা পেয়ে জেগে উঠে মুক্ত চিন্তার বাঙালি। স্বাধীনতার পথ সুগম হয় ওই একই পথ ধরে। ওয়াহিদুল হক সারাজীবন রবীন্দ্রনাথের মধ্য দিয়ে ‘বাঙালির সম্পন্ন জীবনের ঠিকানা’ খুঁজেছেন। তার লেখনীতে ঘুরে ফিরে বারবার এসেছে বাঙালির কৃষি শিল্প বাণিজ্যে প্রাচীনত্বের কথা, শৌর্য-বীর্য, ইতিহাসের কথা, লোকজ সাহিত্য সংস্কৃতির কথা। এই অতুল সংস্কৃতিকে স্মরণে মননে টিকিয়ে রাখতে তার আজীবন সংগ্রাম। তিনি বলেছেন,’ অতি সাম্প্রতিক সময়ে আমার মনে সংশয় দেখা দিয়েছে ওই সাংস্কৃতিক সম্পদের বাস্তবতা নিয়ে। বাংলাদেশে সমাজের কার্যকর অংশ সেই সাহিত্য সংগীতে লোককথায় ঋদ্ধ সাংস্কৃতিক ভাণ্ডারকে বোঝা বলেই মনে করছে যেন এবং তা হিন্দু ভারতেরই প্রবিদ্ধ অংশ ভেবে বর্জন করতে প্রবৃত্ত হয়েছে। ‘(সূত্র : সংগীত সংস্কৃতি-১৪১০, পৃষ্ঠা-২৭) ছাত্র অবস্থা থেকে প্রায় ৫৪ বছর ইংরেজি বাংলা কয়েকটি পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজ করেছেন ওয়াহিদুল হক। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। মূলত তিনি রবীন্দ্রপ্রেমী সংস্কৃতিকর্মী। তার প্রকাশিত গ্রন্থ; সংস্কৃতিই জাগরণের প্রথম সূর্য, চেতনা ধারায় এসো, গানের ভেতর দিয়ে, প্রবন্ধ সংগ্রহ অন্যতম। তিনি দৈনিক জনকণ্ঠ ও ভোরের কাগজে ‘অভয় বাজে হৃদয় মাঝে’ এবং ‘এখনও গেল না আঁধার’ শিরোনামে নিয়মিত দুটি কলাম লিখতেন। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের বার্ষিকী অধিবেশন উপলক্ষে প্রকাশিত ‘সংগীত সংস্কৃতি’ তাঁর ছোঁয়ায় রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার এক ভুবন হয়ে উঠেছিল। এই মহাপ্রাণ বাঙালি চেতনার বাতিঘর ওয়াহিদুল হককে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।

বইমেলার ইতিহাস

বইমেলার ইতিহাস

বইমেলা মানেই জ্ঞানের মেলা, সাহিত্যপ্রেমীদের মিলনস্থল। বইমেলা শুধু বই কেনাবেচার স্থান নয়; এটি সংস্কৃতি, ইতিহাস ও জ্ঞানের আদান-প্রদানের অন্যতম মাধ্যম। সময়ের বিবর্তনে বইমেলার ধারণা এবং গুরুত্ব অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। বইমেলার উৎপত্তি বেশ পুরনো। মানবসভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গ্রন্থ সংরক্ষণ এবং বিতরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয় মানব সমাজে। প্রাচীনকালে গ্রন্থাগারই ছিল বই আদান-প্রদানের প্রধান কেন্দ্র। মধ্যযুগে হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি বিনিময় হতো, কিন্তু ছাপাখানার আবিষ্কারের পর বই প্রকাশনায় বিপ্লব ঘটে। প্রথম দিকের বইমেলাগুলো ইউরোপে অনুষ্ঠিত হতো, যেখানে প্রকাশকরা নতুন প্রকাশিত বই প্রদর্শন করতেন। ১৪৫০ সালে জার্মানির মেইনজ শহরে জোহানেস গুটেনবার্গের ছাপাখানা আবিষ্কারের পর বই ছাপানোর কাজ সহজ হয় এবং বইয়ের জনপ্রিয়তা বাড়ে। ১৬শ’ ও ১৭শ’ শতকে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট ও লিপজিগ শহরে বইমেলার প্রচলন দেখা যায়। ইউরোপ ছাড়াও চীনের প্রাচীন সভ্যতায় বই আদান-প্রদানের জন্য নির্দিষ্ট স্থান ও মেলা বসত। মধ্যপ্রাচ্যের বিখ্যাত শহর বাগদাদ ও দামেস্কেও বিভিন্ন সময় বই বিক্রির জন্য বড় আকারের সমাবেশ হতো। পরবর্তীকালে, বইমেলার ধারণা ইউরোপ থেকে এশিয়া, আমেরিকা এবং অন্যান্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলা ভাষায় বইমেলার সূচনা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে কলকাতায় হলেও, বাংলাদেশে বইমেলার যাত্রা শুরু হয় ১৯৭২ সালে। ঊনবিংশ শতকে কলকাতার কলেজ স্ট্রিট এবং অন্যান্য সাহিত্যকেন্দ্রিক এলাকায় বিভিন্ন প্রকাশনী সংস্থা বই প্রদর্শনের উদ্যোগ নিত। ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলা ভাষার বই প্রকাশের সংখ্যা কম থাকলেও, ধীরে ধীরে বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায় এবং বই বিক্রির জন্য বিভিন্ন মেলার আয়োজন শুরু হয়। বাংলাদেশে বইমেলার সূচনা ঘটে ১৯৭২ সালে, যখন স্বাধীনতার পরপরই বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একদিনের বইমেলা আয়োজন করা হয়। ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি বইমেলাকে নিয়মিত আয়োজনের উদ্যোগ নেয়, এবং ১৯৮৪ সাল থেকে এটাকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এটি ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮০-এর দশকের পর থেকে বইমেলা আরও বৃহৎ পরিসরে আয়োজন করা হতে থাকে। ১৯৯০-এর দশকে বইমেলার প্রসার ঘটে এবং এতে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থাগুলোর অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। বর্তমানে অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বইমেলা এবং এটি এক মাসব্যাপী চলে। এ মেলা শুধু বই কেনাবেচার জন্য নয়, এটি লেখক, প্রকাশক, পাঠক এবং সাহিত্যপ্রেমীদের মিলনমেলা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বইমেলার ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাস রয়েছে। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা বিশ্বের প্রাচীনতম ও বৃহত্তম বইমেলা, যা প্রথম শুরু হয় ১৪৫৪ সালে। এখানে বিভিন্ন ভাষার বই প্রকাশিত ও প্রদর্শিত হয়। লন্ডন বইমেলা মূলত প্রকাশনা সংস্থাগুলোর জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে লেখক ও প্রকাশকদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদনের সুযোগ থাকে। নিউইয়র্ক বইমেলা প্রযুক্তিনির্ভর এবং আধুনিক ডিজিটাল প্রকাশনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ বইমেলা কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা, যেখানে বাংলা ভাষার বইয়ের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক প্রকাশনাও স্থান পায়। বর্তমানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বইমেলার পরিধি ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯০-এর দশকের পর থেকে বইমেলা শুধু প্রকাশকদের প্ল্যাটফর্ম নয়, এটি লেখক, পাঠক, সাহিত্যিক ও গবেষকদের মিলনস্থলে পরিণত হয়েছে। বইমেলার পরিধি প্রসারিত হয়েছে এবং এতে বৈচিত্র্য এসেছে। প্রথমদিকে বইমেলায় সাহিত্যকেন্দ্রিক বই প্রকাশিত হতো, তবে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের বই পাওয়া যায়Ñ গবেষণা, ইতিহাস, আত্মজীবনী, শিশুতোষ, কমিকস, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইত্যাদি। বাংলাদেশের বইমেলা এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সমাদৃত হচ্ছে। বিদেশী প্রকাশকরা এখানে অংশ নিচ্ছেন এবং বাংলাদেশী প্রকাশকরাও আন্তর্জাতিক বইমেলায় অংশ নিচ্ছেন। পরিশেষে বলা যায়, বইমেলা আমাদের সংস্কৃতি, জ্ঞান ও ইতিহাসের ধারক ও বাহক। এটি শুধু একটি বাণিজ্যিক স্থান নয়, এটি জ্ঞানের আলোকবর্তিকা, যা পাঠক, লেখক ও প্রকাশকদের একত্রিত করে। ভবিষ্যতে আরও আধুনিকায়ন ও আন্তর্জাতিকীকরণের মাধ্যমে বইমেলা তার গুরুত্ব ও আবেদন আরও বৃদ্ধি করবে। সরকার, লেখক, প্রকাশক, পাঠক সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সহযোগিতায় বইমেলা তার ঐতিহ্য ধরে রাখবে বলে আশা রাখছি।

নাকফুল

নাকফুল

বাড়ির আয়োজন দেখে নিলুফা বিচলিত,ওর মনে বিদ্যুত খেলে যায়। আজ বিয়ে তাও আবার ওরই। বিয়ের মানে কী ও বোঝে না। ফুলের উপরে কেবলই ভ্রমর এসে বসছে। গ্রামের অতিচঞ্চল লোকেরা মশকরা করে নিলুফাকে বলেন, ‘ফা জানিস আজ তোর বিয়া’। নিলুফাকে গ্রামবাসী ফা বলেই ডাকে। আর ফা বলার একটা কারণও আছে, নিলুফার সামনের পাটির দাঁতগুলো একটু চওড়া তাই মুখটা একটু হা করে থাকে। নিলুফা কিছুদিন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়েও গেছে। গায়-গতরে এই যা একটু উছলে উঠেছে। বাবা দবির। মেয়ের বিয়ে দেওয়া থেকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি। দবির শ্রমিক। মা সাহারা। মরুভূমির মতোই উনার জীবন। দবির উপার্জন বাড়াতে না পারলেও বছর বছর সন্তান জন্ম দিয়েছে। দুই মেয়ে, দুই ছেলে। প্রথম মেয়েই নিলুফা। বয়স যাই হোক নিলুফাকে বিয়ে দেওয়াই যেন আজ বাবা দবিরের দায়িত্ব হয়ে পড়েছে। দিনটি ছিল শুক্রবার। দিনটি নাকি গরিবদের ঈদের দিন। তাই বাবা দবিরের ইচ্ছে মেয়ের জন্য তো আর সানাই এর সুর, পার্টি করা গেলো না আর সে  সাধ্যিও নেই। গরিবদের অতো সাধ-আহ্লাদ থাকতেও নেই। তাই একটা ভালো দিনে নিলুফার বিয়ে হোক এটা বাবা হিসেবে চাওয়া। এখানে মা সাহারার কোনো কথা নেওয়া হয়নি। মেয়েদের নাকি বুদ্ধি-শুদ্ধি কম। কঠিন সিদ্ধান্ত ওরা ধড়ফড় করে নিতে জানে না। তাই সাহারা, সাহারা হয়েই থাকলেন। নিলুফাকে বিয়ে করতে এসেছে পাশের দু গ্রাম পরের গ্রামের সংগ্রাম হোসাইনের ছেলে বিপ্লব হোসাইন। বিপ্লব কোথায় কী বিপ্লব ঘটিয়েছে তা বলা মুশকিল। আজ বিয়ে করতে এসেছে  নিলুফার জন্য শাড়ী, ব্লাউজ, লিপস্টিক, আইভ্রু, আয়না, লেসফিতা আর সাথে নাকফুল সবই কিনেছে নিজের উপার্জনের টাকা থেকে। বাবা সংগ্রাম সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বিয়ে করবি কর, তবে আমি এক টাকাও খরচ করতে পারবো না। বাবা কিছু দিবেন না, তা হোক নিজের ইনকাম করা টাকাতেই সব কিনবে এবং বিয়ে করবে। পড়াশোনা এক লাইনও হয়নি। ছোটো থেকেই কাজ আর কাজ। এখন ভাড়ায় খাটানো চার্জার ভ্যান চালায়। বিয়ে হলো নিলুফার। বিয়ের অর্থ ওর জানা নেই। আর বিয়ের পথ কতদূর যায় তাও অজানা। গ্রামের মসজিদের ইমাম সাব যখন নিলুফাকে বললেন, মা বলো কবুল। তখন নিলুফাও বলল, মা বলো কবুল। ইমাম সাবের ব্যর্থতায় নিলুফার পাশের কে যেন বলে দিল, কবুল। এই বিপর্যয় শেষ হতে না হতে ফকফকে আকাশে বিপর্যয়ের কালো মেঘ এলো। বিপ্লবের নিয়ে আসা নাকফুল নিলুফার নাকে নেই। নিলুফার নাক ফোঁড়ানো নেই তো ফুল বসবে কী করে! চারদিক হট্টগোল বাধল। এখন কী হবে। কেউ একজন বলল, ‘মেয়ের বিয়া দিবা আর নাক ফোঁড়াও নি এইডা কেমন হলো মিয়া।’ এমন কথায় দবিরের নাক কাটা গেল। কথার ফোঁড়ন অসহ্য লাগছিল নিলুফার। চিৎকার দিল। বলল, ‘বিয়া করমু না। ভালা লাগতাছে না বিয়া।’ ওর কথায় সবাই অট্টহেসে গোটাবাড়ি ঝলমলে করে দিল। বরপক্ষ থেকে কথা এলো, এ বিয়ে হচ্ছে না।’ কে বলেছে হচ্ছে না। হচ্ছে অবশ্যই তবে নিলুফার নাক ফোঁড়াবার পরে। নাকফুল নাকি স্বামীর এক দৃশ্যমান বন্ধন। নাকফুল পরিয়েই তবেই নাকি বিয়ে করবে বিপ্লব। বরের এ এক কথায় চারিদিক প্রশংসার ঢলে ঢল নামল। দবির হবু জামাই বিপ্লবের দিকে তাকালেন, ডান হাত দিয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললেন, ‘তো বাবাজি, বিয়া হওনের পর নাকফুলডা পরনেতে কোনো অসুবিধা নাই।’ শ্বশুরের কথার তোড় বিপ্লবের কানে পৌঁছল কিন্তু মন অব্ধি গড়ালো না। বিপ্লব বলল, ‘না, তা হইবো না। আগে নিলুফার নাকে নাকফুল যাইবো তয় বিবাহ হইব, নচেৎ নয়।’ বেশি কথা বললে করিৎকর্মা ছেলে হাতছাড়া হবার ভয়ে কথার সীমান্ত রচিত হলো। টানা পনেরো  দিন পর বিপ্লব সকল বিপ্লবের অবসান ঘটিয়ে নিলুফাকে মেঘ ভাঙা রোদ হিসেবে নিয়ে আসল। নিলুফা বিয়ের অর্থ ঠিকভাবে না বুঝলেও বাবা-মা যে ওকে  বিপ্লবের সাথে থাকবার সঠিক ব্যবস্থা করে দিয়েছে তা বোঝে। বিপ্লব ভালোবাসায় ফেটে পড়েছে। এই জেরে ও জোরে মনের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে বেশ কটা দিন থেকে অটোরিক্সা চালাতে যেতে পারেনি। বিয়ের মতো আধ্যাত্মিক ও রোমান্টিক কাজ করতে পেরে বিপ্লব খুশি হলেও জমানো টাকা শেষের পথে। বসে খেলে তো রাজার ভাণ্ডারও একদিন শেষ হয়ে যায়। বিপ্লব বিয়ের চারদিনের মাথায় ভাড়ায় চালিত অটোরিক্সা চালাতে বের হলো। সকালের হাওয়া বেশ ভেজা ভেজা। হেমন্তের শিশির যেন গোটা আকাশটাকে বিস্তার করে ফেলেছে। সূর্যটাও জাগছে না। জাগলেও কুয়াশা জাপটে ধরে আছে। নিলুফা এ পরিবারে এসে বুঝেছে বিপ্লব ওর স্বামী। স্বামী যা বলে সেভাবেই চলতে হয়। দশ মাস পরের ঘটনা। নিলুফা সন্তান সম্ভবা হয়। দারুণ অস্বস্তিতে ওর সময় যায়। সেদিনই প্রথম নিলুফাকে বিপ্লব ফা বলে ডাকে। নিলুফার মনে ও মননে পা টিপে টিপে হাঁটার মতো বাবা-মার স্পর্শ অনুভব করল। নিলুফা এমনি কম কথা বলে। কিন্তু সেদিন কী যে এক আবেগ উছলে উঠল  বোঝা গেল, জানা গেল না। হুড়মুড় করে বলল, ‘হুনতাছেন মনটা বাপজানের জন্য খচখচ করতাছে। হামারে লইয়া চলেন।’ বিপ্লব নিরিবিলি হয়ে বলল, ‘যামুনে।’  বলেই ঘরের দরজা টেনে একটু ফাঁকা করে চলে গেল। নিলুফার দেহ ভারবাহী হয়ে গেছে, অঙ্গে অঙ্গে মা হবার সকল চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মা-বাবা আর ছেটো ভাইবোনদের জন্য মন  পোড়ে। ওদের কথা ভাবতে ভাবতে ভেতরটা মনে হয় প্রদীপের আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে আর সেই প্রদীপ তার আলোর রোখে ভেতরটাও পুড়াচ্ছে। পুড়পুড় করে পুড়ছে এ পুড়বার গন্ধ নেই শুধু চোখ দিয়ে কফোঁটা অশ্রু বিছানায় পড়ল। নিলুফার এখন এমন অবস্থা যে একা একা হাঁটতে ভয় হয়, বসে থাকলেও মাথা ঘোরায়। বমি হবার ভাব আসে শুধু ওয়াক্ ওয়াক্ শব্দ হয় বমি হয় না। শুয়ে-বসে-দাঁড়িয়ে, কিছানায় এপাশ-ওপাশ হয়ে সময় কাটানো ছাড়া নিলুফার কোনো উপায় নেই। দরজায় ছিটকানি নাড়িয়ে এলেন শাশুড়ি। বললেন, কী করো গো? এহুন শরীরডা ক্যামন লাগতাছে?’ হামার কোমরের ব্যাথাডাও বাড়ছে গো।” নিলুফা তখন থকথকে কাদার মতো বিছানার সাথে লেপটে শুয়ে আছে। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঢক ঢক করে পানি পান করবার মতো জোরালো শব্দের বৃষ্টির বোল। বিপ্লব এলো। সকাল থেকেই ওর মনটা দুর্বহ শঙ্কায় আচ্ছন্ন। বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে। মাথার পানি গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, ‘মা এহানে আছো ভালা করছো। রাত থ্যেইকাই তো ফা এর অসুখডা বাইরা গ্যাছে।’ কথারা যৌবনের ক্ষিপ্রতায় ছুটে গেল। বিপ্লবের মা জোসনা বেগমের সমস্ত শরীর জ্বলতে লাগল। ছেলে মায়ের কথা না বলে বৌয়ের কথা বলছে। শাশুড়ি কী বলবে তা ভাবতে ভয়ে তার বুক শুকিয়ে গেল। কথা ছেড়ে দিয়েও বিপ্লব বুঝেছে মা দুরন্ত ক্রোধে ফেটে পড়বে। কিন্তু না, মায়ের কাছ থেকে কোনো কৈফিয়ত বা জ্বালাময়ী কোনো কথা বের হলো না। জোসনা বেগম বাদ-প্রতিবাদহীন জোছনার মতো বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা বিলাতে লাগলেন । বললেন, ‘বিপ্লব আইছো বাজান। বৌডারে একবার ডাক্তোরের কাছোত লইয়া যাওনের প্রয়োজন। ছাওয়াল হওনের আগে মাইয়াগো কতো অসুখ-বিসুখ আইসা ভর করে। তুই হওনের সময় হামারও অসুখের কমতি আছিলো না। কালই লইয়া যায়ও। হামার ভালা ঠেকতাছে না।’ মা কথা বলেই একদণ্ড ঘরে দাঁড়ালেন না। নিজের ঘরে গেলেন। নিলুফার শরীরে অস্বস্তি বাড়ছে। এ রাতেই কিছু হয়ে যেতে পারে। মায়ের কথা শুনে বিপ্লব খুশি হলো নাকি বেজার হলো বোঝা গেল না। মায়ের কথার  উত্তরও দিল না। ভেজা কাপড় এ ফাঁকে পরিবর্তনও করেছে। বিপ্লব এইবার নিলুফার দিকে তাকালো। নিলুফার মুখ অন্ধকারে ডুবে গেছে। বলল, ‘ফা তোমার খারাপ লাগতাছে? কাল তোমারে ডাক্তোরের কাছে নিমুনি।’ অন্যসময়  হলে নিলুফা ঢক্ ঢক্ করে পানি গেলার মতো কথাও গিলে খেত। কিন্তু এখন তার মানসিক যন্ত্রণার চেয়ে শরীরের যন্ত্রণা বেশি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ পেছনে যায় না, যায় সামনে। নিলুফা বলল, ‘ হামি আর যন্ত্রণার সাথে পারতাছি না; মনে হয় মইরা যামু, কিছু একটা করেন।’ নিলুফার কথার ভাব এর আগে এরকম শোনেনি কখনো বিপ্লব। নিলুফার আনত দৃষ্টি এবার বিপ্লবের মুখোমুখী। বিপ্লব ঘাড়ের গামছাটা হাতে তুলে মুখটা বারবার মুছছে। নিলুফা এ ধরনের কাণ্ড কখনো করে না। তবে কী নিলুফার কষ্টের ভার ওর কাছে কিছুটা গেছে নাকি আগত সন্তান আসবে নাকি আসবে না সে এক অজানা আশঙ্কায় তা বোঝা গেলো না। বুকের ভেতর ধকধক করছে। বাইরে বৃষ্টিরা থামবার অবকাশ পেয়েছে। রাতও চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে রাতজাগা পাখি ও অন্যান্য প্রাণিগুলো ডেকে জড়ো করেছে। সরগরম রাত মানেই ভয় আর ভয়। এদিকে নিলুফা কথা বলা বন্ধ করেছে। বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে আছে। বিপ্লব ‘মা’ বলে এক চিৎকার দিল। বাবা সংগ্রামও মুখ বাড়িয়ে চমকে গেলেন। বিপ্লব অটোরিক্সা বের করে নিলুফাকে পাঁজাকোলা করে তুলে মায়ের পাশে বসিয়ে দিল। দ্রুত কমিউনিটি ক্লিনিকে নিল। সেখানে কোনো ডাক্তার খুঁজে পাওয়া গেল না। তবে আছে নার্স আর কজন ইন্টার্নি। তড়িঘড়ি করে সব ব্যবস্থা হলো। রাতেই নাকি অপারেশন করতে হবে। হেড ডক্টর ইতোমধ্যেই এসেছেন। বললেন, ‘রুগির অবস্থা খারাপ। আর এমতাবস্থায় দুজনকে বাঁচানো সম্ভব নয়। আপনাদেরকে বেছে নিতে হবে মাকে বাঁচাবেন, নাকি সন্তানকে?’ ডাক্তারের কথার কোনো ছিদ্রপথ নেই। বিপ্লবের মনটা কেউ বুঝি পাক দিয়ে ধরে দুমড়ে মুচড়ে ফালাফালা করে দিচ্ছে। একদিকে সন্তান অন্যদিকে নিলুফা। নিলুফাকে অবিশ্রান্ত-অবিরল মাথা উঁচু করে মনের ভেতরে অবস্থান করতে অনুভব করল। তাই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হলো না। বলল, ‘ডাক্তোর সাব্ হামার বৌডারেই বাঁচান।’ বলেই বিপ্লব অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে একবার নিলুফাকে দেখতে চাইলো কিন্তু ডাক্তার, নার্স ঠেলে তা আর সম্ভব হলো না।  খোদা খেয়ালের বশে মা ও সন্তানকে বাঁচিয়ে দিলেন। খবর আসল অপারেশন সঠিক হয়েছে। মা ও সন্তান দুজনই ভালো আছে। একহারা দিগন্তে শব্দের পাখিরা উড়বার আগে বিপ্লব সকল শব্দের মিছিলকে নিস্তব্ধ করে দৌড় দিল সন্তান ও সন্তানের মায়ের কাছে। ডাক্তার, নার্স সবার মাঝে একই কথা এটা কী করে সম্ভব! যেখানে সন্তানই ধারণ করবার সক্ষমতা মেয়েটির পরিপূর্ণতা পায়নি সেখানে মা ও সন্তান দুজনই বহাল তবিয়তে। সাতদিন পর ওদের রিলিজ হলো। ক্লিনিকের বিল গেছে বেড়ে। বিপ্লবের পক্ষে এটা দেওয়া সম্ভব নয়। বাবা সংগ্রাম পারলেও দিবেন না। সপ্তম দিন সকালে ক্লিনিকের খরচের ফর্দ বিপ্লবের হাতে  এসে টুক করে একজন দিয়ে গেল। বিপ্লব কারো সাথে কোনো কথা না বলে বাইরে বের হলো। সারাটা দুপুর ও বিকাল কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। টাকার কোনো ব্যবস্থাই করতে পারেনি বিপ্লব। সন্তান আর স্ত্রী দুজনেই বেঁচে আছে খুশিতে একবার আটখান হয় আবার পরক্ষণেই ক্লিনিকের বিলের কথা ভাবলেই মন দুঃসহ কঠিন বেদনায় ভারী হয়ে ওঠে। সন্ধ্যায় ক্লিনিকে ফিরে বিপ্লব পা টিপে টিপে নিলুফার কাছে গেল। বলল, ‘হুনছ, ট্যাহার কোনো ব্যবস্থা করবার পাননু না। কী করমু আর পারতাছি না। শ্যাষ তুমার নাকফুলডা বে”ন লাগবো। কতা দি”ি আবার তুমারে নাকফুল কিন্না দিমু।’ স্বামীর কথা শুনে নিজেকে অরক্ষিত কোনো বনে ফেলে রেখে আসার মতো মনে হলো নিলুফার। নাকে হাত দিতেই চোখের দৃষ্টিশক্তিটা বুঝি দপ্ করে নিভে যেতে চায়। নিলুফা সন্তানের দিকে তাকাল। আর্তনাদের হাহাকারেরা জটলা পাকালো মনে। নিলুফা জানে স্বামীর যে আয়-রোজগার তাতে আর কোনোদিনই সে নাকফুলের দেখা পাবে না। বিয়ের আগে কত সময় ধরে টাকা সংগ্রহ করেছে- তারপর নাকফুল কিনেছে তার হিসেব তার জানা নেই।  নাকফুল তাও আবার সোনার সেটা কখনো সে পাবে না। এটা সম্ভবও নয়। তবুও স্বামীর ইচ্ছার কাছে নিলুফার স্বপ্ন যেন  নিরর্থক হয়েও অর্থ খুঁজে পায়। নিলুফা কোনো কথা না বলে খুলে দিল স্বামীর অস্তিত্বের নাকফুলটি।

একুশের বইমেলা বাঙালির বাতিঘর

একুশের বইমেলা বাঙালির বাতিঘর

সত্তর দশকে ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মুক্তধারার কর্ণধর চিত্তরঞ্জন সাহা চাটাই বিছিয়ে সাধারণ একটা বইমেলা শুরু করেছিলেন তা এত বিস্তৃত হবে কেউ কি কল্পনায় ভেবেছে?  ফেব্রুয়ারি মাস ক্যালেন্ডারের একটি নির্দিষ্ট মাস শুধু নয়Ñ এটি এখন বাঙালির আত্মমর্যাদা, প্রকাশের অহংকার ও নিজেকে উন্মোচনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ফেব্রুয়ারিতে ভাষা শহীদদের স্মরণ করা হয়। ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে চলে বইমেলা। প্রতিটি বাঙালি অপেক্ষা করে কখন আসবে ফেব্রুয়ারি, আর কখনই বা শুরু হবে বইমেলা। লেখক, পাঠক, প্রকাশক অধীর আগ্রহ অপেক্ষা এই প্রহরের। বাঙালির আবেগ আর ভালোবাসায় থরে থরে কম্পোমান বইমেলা। অজস্র বই প্রকাশিত হয়। কতটুকু মানসম্মত সব বই প্রশ্ন সাপেক্ষ। তবু বই প্রকাশিত হয়। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে বর্ণিল রঙের বিজয় নানা রঙে রঞ্জিত হয় বইমেলা। নতুন বইয়ের মাতোয়ারা গন্ধ ও বই স্পর্শ করার আনন্দে কেটে যায় বাঙালির দিনরাত্রি। বইমেলা যখন শুরু হয়েছিল এর ব্যপ্তি এত ব্যাপক, কীভাবে সৃষ্টি হলো তা জানার আগ্রহ রয়েছে পাঠকের। ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে বইমেলার আলোচনায় সূত্রপাত ১৯৬১তে বাংলা একাডেমিতে। ১৯৬৪ সালে একটি বইমেলার আয়োজন টিচার্স ট্রেনিং কলেজে, অন্যটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের নিচতলায়। প্রথমটি বছরের শুরুতে ও পরেরটা ১৮-২৪ অক্টোবর। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জে একটি সফল বইমেলার আয়োজন করা হয়েছিল। সবচেয়ে সার্থক ও আশাসঞ্চারী বইমেলা ছিল ১৯৭২ সালের ২০-২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে আয়োজিত বইমেলা। উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। মুক্তধারা স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্স ও বর্ণমিছিল বই বিক্রির ব্যবস্থা করেছিল। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের তৎকালীন পরিচালক সরদার জয়েন উদ্দীনের আগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮৭৩ ও ১৯৭৪ সালে শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দুটি বইমেলা ছিল নজরকাড়া। ১৯৭৪ সালের ১৪-২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধন হয়েছিল। সাহিত্য সম্মেলনে যুক্ত করা হয়েছিল বই প্রদর্শনী। একুশকে কেন্দ্র করে ১৯৭৫ সালে মুক্তধারা বাংলা একাডেমির প্রধান ফটকে ছোট পরিসরের বইমেলার অস্থায়ী প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের সূচনা করেছিল তা পরে বৃহৎ পরিসরের বইমেলা আয়োজনের এক বিশাল অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বইমেলায় আস্তে-ধীরে প্রকাশকদের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। ১৯৭৬ ও ১৯৭৭ সালে আয়োজিত বইমেলা পাঠক লেখকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। বাংলা একাডেমির প্রকাশনা, মুদ্রণ বিক্রয় বিভাগ ১৯৭৮ সালের ১৫-১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বইমেলা আয়োজন করে। ১৯৭৯ সালে হয় আরেকটি বইমেলা। এসব মেলা প্রকৃত অর্থে প্রাচুর্য ও সৌন্দর্যে ভরা ছিল। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলার নামকরণ হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। ক্রমে ক্রমে বইমেলার পরিসর বৃদ্ধি পায়। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত বইমেলায় স্থান সংকুলানের অভাব তৈরি হয়। মূল প্রাঙ্গণের বাইরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বইমেলাকে সম্প্রসারিত করা হয়েছে। যন্ত্রসভ্যতার উন্নয়নের জোয়ারে বিশ্ব ভাসলেও বাঙালি তার শেকড় থেকে আজও বিচ্ছিন্ন হয়নি। মাতৃভাষা বাংলা প্রীতি এক সুতোয় রেখেছে বাঙালিকে। আত্মপরিচয় শুধু দেশে নয় বিশ্বময় বিস্তৃত। বাংলা বইমেলা ফ্রাংকফ্রুট, লন্ডন-কলকতাজুড়ে হচ্ছে। বইমেলা মানুষে মানুষে মৈত্রী গড়ে দেয়। সান্নিধ্য, আড্ডা, চর্চা, নিছক ভাব বিনিময় শুধু নয়, আড্ডা, খাওয়া, ছবি তোলা স্মৃতির অনুষঙ্গ। ঝরাপাতা, বিচিত্র ফুল, পাখির ডাক, নানা বয়সী পাঠকের কলরবে বইমেলা শুধু হয়ে ওঠে মিলনমেলা। স্মৃতি ধূসরিত দিনযাপনের অনন্য কেন্দ্র একুশের বইমেলা। ভালোবাসার টানে, নতুন বইয়ের গন্ধে আমরা বইবেলায় আসি। আবার ঘরে ফিরে যাই। মৌসুমি লেখকরা আসে বিদেশবিভূঁই থেকে। লেখক ও প্রকাশের মধ্যে পাণ্ডুলিপি ও অর্থ লেনদেন হয় এটা সবার জানা। দেশেও আছে এ ধরনের লেখক। প্রকাশক অর্থ হাতিয়ে নেয় মৌসুমি লেখকদের কাছ থেকে। প্রকাশনা সংস্থার কোনো সম্পাদনা বোর্ড নেই। শুধু হতাশার কথা নয়। আশাও আছে কিছু। সেই আশা আমাদের স্বপ্ন লালন করে। অনেক তরুণ লেখকের আত্মপ্রকাশ ঘটে। প্রতিভাময় অনেক তরুণের লেখাপড়া মস্তিষ্ক ও মনন মনন দিয়ে অনেক পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়। বইয়ের অধিক প্রকাশ, প্রচ্ছদের বর্ণিল রং সংস্কৃতিতে এক নবমাত্রা যুক্ত করে প্রতি বছর। মেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় বিচিত্র ধারার সাহিত্য, সংস্কৃতির বিকাশ হয় সেক্ষেত্রে কারও দ্বিমত নেই। বিতর্ক, আড্ডা ও সৃষ্টির অগ্নিশিখার স্ফুরণ ঘটে বইমেলা জুড়ে। ছোট প্যাভিলিয়নের সাইজ (২০দ্ধ২০)। বই বিপণন যথাযথ স্বল্প পরিসরে করা কষ্টসাধ্য। জুলাই আন্দোলন/গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-কে নিয়ে গ্রাফিতি ও বই প্রকাশ বিস্তৃত। এগুলো স্মৃতি-বেদনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই বই ইতিহাসের স্মারক। এবারের বইমেলার প্রতিপাদ্য ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান : নতুন বাংলাদেশ নির্মাণ।’ বইমেলায় থাকছে ‘জুলাই চত্বর’ যা আকর্ষণীয়। ৭০৮টি প্রকাশনা সংস্থা স্টল বরাদ্দ পেয়েছে। মূল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ৯৯টি প্রকাশনা সংস্থা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৬০৯টি প্রকাশনা সংস্থার স্টলে প্রতিদিন আসছে নতুন বই। লেখা ও প্রচ্ছদ নান্দনিক। ৩৭টি প্যাভিলিয়নও চিত্ত আকর্ষক। এর মধ্যে বাংলা একাডেমির রয়েছে ১টি প্যাভিলিয়ন। ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ বইমেলা উদ্বোধন করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস উল্লেখ করেন ‘জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে অর্জিত বিজয় নতুন বাংলাদেশ গড়ার ইস্পাত কঠোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছে। মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত এই অভ্যুত্থান এবারের বইমেলায় নতুন তাৎপর্য নিয়ে আমাদের সামনে এসেছে।’ বইমেলা শুধু বই বিক্রির জন্য নয়। এ মেলা মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। মেট্রোরেল চলাচলের সুবিধার জন্য স্টলগুলোর বিন্যাসে পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রবেশপথ ও প্রস্থান গেটটি ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ৪টি প্রবেশ ও ৪টি প্রস্থান পথ তৈরি করা হয়েছে। নিরাপত্তার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হচ্ছে মাসব্যাপী বইমেলা প্রাণেরমেলায় পরিণত হয়েছে। জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। খাবার দোকান, ক্যাসেটের দোকান, রকমারি গৃহস্থালি সামগ্রী বেচাকেনা মেলায় যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল আশির দশকে, পরে এটা বিযুক্ত হয়ে প্রকৃত কেন্দ্রিক মেলায় পরিণত হয়েছে। বইমেলায় রয়েছে আধুনিক প্যাভিলিয়ন, বহু রং ও রেখায় শোভিত বইমেলার স্টল প্রতিদিন দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠছে। বিজ্ঞাপন ও ভাষায় রয়েছে ভিন্নতা ও চমক। বইয়ের নামে এসেছে পরিবর্তন। প্রচ্ছদ সাইজ রয়েছে আকর্ষণ। সুসজ্জিত বইমেলায় প্রকৃতি নানা সাজে রঞ্জিত। ঝরাপাতা, বিচিত্র ফুল, পাখির ডাক ও নানা বয়সী পাঠকের কলরবে মুখরিত বইমেলা শুধু মিলনমেলা নয়, স্মৃতিভারে গ্রথিত একটি অনন্য কেন্দ্র। ভালোবাসার টানে, নতুন বইয়ের গন্ধে আমরা বইমেলায় আসি, আবার ঘরে ফিরে যাই। সঙ্গে নিয়ে যাই প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য স্মৃতি। বইয়ে পড়া কোনো চরিত্র অলক্ষ্যেই হয়ে যাই। আনন্দ-বেদনায় লীন হয়ে কখনো দুই চোখ ভিজে যায়। দীর্ঘশ্বাস বুক ফুড়ে বেরিয়ে আসে। অতীতের পাওয়া না পাওয়া নিয়ে যে দোলাচালে আমরা বন্দি থাকি তার সামান্যটুকুই আমরা ধারণ করতে পারি। বইমেলা ঘিরে আনন্দ ও শঙ্কা দুই-ই ভর করছে। শপিংমল, অফিস আদালত স্বাভাবিক নিয়মে চলছে বটে, তবু দুশ্চিন্তা পিছু পিছু হাটে। ইতোমধ্যে বিশিষ্ট কিছু সিনিয়র সিটিজেনকে হারিয়েছি কোভিড অতিমারির কারণে। রাজনৈতিক, সামাজিক এবং বিজ্ঞানভিত্তিক ধ্যান ধারণা এখন বদলে যাচ্ছে। ছেলে মেয়েরা জন্মের পর ট্যাব, অ্যান্ড্রয়েড ফোন ল্যাপটপ ব্যবহার করছে। ফাস্ট ফুডে আসক্ত হয়ে উঠছে। এখন হাতে নিয়ে বইপড়া, পত্রিকা দেখার চল ভাটার দিকে। নিজস্ব ঐতিহ্য অন্বেষা ও আপন আলোয় ফিরতে বই পাঠের বিকল্প নেই। বইমেলা ঘিরে রকমারি বইয়ের সমাহার দেখা ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের অনুভূতি আলাদা। এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় বইমেলা ঘিরে বইয়ের বিক্রি বেড়েছে। বইমেলায় নতুন লেখকদের অভিষেক ঘটে। ঢাকা শহরে বিনোদন কেন্দ্র সংকুচিত হয়ে গেছে। বইমেলায় আসা যাওয়ার কিছুটা বিনোদন ঘটে। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ ক্ষণে বইমেলা আয়োজন করার আনন্দ উপভোগ করবে প্রকাশক, পাঠক ও লেখক। নির্দিষ্ট দূরত্ব তৈরি করে স্টল স্থাপন করার  বিষয় অগ্রাধিকার দিতে হবে। মেলায় আগত দর্শকদের যাতায়াতে শৃঙ্খলা রক্ষা দুরূহ ও অসম্ভব নয়। দুর্যোগ দূর্বিপাকে বাঙালি ঘুরে দাঁড়াতে জানে। কোভিড-১৯ এর কারণে অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। নতুন স্থান নির্বাচন নিয়ে অনেকে কথা বলছেন। বাংলা একাডেমির মূল ভবনের আশপাশে জায়গা কম। সঙ্গত কারণেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানই হবে মেলা আয়োজনের মূল কেন্দ্র। মুদ্রণ শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক মানুষের ভাগ্য। বইমেলা আয়োজনে সতর্ক অবস্থান নিশ্চিত করা জরুরি। শুভ হোক বইমেলা। একুশের বইমেলা, প্রাণেরমেলা। এই মেলা ঘিরে প্রতিদিন জন্ম নিক নতুন অভিজ্ঞতা।

শীত এবং আমাদের প্রকৃতি

শীত এবং আমাদের প্রকৃতি

ঋতুচক্রের আবর্তে প্রকৃতির চিরন্তন নিয়মে ঘন কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে এসেছে শীত। হেমন্ত যখন অঘ্রানে ফসলের প্রাচুর্য দিয়ে ভরে দিতে থাকে, তখন শীত এ বাংলার বুকে আগমনের প্রস্তুতি নেয়। উত্তরের হিমেল হাওয়ার কাঁপন লাগিয়ে শীত আসে তার নিজস্ব রূপ নিয়ে। বাংলার ষড়ঋতুর মাঝে শীতকাল হচ্ছে প্রকৃতির নিস্তব্ধতার এক নীরব সাক্ষী।   উপভোগ্য শীতের সকাল   শীতকাল বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর ও আরামদায়ক ঋতু। শীতের সকাল যে রূপ ও সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে আবির্ভূত হয়, তা সত্যিই  উপভোগ্য।  মনে হয় দিগন্তজুড়ে সাদা শাড়ি পরে কে যেন প্রকৃতিকে কুয়াশার আড়ালে ঢেকে রেখেছে। সকালে ঘন কুয়াশায় পথঘাট ঢেকে যায়, পাতায় পাতায় এবং সবুজ ঘাসে শিশির পড়ে। বাড়ির উঠানে কিংবা একটু দূরে একত্রে জড়ো হয়ে শীতের প্রকোপ থেকে রেহাই পেতে আগুন পোহানোর চিত্র হরহামেশাই চোখে পড়ে। খোলা জায়গায় কিংবা বাড়ির উঠানে একটু রোদের জন্য প্রত্যাশায় থাকে সব বয়সীরা। গ্রামবাংলায় এসব দৃশ্য দেখে দু’চোখ জুড়িয়ে যায়। অবশ্য শহর এলাকায় এ সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যায় না। লেপ-কম্বল, কাঁথা মুড়ি দিয়ে রোদ না ওঠা পর্যন্ত শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। গ্রামের অনাবৃত দিগন্ত বিস্তৃত প্রকৃতির মাঝখানে বিশেষ করে শীতের সকাল যে সৌন্দর্য মহিমায় সেজে ওঠে, শহরের ইট-পাথরঘেরা কৃত্রিম পরিবেশে তার আভাস নেই। নিত্যদিনের কর্মচঞ্চলতা নিয়ে জেগে ওঠে শহর। কুয়াশা মাখানো কালো পিচের রাস্তায় হেডলাইট জ্বালিয়ে চলে গাড়ি। রিকশাও চলে ধীরে ধীরে কুয়াশা কাটিয়ে। রাস্তার পাশে ফুটপাতের চায়ের দোকানগুলোতে জমে ওঠে ভিড়। শীত দুপুরের আড্ডা শহরে শীত দুপুরে আড্ডার দৃশ্য তেমন একটা চোখে পড়ে না। কিন্তু গ্রামের নিস্তরঙ্গ পরিবেশে অনেকটা একঘেয়ে নারীদের জীবনে শীতের দুপুরটা বেশ মজার। যত দ্রুত পারা যায় হাতের কাজ সেরে নেয় গাঁয়ের মেয়ে-বউরা। দুপুররোদে বসে পান চিবুতে চিবুতে চলে আড্ডা। কেউ কোটেন পিঠার চাল, কেউ বা নতুন চালের মুড়ি ভাজেন, কেউ আবার উঠানে শুকাতে দেয়া ধানের লোভে বাড়ির আশপাশে ঘুরতে থাকা কাক তাড়াতে ব্যস্ত থাকেন। বেলা যতই ছোট্ট হোক না কেন, কাজের পরিধি আর কমে না। তবু রোদের উষ্ণতায় যতটা সম্ভব নিজেকে ভরিয়ে নিতে চান তারা। কে জানে সামনের রাতটুকু কতটা হীমশীতল হবে! থেমে থাকে না কর্মময় জীবন লেপ-কাঁথার মুড়ি থেকে কনকনে শীতে ঘুম থেকে ওঠা কষ্টের হলেও কর্মময় জীবন থেমে থাকে না। শীতের তীব্রতা উপেক্ষা করে সামান্য শীতবস্ত্র গায়ে জড়িয়ে গ্রামের কৃষকরা খুব সকালে লাঙ্গল-জোয়াল কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে খেত-খামারের কাজে। শহরের মানুষও কুয়াশাঘেরা সকাল থেকেই কাজকর্মে বেরিয়ে পড়ে। তাদের গায়ে থাকে বৈচিত্র্যময় সব শীতের পোশাক। ধনী শ্রেণির কাছে শীত বিলাসের সময় হলেও গরিবের কাছে এ সময়টা মৃত্যুর সমান। ধনীরা বিচিত্র মূল্যবান সব গরম পোশাকে শীত নিবারণ করে, লেপ-তোশকের বিছানায় শুয়ে জীবনের উত্তাপ গ্রহণ করে। কিন্তু হাড় কাঁপানো শীতেও গরিবরা রাত কাটায় খড়ের ভাঙ্গা ঘরে কিংবা শহরের ফুটপাতে। তবে এটা ঠিক যে, শীতে গ্রীষ্ম বা বর্ষা ঋতুর মতো প্রতিকূল পরিবেশ না থাকায় কর্মতৎপরতা বেড়ে যায়।   প্রয়োজন হয় ত্বক পরিচর্যার শীতের হাওয়ায় আমাদের মুখ ও ত্বকে দেখা দেয় এক অস্বস্তিকর সমস্যা। যাদের ত্বক শুষ্ক, শীত এলে তাদের ত্বকে একটা টানটান অস্বস্তি, খড়ি ওঠার প্রবণতা ইত্যাদি দেখা যায়। হাত ও পায়ের পাতা অতিরিক্ত শুষ্ক হওয়ার কারণে ফাটতে শুরু করে। শীতের বাতাসে ঠান্ডাভাব ও আর্দ্রতার কারণে ত্বকের মতো চুলও রুক্ষ এবং খসখসে হয়ে ওঠে। শীতে চুলে খুশকি পড়তে বেশি দেখা যায়। যাদের ত্বক তৈলাক্ত, শীতে তাদের ত্বকে টান ধরলেও ভেতরের তৈলাক্ততা একটুও কমে না। বরং মরা ত্বকের ওপরে রোমকূপ বন্ধ হয়ে যায় এবং এর ফলে ব্রণের মতো দানায় মুখ ভরে যায়। শীতে ঠোঁট শুষ্কতা ও ফাটার প্রবণতাও দেখা যায়। এ সময় বয়স্ক বা পরিণত ত্বক চেনা খুবই কঠিন অর্থাৎ কোন্টি শুষ্ক, কোন্টি তৈলাক্ত আর কোন্টি স্বাভাবিক ত্বক, তা সহজে বোঝা যায় না। ত্বকের মাঝে এ সময় কালো কালো ছোপ দেখা যায়, ত্বক বেশি শুকিয়ে যায়। কাজেই শীত এলে সৌন্দর্য রক্ষায় ও ত্বক পরিচর্যার ব্যাপারে অনেক বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। খাবার-দাবারে নতুন মজা শীত মানে নতুন সবজির ছড়াছড়ি। এ সময় বাজার ভরে যায় মজাদার সব নতুন সবজিতে। ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, শিম, মটরশুঁটি, লাউ, টমেটো, মুলা, ধনেপাতা, পালংশাক, আরও কতো কী! ভাতের সঙ্গে মজাদার ব্যঞ্জনের বিভিন্ন উপকরণে বাজার সয়লাব হয়ে ওঠে। প্রথম অবস্থায় শীতের এসব শাকসবজি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে থাকলেও অনেকেই সময়ের সবজি সময়ে খাওয়াকে প্রাধান্য দেন। তবে সবজিতে আর এখন শীতের পুরনো গন্ধ খুঁজে পাওয়া যায় না। হাইব্রিড সবজি এখন বাজারের বড় একটা অংশ দখল করে আছে। তাছাড়া এসব সবজির উৎপাদনও বেশি। কিন্তু স্বাদের দিক থেকে কোথায় যেন বড্ড অমিল! এদেশে অবশ্য গ্রীষ্মের মতো বাহারি ধরনের শীতের ফল তেমন একটা নেই। ফলের মধ্যে কেবল বরই এবং  সিলেটের কিছু কমলা ওঠে বাজারে। বিভিন্ন ধরনের মাছও শীতকালে বেশি পাওয়া যায়। তবে নতুন গুড়ের ক্ষীর-পায়েস বেশ লোভনীয়। পিঠা-পুলির দিন পল্লীর নবান্নের উৎসবের আনন্দ শীতকালকে করে তোলে মধুময়। শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সবার মনে এক ভিন্ন আমেজের সৃষ্টি হয়। গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে পিঠা-পায়েস তৈরির ধুম পড়ে যায়। গ্রামবাংলায় পিঠা-পায়েসের আসর শীতকালেই বেশি জমে। এ সময় খেজুরের রস পাওয়া যায়। খেজুরের রস থেকে গুড়, পায়েস এবং নানা রকম মিষ্টান্ন তৈরি হয়। খেজুরের রসের মোহনীয় গন্ধে তৈরি পিঠা-পায়েস মধুময় হয়ে ওঠে। শীতকালে শুধু গ্রামবাংলায়ই নয়, শহর এলাকায়ও পিঠা খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। হিন্দু সমাজে যেমন নতুন ধানের নতুন চালে জমে ওঠে পৌষ-পার্বণ ও দেবতার নৈবেদ্য, মুসলমান সমাজেও তেমনি পিঠা-পায়েসের আনন্দ ফুটে ওঠে। শীতকালের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় পিঠা হচ্ছে ভাপা পিঠা। এছাড়া আছে কুলি পিঠা, চিতই পিঠা, দুধ চিতই, দুধ কুলি, পাটিসাপটা, ফুলঝুড়ি, ধুপিপিঠা, মালপোয়া, কন্যাভোগ, জামাইভোগ, তিলকুলি ইত্যাদি। শীত এলে শহর এলাকার বিভিন্ন ফুটপাতে, জনবহুল এলাকায়, বিভিন্ন টার্মিনালে ভাপা পিঠা বিক্রির ধুম পড়ে যায়। পাশাপাশি চিতই পিঠা, কুলি পিঠা, পাটিসাপটা ইত্যাদিও মাঝে মধ্যে বিক্রি হতে দেখা যায়। যদিও খোলামেলা স্থানে পিঠা তৈরি ও বিক্রি সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর, তারপরও এ ব্যবসা বিশেষ করে ভাপা পিঠা বিক্রি তখন বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথিক গরম গরম ভাপা পিঠার মোহনীয় গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে কিনে নিয়ে যান পরিবারের জন্য, আদরের সন্তানদের জন্য। শীতের সকাল কিংবা বিকালে ধোঁয়া ওঠা বিচিত্র সব পিঠার অপূর্ব স্বাদ এখনো আমাদের নস্টালজিয়ায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়। নাগরিক জীবনের ব্যস্ততায় গ্রামের সেসব বাহারি পিঠা বানানোর সুযোগ নেই। অবশ্য শহরে অনেক দোকানে ইদানীং বিভিন্ন ধরনের শীতের পিঠা কিনতে পাওয়া যায়। এক সময় সোনার বাংলায় যেমন শত শত নামের ধান ছিল, তেমনি সেসব ধানের পিঠারও অন্ত ছিল না। কতো কী বিচিত্র নামের পিঠা! আমাদের হাজারো সমস্যা সত্ত্বেও গ্রামবাংলায় এসব পিঠা-পার্বণের আনন্দ-উদ্দীপনা এখনো মুছে যায়নি। কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা শীতকালে আকস্মিক বৃষ্টি বা বর্ষার কোনো ভয় থাকে না। আত্মীয়স্বজন বেড়ানোর ধুমও বেশি পড়ে এই শীতে। শীত মানে হচ্ছে বাক্স-প্যাটরা বেঁধে বেরিয়ে পড়া। সবার অবশ্য তেমন সৌভাগ্য হয় না। তাছাড়া আমরা অতটা ভ্রমণবিলাসী জাতিও নই। কিন্তু পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষই কিন্তু ‘উইন্টার এনজয়মেন্ট’ বলতেই বোঝেন ভ্রমণ। বরফ, পাহাড়, দিনের পর দিন শূন্যের নিচের তাপমাত্রা এসব দমাতে পারে না তাদেরকে। আশপাশের দেশ বা মানুষ দেখতে বেরিয়ে পড়েন তারা। নির্দ্বিধায় দেশান্তরী হন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। ভ্রমণ মানুষের মনের জানালা খুলে দেয়। একসময় শীতকালে নিজের চেনা পরিবেশকে পেছনে ফেলে গ্রামে কিংবা মফস্বলে ছুটে যেতেন মানুষ। ছেলেমেয়েদের বার্ষিক পরীক্ষার তখন বাঁধা সময় ছিল। ফলে, নির্দিষ্ট সময়ের পর তারা দাদাবাড়ি, নানাবাড়ি যাবে, পিঠা-পায়েস খাবেÑ এসব নির্ধারিত ছিল। এখন সেই সময়টুকু করে উঠতে পারেন না অনেকে। শীতের সঙ্গে ভ্রমণের যে একটা সম্পর্ক আছে, তা বোঝা যায় শীতের অতিথি পাখিদের দেখলে। প্রতিবছরই শীত মৌসুমে অসংখ্য অতিথি পাখি ডানায় ভর করে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে আসে। আবার শীত চলে যাওয়ার পর গরম আসার মুহূর্তে এরা স্বদেশে ফিরে যায়। কে জানে এদের মনের মধ্যেও হারিয়ে যাবার বাসনা কাজ করে কিনা!   

বাংলা জীবনী সাহিত্যের ধারা

বাংলা জীবনী সাহিত্যের ধারা

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের এক বিরাট অংশে জুড়ে আছে জীবনী সাহিত্য। জীবনী সাহিত্য ধর্মীয় মহাপুরুষদের জীবনীর পাশাপাশি ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস, দর্শন, সমাজজীবন ও রূপকথা বিধৃত হয়েছে। জীবনী সাহিত্য ধারায় মহাপুরুষদের জীবনের অদ্যোপান্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে পাঠকগণ ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনার প্রয়াস পান। তাই মধ্যযুগের জীবনী সাহিত্যের গুরুত্ব অপরিসীম। মধ্যযুগের সাহিত্য ছিল মূলত ধর্মাশ্রিত। দেবদেবীর কথা, ধর্মকথা প্রচারই এ সাহিত্যের মূল লক্ষ্য। অনুবাদ সাহিত্যের মধ্যে কিছুটা মানবিকতা  থাকলেও তা  ধর্মের মোড়কে আবৃত। সুতরাং সে অর্থে মধ্যযুগে মৌলিক সাহিত্য রচিত হয়নি। কেবল সমগ্র মধ্যযুগে শ্রীচৈতন্যদেবের জীবন কে অবলম্বন করে রচিত জীবনী সাহিত্য একমাত্র মৌলিক সাহিত্য। তবে আধুনিক যুগে জীবনী সাহিত্য বলতে আমরা যেমন ব্যক্তিত্ববান মানুষের ভালো-মন্দ, দোষ-গুণ, ভুল-ভ্রান্তি, উত্থান-পতন প্রভৃতি বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রত্যাশা করি, মধ্যযুগের জীবনী সাহিত্যে তা প্রত্যাশা করা হবে নিরর্থক। তবে মধ্যযুগের প্রথানির্ভর সাহিত্যের মধ্যে মর্তের মানুষকে অবলম্বন করে জীবনী সাহিত্যের মতো একটি সাহিত্যের শাখা গড়ে উঠেছে এখানেই এ সাহিত্যের নতুনত্ব ও গুরুত্ব। বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগের গতানুগতিক ধারায় জীবনী সাহিত্য এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। এই জীবনী সাহিত্য শ্রীচৈতন্য দেব ও তার কতিপয় শিষ্যের জীবন কাহিনী নিয়ে এ জীবনী সাহিত্যের সৃষ্টি। তবে তার মধ্যে  চৈতন্য জীবনীই প্রধান। চৈতন্যদেব যে প্রেমধর্মের প্রতিষ্ঠা করে গেছেন-তাতে মানুষে মানুষে উঁচু-নিচু, হিন্দু-মুসলমান জাত বিভেদ ভুলে সবাই প্রেমমন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়েছে। ফলে তার শিষ্যগণ তার প্রেম ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে তার জীবনী নিয়ে আলোচনা করতেন, তা থেকেই এ জীবনী সাহিত্যের সূত্রপাত। মধ্যযুগের সাহিত্য যেহেতু ধর্মাশ্রয়ী সে অর্থে চৈতন্য জীবনী সাহিত্য এর প্রভাব মুক্ত নয়। কারণ চৈতন্যকে অনেকেই কৃষ্ণের অবতার হিসেবে বিবেচনা করছিলেন। তাই তার জীবনী কাব্য ভক্তিকাব্য হয়ে পড়েছে। চৈতন্যের ভক্তরা তাকে নবরূপী নারায়ণ হিসেবে বিবেচনা করতেন। তাই তার জীবনচরিতে ভক্তি মিশ্রিত হয়ে বস্তুনিষ্ঠতা হারিয়ে, জীবনী গ্রন্থ হয়েছে দেব-অবতারের মঙ্গলপাঁচালী। তবে তারা সে যুগের দেশ কাল উপেক্ষা করতে পারেনি। ফলে সে সময়ের সামাজিক, ভৌগোলিক অবস্থা এ সাহিত্য ফুটে উঠেছে।  চৈতন্য জীবনকারদের উদ্দেশ্য ছিল গৌড় সমাজে গৌরব প্রতিষ্ঠা করা। ফলে কাহিনীতে অলৌকিকতা এসেছে। তবে জীবনী সাহিত্যের বিশেষত্ব হচ্ছে, তারা সর্বপ্রথম মর্ত্যরে মানুষকে অবলম্বন করে সাহিত্য রচনা করেছেন। বাস্তব মানুষ সাহিত্যের উপজীব্য হয়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। জীবনে সাহিত্য দুই ভাগে বিভক্ত- সংস্কৃত জীবনী ও বাংলা জীবনী। চৈতন্যের প্রথম জীবনী রচনা হয় সংস্কৃত ভাষায়। নরহরি সরকার, রঘুনাথ দাস প্রমুখ কবিগণ চৈতন্যবিষয়ক পদ রচনা করেছেন। চৈতন্যের প্রথম জীবনী লেখক মুরারী গুপ্ত। তিনি চৈতন্য দেবের সমসাময়িক ছিলেন বিধায় অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। তার কাব্যের নাম শ্রীশ্রী কৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃত। কবি কর্ণপুর উপাধিধারী পরমানন্দ দাস সংস্কৃতে দুই খানি গ্রন্থ রচনা করেন-শ্রীচৈতন্যচন্দ্রোদয় নাটক ও শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত মহাকাব্য। চৈতন্য দেবের বাংলা জীবনীগুলো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালির জীবন, সমাজ ও সাধনা সম্পর্কিত অনেক মৌলিক ঐতিহাসিক তথ্য এসব গ্রন্থে বিধৃত হয়েছে। বাংলায় প্রথম চৈতন্য জীবনী লেখক বৃন্দাবন দাস। তিনি তার গুরু নিত্যানন্দের কাছ থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে কাব্যটি লিখেছেন। তার কাব্যের নাম শ্রীচৈতন্য ভগবত।  চৈতন্যদেবের জীবনকারদের মধ্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজের কাব্য নানাদিক থেকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে। তার কাব্যের নাম শ্রীচৈতন্যচারিতামৃত। আরও অনেক কবি চৈতন্যদেবের জীবন অবলম্বনে জীবনী সাহিত্য রচনা করেছেন। মধ্যযযোগের  জীবনী সাহিত্যের ইতিবাচক প্রভাব যেমন সমাজজীবনে পড়েছিল তেমনি সাহিত্যাঙ্গনও সমৃদ্ধ হয়েছিল। মধ্যযুগের কবিরাই সর্বপ্রথম জীবনী সাহিত্যের সূত্রপাত করেন। বাস্তব মানুষ কে অবলম্বন করে তারাই প্রথম জীবনী লেখেন। তার থেকে জীবনী সাহিত্যের সূত্রপাত। যার ফলে আধুনিক যুগের সাহিত্যকগণ জীবনী সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন এবং মহৎ মানুষের জীবনী রচনা করে সাহিত্যঙ্গনকে সমৃদ্ধ করছেন সেই সঙ্গে পাঠকগণ এ জীবনীগুলো পড়ে নিজের জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার প্রয়াস পাচ্ছে। 

শিল্পী লিওনার্দোর চিন্তার বক্রতা

শিল্পী লিওনার্দোর চিন্তার বক্রতা

চিন্তার বক্রতা কথাটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই এক প্রকার কূপমণ্ডূকতাসম্পন্ন কূটবুদ্ধিপ্রসূত চিন্তা বা মানসিক অবস্থার কথা প্রতীয়মান হলেও কিন্তু গতি ও অন্যান্য অনেক কিছুর মতো স্থানে ও কালে চিন্তা ও বক্রগতি সম্পন্ন বা বক্রগতি লাভ করার ধারণার কথাই মূলত ঘোষণা করা হচ্ছে। চিন্তার বক্রতার কারণেই জ্যোতিবিজ্ঞানের যাত্রা পথিক কোপার্নিকাসই প্রথম ভেবে নিয়েছিলেন পৃথিবী গোল, গ্যালেলিও ভেবে বের করেছিলেন সূর্য পৃথিবীর চারদিকে না ঘুরে পৃথিবীটাই সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। চিন্তার বক্রতা কাজে লাগিয়েই কূটনৈতিক ও রাজনীতিকরা অনেক অসাধ্য সাধন করেন। গোয়েন্দারা ও চররা এই প্রক্রিয়াকে বেশি ব্যবহার করেন। এটাকে কাজে লাগিয়ে তারা আবিষ্কার করে নিতে পারেন অনেক গোপন কথা। যেমন ধরে নেওয়া যেতে পারে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে কোনো ভাড়ার ঘোড়া পাওয়া যায় না। আপনি কখনো সমুদ্র সৈকতে যাননি। আপনার কয়েকজন বন্ধুর মধ্যে বুদ্ধিমান একজন কথা প্রসঙ্গে উদাহরণ টেনে ঘটনার বিবরণ দেওয়ার সময় বলে গেল- সে একবার এখানে ভাড়া ঘোড়ায় চড়ার সময় পড়ে যায়। এই কারণে যে ঘোড়ায় ওঠার জন্য ঝুলন্ত কোনো লাগামের ব্যবস্থা ছিলো না। সে সঙ্গে সঙ্গে আপনার দিকে তাকিয়ে আপনাকে দৃষ্টি আকর্ষণ সহকারে সাক্ষীসূচক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো - কেমন, তাই না? এতে হ্যাঁ বা না সূচক জবাব ও তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেই সেই চালাক বন্ধুটি আপনার অজান্তেই জেনে নিলো আপনি পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে গিয়েছেন কিনা। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির জীবন দর্শনটা প্রণিধানযোগ্য। এ মহান শিল্পী ছিলেন ফ্রান্সের এক গণিকার সন্তান। তৎকালীন ফ্রান্সের জাতীয় দর্শন, সামগ্রিক জীবনবোধ ও সামাজিক চিন্তাধারা এবং পরিস্থিতির কারণে এ সমস্ত গণিকালয়গুলোর স্থানান্তর ও উচ্ছেদ সাধনের ফলে তার মাকে নিয়ে খুবই সংকটেই পড়েছিলেন। এই বিপাকে যেখানে নিজেদের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা বা স্থায়িত্ব ছিলো না সেখানে এই পুত্র সন্তানকে নিয়ে কি করবে এবং তার নিরপরাধ শিশুর ভবিষ্যতের কথা ভেবে তার এক পরিচিত অবিবাহিত যুবক খদ্দের কাছে রেখে সেই গণিকালয় ত্যাগ করেন। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন ঐতিহাসিকের উক্ত মতামতকে আর বিশেষ জোর দিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা যা জানি, সেই এতিম বালক এসবের কিছুই জানতো না। তার পালক পিতা সেই অবিবাহিত চাকরিজীবী কর্মচারীটার বদলিতে তাকে রাখার সমস্যা হেতু একজন মুচির তত্ত্বাবধানে রেখে অন্যত্র চলে যান। মুচির সঙ্গে কাজ করতে করতে সে বেড়ে উঠতে লাগলো। অবসর সময়ে আড্ডা দিতো স্থানীয় বেকার যুবকদের সঙ্গে। এ শহরের কয়েকটি স্থানে যাতায়াতের সুবাদে পরিচয় হয় রকমারী পেশার ও বেকার যুবকদের সঙ্গে। তাদের কেউ ছিলো শিল্পপতির পুত্র, কেউ কেউ সংস্কৃতিমনা শিক্ষিত যুবক, ছাত্র ও বেকার। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের ফলে আর্ট কলেজের কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র গড়ে ওঠে। তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটে কোনো বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আর্ট কলেজগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতো ক্লাব, একাডেমি, সভা-সমিতির হল বা মিলন কেন্দ্র। আর্ট কলেজের নিয়মিত রুটিনমাফিক কার্যক্রম সমাপ্তির পর প্রায়ই শুরু হতো আড্ডা, সম্মেলন, সভা- সমিতির সেমিনার, কর্মশালা ইত্যাদি। এভাবে নানা আচার অনুষ্ঠান ও তার আর্ট কলেজে পড়ুয়া বন্ধুদের সঙ্গে নিত্যদিনকার আড্ডা ও যোগাযোগের ফলে কিছু অঙ্কনমুখী চিন্তাধারার উন্মেষ ও বিকাশ লাভ করতে থাকে কিশোর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির ভিতর। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, এভাবে সে ২৪ বছর বয়সে সেই আর্ট কলেজে পড়ুয়া তার একজন বান্ধবীকে প্রেম নিবেদন করলে মেয়েটা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে বলে যে, মাতৃপিতৃ পরিচয়হীন ও ঠিকানাবিহীন কোনো ছেলেকে একজন অভিজাত কুলবংশের যুবতীর প্রেম ও পাণি গ্রহণ কোনোদিন কোনো সময় সম্ভব নয়। এই প্রত্যাখ্যানে লিওনার্দো মনে প্রচন্ড আঘাত পায়। হয়তো জীবনের প্রতি এভাবেই তার একটা বিকৃত মনোভাবের উদয় হলো। পরবর্তী পর্যায়ে ভিঞ্চির বিবাহ বর্জনসহ ভবঘুরে জীবন ও চিন্তাধারা সবকিছুতেই তার ত্যাগের একটা চরমপন্থী মনোভাব প্রমাণ করে। কেননা ইচ্ছা করলে এই মহাপুরুষ এতো উত্থান ও পতনের মধ্য দিয়েও বস্তুগত ও পার্থিব বা ন্যূনতম আর্থিক সমৃদ্ধি প্রদর্শন করে যেতে পারতেন। এভাবে এক পর্যায়ে পালক পিতার প্রত্যাখ্যান, বন্ধুমহলের বিদ্রুপ ও উপেক্ষা, সমাজের মননহীন অবিবেচনা ও প্রতিভা বিকাশের বাধা বা অবমূল্যায়ন, প্রেম প্রত্যাখ্যান এসব মিলে তা ব্যথা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে এবং সে হয়ে পড়ে গভীর চিন্তাশীল। বারবার ভিঞ্চি তার প্রতিভা বিকাশের চেষ্টা করে। পূর্বেকার ফ্রান্সের সমাজের মানুষগুলোর সামগ্রিক মানসিক গঠন বা মননশীলতার স্তর আজকের মতো এমন উঁচুস্তরে ছিলো না যে তাকে গ্রহণ করবে, যে কিনা একজন পতিতার পুত্র। ঐ সময়কালীন একটা অবস্থা নিশ্চয়ই পেরিয়ে এসেছে সমাজ তার গতিশীলতার মধ্য দিয়ে। শিল্প জগতে তার বন্ধুরা তার সাহচর্য ও সহযোগিতার হাত ধরে তাকে খাটিয়ে নিতেও কার্পণ্য করতো না। যা হোক এটা ভালো ছিলো তার জন্যে। এভাবে তিনি সাহিত্য ও শিল্পজগতের সংস্পর্শে এসে একজন ক্ষুদে ব্যবসায়িক শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এতে জীবিকা নির্বাহ হলেও তার পুরো প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। অল্প বয়েসী এ কিশোর সদা ভাবত ও অভিভূত হতো যে, তার লেখা বা চিত্র উচ্চমানসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও সমাজে তার কোনো সঠিক মূল্যায়ন হতো না বা প্রশংসা পেতো না। সে যাই হোক এভাবে তার শিল্পযাত্রায় বুৎপত্তি ও উচ্চ মার্গের অভিপ্রায় দেখে অনেকে নীরবে হাসতেন। তার বন্ধু-বান্ধীদের অধিকাংশই তাকে তার এই প্রয়াস দেখে ঠাট্টা বা ইয়ার্কি করতে সামান্যতম দ্বিধাগ্রস্ত হতো না। এতে করে মানুষ সম্পর্কে তার এক অদ্ভুত ও ভিন্নধর্মী ধারণা জন্ম নেওয়াই অস্বাভাবিক কোনো কিছু নয়। যা হোক মানব চরিত্র, বিরূপ সমাজ বা জীবন এবং অন্যান্য পারিপার্শ্বিক পরিবেশগত কারণে যে বদ্ধমূল ধারণা তার মনে জন্ম নিতে থাকুক না কেনো তিনি যে অতি উচ্চমানের মননশীল ব্যক্তি ছিলেন তা আজ স্পষ্ট প্রতীয়মান। হতে পারে এটি সমাজের সামগ্রিক মননশীলতার পশ্চাদপদতা যার কারণে প্রচন্ড প্রতিভাবান ও ব্যক্তিত্বশালী হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার প্রতিভার যোগ্য স্বীকৃতি পাননি। এভাবে মনে হয় তার ঊনত্রিশ বছর বয়সের দিকে থাকিয়ে তিনি নিজেই বুঝতে পারেন যে, তার জন্মসূত্রে কোনো দোষ রয়েছে। অর্থাৎ তিনি একজন গনিকার ছেলে বলেই তার সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও প্রতিভার স্বীকৃতির ক্ষেত্রে এতো অন্তরায়। খুব সম্ভবত সেই সময়েই তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, তিনি পিতৃহীন নন, কারণ পিতৃহীন ছেলে জন্ম দিতে পারে না। তিনি মাতৃহীন নন, মাতাহীন শিশু জন্ম নিতে পারে না। তিনি পরিচয়হীন নন। যেভাবে হোক মাতৃপরিচয় বের করতে হবে। তিনি তার যাবতীয় কর্মকাণ্ড ও উদ্দেশ্য নিবদ্ধ করেন তার মাতৃপরিচয় অন্বেষণে। এই কাজটিই তখন তার জীবনের প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মাতৃপরিচয় উদ্ধারে তিনি ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন চষে বেড়ান। জীবিকা নির্বাহের জন্যে পেশাজীবী শিল্পীর কাজও তাকে করতে হতো। এভাবে দেশান্তরিত শিল্পী জন্মস্থানের বন্ধুবান্ধবদের অবজ্ঞা ও তার সহজসরল স্বাতন্ত্র্যকে যেভাবে উপহাস করা হয়েছে সেই অভিমান ও গ্লানির কথা ভেবেই খুব সম্ভবত দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে অবস্থান নেন ও প্রবাস জীবনকেই শ্রেয় মনে করেছিলেন হয়তো। যা হোক প্রচন্ড মানসিক চাপ, আত্মগ্লানি, অভিমান, ক্ষোভ, ব্যর্থতা ইত্যাদি মিলিয়ে যখন সে হারিয়ে যাচ্ছিলো অবক্ষয়ের অতলান্তে, এ সময় তার চিন্তায় খেলে গেলো বিদ্যুতের এক ঝলক। উদয় হলো নতুন এক বোধ। উন্মেষ হলো নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গির। তখন তার বয়স হয়েছিলো পঁয়তাল্লিশ বছর। তিনি ভাবলেন যে, মাতৃহীন পরিচয়ের অভাবে তিনি নিগৃহীত হয়েছেন, যার কারণে তার অবমূল্যায়ন হয়েছে। সেই একমাত্র মাতৃপরিচয় উদ্ধারের জন্যে মায়ের খোঁজে যদি তিনি গোটা পৃথিবী তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকেন তাহলে মাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি ভাবলেন, তার মাকে খুঁজে পেতে পারেন একমাত্র তার অবয়বের মধ্যেই। তিনি নিজের বয়স হিসাব করে চিন্তা করলো তার মা যৌবনে যুবতী বয়সে যদি তাকে জন্ম দিয়ে থাকে তাহলে এতোদিন তিনি বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। ভিঞ্চির এই বক্র চিন্তার কথা কেউ জানে না। ঘটনাটি দাঁড়ায় এরকম-ভিঞ্চি যা চিন্তা করে তা কেউ জানে না, আর ভিঞ্চি সম্পর্কে লোকে যা জানে তা ভিঞ্চি জানে না। যা হোক, তিনি আবার ফ্রান্সে ফিরে এসে তৈলচিত্র প্রদান যুবতীর প্রতিকৃতি আঁকতে শুরু করেন। পুরনো বন্ধুরা ভিঞ্চির মনে আবার নব যৌবনের উদ্রেক হয়েছে বলে কৌতুক করতেও ছাড়েনি। অনেকে কৌতূহলবশত তার প্রবাসের সম্ভাব্য স্থানগুলোতে খোঁজখবর নিয়ে দেখলেন লিওনার্দোর আঁকা ছবিতে প্রতিকৃত মেয়েটি কে? কেউ মন্তব্য করলো নতুন প্রেমিকা, ভ্রষ্টা ইত্যাদি মিলিয়ে। অপবাদ ও অপমানের শেষ সীমা ছাড়িয়ে যেতে থাকলো। আর এই অপবাদের শেষ সীমা পেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার তীব্র চেতনা ও ক্ষুরধার অনুভূতির পরিমাণও বেড়ে যেতে থাকে। (এই ব্যাপারটাকে ক্রিয়ার সম্প্রতিক্রিয়ার বিধিতে মেনে নেওয়া যায়)। এই তীব্র ভাবাবেগকে তিনি তার ক্ষেত্রে প্রকাশ করলেন। শিল্পীদের দৃষ্টি ভিন্ন। আমরা যা যেভাবে দেখি শিল্পীরা তা সেভাবে দেখে না। তারা দেখেন অন্যভাবে। তিনি তার যুবক বয়সের অবয়ব অনুকরণে মেয়েলী প্রতিকৃতি আঁকতে শুরু করেন। তার নিজের যৌবনের বাহু, ঘাড়, মাথা প্রভৃতি রমনীয় ঢং-এ আঁকতে শুরু করেন। অর্থাৎ তিনি মেয়ে হলে শারীরিক গঠন ও আকৃতি যেমন হতো শিল্পের প্রকরণের মাধ্যমেই তিনি সেভাবে তার শারীরিক কাঠামোর অনুকরণে তার মাতৃরূপটি ফুটিয়ে তোলেন। বাহু পুরুষদের না হয়ে মেয়েলী হলে নিশ্চয়ই শিরাবিহীন মাংশল হতো। গ্রীবা হতো ভরাট। চোখের কোটর হতো কটন, আংগুল হতো মাংশল, চুল হতো লম্বা। মুখমণ্ডল হতো দাড়ি বা গোঁফ বর্জিত। তার স্বল্প কুঞ্চিত কেশরাশি হতো ঢেউ খেলানো জলতরঙ্গ। এভাবে এক সুন্দরী তরুণীর ছবি আঁকতে গিয়ে শিল্পীকে নানা মানসিক নির্যাতন, কৌতুক, কৌতূহল, ঔৎসুক্য, বিদ্রƒপ ইত্যাদি কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে অবিরত। তবুও তিনি ছাড়েননি এ মত ও পথ।

কবিদের কারাবাস

কবিদের কারাবাস

অনেক সময়ই রাষ্ট্রের চিন্তাশীল মানুষ কিংবা স্বাধীনচেতা কবিদের ক্ষমতাধর শাসকগোষ্ঠী, রাজা বা শোষকদের নিষ্ঠুর বৈরিতা এবং রক্তচক্ষের মোকাবিলা করতে হয়। বাংলা সাহিত্যের বহু সুপরিচিত কবি আছেন, যাদের লেখনীর কারণে তাদেরকে শিকার হতে হয়েছে নানা অন্যায় ও জুলুমের। এমনকি অনেককে কারাবাস ভোগ করতে হয়েছে। তবুও সকল রকম শোষণের বিরুদ্ধে নির্ভীক ছিল তাদের কণ্ঠস্বর। ॥ এক ॥ সপ্তদশ শতকের প্রথম দশকে আলাওলের জন্ম। তিনি ছিলেন ফরিদপুরের ফতেয়াবাদ পরগণার জালালপুরের অধিপতি মজলিস কুতুবের একজন মন্ত্রীর পুত্র। ড. মুহম্মদ এনামুল হক চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার জোবরা গ্রামে আলাওলের জন্ম বলে মনে করেন। কিন্তু কবির নিজের উক্তি অনুসারে ফরিদপুরের জালালপুরেই তাঁর জন্ম এবং এ সিদ্ধান্তই পণ্ডিতগণ গ্রহণ করেছেন। পিতাপুত্র জলপথে পরিভ্রমণ কালে পর্তুগিজ জলদস্যু কর্তৃক আক্রান্ত হন। এর ফলে, পিতার জীবননাশ হয় এবং আলাওল আরাকানে আশ্রয়লাভ করেন। প্রথমে আরাকান রাজের অশ্বারোহী সৈন্য বিভাগে রাজদেহরক্ষী পদে আলাওল নিযুক্ত হন।সঙ্গীতনৈপুণ্য ও কবিত্বগুণের জন্য আলাওল সৈন্যবিভাগ থেকে খোদ মিন্তারের অমাত্য সভায় কবির আসনে অধিষ্ঠিত হন। অতঃপর ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে সোলেমানের আদেশে দৌলত কাজীর অসমাপ্ত সতীময়না আলাওল সম্পূর্ণ করেন। ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে সপ্তপয়করের আত্মজীবনী রচনাকালে শাহজাদা শাহ সুজার সঙ্গে কবির ঘনিষ্ঠতা হয়। সপ্তপয়করের আত্মজীবনী বৃত্তান্তের অংশে আরাকানে শাহ সুজার আশ্রয় গ্রহণের উল্লেখ আছে ‘দিল্লিশ্বর বংশ আসি/যাহার শরণে পশি/তার সম কাহার মহিমায়’ এ গ্রন্থ রচনায় কবির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন আরাকান রাজের সমরসচিব সৈয়দ মুহাম্মদ খান। এই গ্রন্থে সংক্ষেপে অথচ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলাওল চন্দ্র-সুধার্মার রাজত্বের বর্ণনা করেছেন। রাজনামাঙ্কিত মুদ্রায় যে স্বর্ণময় রাজপ্রাসাদের উল্লেখ পাওয়া যায়, এখানে তার বর্ণনা আছে। ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে শাহ সুজা নিহত হন। ইতোমধ্যে ঘটে গেছে আলাওলের ভাগ্যবিপর্যয়। বিশ্বাসঘাতক শাহ সুজার সঙ্গে কবি আলাওলের ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে রাজদরবারে মৃজা নামক এক রাজ-অনুচর কবির নামে রাজদ্রোহিতার অভিযোগ আনেন। এর ফলে, কবি পঞ্চাশ দিনের কারাবাস যন্ত্রণা ভোগ করেন। পরে অভিযোগ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হওয়ায় আলাওল মুক্তি পান এবং মৃজা দণ্ডিত হন। কিন্তু আলাওল রাজসভায় আর পূর্বসমাদর ফিরে পেয়েছিলেন বলে মনে হয় না। তবে পূর্বোক্ত ঘটনার এগারো বছর পর মজলিস নবরাজের সহায়তায় কবির ভাগ্যোদয় হয়েছিল বলে জানা যায়। আলাওল ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।