ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১৮ চৈত্র ১৪৩১

সাহিত্য

সাহিত্য বিভাগের সব খবর

গাক এনজিওতে বিশাল নিয়োগ

গাক এনজিওতে বিশাল নিয়োগ

গ্রাম উন্নয়ন কর্ম সংস্থাটির চলমান মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচিতে নিম্নবর্ণিত পদে জনবল নিয়োগের জন্য আগ্রহী প্রার্থীদের কাছ থেকে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়েছে। ১. পদের নাম: সিনিয়র শাখা ব্যবস্থাপক। পদ সংখ্যা: ২৫টি। মাসিক বেতন: সাকল্যে ৪৮,৬০৯/- (বিভিন্ন ভাতাসহ)। অতিরিক্ত সুবিধা: লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ভিত্তিতে ২৪,০০০-৩৩,০০০/- পর্যন্ত ইনসেনটিভ এবং বিনামূল্যে আবাসন সুবিধা। শিক্ষাগত যোগ্যতা: স্নাতকোত্তর/ সমমান/ স্নাতক। অভিজ্ঞতা: জাতীয় পর্যায়ের ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানে শাখা ব্যবস্থাপক পদে কমপক্ষে ৩ বছরের অভিজ্ঞতা। বয়স সীমা: সর্বোচ্চ ৪০ বছর। ২. পদের নাম: সিনিয়র ফিল্ড অফিসার। পদ সংখ্যা: ১০০টি। মাসিক বেতন: সাকল্যে ৩৫,৩৬০/-। অতিরিক্ত সুবিধা: ইনসেনটিভ ১৬,০০০-২২,০০০/- পর্যন্ত এবং বিনামূল্যে আবাসন সুবিধা। শিক্ষাগত যোগ্যতা: স্নাতক/সমমান। অভিজ্ঞতা: মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচিতে ন্যূনতম ৫ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা। বয়সসীমা: সর্বোচ্চ ৩৫ বছর। ৩. পদের নাম: ফিল্ড অফিসার। পদ সংখ্যা: ৪০০টি। মাসিক বেতন: ১৮,০০০/- (প্রশিক্ষণকাল, ৬মাস)। নিয়মিত হলে বেতন: সাকল্যে ৩০,০২২/-। অতিরিক্ত সুবিধা: ইনসেনটিভ ১৬,০০০-২২,০০০/- পর্যন্ত এবং বিনামূল্যে আবাসন সুবিধা। শিক্ষাগত যোগ্যতা: স্নাতক/সমমান। বয়সসীমা: সর্বোচ্চ ৩৫ বছর। ৪. পদের নাম: জুনিয়র ফিল্ড অফিসার। পদ সংখ্যা: ১৫০টি। মাসিক বেতন: ১৬,০০০/- (প্রশিক্ষণকাল, ৬ মাস)। নিয়মিত হলে বেতন: সাকল্যে ২৮,০২৫/-। অতিরিক্ত সুবিধা: ইনসেনটিভ ১৬,০০০-২২,০০০/- পর্যন্ত এবং বিনামূল্যে আবাসন সুবিধা। শিক্ষাগত যোগ্যতা: এইচএসসি/সমমান। বয়সসীমা: ২৫-৩৫ বছর। ৫. পদের নাম: অ্যাসিস্ট্যান্ট অডিট অফিসার। পদ সংখ্যা: ১০টি। মাসিক বেতন: ১৮,০০০/- (প্রশিক্ষণকাল, ৬ মাস)। নিয়মিত হলে বেতন: সাকল্যে ২০,৪৪৩/-। শিক্ষাগত যোগ্যতা: স্নাতকোত্তর (অগ্রাধিকার এমকম/এমবিএস)। বয়সসীমা: সর্বোচ্চ ৩৫ বছর। ৬. পদের নাম: অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাকাউন্টস অফিসার। পদ সংখ্যা: ৫০টি। মাসিক বেতন: ১৮,০০০/- (প্রশিক্ষণকাল, ৬ মাস)। নিয়মিত হলে বেতন: সাকল্যে ২৫,৫২২/-। অতিরিক্ত সুবিধা: ইনসেনটিভ ১৬,০০০-২২,০০০/-। পর্যন্ত এবং বিনামূল্যে আবাসন সুবিধা। শিক্ষাগত যোগ্যতা: ন্যূনতম বিকম/বিবিএস। বয়সসীমা: সর্বোচ্চ ৩৫ বছর। বিস্তারিত জানুন: www.guk.org.bd আবেদনের শেষ সময়: ১০ এপ্রিল ২০২৫।

টার্ডিগ্রেড

টার্ডিগ্রেড

পৃথিবীতে অজানা অনেককিছুই আছে। আছে এমনও কিছু প্রাণী যা আমরা খালি চোখে দেখি না বা আমাদের চোখে ধরা দেয় না। এমনও কিছু প্রাণী আছে যেগুলো আমাদের ধারণারও বাইরে। এরকমই এক বিস্ময়কর প্রাণী ‘টার্ডিগ্রেড’। আল্লাহ তায়ালা এই প্রাণীর ভেতর এমন একটা ক্ষমতা বা গুণ দিয়েছেনÑ বিজ্ঞানীদের ধারণা, পৃথিবী যদি অন্যান্য প্রাণীর বসবাসের অনুপযুক্ত হয়েও যায় তবু টিকে থাকতে পারে টার্ডিগ্রেড। অদ্ভুত এই ক্ষুদ্র প্রাণী মাত্র আধ সেন্টিমিটার লম্বা। টার্ডিগ্রেড দেখতে অদ্ভুত চেহারার। এর রয়েছে আটটি পা। তাতে আবার নখঅলা থাবাও আছে। এদের দেখলে মনে হয় এটা এক ধরনের পতঙ্গ বা ইনসেক্ট। কিন্তু আসলে তারা ‘ওয়ার্ম’ বা কেঁচো-শুঁয়োপোকা জাতীয় প্রাণীর কাছাকাছি একটি প্রাণী। এদের বলা হয় ‘ওয়াটার বিয়ার’ বা ‘পানির ভালুক’। এরা পানিতে ভাসমান থাকে। এই প্রাণীটির কথা সর্বপ্রথম জানা যায় ১৭৭৩ সালে । ১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা পর্যন্ত সহ্য করতে পারে টার্ডিগ্রেড। এদেরকে পাওয়া যায় পুকুরে শুকিয়ে যাওয়া উদ্ভিদের মধ্যে। ৩০ বছর খাদ্য বা পানীয় ছাড়াও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে বলেও ধারণা গবেষকদের। এই অতিক্ষুদ্র প্রাণীটি তেজস্ক্রিয়তা, অতিমাত্রায় ঠাণ্ডা, চরম পানিশূন্যতা থেকে শুরু করে মহাশূন্যেও টিকে থাকতে পারে। তাছাড়াও এটি শূন্য ডিগ্রি থেকে হাজার ডিগ্রি তাপমাত্রায় বেঁচে থাকে। এমনকি এটি মহাশূন্যেও বেঁচে থাকতে পারে। গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে, যদি এই প্রাণী খাদ্য না পায় তবে এর শারীরিক প্রক্রিয়া অনেকটাই স্থির হয়ে যায় যা একে বহু বছর বিনা আহারে বাঁচিয়ে রাখে। এদের ডিএনএ সম্পর্কে গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে পিএলওএস বায়োলজি নামের একটি সাময়িকীতে। এতে উঠে এসেছে, পৃথিবীতে যত রকম মহাজাগতিক দুর্যোগ ঘটতে পারে তার প্রায় সবগুলোই মোকাবিলা করে টিকে থাকার ক্ষমতা আছে এই টার্ডিগ্রেডের।

মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা

মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা

অনেক বীর ও বীরাঙ্গনার ত্যাগে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা। কোনো কালেই কোনো দেশে স্বাধীনতা বিনা চেষ্টায় বা বিনা ত্যাগে আসেনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও অনেক মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। অনেকে আবার হয়েছেন পঙ্গু। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গ করা এমনি একজন বীরশ্রেষ্ঠ’র গল্প আজ আমি তোমাদের শোনাব। তিনি ১৯৭১ সালের শেষদিকে সদ্য গঠিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর গানবোট পলাশের ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার মো. রুহুল আমিন। বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন ১৯৩৫ সালের জুন মাসে নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার বাঘপাচরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আজহার পাটোয়ারী এবং মাতার নাম জোলেখা খাতুন। কিন্তু পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে তিনি হাইস্কুল পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। তিনি ১৯৫৩ সালে জুনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যোগ দেন। করাচির অদূরে আরব সাগরে অবস্থিত পিএনএস বাহাদুরে সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করেন। পরবর্তী কর্মজীবনে তিনি ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি চট্টগ্রামে পাকিস্তান নৌবাহিনীর ঘাঁটি পিএনএস বখতিয়ারে কর্মরত ছিলেন। পরে নৌঘাঁটি থেকে পালিয়ে তিনি মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বাধীন ২নং সেক্টরে স্থলযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এরপর ১৯৭১ সালের শেষদিকে ভারত থেকে প্রাপ্ত দুটি গানবোট পদ্মা ও পলাশ দিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠিত হলে তিনি পলাশের ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার পদে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে যশোর সেনানিবাসের পতন হলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পদ্মা ও পলাশ ও ভারতীয় নৌবাহিনীর প্যানভেল গানবোট তিনটি ৭ ডিসেম্বর মোংলা থেকে রওনা দেয় পাকিস্তানি নৌঘাঁটি পিএনএস তিতুমীর দখলের উদ্দেশ্যে নিয়ে। রূপসা নদীতে গানবোট তিনটির যাত্রাকরে রূপসা ফেরিঘাটের কাছে আসতেই আকাশে উড়ে আসে তিনটি জঙ্গী বিমান। রুহুল আমিনসহ কয়েকজন বাঙালি নৌসেনা জঙ্গি বিমান তিনটিকে বিমান বিধ্বংসী কামান দিয়ে গুলি করতে চাইলেন। কিন্তু প্যানভেলের ভারতীয় কমান্ডার জানালেন যে ঐ বিমানগুলো ভারতীয়। তিনি গুলি করার অনুমতি দিলেন না। হঠাৎ জঙ্গি বিমানগুলো খুব নিচু দিয়ে উড়ে এসে প্রথমে পদ্মা এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পলাশের ওপর বোমাবর্ষণ করে। ভারতীয় কমান্ডারের নির্দেশে অনেক নৌসেনা যুদ্ধ না করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে জীবন রক্ষা করেন। কিন্তু ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার মো. রুহুল আমিন কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে এই বিমান হামলা প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। কিন্তু বোমা বর্ষণে ইঞ্জিন রুমে আগুন ধরে গেলে তিনি আহত অবস্থায় রূপসা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোনোক্রমে নদীর পূর্ব পাড়ে ওঠেন। কিন্তু সেখানেও তার জন্য অপেক্ষা করছিলো দুর্ভাগ্য। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তান সেনারা তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৯৭১ সালের  ১০ ডিসেম্বর শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন। বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন বাংলাদেশকে ভালোবেসে, এ দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের অমূল্য প্রাণ বিসর্জন দিয়ে গেছেন। তিনি যে স্বাধীন, সার্বভৌম, জনকল্যাণকর ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আত্ম-বিসর্জন করেছেন, আমরা যেন সেই লক্ষ্যটি ভুলে না যাই। ভুলে না যাই বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনসহ নাম জানা ও না জানা সব শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের কথা।

রাশি রাশি ঈদের খুশি

রাশি রাশি ঈদের খুশি

জাফরুল আর অসির দুই বন্ধু। তারা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। দু’জনেই খুব ভালো ছাত্র। তাদের মধ্যে খুব প্রতিযোগিতা হয় লেখাপড়া নিয়ে। কেউ হাল ছাড়বার পাত্র নয়। শুধু লেখাপড়াতেই নয় আচার-আচরণেও তারা খুব ভালো। তাদের গুণের প্রশংসা সকল শিক্ষক ও প্রতিবেশীদের মুখেমুখে। তারা একজনকে ছাড়া অন্যজন চলে না। খেলাধুলাও দু’জন একসাথেই করে। কিন্তু একটা বিষয়ে দু’জনের মধ্যে দূরত্ব। জাফরুলের বাবা সরকারি কর্মকর্তা। অন্যদিকে অসির বাবা দরিদ্র, ভ্যান চালিয়ে সংসার চালায়। তাই অন্য সব বাবাদের মতো ছেলে-মেয়েদের জামাকাপড় এবং পড়ালেখার খরচাপাতি বহন করতে পারে না। আর্থিক অনটনের কারণে অসি ঠিকমতো পোশাক তৈরি করে পরতেও পারে না। সাথের বন্ধুরা নতুন নতুন পোশাক পরে আর অসি তাদের পোশাকের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তার মনের আকাশে যেনো মেঘ জমেই থাকে। ক’দিন পরেই ঈদ। অসির বাবা অনেক চিন্তিত, কেমনে ঈদের বাজার সওদা করবে, রোজার দিনে তেমন ভ্যান চালানো সম্ভব হয় না রোজা থেকে। এদিকে দ্রব্যমূল্য বাড়াতে যা আয় রোজগার হয় তা দিয়ে পেটের খাবারই জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়। ঈদের মধ্যে তো ছেলে-মেয়েকে নতুন একখান করে জামা দিতেই হয়, এক বছর হলো তাদের নতুন পোশাক দিতে পারেনি। ঈদের মধ্যে দেয়া হবে এই আশা দিয়ে রেখেছে। এসব ভাবনায় অসিরের বাবা খুবই অস্থির হয়ে উঠছে। অসিরও আশায় আছে ঈদের আগে তার বাবা নতুন পোশাক কিনে দিবে এজন্য মনের ভিতরে তার নীরব খুশির বাতাস বইছে। খুশিতে সে মাঝে মাঝে তার বাবার অনেক কাজের সহযোগিতাও করে চলছে। ঈদের আর মাত্র দু’দিন বাকি আছে। অসির নতুন পোশাক কেনার খবর নেই। সে তার বাবাকে বলছে বাবা কবে কিনে দিবে আমার নতুন পোশাক? বাবা মনে কষ্ট নিয়ে বলে দেখি বাবা কী করা যায়। এই বলে সে কষ্টের বোঝা বুকের মধ্যে বয়ে চলে। জাফরুলের নতুন পোশাকের অভাব নেই, আর থাকবেই বা কেনো! বাবা সরকারি চাকরিজীবী, সংসারের অবস্থাও অনেক ভালো। কোনো কিছুর অভাব নেই তাদের। সব সত্ত্বেও জাফরুলের মনে কোনো অহংকার নেই। সে ইফতারের আগে অসিরকে বাসায় ডেকে এনে বলছে, ‘অসির আজ তুই আমাদের বাসায় ইফতার করে যাবি।’ অসির সংকোচ বোধ করে বলে, ‘না না,  আমি বাড়ি গিয়েই ইফতার করব। তুই কি জন্য ডেকেছিস ঝটপট বলে ফেল দেখি।’ জাফরুল বেদরকারি কথা বলে শুধু সময় পার করছে যাতে ইফতারের সময় হয়ে আসে। এদিকে জাফরুলের মা চটজলদি বাড়ির কাজের মেয়ের সাথে নানা পদের ইফতার তৈরি করছে। জাফরুলের মা-বাবা ও অসিরকে খুব আদর করে ভালো ও মেধাবী ছেলে হিসেবে। ‘ঈদ তো এসেই গেলো তবে ঈদের জন্য কি তোর বাবা নতুন পোশাক কিনে দিয়েছে?’ বললো জাফরুল। অসির হতাশা চেপে কষ্ট নিয়েই উত্তর দেয়, ‘না রে, গরীবের ঈদের চাঁদ সবসময় মেঘেই ঢাকা থাকে! বাবা কিনে দিবে বলেছেন। তবে না দিলেও কষ্ট নেই।’ এই বলে এক ঝলক কষ্টমাখা হাসি অসিরের সামনের দাঁতের উপরে ফোটে। জাফরুল বুঝতে পারে এটা তার অন্তরের হাসি নয়। দায়সারা হাসি মাত্র। যাক সে তো তার বাবা-মা’য়ের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেই অসিরকে বাসায় ডেকে এনেছে। ইফতার করেই জাফরুলের বাবা-মাসহ অসিরকে সাথে নিয়ে বাজারে গিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে। ইফতার করে জাফরুলের বাবা বলে অসির চলো তো বাজারে যাই আমাদের একটু বাজার করার কাজ আছে, তুমি একটু সাথে থাকলে ভালো হয়। বাজারের কাজ শেষ করে আমি নিজেই তোমাকে তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসব। আর কাল চাল ডাল অনেক কিছু কিনতে হবে সে জন্য তোমার বাবার ভ্যান গাড়িটাও নিয়ে আসতে বলব। অসির মাথা নিচু করে রাজি হয়ে তাদের সাথে বাজারের যায়। জাফরুলের বাবা ইমরান সাহেব পোশাক দেখতে শুরু করে। একই রঙের দু’টো পাঞ্জাবি দেখে ইমরান সাহেব। অসির মনে মনে বুঝতে পারে জাফরুলের বাবা হয়তো তাদের দুজনের জন্যই পছন্দ করেছেন। অসিরের মনে খুশির ঢেউ বইতে শুরু করেছে। জাফরুলের বাবা ইমরান সাহেব পাঞ্জাবি-পায়জামা, চামড়ার জুতো কিনে দিয়ে অসিরের হাতে তুলে দেয়। অসির নিতে না চাইলেও হাতে করে ধরে রাখতে বলে। এরপর ইমরান সাহেব অসিরের বাবা-মা’য়ের জন্য নতুন পাঞ্জাবি ও শাড়ি কিনে নিজের হাতেই রেখে বলে, ‘এবার চলো বাবা।  তোমাকে তোমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমরা বাড়ি যাব।’ এই বলে দুটি রিক্সা যোগে ইমরান সাহেব অসিরদের বাড়ি যায়। ইমরান সাহেবকে দেখে অসির বাবা-মা চমকে উঠেন! তারা খুব খুশি হয়ে শোয়ার ঘরের খাটের উপরে বসতে দেয় এবং চা-নাস্তার ব্যবস্থা করতে শুরু করে। ইমরান সাহেব ও তার স্ত্রী বলে, ‘না না, আমরা কিছুই খাব না। এখনই চলে যাব। কাল আপনি সকালে  ভ্যান গাড়িটি নিয়ে বাজারে থাকবেন। আমি চাউলের বস্তাসহ আরো কিছু বাজার-সওদা করবো- সেগুলি বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবেন।’ এই বলে ইমরান সাহেব তার হাতে থাকা জামা-কাপড়ের ব্যাগটি অসিরের হাতে দিয়ে বলেন, ‘এই ব্যাগটা রাখুন। আর এই যে ধরুন, এখানে কিছু  টাকা আছে। এই টাকা দিয়ে ঈদের খরচাপাতি করে সবাই আনন্দ করে ঈদ করবেন!’ এই বলে তারা বেরিয়ে পড়লেন। অসির বাবা-মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে। তাদেরকে অনেকটাই নির্ভার লাগছে। হ্যাঁ, এবার ঘন মেঘের পর্দা ফুঁড়ে সত্যিকারের ঈদ নেমে আসছে অসিরদের বাড়িতে।

এই যে বেঁচে আছি

এই যে বেঁচে আছি

তিরিশ বছর চার মাসের সম্পর্ক ছিন্ন করে রাত্রির চলে যাওয়া আমার জীবনে স্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। না। প্রথম প্রথম মন খারাপ হয়ে নিজের আবর্তে ঘুরপাক খেতাম। তারপর থেকে বুঝতে পারি এটাই স্বাভাবিক, আমাকে বাস্তব মেনে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। এইতো আমার নিয়তি। দুই ছেলেমেয়েকে বড় করে তুলতে হবে। নিজেও ভালো থাকার চেষ্টা করতে হবে। তারপর আলো-আঁধার, ঝরাপাতার ক্রন্দন, ঝড় অতিক্রম শেষে দিনযাপনকে উপভোগ করতে শিখি। ছোট বেলা থেকে একেক করে কতজনকে হারিয়েছি। বাবা চলে গেছেন, আত্মীয়স্বজন কত মানুষেরা অনন্তের উদ্দেশে যাত্রা করেছে। প্রথম প্রথম কষ্ট হয়েছে। তারপর সহ্য হয়ে গেছে। অভিযোজন করেছি সব বেদনা সব হারানোকে’ নিজের মধ্যে। যে চলে যাবার তাকে ধরে রাখা যায় না। রাত্রির শরীর খারাপ। শরীরে একটা ছোট অপারেশন হয়েছে। মানসিকভাবে বিপর্যন্ত- আমি জেনেছি তার কাছের মানুষদের কাছ থেকে। যে সমস্ত দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াতো, যার মানসিক শক্তি ছিল অন্যদের থেকে অনেক উঁচুতে সেও অনেকখানি স্থিতু। কেউ বুঝতে পারে না। তার কথা বলার স্টাইল আগের মতো রয়েছে। খাওয়া দাওয়ার তালিকা থেকে রাত্রি অনেক কিছু বাদ দিয়েছে। তবু অনেকখানি সে নিষ্প্রভ। সে-ই আমাকে প্রথম বাদ দিতে চেয়েছে। কিন্তু আমি তার জীবনে ছিলাম অমোঘ সত্য আলোর মতো দীপ্তিময়। সে যখন আমাদের সমস্ত ডিল/চুক্তি ছিন্ন করার কাগজে স্বাক্ষর করলো তখন অনেকখানি হাসি খুশি ছিল। আমি সুখী, অসুখী, সন্তুষ্ট, অসন্তুষ্ট কিছুই বুঝতে দেইনি। কাজী অফিস থেকে বেরিয়ে দুইজন দুটি রিক্সায় ভিন্ন গন্তব্য আমরা পৌঁছেছিলাম। ছেলেমেয়ের জন্য আমাকে শক্ত থাকতে হয়েছিল। পুরুষের চোখে জল কাউকে দেখাতে নেই আমিতো জানি। আমি একাকী নিজের ঘরে বসে প্লেয়ার বাজিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান শুনেছিলাম অনেকক্ষণ। কিছুদিন পর অনেকে বলেছিল দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা। ন্যাড়া কি বেল তলায় কি বারবার যায়? তখন অনেকখানি হাসি খুশি ছিল। আমি সুখী, অসুখী, সন্তুষ্ট, অনুনুট কিছুই বুঝতে দেয়নি। কাজ, ব্যস্ততার মধ্যে এর মধ্যে নয় বছর কেটে গেছে। রাত্রির সাথে আর যোগাযোগ হয়নি। রাত্রি সযত্নে ভুলে গেছে তার ছেলেমেয়েকে। ছেলে-মেয়েরাও একবারও তার কথা বলেনি। মনে হয় বাবাকে নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি ওরা দাঁড় করাতে চায়নি। অনেকদিন ঘটনাবর্তে আমার জীবন উত্তাল থেকেছে। আজ এসেছি রাত্রির অফিসে। এ অফিস আমার অফিসও বলা যায়। আমি আর রাত্রি একই অফিসে কাজ করেছি বহুদিন। আমার অফিস ছিল নীচতলায় ওর অফিস চতুর্থতলায়। রাত্রি যখন চাকরিতে প্রবেশ করে সেটা ২০১০ সালে। আমিতে ১৯৯৪ সাল থেকে আছি। আমাদের নীচতলায় নিয়মিত আড্ডা জমে উঠতো কাজ শুরু হওয়ার আগে। শিল্প, সংস্কৃতি, অফিস রাজনীতির গল্প বাদ যেতোনা। একদিন রাত্রি এসে আমাদের আড্ডায় যোগ দেয়। দিনে দিনে আমি তার রূপ-কাজ জ্ঞানে মুগ্ধ হতে থাকি। একদিন রাত্রি বলে কয়েকদিন ধরে ওর জ্বর। আমি প্যারাসিটামল কিনে আনি এক পাতা। রাত্রি টেবিলে রাখা কাচি দিয়ে একটা ওষুধ কেটে নিয়ে আমাকে বাকি ওষুধ ফেরত দেয়। আমি বলি ‘রেখে দিন- অন্য কখনো কাজে লাগবে। রাত্রি নেয় না। রাত্রি একবার না বললে সেটা চড়ান্ত না। ওকে ‘হ্যাঁ’ বলতে শুনেছি অনেক বার। রাত্রির জন্মদিনে আমি কয়েকটি প্রাইজবন্ড উপহার দিই। ও বলে’ নিতে পারি একটি’। আমি ফেরত নিতে নারাজ। আমি দ্রুত হারিয়ে যাই। ও বলে একজন আমাকে দশটাকা দিয়েছিল আমি ও টাকা আজো জমা রেখেছি। রাত্রির অফিসে পার্টিতে মাঝ খানে বসি। সবাই সামনে টেনে নিয়ে যেতে চায়। অনুষ্ঠান শুরুর আগে রাত্রি আসে। অনুষ্ঠান আলোচনা-বক্তৃতা শেষে রাত্রি চলে যায়। আমি বসে আছি। রাত্রি তাকায় না, আমাকে কোন গুরুত্ব না দিয়ে, এমকি আমার দিকে একবারও না দেখে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করে। আমি অনুষ্ঠা চলে যাওয়া দেখি,। রাত্রি আমার কিছু নয়, আমি রাত্রির কেউ নই। বুক ফুঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস রেড়িয়ে শূন্য মিলিয়ে যায়। আমি নিজেকে সামলে নিই।আমি প্রথম সারিতে গিয়ে বসি। একদল শিল্পী নাচ, গানে ভরপুর সেগুন বাগিচার হল রুম। আমি মোবাইল খুলে ভিডিও করি, স্থিরচিত্র তুলি। কোথাও অলক্ষ্যে কোকিল ডেকে ওঠে। শীত সন্ধ্যা ভেদ করে টুপটুপ ঝরে পড়ে শিশির। পাতা ঝরার শব্দ শুনি। কোকিল ডাকে। অন্তর্গত আত্মা বলে আমার নামে কেউ কি ডেকে চলেছে কোথাও। আমাকে ভাবার মতো এ মুলুকে কেউ নেই। ভুল ভালোবাসায় কেটে গেল সারা জীবন। হায় জীবন কত নামবুর, কত না বেদনার। আমরা শুধু আমাদের স্মৃতিচিহ্ন রেখে যাই। কেউ কাউকে মনে রাখে না। দূর থেকে ভেসে ওঠে রবি ঠাকুরের সেই গান ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে। কি বিষাদ আর স্মৃতিতে মাখা। এক ঘোর মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে। রাত্রি কি সব ভুলে বসে আছে? রক্তমাংসের মানুষ স্মৃতি শূন্য হয়ে যায় কীভাবে? আমি অনেকক্ষণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কাটিয়ে ফিরে যাই খাবার টেবিলে। পুরনো দুই একজন এখনো আছে। তাদের সাথে কথা হয়। সিও’র পাশাপাশি বসি। সেই আড্ড সেই সব হারানো দিনের গল্প আমাদের পিছনে নিয়ে যায়। জীবনানন্দ দাশতো বলেছেন ‘কেউ হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!”

বালুচর

বালুচর

আল ফেরদৌস সম্পাদিত ছোট কগজ  ‘বালুচর’ রাজনীতি ও ইতিহাসের দায়বোধে সমৃদ্ধ : সোহেল মাজহার শিল্প-সাহিত্য, চিন্তা ও দর্শনের বিপ্রতিপ আয়োজন করে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা, অবস্থানের বিরুদ্ধে একটি সুসংহত আন্দোলন গড়ে তোলা এবং কাগজে প্রকাশ করাকে লিটলম্যাগ বা ছোটকাগজ বলে। কার্যত লিটলম্যাগ আরও বিস্তৃত সুসংহত ধারণাকে লালন করে সাহিত্যের একটি অপ্রাতিষ্ঠানিক গোষ্ঠীবদ্ধ আন্দোলন চালিয়ে যায়। এর মাধ্যমে গোষ্ঠীবদ্ধ কিংবা গোষ্ঠীর বাইরে সমমনা লেখক- চিন্তকদের নতুন বিষয়, গদ্য শৈলী- প্রকরণ ও বাকভঙ্গি ও কাঠামোর লেখা প্রাধান্য থাকে। এই সব লেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হলো তীব্র বাদানুবাদ, তীব্র প্রতিবাদ, শ্লেষ ও বিদ্রোহ। ছোটকাগজ প্রধানত রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রতিষ্ঠানতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী ও বিপরীতমুখী অভিযাত্রা। যার মধ্যে শিল্পবোধের পাশাপাশি  ক্রিয়াশীল থাকে রাজনীতিবোধ, ইতিহাস চেতনা ও উচ্চ মনীষা। রিয়াদ আল ফেরদৌস সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘বালুচর’ - এ ইতিহাস ও রাজনীতি চেতনায় সমৃৃদ্ধ একটি কাগজ। কাগজটি কবি রিঙ্কু অনিমিখ ও জ্যোতি পোদ্দারের সূত্রে সম্পাদক রিয়াদ আল ফেরদৌসের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি। বালুচরের এই সংখ্যায় প্রধানত কৃষক বিদ্রোহ, কৃষকসভার সম্মেলন ও ইতিহাসের পুনর্পাঠ দিয়ে সাজানো হয়েছে। কাগজটিতে মোট ১৪টি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। প্রবন্ধগুলোকে তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যায়। ১৯৪৩ সালে নালিতাবাড়ী ষষ্ঠ বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার সম্মেলনের স্মৃতিচারণ করে আটটি প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। প্রবন্ধগুলো লিখেছেন আড়াইআনি বাজারের নওজোয়ান মাঠ : ইতিহাসের পুনঃপাঠ- জ্যোতি পোদ্দার, ষষ্ঠ সম্মেলন : নালিতাবাড়ী- মুহম্মদ আব্দুল্লাহ্ রসুল,  প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন ১৯৪৩: নালিতাবাড়ী- কমরেড মণি সিংহ, করোটির ভেতর বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিষাণ সভার সম্মেলন- চিত্তরঞ্জন বকসী, নালিতাবাড়ী কৃষক সম্মেলন ও আনুষাঙ্গিক কথা- দিলীপ চক্রবর্তী, কমরেড জলধর পাল : বিস্মৃত এক ভূমিপুত্র- রিয়াদ আল ফেরদৌস ও গারো পাহাড়ের সমতলে কৃষক আন্দোলন : হালুয়াঘাটের সংগ্রামী ঐতিহ্য- মাহমুদ আব্দুল্লাহ। প্রধানত ১৯৪৩ সালে নালিতাবাড়ীতে ষষ্ঠ বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন এই সংখ্যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। কৃষি ও লোকসংস্কৃতি নিয়ে মোট ৪টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধগুলো হলো যাপনে নালিতাবাড়ী- বিমল বসু (স্বপন), ব্রিটিশ শাসনামলে পূর্ব বাংলার কৃষি দৃশ্য- হারুন অর রশীদ, কৃষিকর্ম ও ঐতিহ্যবাহী গারো সংস্কৃতির কিছু লক্ষণীয় কিছু দিক - বাঁধন আরেং এবং কৃষিভিত্তিক গারো সমাজের হারিয়ে যাওয়া কৃত্য- পরাগ রিছিল। সামগ্রিক কৃষক আন্দোলন- কৃষক বিদ্রোহ ও  ইতিহাস নিয়ে দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধগুলো হলো - আমি সেই দিন হব শান্ত - রবি নিয়োগী ও  বিদ্রোহী ময়মনসিংহ- স্বপন ধর। এসকল প্রবন্ধে ময়মনসিংহের ইতিহাস, নীল বিদ্রোহ, হাতিখেদা আন্দোলন, ফকির- সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, পাগলপন্থী বিদ্রোহ,  নানকার প্রথাবিরোধী আন্দোলন, টঙ্ক আন্দোলন, জমিদার প্রথা উচ্ছেদ আন্দোলন, ভাষা আন্দোল ও মুক্তিযুদ্ধ মানুষের সংগ্রামী জীবনের নানা ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। কবি এম. কে. হক ‘আমার গাঁয়ের কথা’ শিরোনামে কবিতা লিখেছেন। শিল্প, সাহিত্য ও মনন চিন্তার কাগজ ‘বালুচর’ বর্ষ ৩, সংখ্যা : ৪, মাঘ ১৪৩০। সম্পাদক : রিয়াদ আল ফেরদৌস। সম্পাদনা পর্ষদে আছেন যথাক্রমে জ্যোতি পোদ্দার ও সজল কর্মকার এবং সহযোগী সম্পাদক : মানিক কুমার সাহা। প্রচ্ছদ : শিবশংকর সরকার। মূল্য : আশি টাকা। সংখ্যাটি উৎসর্গ করা হয়েছে যথাক্রমে বিপ্লবী কমরেড  মণি সিংহ, বিপ্লবী কমরেড  রবি নিয়োগী, বিপ্লবী কমরেড প্রমথ  গুপ্ত, বিপ্লবী কমরেড  জলধর পাল ও টঙ্ক আন্দোলনে শহিদ কমরেড শচী রায়কে। বালুচর পাঠকপ্রিয় হোক।

আত্মহত্যার আগে এবং পরের রূপালী মুহূর্ত

আত্মহত্যার আগে এবং পরের রূপালী মুহূর্ত

(পূর্ব প্রকাশের পর) বলে, এখানে কফি পাবেন কোথায়? আফতাব কিচেনে যেতে যেতে বলে, কফি মেশিন আছে। তাহমিনা কৌতুহলী ভঙ্গিতে আফতাব কে ফলো করে। তার দু’হাত তার বুকের উপর তুলে সারেন্ডার করার ভঙ্গিতে বলে, টু বি অনেস্ট-আমি কখনো কফি খাইনি। আফতাবও রসিকতার ভঙ্গিতে বলে এ তো খাওয়ার জিনিষ নয়-এটা পান করার। এতোক্ষণ যেমন মেয়েটি হালকা চালে ব্যাটিং করে যাচ্ছিল এবং অনায়াসে রানও তুলে নিচ্ছিল-এই প্রথম যেন ঘুঘলি বলে ধরা খেয়ে গেল। সহসা তার মুখে কথা জোগায় না। আফতাব পরিবেশ সহজ করার ভঙ্গিতে বলে, জাস্ট জোকিং..মেয়েটিও হার স্বীকার করার ভঙ্গিতে বলে, জোকিং হলেও তা হূল ফোটানোর জন্যে যথেষ্ট। আফতাবও ঘাট মানার ভঙ্গিতে বলে, সরি..মাই সিনসিয়ার এপোলজি। মেয়েটির দিকে সরাসরি তাকিয়ে আফতাব বলে, আপনার জন্যে কফির পানি দেব। মেয়েটি বলে, নো থ্যাঙ্কস। আবার ব্যাটিং করার ভঙ্গিতে মেয়েটি বলে, তবে কফি সম্পর্কে পত্রিকায় পড়েছি, নিয়মিত কালো কফি পান করলে নাকি পুরুষরা অনেক দিন সেক্স ধরে রাখতে পারে। কোন মেয়ের মুখ থেকে সরাসরি সেক্স বিষয়ে কথা শুনে আফতাব খুব অবাক হয়। বলে, তাই নাকি! এই তথ্যটা তো আমিও জানতাম না। অবশ্য আমি সেই উদ্দেশ্যে কফি পান করিনা-রাতে একটু পান টান করি তো তাই সকালে হ্যাংওভার কাটাতে এই কালো কফি খুবই সাহায্য করে। পেয়ালায় কফি ঢালতে আফতাব কিচেনে যায়। আর মেয়েটি ওর বুক সেলফে বই দেখতে থাকে। কফিতে চুমুক দেওয়ার পর আফতাবের মাথাটা খুলে যায়। ওর মনে পড়ে যায়, কাল যখন মেয়েটি ওর অফিসে গিয়েছিল-আফতাব তখন ছিল একটা এসাইনমেন্টে। অফিসে এসে পিয়নের কাছ থেকে জানতে পারে একটি মেয়ে তার বাসার ঠিকানা নিয়ে গেছে। আফতাব পিওনের উপর চড়াও  হয়েছিলা এই বলে যে, কেন সে তার বাসার ঠিকানা দিল! পিওনও কম যায়না। প্রত্তুত্তরে বলেছিল, আপনাগো নিয়া  সমস্যার শেষ নাই-ইকবাল সাবের এক বান্ধবী আইসা তার বাসার ঠিকানা চাইলো- আমি দিলাম না। কেন আমি তার ঠিকানা দিলামনা-এই নিয়ে উনি আমাকে এই মারে তো সেই মারে-আর আপনি বলতেছেন উল্টো কথা। এই আমি কানে ধরলাম এরপরে কোন মহিলা এলে আমি সাফ সাফ বইলা দিমু-সারেরা এখানে কাজ করে বটে তবে আমি তাহাদের চিনিনা-ঠিকানাও জানিনা। ওর কথায় সবাই হেসে ফেলে। আফতাব তাকে পটানোর ভঙ্গিতে বলে,বুঝলানা মিয়া, মাইয়া মানুষ তো-দেবতারাই তাদের মনের দিশা পায় নাই আর আমরা তো মানুষ! যদি বাসায় গিয়ে বলে-চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি-তখন কি করবো? পিওনও বলে, কেন বিয়া করে ফালাইবেন! বিয়ার বয়স তো আপনার হইছেই..আফতাব আর কথা বাড়ায় না। আফতাব এবারে চায়ের পেয়ালা নিয়ে সোফায় গিয়ে বসে। আর মেয়েটিও আফতাবকে অবাক করে কোমরে শাড়ি গুঁজে দিয়ে ঘর গোছাতে লেগে যায়। এতে তার নাভিমন্ডল আরও দৃষ্টি গোচর হয়। আফতাব আড়ালে আবডালে নয়-ড্যাব ড্যাব করে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটি বুঝতে পেরে আঁচলটা আরও একটু বেশী করে কোমরে গুঁজে দিয়ে আড়চোখে মিষ্টি করে হেসে বলে, কি দেখছেন? আফতাবও বেহায়ার মতো বলে, যা দেখাচ্ছেন-তাই দেখছি। দেয়ালে টাঙ্গানো শিল্প কর্ম দেখানোর ভঙ্গিতে মেয়েটি বলে, ইজ ইট ইমপ্রেসিভ? আফজালও কম যায়না বলে, ইউ নো ইউ আর বিউটিফুল। পুরুষকে ঘায়েল করার জন্যে যে কয়টা মোক্ষম বাণ আপনার ত ূণে থাকা দরকার-তার সব ক’টিই আছে। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি, আপনি কেন ঘর গোছাতে হাত লাগাচ্ছেন? মেয়েটি অধিকার প্রয়োগ করার ভঙ্গিতে বলে,কেন এ ঘর আমার ঘর হলে আমি কি এভাবে আগোছালো রাখতে পারতাম? আফতাব তার ধারণা ভেঙ্গে দেয়ার ভঙ্গিতে বলে, কিন্তু ঘরটাতো আপনার নয়-কেন মিছেমিছি আপনার পরিপাটি শরীরে ধূলো বালি লাগাচ্ছেন? মেয়েটি আফতাবের দিকে সরাসরি তাকায়। মুখে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে বলে, এক সময় হতেও তো পারে! মেয়েটির কথা বলার ধরণ দেখে আফতাব এবারে ভয় পেয়ে যায়। সে কি এই সাত সকালে আফতাবকে ফাঁদে ফেলার জন্যে এসেছে?              আফতাব মেয়েটির কথায় খুশী হয়না-বরং কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বলে, সেই সময় যখন আসে-তখন না হয় দেখা যাবে’ক্ষণ। আপনি বসুন।  ব্যাটিং-এ আবার একটা গুগলীর আক্রমণে কিছুটা ধরাশায়ী হয়ে অগত্যা সোফায় বসতে উদ্যত হলে আফতাব তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, আপনার  হাত ডার্টি ওইতো- ওয়াশ রুম। ধুয়ে আসুন। মেয়েটি আর কোন কথা না বাড়িয়ে ওয়াশ রুমে গিয়ে দরোজা লাগিয়ে দেয়। আফতাব হাফ ছেড়ে বাঁচে। ভাবে, এই হ্যাং ওভারটা মাঝে মাঝে বেশ কাজে দেয়। সাধারণতঃ একজনের মুখের উপর অনেক অপ্রিয় কথাই বলা সম্ভব হয় না। কিন্তু হ্যাং ওভার থাকলে জ্ঞানের নাড়িটা থাকে টনটনে। একটা ব্যক্তিত্বের আবরণে মুখটা থাকে ঢাকা। চট করে কেউ তাতে ঢুকতে পারেনা। আফতাব এবার একটা সিগ্রেট ধরিয়ে টেবিলের উপর পা দু’টো মেলে ধরে আয়াস করে সিগ্রেট টানতে থাকে। মেয়েটা দরোজা খুলে ওয়াশ রুম থেকে বের হয়। কিন্তু আফতাব চোখ বুজে সেই ভঙ্গিতেই বসে থাকে। মেয়েটি তার তন্ময়তা ভেঙ্গে দেয়ার ভঙ্গিতে ছোট্ট একটা কাশি দিয়ে বলে, বসতে পারি? আফতাব নির্বিকার কন্ঠে বলে, বসুন। মেয়েটি খুব বিনয়ী ভঙ্গিতে বলে, একটা প্রশ্ন করতে পারি? আফতাব বলে, নিশ্চয়ই। মেয়েটি বলে, আপনার ওয়াশ রুমে দেখলাম,সব কিছুই বিদেশী এবং বেশ দামী-আপনি কি সাংবাদিকতা ছাড়াও ব্যবসায় করে থাকেন? আফতাব হাসে। বলে, না। আমার মা বাবা কেউ নেই। আছে শুধু আমার একটাই বোন। সে আমার বড়। থাকে আমেরিকায়। দেশে আসছে এমন কাউকে পেলেই গাদা গাদা জিনিষ পাঠায়। একা এতো জিনিষ কি ভাবে ব্যবহার করবো! বন্ধু বান্ধবদের গিফট করে দেই। মাঝেমধ্যে কল করে বলে, একটা বিয়ে করে দেখনা-তোর বউকে এমন এমন সব প্রসাধনী পাঠাবো না শি উইল বি অ্যা ম্যাড। মেয়েটি মিটি মিটি হেসে ভ্রু নাচিয়ে বলে, তা বিয়ে করছেন না কেন? এবারে সিগ্রেটটায় শেষ টান দিয়ে টুকরোটা এ্যাশ ট্রে-তে গুঁজে দিয়ে সরাসরি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আফতাব বলে, অনেক কথাই তো হলো-এবার বলুন তো আপনি কে? কেনই বা সাত সকালে আমার বাড়ি এসে হানা দিয়েছেন? আপনার মতলব টা কি? আজ আমার ডে অফ অনেক কিছু করার প্লান আছে। (চলবে...)  সামনের মাসে বোনের ওখানে যাচ্ছি। সাংবাদিকতা করি তো-এই ধরুন কুকুরের কোন কাজ নেই কিন্তু তার দৌড় ছাড়া হাঁটাও নেই। আফতাব এবারে মেয়েটির মুখ থেকে কিছু শোনার অপেক্ষায় থাকে। মেয়েটি কিন্তু কোমরে যেভাবে আঁচলটা গুঁজে রেখেছিল-সেভাবেই রেখেছে। ওয়াশ রুমে গিয়েও তাতে কোন ব্যত্যয় ঘটায়নি। এবার সে নিজেকে বেশ গুছিয়ে কথা বলতে শুরু করে। বলে, আমার নাম তাহমিনা রহমান-সবাই মিনা বলেই ডাকে। আফতাব তাকে থামিয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বলে, আমি কিন্তু আপনাকে আমার অতি প্রিয় একজন নায়িকা-মীনা কুমারী বলে ডাকবো-আপত্তি নেই তো? মিনা হেসে বলে, আপত্তি থাকবে কেন-এটা তো বরং একটা কমপ্লিমেন্টস। মিনা বলতে শুরু করে। আমারও আপনার মতো মা বাবা নেই। ভাইয়ের কাছে মানুষ। মাস্টার্স করে একটা কলেজে পড়াচ্ছি। আমার এক বন্ধুর সাথে স্পেস শেয়ার করে থাকি। মাঝে মধ্যে কবিতা লিখি। গদ্য লিখতে চেষ্টা করি। পারিনা। আফতাব তার কথা কেড়ে নিয়ে বলে,এখানে আপনার সঙ্গে আমার একটা মিল-আপনি গদ্য লিখতে চেষ্টা করেন পারেন না। আর আমিও আপনার মতো পদ্য লিখতে চেষ্টা করি পারিনা। তবে সম্ভবত গত সপ্তাহে আপনার একটা কবিতা আমি দৈনিক বাংলার সাহিত্যের পাতায় পড়েছি। কবিতায় কিছুটা হতাশা ছিল আবার আশার কথাও আছে-ঠিক কিনা! মিনা মাথা নাড়ে। আফতাব অনেকটা অসহিষ্ণু কন্ঠে বলে, তা আমার ব্যাপারে আপনার উৎসাহের হেতুটা কি? কালকে অফিসে গিয়ে আমার ঠিকানা সংগ্রহ করেছেন.. মিনা এবারে নড়েচড়ে বসে। বলে, পত্রিকার পাতায় আপনার ব্যাপারে একটা ছোট্ট খবর আমাকে আপনার ব্যাপারে কৌতুহলী করে তোলে। আফতাব বলে, ওই যে ‘একজন গল্পকার পকেটমার হিসেবে ধৃত’.. মিনা খুব অবাক হয়। আপনার ইনটুইশন তো দারুণ। আফতাব বলে, আশলে রাতারাতি সকলের মনোযোগ কাড়ার জন্যেই ওটা আমি করেছিলাম। তাতে অবশ্য সাফল্যও জুটে গিয়েছিল। আমাকে কোথাও গিয়ে আর পরিচয় দিতে হয়নি। ওই খবরটার কথা বললেই সবাই চিনে ফেলে। সেই সুবাদে পত্রিকায় একটা কাজও জুটে গেল। তবে জেলে গিয়ে একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সন্ত্রাসী গালকাটা কামালের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তার ছিল সুন্দর গানের কন্ঠ। আমি জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরপরই তার ফাঁসি হয়ে যায়। তবে আমার বোন খুব দুঃখ পেয়েছিল।বলেছিল, তুই টাকার জন্যে মানুষের পকেট মারতে গিয়েছিলি?  তাকে বলি,এটা ছিল একটা এডভেঞ্চার-সে এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। মিনা বলে,  তবে আপনার লেখার হাতটা কিন্তু চমৎকার। আপনার গল্প ছাপা হলেই পড়ি। তবে একটা সত্যি কথা বলবো-মাইন্ড করবেন না তো? আফতাব তাকে অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, মাইন্ড থাকলে না করবো! মিনা হাসে। বলে, আপনার গল্পে কোন রোমান্স থাকেনা কেন? আফতাব অকপটে বলে,রোমান্স থাকলে না তা কলমের ঢগায় শেফালির মতো স্নিগ্ধ ঘ্রাণ ছড়াবে। মিনা কিছুটা ডেসপারেট ভঙ্গিতে বলে, ইন্সটান্ট আই ফল লাভ উইথ ইউ..আফতাব নির্মোহ ভঙ্গিতে বলে, বাট আই এ্যাম নট..মিনা অধীর কন্ঠে বলে, হোয়াই নট। আফতাব মিনাকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে, দ্রুত প্রেমে পড়লে তা কখনো মধুরেণ সমাপয়েত হয়না। তা বরং চিনে মাটির বাসন ভেঙ্গে গেলে যেমন একটা আঁচর পড়ে-এ আঁচরটা লাগে হৃদয়ে যা কখনোই মুছে যায়না। তারপর ওরা প্রেমের নানা রকম যুক্তি তক্ক দাঁড় করায়। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়, বিকেল গড়িয়ে নামে সন্ধ্যা, তারপর রাত, সারা রাত এবং সকালে গিয়ে তা রফা হয় কাজির অফিসে গিয়ে। মিনা সেদিনই এসে উঠে আফতাবের ফ্লাটে। এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিয়ের পরের দিন থেকেই ওদের মতের চেয়ে অমতই হয় বেশী। মিনার বড় খরচের হাত। প্রতি রাতেই চায়নিজ খাওয়ার জন্যে বায়না ধরে। এবং মিনা খুব ধুরন্ধরও বটে। সে বুঝতে পেরেছে আফতাবের ব্যয়ের একটা মোটা অংশ আসে তার বোনের কাছ থেকে। তাই সে শাড়ি গহনা কিনে আলমারী দেরাজ সব ভরে ফেলে। আফতাব তার বোনের কাছে তার এই মধুর দাম্পত্য জীবনের কাহিনী বিবৃত করে। বোন ভাইটাকে খুব ভালবাসে। বলে, এখন কি করবি? আফতাব বলে, কিছুই তো বুঝতে পারছিনা। বোন বলে, যতো দিন যাবে ততোই ইট উইল বি ওয়াস্ট..ওয়াইজ ডিসিসান হচ্ছে-টু লিভ হার। তুই যে আমেরিকায় আসছিস সে কি এ কথা জানে? আফতাব বলে, কথাচ্ছলে একদিন বলেছিলাম। বোন বলে, আর বলবিনা। বরং কায়দা করে বলে দে-এখন আর এখানে আসছিস না আমি ইউরোপ ট্যুরে যাচ্ছি। কথাটা ইনটেনশনালী বলবিনা। বলবি খুব ক্যাজুয়ালী। একটা আফসোসও থাকবে তোর কথা বলার ধরণে-যা তার কাছে বিশ^াসযোগ্য মনে হয়। খুব কানিং মেয়ে তো ধরে ফেলবে। পাসপোর্ট টিকেট তোদের ক্লাবের লকারে রেখে দে। যখনই আমেরিকার প্রসঙ্গ তুলবি-তারপর থেকেই ও কিন্তু তোর পাসপোর্ট হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে। একদিন মিনাই নিজের থেকে বলে-এই এ মাসেই না তোমার আমেরিকায় যাওয়ার কথা। আফতাব তার বোনের শেখানো পাঠ গাইতে থাকে। মিনা কিছুটা বিস্মিত হয়। এবং সেই ভঙ্গিতেই বলে, তা তোমার পাসপোর্ট কোথায়? আফতাব অবাক হয়। তুমি আমার পাসপোর্ট খুঁজছিলে কেন বলতো? মিনা পাকা অভিনেত্রীর মতোই বলে-বারে! তোমার স্ত্রী হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছেনা? টিকেট পাসপোর্ট সুটেকেস এসব গুছিয়ে দিতে হবেনা! এবং আরও একটা কথা-তোমার যে ট্রিপটা ক্যানসেল হয়েছে সে কথাটা আমাকে জানালে না কেন? আমি যখন ট্রিপের ব্যাপারে জানতে চাইলাম-শুধু তখনই বললে-অ্যাই এ্যাম গেটিং সাম স্মেল ফ্রম হেয়ার..আফতাব উত্তেজিত হয়না। বলে, কি স্মেল পাচ্ছ? আফতাবের দিকে সরাসরি তাকিয়ে কঠিন মুখে মিনা বলে,হোয়ের ইজ ইউর পাসপোর্ট? আফতাব একটুও ভড়কে যায়না। বলে, সন্দেহ দাম্পত্য জীবনের অন্তরায়। আমার তো মনে হয়না,আমি তোমার সঙ্গে এমন আচরণ করেছি যাতে তোমার মনে সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে। পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে। সামনের সপ্তাহে দেয়ার কথা। তোমাকে সঙ্গে করে নিয়েই না হয় তুলে আনবো। মিনা ঠিক ওর কথায় বিশ^াস করেনা। বলে, তোমার রশিদ কই? আফতাব হেসে হেসে বলে, এসব কাজ সাধারণতঃ আমাদের অফিসের স্টাফরাই করে থাকে। রাতে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে না হয় নিয়ে আসবো। মিনা দৃঢ়তার সাথে বলে,ডোন্ট ফরগেট.. অবশ্যই নিয়ে আসবে। আফতাবের কপাল ভাল। সে রাতেই ছিল তার ফ্লাইট। শুধু মিনার থেকে নয়-ও সকলের কাছেই ফ্লাইটের ব্যাপারটা চেপে গিয়েছিল। লাগেজটাও গোপনে গোপনে গুছিয়ে ফেলেছিল। বিয়ের পরেই আফতাব বুঝেছিল,সে সাপের গর্তে পা ঢুকিয়ে দিয়েছে। যে কোন মুহূর্তে সাপটা ছোবল হানতে পারে। ওর বোন আমেরিকায় থাকে-সম্ভবত এটাই ওকে রাতারাতি আফতাবকে বিয়ে করার ব্যাপারে প্রলুদ্ধ করে থাকতে পারে। মাখনের ভেতর লুকানো ছুরি চালানোর মতোই ঘটনাটি ঘটলো। বিমানে পঁয়ত্রিশ হাজার ফিট ওপরে ওঠার পর আফতাব নিশ্চিত হলো-তার ফাঁড়া কেটে গেছে। আমেরিকায় গিয়েই ওর প্রথম কাজ হবে মিনাকে একটা ডিভোর্স লেটার পাঠানো। যদিও সে এটাকে সহজ ভাবে ছেড়ে দেবেনা।এমবেসিতে গিয়ে প্রমান করার চেষ্টা করেবে-সে তার বিবাহিত স্ত্রী। তবে সুখের কথা হচ্ছে,আফতাব গ্রীন কার্ড ধারী নয়-এসেছে ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে। হাজবেন্ডকে ফলো করার জন্যে এমবেসি থেকে স্ত্রীকেও ট্যুরিস্ট ভিসা দেবে-ওরা কি এতোটাই উদার আর মানবিক! তারপর আফতাব অনেক কাল থেকে গিয়েছিল আমেরিকা। ওর এক্সও আরও তিন তিনটি বিয়ে করে বর্তমানে শুনেছে ইউরোপের কোন একটি দেশে আছে। আমেরিকায় থাকবে না বলেই আফতাব আর গ্রীন কার্ডের চেষ্টা করেনি। এক বুক আশা নিয়ে আফতাব দেশে ফিরে এসেছিল। মীনা কুমারীর কারণেই দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল আফতাব। ফিরে এসে আর সে সেই দেশ আর পেলোনা। তাই তার না ফেরার দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ স্বস্তি ফিরে পেয়েছে মনে ও প্রানে। ফেলে যাওয়া সেই জীবন আর ফিরে পাবেনা আফতাব। কাল থেকে এই পৃথিবীতে আফতাব বলে একজন ব্যর্থ মানুষের আর অস্তিত্ব থাকবেনা। তারপর দেশের কি হলো-পৃথিবীর কি হলো-এ নিয়ে ওর আর মাথা ঘামাবার কিছু থাকবেনা। তার প্রস্তুতি হিসেবে ওর স্ত্রীর অগোচরে একটা কালো বল পেন আর ব্যাঙ্কের চেক বইটা পকেটে পুরে নেয়। জিন্সের একটা প্যান্ট আর গায়ে চাপায় হাওয়াই সার্ট। খুবই নরম তুলতুলে ইতালীয় চামড়ার একটা পাম শো পড়ে নেয়। ফাঁসি কাষ্টে ঝোলার আগে যেমন ফাঁসির আসামীদের খাওয়ার রুচি থাকেনা। আফতাবের অবস্থাও তাই হলো। ওর চোখে মুখে বেদনার নীল মেঘের হাওয়া বারবার ঝাপটা দিচ্ছে। অনঢ় আফতাব দু’হাত দিয়ে তা ঠেলে দিচ্ছে। ওর কোন সন্তান সন্ততি নেই। স্ত্রীও বেশ ইয়াং। আফতাবকে পাগলের মতো ভালবাসে-কিন্তু জীবনের হতাশা এমনই যে তাতে শরতের কাশ ফুলের মতো আশা জাগায় না। কুরে কুরে মরার চেয়ে একবারে চলে যাওয়াই তো ভাল। যদিও সে এই মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করেনা। কিন্তু ওর অযুত সম্ভাবনাকে ওর কাছের লোকেরাই হিংসের বশবর্তী হয়ে আটকে দিয়েছে। আবার ঘুরে দাঁড়াবার জন্যে যে সময়ের প্রয়োজন-সেই সময় ওর হাতে নেই। তার উপর ও খুবই অসুস্থ। স্ত্রী রান্না ঘরে ছিল। সেই ফাঁকে আফতাব বেরিয়ে পড়ে। ও দরোজায় এসে দাঁড়ায় তখন আফতাব অনেকটা দূর চলে এসেছে। ব্যাঙ্কে সর্ব সাকুল্যে ছিল পনোরো হাজার টাকা। এক হাজার টাকা রেখে বাকীটা তুলে ফেলে। এক প্যাকেট দামী সিগ্রেট কেনে। তাতে ফাও পায় একটা লাইটার। একটা সিএনজি ধরে বারিধারার ও দিকটায় একটা পাঁচ তারকা হোটেলে যেতে বলে ড্রাইভারকে। লবিতে ডাক্তারদের মেলা বসেছে। দু’দিন ব্যাপী ওয়ার্ল্ড সাইক্রিয়াটিস্ট এসোসিয়েশনের সম্মেলন শুরু হয়েছে। রুম পাওয়া যাবে কি না তাতে সন্দেহ আছে। সবই প্রায় লালমুখো ডাক্তার। হংস মাঝে বক যথার মতোই কিছু কৃষ্ণ বর্ণের লোকের উপস্থিতি ওর চোখে পড়ে। আফতবের সন্দেহ হয়-আজ এখানে কোন রুম খালি পাবে কিনা! হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়, সে তো রুম পাওয়ার জন্যে এই ইভেন্টটাকে কাজে লাগাতে পারে। তরুণ বুদ্ধিদীপ্ত একজন কাজ করছিল রিসিপসনিস্ট হিসেবে পাশে একজন সুন্দরী রিসিপসনিস্টও ছিল। কপাল ভাল থাকলে এ রকম মেয়েরা বেশ সহযোগিতা করে আর যদি হয় বদ নসীব তাহ’লে তাদের দিয়ে কোনভাবেই না কে হাঁ করানো যায় না। সুন্দরীদের ইগো মারাত্নক। আফতাবের এ রকম অনেক অভিজ্ঞতা আছে। মেয়েটিই সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এলো-আফতাব কোন ঝুঁকি না নিয়ে ছেলেটার কাছেই গেল। ছেলেটি তাকে চিনে ফেললো। বললো, আপনাকে তো মাঝেমধ্যে টক শো-তে দেখি। আপনি তো পত্রিকাতেও লেখালেখি করেন। তা-কোন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন-ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড? আফতাব বললো, আপাততঃ ফ্রি ল্যান্সিং করছি। ছেলেটিই বলে, তা সাইক্রাটিস্টদের এই সম্মেলন কভার করতে এসেছেন নাকি? ছেলেটি একটু প্রগলভ। একাই কথা বলে চলেছে। আপনার কি রুমের দরকার পড়বে। আফতাব খুশী হয়ে বলে তাহ’লে তো খুবই ভাল হয়। ছেলেটি কমপিউটারে চেক করে বললো, ইউ আর ভেরি লাকি জাস্ট একটা রুমই ছিল। আমার ক্যাপাসিটিতে আপনাকে ফিফটি পারসেন্ট ডিসকাউন্ট দিয়ে দিচ্ছ্।ি আফতাব আমতা আমতা করে বলে,না না ডিসকাউন্ট লাগবেনা। ছেলেটি দৃঢ়তার সাথে বলে, কেন লাগবেনা স্যার-এতো একজন সেলিব্রিটি হিসেবে আপনার প্রাপ্য। ছেলেটি এবারে আফতাবের দিকে তাকিয়ে বলে, ওয়ান নাইটের জন্যে না টু নাইটস? আফতাব বলে,ওয়ান নাইট ইজ ফাইন। আফতাব রসিকতার ছলে বলে, সাইক্রিয়াটিস্টদের সাথে দু’রাত কাটালে সুস্থ অবস্থায় কি বাড়ি ফিরতে পারবো? ছেলেটি বলে, তা সুন্দর বলেছেন তো! তা পেমেন্ট করবেন কিসে? ক্যাশ না ক্রেডিট কার্ডে? ক্রেডিট কার্ডে করলে আরও দশ পাসেন্ট ডিসকাউন্ট। আফতাব কথা বাড়ায় না। পেমেন্ট করে পা বাড়াতে যাচ্ছে এমন সময় ছেলেটি আবার বলে, এই তথ্যটি আপনার বেশ কাজে লাগবে। এই ইভেন্টটা কিন্তু অর্গানাইজ করেছে আমাদেরই একজন বাঙ্গালী লেডি সাইক্রিয়াটিস্ট। ডাঃ নীলুফার জাহান। আফতাব অবাক হয়। বলে, তিনি তো লন্ডনে ছিলেন। ছেলেটি কৌতুহলী হয়ে বলে, চেনেন নাকি? আফতাব বলে, সে তো অনেক কাল আগের কথা। আফতাব আর কথা বাড়ায় না। রুমের চাবি নিয়ে চলে যায়। সাথে কোন  মোবাইল নেই। তাই কারও সঙ্গে কোন যোগাযোগও হবেনা। বেয়ারের তেষ্টা পেয়েছে। বারে গিয়ে বিয়ারের অর্ডার দেয়। বিয়ার পানের পর মুখ থেকে মনে হলো, ওর বিষন্নতার ভাবটা কেটে গেছে। কিন্তু খুব ক্লান্ত লাগছিল আফতাবের। তাই আপাততঃ রুমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বেশ সুন্দর পরিপাটি রুম। জানালা দিয়ে রাস্তা চোখে পড়লো। আশ্চর্য রাস্তায় কোন যানজট নেই। দূরে এক চিলতে আকাশ। নীলের মাঝে মাঝে সাদা মেঘের ভেলা। হঠাৎ আফতাবের মনে হয়-এটা কি শরৎ কাল! হবেও বা! গ্রীষ্ম,বর্ষা,শরৎ-হেমন্ত, হোয়াটএভার! এই তো-মাঝ রাতের পরেই তো..সব পাখি ফিরে যাবে ঘরে..সব ঋতুই করবে আয়োজন এই পৃথিবীর মঞ্চে..ফুলে ফলে নতুন কচি পাতায় বসন্তে পাখিরা গাইবে গান..সে গান তো আর আফতাবের শোনা হবেনা কোনদিন! এটাই ছিল ওর নিয়তি। ওর জীবনের শুরুটা ছিল বেশ বর্ণময়-এই মীনা কুমারী তাতে এসে সব ভন্ডুল করে দিল। ওর খপ্পর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে ছাড়তে হলো দেশ আর তাতেই ঘটলো ছন্দ পতন। সব কিছুই হয়ে গেল ওলট পালট। এই সুন্দর প্রানবন্ত পৃথিবীতে শুধু তারই ঠাঁই হলো না। নাভির থেকে একটা দীর্ঘশ^াস উঠে তা মাঝ পথে আটকে গেল। বিয়ার পানের পর সিগ্রেট বড়ই আরাম দায়ক। সিগ্রেট ধরালো-কিন্তু সেই সাধটা পেলনা। এসট্রেতে সিগ্রেটটা গুঁজে দিয়ে ও ভাবলো আরে মর্টিনই তো কেনা হয়নি। ও মর্টিন কেন কিনছে-দোকানীর যেন এ রকম কোন সন্দেহ না হয় এ রকম বোকা সোকা একজন দোকানী পেয়ে গেল। হাতে না নিয়ে মর্টিন টা পিঠের দিকে গেঞ্জির ভাজে রেখে দিল। হোটেলে ফিরে এসে আফতাব ভাবে সুইসাইডাল নোটটা লিখতে শুরু করবে কিনা! ভাবে নোটের কথা তো হবে খবুই সংক্ষিপ্ত। ঘটনাটা ঘটাবে ও মাঝ রাত্তিরের পর। এরমধ্যে হোটেলের হাউজ কিপিং-এর লোক যদি এসে পড়ে..মর্টিন আর নোট যদি দেখে ফেলে তহ’লে তো কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে। আত্নহত্যার বিষয়টি ধরা পড়ে গেলে সেটা হবে পরিবারের জন্যে খুবই লজ্জাজনক। বিছানায় শুয়ে শুয়ে এসব ভাবতে ভাবতে আফতাব ঘুমিয়ে যায়। ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখতে পায় ন’টা বেজে গেছে। জানালা দিয়ে দেখতে পায় নগরী আলোতে ভাসছে। অনেক দালান কোঠা। ধীরে ধীরে নগরী আধুনিক হয়ে ওঠেছে। একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে ভাবে এটা এখন তিলোত্তমা নগরী হলেও এখানে এখন আর তার হৃদয় বাঁধা থ্কবে না। হঠাৎ আফতাবের মনে হয়, সে কেন কাল রাতে এই আত্নহননের সিদ্ধান্ত নিল। ওর হৃদয়ে যেন একটু আলো জ¦লে ওঠে। বিষয়টি ও ছাড়া তো আর কেউ জানেনা। আবার কি চেষ্টা করে দেখতে পারেনা-ও কি তার ভাগ্য ফেরাতে পারে কিনা! শুরুতে কি কষ্টের জীবন ছিল ওর-সেই কষ্টটা যখন জয় করতে পেরেছিল-এখন কেন ওর মনোবল ভেঙ্গে গেল! তাছাড়া ওর বর্তমান স্ত্রী ওকে মনপ্রান দিয়ে ভালবাসে-ওর একার আয়ে সংসার চলছে না-তারপরেও বেচারী আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ও চলে গেলে সে খুব কষ্ট পাবে। এই শোক কাটিয়ে ওঠা তার পক্ষে কি সম্ভব হবে? হয়তো নয়। আমেরিকা থেকে ঢাকায় নেমেই এক বন্ধুর বাড়িতে এক পার্টি হচ্ছিল-সেখানেই আলাপ হয় ওর বর্তমান স্ত্রী অনামিকার সঙ্গে। ভাললাগা ভালবাসা তারপরে গিয়ে গড়ায় পরিণয়ে। অনামিকা ওকে সাহস জুগিয়েছে,প্রেরণা জুগিয়েছে তার বুকটা এভাবে ভেঙ্গে দেয়ার কি অধিকার আছে তার! সে তার সিদ্ধন্তে অটল থাকতে পারছেনা। একটু একটু করে সংশয় দেখা দিচ্ছে। গৌতম বুদ্ধু বলেছেন, আত্নহত্যা মহা পাপ। আফতাব আপন মনেই হেসে ওঠে। সে এখন পাপপূণ্যের অনেক উর্দ্ধে। সে একজন পুরুষ মানুষ-সে বরং এখন সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলেই বরং কাপুরুষ হয়ে যাবে। গুণী লোকেরা অবশ্য বলে, আত্নহত্যা কাপুরুষিত কাজ। আফতাবের মাথায় ব্যথাটা আবার চারা দিয়ে ওঠতে শুরু করেছে। সে আবার বারে গিয়ে বসে। বিয়ারটা পান করার পর একটু ধাতস্থ হলো। নিজের মনেই হিন্দী সিনেমার সংলাপ আওড়ায়-সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছি তখন চলেই যাব। কেউ আমাকে আটকিয়ে রাখতে পারবেনা। এলিভেটরে ওঠার আগ মুহূর্তে একটা নারী কন্ঠ শুনতে পেল। ওর নাম ধরে ডাকছে। ও ভয় পেয়ে পা চালায়-কেউ নিশ্চয়ই চিনে ফেলেছে। এই শালার টক শোতে গিয়েই সব ঝামেলা হয়েছে। এখন শান্তিমতো মরতেও পারবোনা। মহিলাটা এসে ওর সামনে দাঁড়ায়। এক ঝটকায় চিনতে পারে-নীলুফার জাহান। নীলুফার অবাক হয়ে বলে, আমি কিন্তু আপনাকে সেই দুপুরে দেখেই চিনতে পেরেছি। বিকেলে দেখলাম বেরিয়ে গেলেন। আমি তো লবিতেই আছি আপনার গতি বিধি লক্ষ্য করছি। আপনি বেশ ক’বার আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। আপনাকে একবার লন্ডনে আসতেও বলেছিলাম। পরে দেশে এসে শুনলাম,আপনি আমেরিকায় চলে গিয়েছেন। নীলুফারের কথা শুনতে আফতাবের ভাল লাগছেনা। মাতালের ভান করে আফতাব বলে, খুব ভাল লাগলো, আপনার সঙ্গে দেখা হলো। নীলুফার অবাক হয়। বলে, একজন সাইক্রিয়াটিস্ট হিসেবে আমার বেশ নাম ডাক হয়েছে। আপনি আমার পুরণো বন্ধু-আপনার সঙ্গে এসব নিয়ে শেয়ার করবো না? কি বলেন, আপনি ছিলেন একজন প্রমিজিং ইয়ং জার্নালিস্ট অথচ আপনাকে এখন কেউ চেনেনা। আমি তো এখানে ফিরে এসেছি তা বছর দুয়েক হলো-আপনাকে দেখার আমার খুব ইচ্ছে,কি করছেন,কেমন আছেন বা আপনার কোন সাহায্যে আমি আসতে পারি কিনা-এসব আমার মনে আছে। কিন্তু কোথায় পাবো-আপনাকে? আই এ্যাম সিঙ্গল-স্টিল ইজ লাভ উইথ ইউ..আফতাব ভেতরে ভেতরে ভাঙতে শুরু করলেও পরিস্থিতি সামলাতে চেষ্টা করে। বলে, দেখুন, আমি একটা কাজে ভীষণ ব্যস্ত..আপনি তো ঢাকায়ই আছেন। নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে। নীলুফার কৌতুহলী ভঙ্গিতে বলে, কি কাজে ব্যস্ত আছেন আপনি-না তুমি করেই বলছি। আমরা তো পরস্পরকে তুমি বলেই সম্বোধন করতাম। আফতাব কিছুটা অসহিষ্ণু কন্ঠে বলে, বিষয়টা আমার ব্যক্তিগত। আর তাছাড়া আপনার আর কোন কিছুই আমার মনের ভেতর নেই। আর আমি সিঙ্গলও নই। আমার স্ত্রী আছে। তাকে ছেড়ে তো আপনার গলায় ঝুলে পড়তে পারিনা। আফতাবের ইঙ্গিতটা খুবই কদর্য। তারপরেও নীলুফার রাগেনা বলে, তুমি রুমে যাচ্ছো? আমিও যাবো। আফতাব এবারে রেগে যায়। বলে, আপনি কিন্তু সত্যিই মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। নীলুফার নিস্পৃহ কন্ঠে বলে, একটুও না। আমি মানুষের মনের কারবারী। ইউর বিহেভিয়ার ইজ নট নরমাল। আমি রিসিপশনে খবর নিয়েছি। তুমি সেখানে বলেছো তুমি এসেছো ইভেন্ট কভার করতে-কিন্তু ওখানে তোমাকে দেখা যায়নি। নীলুফার আফতাবের হাত ধরে। বলে, তুমি কি ডিনার করেছো? আফতাব বলে, আমার ক্ষিধে নেই। নীলুফার অবাক হয়। কেন ক্ষিধে থাকবেনা কেন? নীলুফার আফতাবের হাত ধরে টানতে টানতে লবির এক কোণে গিয়ে বসে। সাপ যেমন মানুষের দু’পা পেচিয়ে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। নীলুফারও তেমনি আফতাবকে পেচিয়ে ধরেছে। ছাড়ছেনা। আফতাব শেষ চেষ্টা করে বলে, আপনিই তো অর্গানাইজার-আমাকে নিয়ে পড়েছেন কেন? আপনার তো ওখানেই থাকা উচিত। ওখানের চেয়ে এখন তোমাকেই আমার সময় দেয়াটা বেশী জরুরী। আফতাব অবাক হয়। বলে, এসব আপনি কি বলছেন? আমাকে কেন আপনি সময় দেবেন? কেন? নীলুফার অবাক বলে, তোমাকে কেন সময় দেব বা দেওয়াটা কেন আমার জন্যে জরুরী তা তুমি নিজেকেই জিগ্যেস করনা কেন! আফতাব বিরক্ত হয়। বলে, আপনার কথা কিন্তু আমি বুঝতে পারছিনা। এবারে নীলুফার সরাসরি আফতাবের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, হোটেলে তুমি কি করতে এসেছো? আস্ক ইউর সেলফ। ইউ আর লাকি-ইউর ওয়াইফ অলসো লাকি তুমি উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে তোমাকে ধরে ফেলেছি। আফতাব নিজে কে আর সামলাতে পারেনা। ওর গা গুলিয়ে আসছে। নাড়ি ভুড়ি ছিড়ে কি যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে। আফতাব ঘাড়টা এলিয়ে দেয়। নীলুফার সিকুরিটির লোকজনের সাহায্যে আফতাবকে তার রুমে নিয়ে যায়। রুমে বসিয়ে আফতাবকে একটা ট্যাবলেট খাইয়ে দেয়। আফতাব ঘুমিয়ে যায়। মর্টিনের কৌটাটা নীলুফার সিকিউরিটির লোকদের দিয়ে দেয়। নীলুফার সিকিউরিটির লোকদের সাবধান করে দিয়ে বলে,বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে তাদের জন্যে ভাল হবেনা। তারা বলে, ঘটনাটা ঘটলে তো নিশ্চয়ই তাদের হোটেলের সুনাম ক্ষুন্ন হতো। যদিও তারা এর সাথে কোন ভাবেই জড়িত নয়। পরের দিন সকালে আফতাবের স্ত্রীকেও নীলুফার ডেকে নিয়ে আসে হোটেলে। বলে, আমরা ডেঞ্জারাস টাইমটা ওভার কাম করেছি। ও এখন ইচ্ছে করলেও ওটা করতে পারবেনা। ইট’স ব্লকড। আর আমি তো আছিই। নীলুফার আফতাবের স্ত্রীকে বলে,  বেশীরভাগ মানুষই মানবেতর জীবন যাপন করেও বেঁচে থাকার আকাংখা জাগিয়ে রাখে আবার কিছু লোক সামাণ্যতেই ভেঙ্গে পড়ে। এবং বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। মানুষ যখন একা হয়ে যায়,তখন তার মাথায় আত্নহত্যার ভ ূত চেপে বসে। আফতাবের স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে নীলুফার বলে,  তোমার অবশ্য এসব বোঝা ও জানার কথা নয়। যা হোক ওকে এখন থেকে চোখে চোখে রাখবে। প্রেরণা জোগাবে। মেয়েরা অবশ্য এ কাজটি ভাল জানে। গুড লাক ফর ইউ। এনি ওয়ে হি ইজ নট লিভিং আস। বলে আফতাবের বউয়ের কাঁধে চাপড় মারে। এবং আফতাব যদি সত্যি সত্যি ঘটনা-টা ঘটাতো তাহ’লে মিডিয়া বিশেষ কওে ইরেকট্রনিক মিডিয়া যেভাবে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো তার থেকে রক্ষা নীলুফার জাহান ওকে যেভাবে রক্ষা করলো সেই কৃতজ্ঞতায় নীলুফাকে সে জড়িয়ে ধরে ঢুকরে কেঁদে ওঠে। নীলুফার ওকে কাঁদতে দেয়। কিছু বলেনা। [email protected] [RTF bookmark start: }_GoBack[RTF bookmark end: }_GoBack

মাইকেল মধুসূদন দত্তের ছন্দ প্রবর্তন

মাইকেল মধুসূদন দত্তের ছন্দ প্রবর্তন

মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্মগ্রহণ করেন ২৫ জানুয়ারি ১৮২৪ সালে, যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক। তার অসামান্য সাহিত্যকর্ম বাংলা কাব্যজগতে এক নতুন যুগের সূচনা করে। বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছন্দে যে বিপ্লব সাধন করেছেন, তা বাংলা কাব্যধারায় এক নবজাগরণের সূচনা করে। বাংলা কবিতায় গদ্যের মতো স্বাভাবিক গতির ছন্দ এবং ইউরোপীয় কাব্যরীতির সংমিশ্রণ তার এক অনন্য কৃতিত্ব। তবে এই নতুন ধারার  প্রবর্তনে তাকে যে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছিল এবং তার ছন্দনৈপুণ্যের পেছনের কাহিনি অনেকের কাছেই অজানা। মধুসূদন ছিলেন ইংরেজি ও গ্রিক-ল্যাটিন সাহিত্য অনুরাগী। তিনি মিল্টন, বায়রন ও হোমারের কাব্যগুণে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে, বাংলা ভাষায় তাদের মতো গভীরতা ও ছন্দ আনার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই লক্ষ্যে বাংলা কবিতায় প্রথমবারের মতো ইউরোপীয় কাব্যছন্দ অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দ হলো এমন এক ছন্দ, যেখানে নির্দিষ্ট মাত্রা ও কাঠামো বজায় থাকে, কিন্তু মিলবদ্ধ থাকে না। এটি বাংলা সাহিত্যে এক বিপ্লব এনে দেয়। মধুসূদন তার মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ (১৮৬১) রচনার সময় বাংলা কবিতায় প্রচলিত পদ্যরীতির বাইরে গিয়ে দীর্ঘ পঙ্ক্তি ও ছন্দহীন অনুরণন ব্যবহার করেন। এটি বাংলা কাব্যে এক নতুন যুগের সূচনা করে। প্রথমদিকে অনেকে এই ছন্দকে গ্রহণ করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। অনেক সাহিত্যবোদ্ধা মনে করতেন, বাংলা ভাষার জন্য এটি উপযুক্ত নয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এটি স্বীকৃতি পায় এবং বাংলা কবিতায় স্থায়ী জায়গা করে নেয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা সাহিত্যে সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতার প্রবর্তক। সনেট মূলত ইতালীয় ও ইংরেজি কবিদের মধ্যেই জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু মধুসূদন বাংলা ভাষার উপযোগী করে এটিকে নতুন মাত্রায় নিয়ে আসেন। তার রচিত ‘কপোতাক্ষ নদ’ বাংলা ভাষায় প্রথম সনেট। যদিও প্রথম দিকে এই ধরনের কবিতা তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি, পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অন্য কবিরা সনেট রচনায় উৎসাহী হন। মাইকেল যখন বাংলা কবিতায় নতুন ছন্দ প্রয়োগ করেন, তখন তৎকালীন কবি ও পাঠক সমাজের বিরোধিতার সম্মুখীন হন। প্রথাগত পয়ার ছন্দের বাইরে গিয়ে এমন বিপ্লব সাধন করায় অনেকেই তাকে বাংলা কবিতার নিয়ম ভঙ্গকারী বলে মনে করতেন। কিন্তু তার অসাধারণ সাহিত্য প্রতিভা ও নিরীক্ষাধর্মী প্রয়াসের ফলে বাংলা কবিতায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলা কবিতায় শুধু নতুন বিষয়বস্তু আনেননি, বরং ছন্দের ক্ষেত্রেও যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন। তার প্রচলিত অমিত্রাক্ষর ছন্দ ও সনেট পরবর্তী কবিদের জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে। প্রথমে সমালোচিত হলেও, পরবর্তীতে তার ছন্দ বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। তার এই অজানা সংগ্রাম বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম

বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা সংগ্রাম

বর্তমান আমরা যে বাংলাদেশে বসবাস করি, তা কিন্তু চিরায়ত বাংলা নয়। প্রাচীন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা যে চিরায়ত বাংলা সীমানা পাই তা হলো উত্তরে গিরীরাজ হিমালয়, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে মিয়ানমার ও পশ্চিমে বিহার ও উড়িষ্যা প্রদেশ। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর পূর্বেও এই বাংলার সীমানাও অখণ্ড ছিল না। তখন এটা পুর্ন্ড্রবর্দ্ধন ও দণ্ডভুক্তি নামে দুটি ভুক্তিতে বিভক্ত ছিল। পুর্ন্ড্রবর্দ্ধন ভ্ুিক্ত রাজধানী ছিল পুর্ন্ড্রবর্দ্ধন যা বর্তমান বগুড়া জেলার অন্তর্গত মহাস্থানগড় নামে পরিচিত। আর দণ্ডভুক্তির রাজধানী মেদীনিপুর জেলায় অবস্থিত ছিল। গুপ্ত যুগে এই ভুক্তি দুটি ভেঙ্গে বঙ্গ, বরেন্দ্র, রাঢ়, সমতট, হরিকেল, রত্নদীপ নামে ছয়টি স্বাধীন রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়। খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় দুই হাজার দুইশত বছর পূর্বে মধ্য এশিয়া থেকে আর্য নামে এক যাযাবর জাতি, পুন্ড্রবর্দ্ধনে তথা বাংলাদেশে আগমন ঘটে। তারা (পুন্ড্রবর্দ্ধন) এদেশের জনগণের ওপর অকথ্য অত্যাচার ও আগ্রাসন চালায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এটাই ছিল সম্ভবত বাঙালি জাতির ওপর সর্বপ্রথম বৈদেশিক আক্রমণ। বাঙালির স্বাতন্ত্র্যবোধ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রাণপণে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে শোচনীয়ভাবে তারা এই আর্য জাতির নিকট পরাজিত হয়। অনুমান করা হয় এটাই বাঙালি জনতার প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের উৎপত্তির বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। অবশ্য একথা অনস্বীকার্য কলাকৌশলে আর্যরা সামরিক শক্তিতে সে সময়ে অনেক উন্নত ছিল। এর কারণেই পরবর্তীতে তারা আর্য জাতির নিকট পর্যুদস্ত ও পরাজিত হয়। আর্যরা এদেশে দখল করে তৎকালীন অনার্য জনগণকে দস্যু, অসুর প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করে এবং সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজেদের দেবজাতি বলে প্রচার করতে শুরু করে। আর্র্যদের পরে খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ খ্রিস্টাব্দে গ্রীক বীর আলেকজান্ডার হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে শক্তিশালী পুরুর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। পুরু বীর বিক্রমে প্রাণপণে যুদ্ধ করে আলেকজান্ডারের নিকট পরাজিত  ও বন্দী হন। আলেকজান্ডার বাংলা আক্রমণের জন্য অগ্রসর হলে তদান্তিন শক্তিশালী বাংলার সামরিক বাহিনীর  উন্নত যুদ্ধের কলাকৌশল ও শৌর্য, বীর্যের পরিচয় পেয়েও বীর বিক্রম বঙ্গরাজের নাম শুনে পিছু হটতে বাধ্য হন। এরপর ৩২৩ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে ব্যাবিলনে বর্তমান মেসোপটেমিয়া ইরাকে আলেকজান্ডার মৃত্যুমুখে পতিত হন। এরপর বাংলার তুর্কী ও পাঠান শাসনের উদ্ভব হয়। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজী রাজা লক্ষণ সেনকে বিতাড়িত করে বাংলার মুসলিম শাসনের সূচনা করেন। শিরিন খলজী, আলী মর্দান খলজী, গিয়াস উদ্দীন ইওয়াজ খলজী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে খলজী শাসনের অবসান হয় এবং ১২৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই দীর্ঘ ৬০ বছরের পরিক্রমায় বাংলা দিল্লীর অধীনে চলে যায়। এই দীর্ঘ ৬০ বছরে বাংলা ১৬ জন শাসনকর্তা দ্বারা শাসিত হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, বাংলার এই দীর্ঘ ৬০ বছরের ইতিহাস অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় ও গৌরবমন্ডিত। এই শাসকদের অনেকের মুখে দিল্লীর স্বাধীনতা শিকার করলেও কার্যত বাংলা প্রায় স্বাধীনই ছিল। দিল্লী থেকে বাংলার দূরত্ব দীর্ঘ এবং বর্ষাকালে রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত ও দুর্গমতার জন্য অধিকাংশ এলাকায় বাংলার বিদ্রোহ দেখা দিত। ঘন ঘন বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার জন্য বাংলাকে বলা হতো ‘বুলগ্রাকপুর’ বা বিদ্রোহী নগরী। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তুর্কী জাতি ক্রমে ক্রমে সমগ্র বঙ্গ জয় করে স্বাধীনভাবে বাংলাদেশের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তুর্কী শাসনামলে ১৬ জন গর্ভনর বাংলা শাসন করে বলে ঐতিহাসিকরা অভিমত ব্যক্ত করেন। অবশ্য উল্লেখ করতে হয় কেন্দ্র ও বাংলার শাসনকর্তা মূলত সবাই ছিলেন সে সময় তুর্কী জাতি। তৎকালীন বাংলার শাসনকর্তার সেই ১৬ জন গর্ভনরের নাম ও পরিচিতি তুলে ধরা হলো- ১) বখতিয়ার খলজী [১২০৪ খ্রিষ্টাব্দ], ২) শিরিন খলজী, ৩) আলী মর্দান খলজী, ৪) গিয়াস উদ্দীন ইওয়াজ খলজী, ৫) নাসির উদ্দীন মাহমুদ [১২২৭-১২২৯ খ্রিষ্টাব্দ], ৬) মালিক বলখ খলজী [১২২৯-১২৩০ খ্রিষ্টাব্দ] ৭) নশরত শাহ বিন মওদুদ [অল্প দিন], ৮) মালিক আলাউদ্দীন জানী [১ বছর], ৯) সাইফ-উদ-দীন আইবক [৩ বছর], ১০) আওর খান [অল্প দিন], ১১) তুগরল তুগান খান [১২৩৬-১২৪৫ খ্রিস্টাব্দ], ১২) ওমর খান কিয়ান [১২৪৫-১২৪৭ খ্রিস্টাব্দ], ১৩) মালিক জালাল উদ-দীন-মাসুদ [১২৪৭-১২৫১ খ্রিস্টাব্দ], ১৪) মালিক ইখতিয়ার উদ্দীন ইউজেবেক [১২৫১-১২৫৭ খ্রিস্টাব্দ], ১৫) ইজ্জ উদ-দীন বলখ ই-ইউজ-বলকী [১২৫৭ খ্রিস্টাব্দ], এবং ১৬) তাজউদ্দীন আরসালান [১২৫৭-১২৬৫ খ্রিস্টাব্দ মৃত্যু]। এরপর ১২৬৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর সুলতান নাসির উদ্দীন মাহমুদ মৃত্যুবরণ করলে বলবন, সুলতান গিয়াস উদ্দীন বলবন নাম ধারণ করে দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। বলবনী শাসনের অধীনে বাংলার গভর্নর ছিলেন যথাক্রমে- ১) তাঁতার খান [১২৬৫-১২৬৮ খ্রিস্টাব্দ], ২) শের খান [১২৬৮-১২৭২ খ্রিস্টাব্দ], ৩) আমীন খান [অল্পদিন], ৪) তুগরল খান [১২৭৩ খ্রিস্টাব্দ], এবং ৫) নাসির উদ্দীন মাহমুদ বুগরা খান [১২৮১-১২৮৮ খ্রিস্টাব্দ]। বুগরা খান সত্যিকারভাবেই বাংলা ও বাংলার মানুষকে অকৃত্রিমভাবে ভালোবেসেছিলেন বলেই জীবনে অনেক মূল্যবান সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। এমনকি তিনি বাংলার মদসন ছেড়ে দিল্লীর সিংহাসনে বসতে রাজি হননি। বুগরা খান বাংলায় কখন মৃত্যুবরণ করে তা আজও জানা যায় নেই। বুগরা খানের পুত্র সুলতান রুকুন উদ-দীন কায় কাউস [১২৯১-১৩০০ খ্রিস্টাব্দ] পর্যন্ত বাংলাদেশ শাসন করেন। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার খলজী, তুর্কী, মালিক এবং বলবনী সুলতান ও গভর্নরগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলার প্রতিষ্ঠা পাবার লালায়িত ছিলেন। ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সম্রাট জহিরুদ্দীন বাবর। বাবরের আমলে বাংলা বিজিত হয় নাই। বাবরের পুত্র বাদশাহ হুমায়ুন ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ গৌড় দখল করেন, কিন্তু কৌনজের যুদ্ধের পর শেরশাহ বাংলার মুঘল শাসক জাহাঙ্গীর কুলিকে পরাজিত করে বাংলাকে শুরু সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দ। চুনার দুর্গ দখল করতে গিয়ে বারুদের আগুনে পুড়ে শেরশাহ মারা যান অকস্মাৎ। শেরশাহ মারা যাবার কিছু দিন পরেই এই শুর সাম্রাজ্যে পতন ঘটে। আকবর বাংলা জয় করেন ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে। বাংলা আবার মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। সম্রাট আকবরের সময় সমগ্র বঙ্গদেশ ‘সুবই-ই-বঙ্গাল’ নামে পরিচিত হয়। সম্রাট আকবর শাসনকার্যের সুবিধার জন্য বৃহত্তর বাংলাকে ১৯টি সরকারে বিভক্ত করেন। তখন বাংলার রাজধানী ছিল রাজমহল। মুঘলদের হাত থেকে বাংলার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য দাউদ খান কবুরানী ও বার ভুঁইয়া এবং তাদের নেতা ঈশা খাঁ বহুদিন পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়েছিলেন এবং বাংলাকে স্বাধীন করবার জন্য মুঘলদের বিরুদ্ধে তারা প্রচণ্ড প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তাদের সেই সময় এই বাংলায় সৈন্যদল ও নৌবহর ছিল। ঈশা খাঁর রাজধানী ছিল ঢাকার অদূরে সোনারগাঁও নামক স্থানে। অনেক সময় তারা একজোট হয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করতেন। কিন্তু বিশাল মুঘল বাহিনীর সঙ্গে তারা কিছুতেই পেরে উঠতে পারেন নাই। ১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লীর মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর বাংলার সুবাদার মুর্শিদ কুলি খাঁ বাংলাকে নামে মাত্র দিল্লীর অন্তর্ভুক্ত রেখে প্রায় স্বাধীনভাবে রাজকার্য পরিচালনা করেন। বাংলার রাজধানী ছিল তখন মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদ কুলি খাঁ বাংলার রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য সারা বাংলাকে ১৩টি চাকলায় বিভক্ত করেছিলেন। মুর্শিদ কুলি খাঁর পর বাংলার নবার হন তার নিজ পুত্র সুজাউদ্দৌলাহ তদ্বীয় পুত্র সরফরাজ খানও পরবর্তীতে আলীবর্দী খান। আলীবর্দী খানের সুশাসনে প্রজারা বাংলার সুখে-শান্তিতে বসবাস করেন। তার আমলে বাংলার বিখ্যাত বর্গীর হামলা হয়। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সে সময় বর্গীয় হামলা মোকাবিলা করেন। বাংলা থেকে বর্গীদের চিরতরে পর্যুদস্ত, পরাজিত ও বিতাড়িত করেন। ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ এপ্রিল আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পরে তার কোন ঔরসজাত পুত্র সন্তান না থাকায় বিহার, উড়িষ্যার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করে যান সিরাজউদ্দৌলাকে। এ সময় সিরাজউদ্দৌলার বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের ২২ জুন পর্যন্ত বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা নিয়ে গঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তাঁর  সিংহাসনের আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র ১৪ মাস১৪ দিন। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দ ইংরেজ জাতি পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে প্রহসনের যুদ্ধে পরাজিত করে বাংলার স্বাধীনতা হরণ করেন। ইতিহাসের কালানুক্রমিক অনুষঙ্গ এসেছে বাঙালির বিদ্রোহের সোপান বেয়ে। ১৭৬৩ থেকে ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলমান ছিল বাংলাদেশে প্রথম কৃষক বিদ্রোহ। ইংরেজ শাসক গোষ্ঠী যার নাম দিয়েছিলেন ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। অতঃপর মেদিনীপুরে আদিবাসী কৃষক বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৭৮৩ খ্রি.), কুমিল্লার কৃষক বিদ্রোহ (১৭৬৭-১৭৬৮ খ্রি.), সন্দ্বীপের কৃষক বিদ্রোহ (১৭৬৯, ১৮১৯, ১৮৭০ খ্রি.), তাঁতি বিদ্রোহ (১৭৭০-১৭৮০ খ্রি.), চাকমা বিদ্রোহ (১৭৭৬-১৭৮৭ খ্রি.), নীল বিদ্রোহ (১৭৭৮-১৮০০ খ্রি, ১৮৩০-১৮৪৮ খ্রি, ১৮৫৯-১৮৬১ খ্রি.)। এভাবে একে একে লবণ চাষী বিদ্রোহ (১৭৮০-১৮০৪ খ্রি.), রেশম চাষী বিদ্রোহ (১৭৮০-১৮০০ খ্রি.) রংপুরের কৃষক বিদ্রোহ (১৭৮১-১৭৮৩ খ্রি.), যশোহ, খুলনার কৃষক বিদ্রোহ (১৭৮৪-১৭৮৬ খ্রি.), বীরভূম কৃষক বিদ্রোহ (১৭৮৫-১৭৮৬ খ্রি.), বীরভূমে বাকুড়ায় আদিবাসী বিদ্রোহ (১৭৮৯-১৭৯১ খ্রি.), বরিশালের দক্ষিণাঞ্চলে কৃষকবিদ্রোহ (১৭৯২ খ্রি.), ময়মনসিংহ গারো বিদ্রোহ (১৭৭৫-১৮০২ খ্রি. ১৮৩৭-১৮৮২ খ্রি.), ময়মনসিংহ কৃষক বিদ্রোহ (১৮১২-১৮৩০ খ্রি.), মহাবিদ্রোহ যা সিপাহী বিদ্রোহ নামে পরিচিত (১৮৫৭ খ্রি.), পলাশী পরবর্তী ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সেই হারানো স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য বাঙালি জাতি ইংরেজদের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এটা ছিল সে সময় আধুনিক বাংলার প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম। এই স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাংলার শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। কিন্তু যুদ্ধে তিনি জয়ী হতে পারেন নাই। ইংরেজদের প্রহসনের বিচারে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন, এবং বর্তমানে মায়ানমারের রেঙ্গুনে তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অতিবাহিত করেন। তাঁর স্ত্রী জিনাত-উন-নেসাসহ তাঁর সমাধি আজও রেঙ্গুনে বিদ্যমান রয়েছে। অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস ইংরেজরা তার দুই পুত্রকেও প্রকাশ্য দিবালোকে দিল্লীর রাজপথে গুলি করে হত্যা করে। দৃপ্তমুক্ত আলোর আযাদীর সংগ্রামে বাংলার রাজপথ বারবার হয়েছে রক্তে রঞ্জিত। পরবর্তীতে সুন্দর বন অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ হয় (১৮৬১ খ্রি.), সিরাজগঞ্জে কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭২-১৮৭৩ খ্রি.), কুমিল্লার কৃষক বিদ্রোহ (১৯২৮-১৯৩১ খ্রি.), কিশোরগঞ্জে কৃষক বিদ্রোহ (১৯৩০ খ্রি.) এবং তেভাগা কৃষক বিদ্রোহ জ্বলে উঠে (১৯৪৬-১৯৪৭ খ্রি.)। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজ ভারত ত্যাগ করলে দিল্লী ও পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করে ভারত ও পাকিস্তানভুক্ত করে নেয়। প্রায় দীর্ঘ ২০০ বছর পর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে চিরতরে ইংরেজ শাসনের অবসান হয়। পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান রাষ্ট্রের আওতাভুক্ত হলো কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে ধীর ধীরে বাঙালিদের মধ্যে প্রচন্ড অসন্তোষ ক্ষোভ দানা বেধে ওঠে। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ দফার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলা চূড়ান্ত আন্দোলনের পথে এগিয়ে যায়। এর পরেই এলো সেই অগ্নিঝরা ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ও ২৬ মার্চের বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ মাস বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলে। দেশকে স্বাধীন করবার জন্য চলে মরণপণ স্বাধীনতার যুদ্ধ। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পাশবিক অত্যাচারের কবল থেকে মুক্তির জন্য চলে আপোসহীন স্বতঃস্ফূর্ত যুদ্ধ। ২৫ বছরব্যাপী শোষণ, বঞ্চনা, এক যুগব্যাপী সামরিক শাসনের প্রতিবাদে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মানসিক জাগরণ আবর্ত হয়ে এক মোহনায় প্রবেশ করেছিল বাঙালির স্বাধীনতার ডাক সেই ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মার্চ। ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ মহান মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের স্মৃতি অমর হোক। সেই সঙ্গে যুগে যুগে এই বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের যে সব বীর শহীদরা অকাতরে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাংলাকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তাদেরও আজ সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করছি। ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে যে গৌরব আমাদের অর্জিত হয়েছিল তা যেনো চিরকাল এই বাংলায় অটুট থাকে।

আত্মহত্যার আগে এবং পরের রূপালী মুহূর্ত

আত্মহত্যার আগে এবং পরের রূপালী মুহূর্ত

অবশেষে গত রাতে শুতে যাওয়ার আগে মিনিট খানিক ভেবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো আফতাব। মাথার বাঁ পাশে যে জায়গাটায় আগুনের তুবরির মতো ব্যথা ফুটতে থাকে, একটা,দুটো নয় অন্ততঃ চারটে পেন কিলার ট্যাবলেট না খেলে-ব্যথা ব্যথার মতোই থাকে। আশ্চর্য! একটা স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পর-সেখানে সব কিছু শান্ত ও স্থির হয়ে এলো। নিউইয়র্কে থাকার সময় মাঝে মাঝে এ ব্যথার কারণে দু’তিনদিন কাজে যেতে পারেনি। সেজন্যে অনেক জায়গায় তার কাজও ছুটে গেল। শেষমেষ ক্যাব ধরলো। কাজের ব্যাপারে অনেকটা স্বাধীনতা পেল। ব্যথার কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে প্রথমে টাইনানল-তারপর বিয়ার এবং তারপরে লিকারের সঙ্গে নানা রকম ড্রাগ মিশিয়ে খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা হলো নেশা কেটে যেতেই আবার সেই ব্যথা। হাসপাতালে গিয়ে ক’দিন ইমার্জেন্সিতে গিয়ে লাইন দিয়েছে কোন কাজ হয়নি। নার্সের প্রথম কথা-তোমার ইনসুরেন্স আছে-আফতাব মাথা নাড়তেই-নার্স আর কথা বাড়ায়নি। ভেবেছিল ওর বন্ধু মামুনের মতো যদি একজন ভাল নার্স জুটে যায় তার কপালে! কিডনির প্রচন্ড ব্যথায় মামুন ইমার্জেন্সির দরোজার সামনে গিয়ে শুয়ে পড়ে-শুয়ে পড়ে মানে তার আর কোন সেন্স ছিলনা। যখন সেন্স এলো-অনুভব করলো-দুগ্ধ ফেননিভ শয্যায় সে শুয়ে আর তার চারপাশ ঘিরে অপ্সরীদের মতো মন ভোলানো নার্স। ফিসফিসিয়ে তারা তাদের গোটা মুখে হাসির আভা ছড়িয়ে জানতে চায়-এখন সে কেমন বোধ করছে। সে বলে খুবই ভাল বোধ করছে। একজন জানায় তোমার কিডনিতে সামান্য আঁচড় ধরেছে। তোমার ভাগ্যই বলতে হবে-সেদিনই  একজন কিডনি স্পেশালিস্ট এসেছেন জার্মানীর থেকে-এখানে একটা লেকচারে অংশ নিতে। কিডনিতে আঁচড়ের একজন রোগী পেয়ে তিনি খুব খুশি। এখন তোমাকে কি করে কিওর করা যায়-সেটা নিয়ে একটা টিম করা হয়েছে। তুমি চিকিৎসা এবং অর্থ দুই-ই পাবে। এ ক্ষেত্রে তোমার স্ট্যাটাস কিংবা ইন্সুরেন্স কোন ফ্যাক্টর নয়। টানা দু’মাস চিকিৎসা চলার পর-শ্যামলা রঙের মামুন সাহেরদেব মতোই ধবল রূপ পেল এবং গালের দু’পাশে আপেলের মতোই লাল ছোপ লেগে গেল। হাসপাতাল থেকে বেরিয়েই মামুন ফ্লাই করলো বাংলাদেশে। আফতাবও মামুনের মতো নিউইয়র্কের বিভিন্ন হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ভাগ্য পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে ব্যর্থ হতে হতে-একদিন নিজের কাছে প্রশ্ন করলো-কেন সে নিউইয়র্কে এভাবে পড়ে আছে! মামুন তো দেশে গিয়ে দিব্যি পত্রিকায় ঢুকে গেছে। মামুনকে কল করলেই বলে-চলে আয় দোস্-দেশে তো এখন মিডিয়ায় বুমিং! পত্রিকা আর টিভির ছড়াছড়ি-এখন তো তারা লোকই খুঁজে পাচ্ছেনা-ওখানে বসে বসে কি করছিস-লাইফ ইজ টু শর্ট মান-! শেষে একদিন আফতাব নিউইয়র্কের পাততাড়ি গুটিয়ে ফিরে এলো-ব্যাক টু দ্য প্যাভলিয়নে-ঢাকায়-বাংলাদেশে। আফতাব ফিরে এসেছিল একবুক আশা নিয়ে-দিনে দিনে সেই আশার সমুদ্র নদী নয়-শুষ্ক খালে রূপান্তরিত হলো। আফতাব প্রথমে ধাক্কা খেল মামুনের কাছ থেকে। সাতদিন সাতরাত অনবরত চেষ্টা করার পর মামুনের মোবাইল ওপেন হলো মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডের জন্যে। আফতাবের আশার বেলুনে মামুন আলপিন নয় যেন একটা পেরেক ঠুকে দিল। নভোমন্ডল থেকে আফতাব মাটিতে ধরাশায়ী হলো এবং ওর সামনের পৃথিবীটা ক্রমশঃ ধূসর হয়ে এলো। চেনা জানা যাকে ও পত্রিকায় কাজ পাইয়ে দিতে সাহায্য করেছে-তারা এখন গাড়ি ও ফ্লাটের মালিক। তারা ওর কাছে অকপটে স্বীকার করেছে-তার জন্যেই তারা আজ এখানে আসতে পেরেছে। আকার ইঙ্গিতে তারা ওকে এটাও বলার চেষ্টা করেছে যে,নিজের পথটা নিজেকেই করে নিতে হয়। সময় এবং পদ তো কারও জন্যে অপেক্ষা করেনা বন্ধু-বলে অনেকেই ওকে নিয়ে গেছে বারে। প্রথম প্রথম আশায় আশায় ওদের সঙ্গ দিয়েছে-পরে যখন বুঝতে পারলো-এসবই আলেয়া-তারপর ধীরে ধীরে নিজেকে সবখান থেকে গুটিয়ে নিয়েছে। দেশ ছাড়ার আগে আফতাবের ছোটখাট একটা সংসারও ছিল। সকাল আটটা থেকে পরের দিন সকাল আটটা পর্যন্ত ওরা-মানে ওর এক্স তাহ্মিনা-ও বলতো, মিনা-মিনাকুমারী,একসঙ্গে ছিল। ওদের চিন্তাচেতনা-এতোটাই মিলে গেল যে-মিনাই সুন্দর করে হেসে আফতাবের বুকে মাথা রেখে বললো,দেখ, আমরা দু’জনে  এই ধরায় একত্রে বসবাস করার জন্যেই এসেছি-চলো কাজির ওখানে গিয়ে আমরা বিয়েটা সেরে ফেলি। আফতাব রগর করে বললো, এতো সকালে তো কাজি তার দোকান খুলেনি। আফতাবের কথায় তাহমিনা প্রচন্ড রেগে গেল। সে হুড়হুড় করে তাকে মগবাজারের কাজির অফিসে নিয়ে গেল। সকালে আফতাবের দু’কামরার ছোট্ট ফ্লাটে দমকা হাওয়ার মতোই দরোজায় হামলে পড়েছিল মিনা। আর আফতাবও রাতে বেহুঁশ ছিল বলে দরোজায় ছিটকিনি লাগাতে ভুলে গিয়েছিল। পরিধেয় বস্ত্র খুলে একটা টাওয়েল জড়িয়ে বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিয়েছিল। নারীর কোমল স্পর্শে যখন তার ঘুম ভাঙলো তখন নিজেকে আবিষ্কার করলো-সে তার বিছানায় শুয়ে আছে উপুড় হয়ে কিন্তু কোন সূতাও নেই তার গায়ে। মিনাই মেঝের থেকে টাওয়েলটা কুড়িয়ে আফতাবকে দিল। বললো, আমি মুখ ঘুরিয়ে রাখছি টাওয়েলটা দিয়ে লজ্জা নিবারণ করুন। আদম তো ডুমুর পাতা দিয়ে ওই জায়গাটা ঢেকেছিল,মডার্ন এজ; পাতার বদলে টাওয়েল। তাহমিনা এতো কথা বলছে অথচ তার কিছু যে আফতাবের কর্ণ কুহরে ঢুকছে তা বোঝার উপায় নেই। তাহমিনা এটা বুঝতে পেরে জগ থেকে কিছুটা পানি হাতে নিয়ে ওর মুখে ছিটিয়ে দেয়। আফতাব মদির চোখে তাকায়। (চলবে... ) নিজের চোখ কে ঠিক বিশ^াস করতে পারছিলনা-সুন্দর,সুশ্রী ও আকর্ষনীয় ফিগারের অতীব স্মার্ট এক তরুণী তার সামনে দাঁড়িয়ে। তাহমিনা নিজেকে চেনানোর ভঙ্গিতে বলে, হ্যাঁ আমি। দরোজা খোলাই ছিল-সেই সুযোগে বসন্তের উথাল পাথাল হাওয়া ঢুকে পড়েছে। কাল রাতে আফতাব বিয়ার হুইস্কি রাম সব মিলিয়ে মিশিয়ে পান করেছে। একটা প্রচন্ড হ্যাংওভার ওকে মাথাটাই তুলতে দিচ্ছিলনা। আফতাব ওভাবেই উপুর হয়ে শুয়ে থাকে। আর তাহমিনা ভাবে,সে নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে বলে লজ্জায় শয্যা ত্যাগ করতে পারছেনা। তাহমিনা আরও সাহসী হয়ে ওঠে। সে টাওয়েলটা দিয়ে আফতাবের পশ্চাদদেশ  ঢেকে দেয়। এতে অবশ্য আফতাবের উঠে পড়াটা সহজ হয়। তারপরেও এইরকম একজন অপরিচিত তরুণীর কাছে সে সহজ হতে পারেনা। বাথরুমেই পাজামা সার্ট ছিল। সে দ্রুত পরে নেয়। দাঁত ব্রাশ করে কিছুটা স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে। আফতাব নিজের মনেই প্রশ্ন করে-এ মেয়েটাকে কখনও কি কোথাও কি দেখেছে! নাহ্ কোনভাবেই কোন যোগসূত্র মেলাতে পারেনা। বাথরুমে আর কতোক্ষণ পালিয়ে থাকবে! ফাঁকা পেয়ে  দুর্গের ভেতরে যখন ঢুকেই গেছে-তখন তাকে তো ফেস করতেই হবে। অগত্যা বেরিয়ে পড়ে আফতাব। আফতাব মেয়েটির দিকে তাকায়। বেগুনি জমিনে নীল পাড়ের একটা সিল্কের শাড়ি পড়েছে সে। নাভির উপর থেকে বুকের চূড়ার আগ পর্যন্ত মেদহীন চড়াচড়। এই প্রথম আফতাব খুব কাছের থেকে একজন তরুণীকে দেখলো। চুল থেকে নারকেলের সুবাস আর মুখ থেকে ক্রিমের একটা হালকা ঘ্রান আর শরীর থেকে ইন্দ্রিয় নাড়া দেওয়ার মতো পারফিউম ওকে কিছুটা উন্মাতাল করে তোলে। নিজেকে সামলে নিয়ে আফতাব বলে কফি চলবে তো? তাহমিনা অবাক হয়। (চলবে...) বলে, এখানে কফি পাবেন কোথায়? আফতাব কিচেনে যেতে যেতে বলে, কফি মেশিন আছে। তাহমিনা কৌতুহলী ভঙ্গিতে আফতাব কে ফলো করে। তার দু’হাত তার বুকের উপর তুলে সারেন্ডার করার ভঙ্গিতে বলে, টু বি অনেস্ট-আমি কখনো কফি খাইনি। আফতাবও রসিকতার ভঙ্গিতে বলে এ তো খাওয়ার জিনিষ নয়-এটা পান করার। এতোক্ষণ যেমন মেয়েটি হালকা চালে ব্যাটিং করে যাচ্ছিল এবং অনায়াসে রানও তুলে নিচ্ছিল-এই প্রথম যেন ঘুঘলি বলে ধরা খেয়ে গেল। সহসা তার মুখে কথা জোগায় না। আফতাব পরিবেশ সহজ করার ভঙ্গিতে বলে, জাস্ট জোকিং..মেয়েটিও হার স্বীকার করার ভঙ্গিতে বলে, জোকিং হলেও তা হূল ফোটানোর জন্যে যথেষ্ট। আফতাবও ঘাট মানার ভঙ্গিতে বলে, সরি..মাই সিনসিয়ার এপোলজি। মেয়েটির দিকে সরাসরি তাকিয়ে আফতাব বলে, আপনার জন্যে কফির পানি দেব। মেয়েটি বলে, নো থ্যাঙ্কস। আবার ব্যাটিং করার ভঙ্গিতে মেয়েটি বলে, তবে কফি সম্পর্কে পত্রিকায় পড়েছি, নিয়মিত কালো কফি পান করলে নাকি পুরুষরা অনেক দিন সেক্স ধরে রাখতে পারে। কোন মেয়ের মুখ থেকে সরাসরি সেক্স বিষয়ে কথা শুনে আফতাব খুব অবাক হয়। বলে, তাই নাকি! এই তথ্যটা তো আমিও জানতাম না। অবশ্য আমি সেই উদ্দেশ্যে কফি পান করিনা-রাতে একটু পান টান করি তো তাই সকালে হ্যাংওভার কাটাতে এই কালো কফি খুবই সাহায্য করে। পেয়ালায় কফি ঢালতে আফতাব কিচেনে যায়। আর মেয়েটি ওর বুক সেলফে বই দেখতে থাকে। কফিতে চুমুক দেওয়ার পর আফতাবের মাথাটা খুলে যায়। ওর মনে পড়ে যায়, কাল যখন মেয়েটি ওর অফিসে গিয়েছিল-আফতাব তখন ছিল একটা এসাইনমেন্টে। অফিসে এসে পিয়নের কাছ থেকে জানতে পারে একটি মেয়ে তার বাসার ঠিকানা নিয়ে গেছে। আফতাব পিওনের উপর চড়াও  হয়েছিলা এই বলে যে, কেন সে তার বাসার ঠিকানা দিল! পিওনও কম যায়না। প্রত্তুত্তরে বলেছিল, আপনাগো নিয়া  সমস্যার শেষ নাই-ইকবাল সাবের এক বান্ধবী আইসা তার বাসার ঠিকানা চাইলো- আমি দিলাম না। কেন আমি তার ঠিকানা দিলামনা-এই নিয়ে উনি আমাকে এই মারে তো সেই মারে-আর আপনি বলতেছেন উল্টো কথা। এই আমি কানে ধরলাম এরপরে কোন মহিলা এলে আমি সাফ সাফ বইলা দিমু-সারেরা এখানে কাজ করে বটে তবে আমি তাহাদের চিনিনা-ঠিকানাও জানিনা। ওর কথায় সবাই হেসে ফেলে। আফতাব তাকে পটানোর ভঙ্গিতে বলে,বুঝলানা মিয়া, মাইয়া মানুষ তো-দেবতারাই তাদের মনের দিশা পায় নাই আর আমরা তো মানুষ! যদি বাসায় গিয়ে বলে-চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি-তখন কি করবো? পিওনও বলে, কেন বিয়া করে ফালাইবেন! বিয়ার বয়স তো আপনার হইছেই..আফতাব আর কথা বাড়ায় না। আফতাব এবারে চায়ের পেয়ালা নিয়ে সোফায় গিয়ে বসে। আর মেয়েটিও আফতাবকে অবাক করে কোমরে শাড়ি গুঁজে দিয়ে ঘর গোছাতে লেগে যায়। এতে তার নাভিমন্ডল আরও দৃষ্টি গোচর হয়। আফতাব আড়ালে আবডালে নয়-ড্যাব ড্যাব করে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটি বুঝতে পেরে আঁচলটা আরও একটু বেশী করে কোমরে গুঁজে দিয়ে আড়চোখে মিষ্টি করে হেসে বলে, কি দেখছেন? আফতাবও বেহায়ার মতো বলে, যা দেখাচ্ছেন-তাই দেখছি। দেয়ালে টাঙ্গানো শিল্প কর্ম দেখানোর ভঙ্গিতে মেয়েটি বলে, ইজ ইট ইমপ্রেসিভ? আফজালও কম যায়না বলে, ইউ নো ইউ আর বিউটিফুল। পুরুষকে ঘায়েল করার জন্যে যে কয়টা মোক্ষম বাণ আপনার ত ূণে থাকা দরকার-তার সব ক’টিই আছে। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি, আপনি কেন ঘর গোছাতে হাত লাগাচ্ছেন? মেয়েটি অধিকার প্রয়োগ করার ভঙ্গিতে বলে,কেন এ ঘর আমার ঘর হলে আমি কি এভাবে আগোছালো রাখতে পারতাম? আফতাব তার ধারণা ভেঙ্গে দেয়ার ভঙ্গিতে বলে, কিন্তু ঘরটাতো আপনার নয়-কেন মিছেমিছি আপনার পরিপাটি শরীরে ধূলো বালি লাগাচ্ছেন? মেয়েটি আফতাবের দিকে সরাসরি তাকায়। মুখে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে বলে, এক সময় হতেও তো পারে! মেয়েটির কথা বলার ধরণ দেখে আফতাব এবারে ভয় পেয়ে যায়। সে কি এই সাত সকালে আফতাবকে ফাঁদে ফেলার জন্যে এসেছে?              আফতাব মেয়েটির কথায় খুশী হয়না-বরং কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বলে, সেই সময় যখন আসে-তখন না হয় দেখা যাবে’ক্ষণ। আপনি বসুন।  ব্যাটিং-এ আবার একটা গুগলীর আক্রমণে কিছুটা ধরাশায়ী হয়ে অগত্যা সোফায় বসতে উদ্যত হলে আফতাব তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, আপনার  হাত ডার্টি ওইতো- ওয়াশ রুম। ধুয়ে আসুন। মেয়েটি আর কোন কথা না বাড়িয়ে ওয়াশ রুমে গিয়ে দরোজা লাগিয়ে দেয়। আফতাব হাফ ছেড়ে বাঁচে। ভাবে, এই হ্যাং ওভারটা মাঝে মাঝে বেশ কাজে দেয়। সাধারণতঃ একজনের মুখের উপর অনেক অপ্রিয় কথাই বলা সম্ভব হয় না। কিন্তু হ্যাং ওভার থাকলে জ্ঞানের নাড়িটা থাকে টনটনে। একটা ব্যক্তিত্বের আবরণে মুখটা থাকে ঢাকা। চট করে কেউ তাতে ঢুকতে পারেনা। আফতাব এবার একটা সিগ্রেট ধরিয়ে টেবিলের উপর পা দু’টো মেলে ধরে আয়াস করে সিগ্রেট টানতে থাকে। মেয়েটা দরোজা খুলে ওয়াশ রুম থেকে বের হয়। কিন্তু আফতাব চোখ বুজে সেই ভঙ্গিতেই বসে থাকে। মেয়েটি তার তন্ময়তা ভেঙ্গে দেয়ার ভঙ্গিতে ছোট্ট একটা কাশি দিয়ে বলে, বসতে পারি? আফতাব নির্বিকার কন্ঠে বলে, বসুন। মেয়েটি খুব বিনয়ী ভঙ্গিতে বলে, একটা প্রশ্ন করতে পারি? আফতাব বলে, নিশ্চয়ই। মেয়েটি বলে, আপনার ওয়াশ রুমে দেখলাম,সব কিছুই বিদেশী এবং বেশ দামী-আপনি কি সাংবাদিকতা ছাড়াও ব্যবসায় করে থাকেন? আফতাব হাসে। বলে, না। আমার মা বাবা কেউ নেই। আছে শুধু আমার একটাই বোন। সে আমার বড়। থাকে আমেরিকায়। দেশে আসছে এমন কাউকে পেলেই গাদা গাদা জিনিষ পাঠায়। একা এতো জিনিষ কি ভাবে ব্যবহার করবো! বন্ধু বান্ধবদের গিফট করে দেই। মাঝেমধ্যে কল করে বলে, একটা বিয়ে করে দেখনা-তোর বউকে এমন এমন সব প্রসাধনী পাঠাবো না শি উইল বি অ্যা ম্যাড। মেয়েটি মিটি মিটি হেসে ভ্রু নাচিয়ে বলে, তা বিয়ে করছেন না কেন? এবারে সিগ্রেটটায় শেষ টান দিয়ে টুকরোটা এ্যাশ ট্রে-তে গুঁজে দিয়ে সরাসরি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আফতাব বলে, অনেক কথাই তো হলো-এবার বলুন তো আপনি কে? কেনই বা সাত সকালে আমার বাড়ি এসে হানা দিয়েছেন? আপনার মতলব টা কি? আজ আমার ডে অফ অনেক কিছু করার প্লান আছে। সামনের মাসে বোনের ওখানে যাচ্ছি। সাংবাদিকতা করি তো-এই ধরুন কুকুরের কোন কাজ নেই কিন্তু তার দৌড় ছাড়া হাঁটাও নেই। আফতাব এবারে মেয়েটির মুখ থেকে কিছু শোনার অপেক্ষায় থাকে। মেয়েটি কিন্তু কোমরে যেভাবে আঁচলটা গুঁজে রেখেছিল-সেভাবেই রেখেছে। ওয়াশ রুমে গিয়েও তাতে কোন ব্যত্যয় ঘটায়নি। এবার সে নিজেকে বেশ গুছিয়ে কথা বলতে শুরু করে। বলে, আমার নাম তাহমিনা রহমান-সবাই মিনা বলেই ডাকে। আফতাব তাকে থামিয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে বলে, আমি কিন্তু আপনাকে আমার অতি প্রিয় একজন নায়িকা-মীনা কুমারী বলে ডাকবো-আপত্তি নেই তো? মিনা হেসে বলে, আপত্তি থাকবে কেন-এটা তো বরং একটা কমপ্লিমেন্টস। মিনা বলতে শুরু করে। আমারও আপনার মতো মা বাবা নেই। ভাইয়ের কাছে মানুষ। মাস্টার্স করে একটা কলেজে পড়াচ্ছি। আমার এক বন্ধুর সাথে স্পেস শেয়ার করে থাকি। মাঝে মধ্যে কবিতা লিখি। গদ্য লিখতে চেষ্টা করি। পারিনা। আফতাব তার কথা কেড়ে নিয়ে বলে,এখানে আপনার সঙ্গে আমার একটা মিল-আপনি গদ্য লিখতে চেষ্টা করেন পারেন না। আর আমিও আপনার মতো পদ্য লিখতে চেষ্টা করি পারিনা। তবে সম্ভবত গত সপ্তাহে আপনার একটা কবিতা আমি দৈনিক বাংলার সাহিত্যের পাতায় পড়েছি। কবিতায় কিছুটা হতাশা ছিল আবার আশার কথাও আছে-ঠিক কিনা! মিনা মাথা নাড়ে। আফতাব অনেকটা অসহিষ্ণু কন্ঠে বলে, তা আমার ব্যাপারে আপনার উৎসাহের হেতুটা কি? কালকে অফিসে গিয়ে আমার ঠিকানা সংগ্রহ করেছেন.. মিনা এবারে নড়েচড়ে বসে। বলে, পত্রিকার পাতায় আপনার ব্যাপারে একটা ছোট্ট খবর আমাকে আপনার ব্যাপারে কৌতুহলী করে তোলে। আফতাব বলে, ওই যে ‘একজন গল্পকার পকেটমার হিসেবে ধৃত’.. মিনা খুব অবাক হয়। আপনার ইনটুইশন তো দারুণ। আফতাব বলে, আশলে রাতারাতি সকলের মনোযোগ কাড়ার জন্যেই ওটা আমি করেছিলাম। তাতে অবশ্য সাফল্যও জুটে গিয়েছিল। আমাকে কোথাও গিয়ে আর পরিচয় দিতে হয়নি। ওই খবরটার কথা বললেই সবাই চিনে ফেলে। সেই সুবাদে পত্রিকায় একটা কাজও জুটে গেল। তবে জেলে গিয়ে একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সন্ত্রাসী গালকাটা কামালের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তার ছিল সুন্দর গানের কন্ঠ। আমি জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরপরই তার ফাঁসি হয়ে যায়। তবে আমার বোন খুব দুঃখ পেয়েছিল।বলেছিল, তুই টাকার জন্যে মানুষের পকেট মারতে গিয়েছিলি?  তাকে বলি,এটা ছিল একটা এডভেঞ্চার-সে এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। মিনা বলে,  তবে আপনার লেখার হাতটা কিন্তু চমৎকার। আপনার গল্প ছাপা হলেই পড়ি। তবে একটা সত্যি কথা বলবো-মাইন্ড করবেন না তো? আফতাব তাকে অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, মাইন্ড থাকলে না করবো! মিনা হাসে। বলে, আপনার গল্পে কোন রোমান্স থাকেনা কেন? আফতাব অকপটে বলে,রোমান্স থাকলে না তা কলমের ঢগায় শেফালির মতো স্নিগ্ধ ঘ্রাণ ছড়াবে। মিনা কিছুটা ডেসপারেট ভঙ্গিতে বলে, ইন্সটান্ট আই ফল লাভ উইথ ইউ..আফতাব নির্মোহ ভঙ্গিতে বলে, বাট আই এ্যাম নট..মিনা অধীর কন্ঠে বলে, হোয়াই নট। আফতাব মিনাকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে, দ্রুত প্রেমে পড়লে তা কখনো মধুরেণ সমাপয়েত হয়না। তা বরং চিনে মাটির বাসন ভেঙ্গে গেলে যেমন একটা আঁচর পড়ে-এ আঁচরটা লাগে হৃদয়ে যা কখনোই মুছে যায়না। তারপর ওরা প্রেমের নানা রকম যুক্তি তক্ক দাঁড় করায়। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়, বিকেল গড়িয়ে নামে সন্ধ্যা, তারপর রাত, সারা রাত এবং সকালে গিয়ে তা রফা হয় কাজির অফিসে গিয়ে। মিনা সেদিনই এসে উঠে আফতাবের ফ্লাটে। এবং আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিয়ের পরের দিন থেকেই ওদের মতের চেয়ে অমতই হয় বেশী। মিনার বড় খরচের হাত। প্রতি রাতেই চায়নিজ খাওয়ার জন্যে বায়না ধরে। এবং মিনা খুব ধুরন্ধরও বটে। সে বুঝতে পেরেছে আফতাবের ব্যয়ের একটা মোটা অংশ আসে তার বোনের কাছ থেকে। তাই সে শাড়ি গহনা কিনে আলমারী দেরাজ সব ভরে ফেলে। আফতাব তার বোনের কাছে তার এই মধুর দাম্পত্য জীবনের কাহিনী বিবৃত করে। বোন ভাইটাকে খুব ভালবাসে। বলে, এখন কি করবি? আফতাব বলে, কিছুই তো বুঝতে পারছিনা। বোন বলে, যতো দিন যাবে ততোই ইট উইল বি ওয়াস্ট..ওয়াইজ ডিসিসান হচ্ছে-টু লিভ হার। তুই যে আমেরিকায় আসছিস সে কি এ কথা জানে? আফতাব বলে, কথাচ্ছলে একদিন বলেছিলাম। বোন বলে, আর বলবিনা। বরং কায়দা করে বলে দে-এখন আর এখানে আসছিস না আমি ইউরোপ ট্যুরে যাচ্ছি। কথাটা ইনটেনশনালী বলবিনা। বলবি খুব ক্যাজুয়ালী। একটা আফসোসও থাকবে তোর কথা বলার ধরণে-যা তার কাছে বিশ^াসযোগ্য মনে হয়। খুব কানিং মেয়ে তো ধরে ফেলবে। পাসপোর্ট টিকেট তোদের ক্লাবের লকারে রেখে দে। যখনই আমেরিকার প্রসঙ্গ তুলবি-তারপর থেকেই ও কিন্তু তোর পাসপোর্ট হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে। একদিন মিনাই নিজের থেকে বলে-এই এ মাসেই না তোমার আমেরিকায় যাওয়ার কথা। আফতাব তার বোনের শেখানো পাঠ গাইতে থাকে। মিনা কিছুটা বিস্মিত হয়। এবং সেই ভঙ্গিতেই বলে, তা তোমার পাসপোর্ট কোথায়? আফতাব অবাক হয়। তুমি আমার পাসপোর্ট খুঁজছিলে কেন বলতো? মিনা পাকা অভিনেত্রীর মতোই বলে-বারে! তোমার স্ত্রী হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছেনা? টিকেট পাসপোর্ট সুটেকেস এসব গুছিয়ে দিতে হবেনা! এবং আরও একটা কথা-তোমার যে ট্রিপটা ক্যানসেল হয়েছে সে কথাটা আমাকে জানালে না কেন? আমি যখন ট্রিপের ব্যাপারে জানতে চাইলাম-শুধু তখনই বললে-অ্যাই এ্যাম গেটিং সাম স্মেল ফ্রম হেয়ার..আফতাব উত্তেজিত হয়না। বলে, কি স্মেল পাচ্ছ? আফতাবের দিকে সরাসরি তাকিয়ে কঠিন মুখে মিনা বলে,হোয়ের ইজ ইউর পাসপোর্ট? আফতাব একটুও ভড়কে যায়না। বলে, সন্দেহ দাম্পত্য জীবনের অন্তরায়। আমার তো মনে হয়না,আমি তোমার সঙ্গে এমন আচরণ করেছি যাতে তোমার মনে সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে। পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে। সামনের সপ্তাহে দেয়ার কথা। তোমাকে সঙ্গে করে নিয়েই না হয় তুলে আনবো। মিনা ঠিক ওর কথায় বিশ^াস করেনা। বলে, তোমার রশিদ কই? আফতাব হেসে হেসে বলে, এসব কাজ সাধারণতঃ আমাদের অফিসের স্টাফরাই করে থাকে। রাতে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে না হয় নিয়ে আসবো। মিনা দৃঢ়তার সাথে বলে,ডোন্ট ফরগেট.. অবশ্যই নিয়ে আসবে। আফতাবের কপাল ভাল। সে রাতেই ছিল তার ফ্লাইট। শুধু মিনার থেকে নয়-ও সকলের কাছেই ফ্লাইটের ব্যাপারটা চেপে গিয়েছিল। লাগেজটাও গোপনে গোপনে গুছিয়ে ফেলেছিল। বিয়ের পরেই আফতাব বুঝেছিল,সে সাপের গর্তে পা ঢুকিয়ে দিয়েছে। যে কোন মুহূর্তে সাপটা ছোবল হানতে পারে। ওর বোন আমেরিকায় থাকে-সম্ভবত এটাই ওকে রাতারাতি আফতাবকে বিয়ে করার ব্যাপারে প্রলুদ্ধ করে থাকতে পারে। মাখনের ভেতর লুকানো ছুরি চালানোর মতোই ঘটনাটি ঘটলো। বিমানে পঁয়ত্রিশ হাজার ফিট ওপরে ওঠার পর আফতাব নিশ্চিত হলো-তার ফাঁড়া কেটে গেছে। আমেরিকায় গিয়েই ওর প্রথম কাজ হবে মিনাকে একটা ডিভোর্স লেটার পাঠানো। যদিও সে এটাকে সহজ ভাবে ছেড়ে দেবেনা।এমবেসিতে গিয়ে প্রমান করার চেষ্টা করেবে-সে তার বিবাহিত স্ত্রী। তবে সুখের কথা হচ্ছে,আফতাব গ্রীন কার্ড ধারী নয়-এসেছে ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে। হাজবেন্ডকে ফলো করার জন্যে এমবেসি থেকে স্ত্রীকেও ট্যুরিস্ট ভিসা দেবে-ওরা কি এতোটাই উদার আর মানবিক! তারপর আফতাব অনেক কাল থেকে গিয়েছিল আমেরিকা। ওর এক্সও আরও তিন তিনটি বিয়ে করে বর্তমানে শুনেছে ইউরোপের কোন একটি দেশে আছে। আমেরিকায় থাকবে না বলেই আফতাব আর গ্রীন কার্ডের চেষ্টা করেনি। এক বুক আশা নিয়ে আফতাব দেশে ফিরে এসেছিল। মীনা কুমারীর কারণেই দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল আফতাব। ফিরে এসে আর সে সেই দেশ আর পেলোনা। তাই তার না ফেরার দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ স্বস্তি ফিরে পেয়েছে মনে ও প্রানে। ফেলে যাওয়া সেই জীবন আর ফিরে পাবেনা আফতাব। কাল থেকে এই পৃথিবীতে আফতাব বলে একজন ব্যর্থ মানুষের আর অস্তিত্ব থাকবেনা। তারপর দেশের কি হলো-পৃথিবীর কি হলো-এ নিয়ে ওর আর মাথা ঘামাবার কিছু থাকবেনা। তার প্রস্তুতি হিসেবে ওর স্ত্রীর অগোচরে একটা কালো বল পেন আর ব্যাঙ্কের চেক বইটা পকেটে পুরে নেয়। জিন্সের একটা প্যান্ট আর গায়ে চাপায় হাওয়াই সার্ট। খুবই নরম তুলতুলে ইতালীয় চামড়ার একটা পাম শো পড়ে নেয়। ফাঁসি কাষ্টে ঝোলার আগে যেমন ফাঁসির আসামীদের খাওয়ার রুচি থাকেনা। আফতাবের অবস্থাও তাই হলো। ওর চোখে মুখে বেদনার নীল মেঘের হাওয়া বারবার ঝাপটা দিচ্ছে। অনঢ় আফতাব দু’হাত দিয়ে তা ঠেলে দিচ্ছে। ওর কোন সন্তান সন্ততি নেই। স্ত্রীও বেশ ইয়াং। আফতাবকে পাগলের মতো ভালবাসে-কিন্তু জীবনের হতাশা এমনই যে তাতে শরতের কাশ ফুলের মতো আশা জাগায় না। কুরে কুরে মরার চেয়ে একবারে চলে যাওয়াই তো ভাল। যদিও সে এই মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করেনা। কিন্তু ওর অযুত সম্ভাবনাকে ওর কাছের লোকেরাই হিংসের বশবর্তী হয়ে আটকে দিয়েছে। আবার ঘুরে দাঁড়াবার জন্যে যে সময়ের প্রয়োজন-সেই সময় ওর হাতে নেই। তার উপর ও খুবই অসুস্থ। স্ত্রী রান্না ঘরে ছিল। সেই ফাঁকে আফতাব বেরিয়ে পড়ে। ও দরোজায় এসে দাঁড়ায় তখন আফতাব অনেকটা দূর চলে এসেছে। ব্যাঙ্কে সর্ব সাকুল্যে ছিল পনোরো হাজার টাকা। এক হাজার টাকা রেখে বাকীটা তুলে ফেলে। এক প্যাকেট দামী সিগ্রেট কেনে। তাতে ফাও পায় একটা লাইটার। একটা সিএনজি ধরে বারিধারার ও দিকটায় একটা পাঁচ তারকা হোটেলে যেতে বলে ড্রাইভারকে। লবিতে ডাক্তারদের মেলা বসেছে। দু’দিন ব্যাপী ওয়ার্ল্ড সাইক্রিয়াটিস্ট এসোসিয়েশনের সম্মেলন শুরু হয়েছে। রুম পাওয়া যাবে কি না তাতে সন্দেহ আছে। সবই প্রায় লালমুখো ডাক্তার। হংস মাঝে বক যথার মতোই কিছু কৃষ্ণ বর্ণের লোকের উপস্থিতি ওর চোখে পড়ে। আফতবের সন্দেহ হয়-আজ এখানে কোন রুম খালি পাবে কিনা! হঠাৎ তার মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়, সে তো রুম পাওয়ার জন্যে এই ইভেন্টটাকে কাজে লাগাতে পারে। তরুণ বুদ্ধিদীপ্ত একজন কাজ করছিল রিসিপসনিস্ট হিসেবে পাশে একজন সুন্দরী রিসিপসনিস্টও ছিল। কপাল ভাল থাকলে এ রকম মেয়েরা বেশ সহযোগিতা করে আর যদি হয় বদ নসীব তাহ’লে তাদের দিয়ে কোনভাবেই না কে হাঁ করানো যায় না। সুন্দরীদের ইগো মারাত্নক। আফতাবের এ রকম অনেক অভিজ্ঞতা আছে। মেয়েটিই সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এলো-আফতাব কোন ঝুঁকি না নিয়ে ছেলেটার কাছেই গেল। ছেলেটি তাকে চিনে ফেললো। বললো, আপনাকে তো মাঝেমধ্যে টক শো-তে দেখি। আপনি তো পত্রিকাতেও লেখালেখি করেন। তা-কোন পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন-ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড? আফতাব বললো, আপাততঃ ফ্রি ল্যান্সিং করছি। ছেলেটিই বলে, তা সাইক্রাটিস্টদের এই সম্মেলন কভার করতে এসেছেন নাকি? ছেলেটি একটু প্রগলভ। একাই কথা বলে চলেছে। আপনার কি রুমের দরকার পড়বে। আফতাব খুশী হয়ে বলে তাহ’লে তো খুবই ভাল হয়। ছেলেটি কমপিউটারে চেক করে বললো, ইউ আর ভেরি লাকি জাস্ট একটা রুমই ছিল। আমার ক্যাপাসিটিতে আপনাকে ফিফটি পারসেন্ট ডিসকাউন্ট দিয়ে দিচ্ছ্।ি আফতাব আমতা আমতা করে বলে,না না ডিসকাউন্ট লাগবেনা। ছেলেটি দৃঢ়তার সাথে বলে, কেন লাগবেনা স্যার-এতো একজন সেলিব্রিটি হিসেবে আপনার প্রাপ্য। ছেলেটি এবারে আফতাবের দিকে তাকিয়ে বলে, ওয়ান নাইটের জন্যে না টু নাইটস? আফতাব বলে,ওয়ান নাইট ইজ ফাইন। আফতাব রসিকতার ছলে বলে, সাইক্রিয়াটিস্টদের সাথে দু’রাত কাটালে সুস্থ অবস্থায় কি বাড়ি ফিরতে পারবো? ছেলেটি বলে, তা সুন্দর বলেছেন তো! তা পেমেন্ট করবেন কিসে? ক্যাশ না ক্রেডিট কার্ডে? ক্রেডিট কার্ডে করলে আরও দশ পাসেন্ট ডিসকাউন্ট। আফতাব কথা বাড়ায় না। পেমেন্ট করে পা বাড়াতে যাচ্ছে এমন সময় ছেলেটি আবার বলে, এই তথ্যটি আপনার বেশ কাজে লাগবে। এই ইভেন্টটা কিন্তু অর্গানাইজ করেছে আমাদেরই একজন বাঙ্গালী লেডি সাইক্রিয়াটিস্ট। ডাঃ নীলুফার জাহান। আফতাব অবাক হয়। বলে, তিনি তো লন্ডনে ছিলেন। ছেলেটি কৌতুহলী হয়ে বলে, চেনেন নাকি? আফতাব বলে, সে তো অনেক কাল আগের কথা। আফতাব আর কথা বাড়ায় না। রুমের চাবি নিয়ে চলে যায়। সাথে কোন  মোবাইল নেই। তাই কারও সঙ্গে কোন যোগাযোগও হবেনা। বেয়ারের তেষ্টা পেয়েছে। বারে গিয়ে বিয়ারের অর্ডার দেয়। বিয়ার পানের পর মুখ থেকে মনে হলো, ওর বিষন্নতার ভাবটা কেটে গেছে। কিন্তু খুব ক্লান্ত লাগছিল আফতাবের। তাই আপাততঃ রুমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বেশ সুন্দর পরিপাটি রুম। জানালা দিয়ে রাস্তা চোখে পড়লো। আশ্চর্য রাস্তায় কোন যানজট নেই। দূরে এক চিলতে আকাশ। নীলের মাঝে মাঝে সাদা মেঘের ভেলা। হঠাৎ আফতাবের মনে হয়-এটা কি শরৎ কাল! হবেও বা! গ্রীষ্ম,বর্ষা,শরৎ-হেমন্ত, হোয়াটএভার! এই তো-মাঝ রাতের পরেই তো..সব পাখি ফিরে যাবে ঘরে..সব ঋতুই করবে আয়োজন এই পৃথিবীর মঞ্চে..ফুলে ফলে নতুন কচি পাতায় বসন্তে পাখিরা গাইবে গান..সে গান তো আর আফতাবের শোনা হবেনা কোনদিন! এটাই ছিল ওর নিয়তি। ওর জীবনের শুরুটা ছিল বেশ বর্ণময়-এই মীনা কুমারী তাতে এসে সব ভন্ডুল করে দিল। ওর খপ্পর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে ছাড়তে হলো দেশ আর তাতেই ঘটলো ছন্দ পতন। সব কিছুই হয়ে গেল ওলট পালট। এই সুন্দর প্রানবন্ত পৃথিবীতে শুধু তারই ঠাঁই হলো না। নাভির থেকে একটা দীর্ঘশ^াস উঠে তা মাঝ পথে আটকে গেল। বিয়ার পানের পর সিগ্রেট বড়ই আরাম দায়ক। সিগ্রেট ধরালো-কিন্তু সেই সাধটা পেলনা। এসট্রেতে সিগ্রেটটা গুঁজে দিয়ে ও ভাবলো আরে মর্টিনই তো কেনা হয়নি। ও মর্টিন কেন কিনছে-দোকানীর যেন এ রকম কোন সন্দেহ না হয় এ রকম বোকা সোকা একজন দোকানী পেয়ে গেল। হাতে না নিয়ে মর্টিন টা পিঠের দিকে গেঞ্জির ভাজে রেখে দিল। হোটেলে ফিরে এসে আফতাব ভাবে সুইসাইডাল নোটটা লিখতে শুরু করবে কিনা! ভাবে নোটের কথা তো হবে খবুই সংক্ষিপ্ত। ঘটনাটা ঘটাবে ও মাঝ রাত্তিরের পর। এরমধ্যে হোটেলের হাউজ কিপিং-এর লোক যদি এসে পড়ে..মর্টিন আর নোট যদি দেখে ফেলে তহ’লে তো কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে। আত্নহত্যার বিষয়টি ধরা পড়ে গেলে সেটা হবে পরিবারের জন্যে খুবই লজ্জাজনক। বিছানায় শুয়ে শুয়ে এসব ভাবতে ভাবতে আফতাব ঘুমিয়ে যায়। ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখতে পায় ন’টা বেজে গেছে। জানালা দিয়ে দেখতে পায় নগরী আলোতে ভাসছে। অনেক দালান কোঠা। ধীরে ধীরে নগরী আধুনিক হয়ে ওঠেছে। একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে ভাবে এটা এখন তিলোত্তমা নগরী হলেও এখানে এখন আর তার হৃদয় বাঁধা থ্কবে না। হঠাৎ আফতাবের মনে হয়, সে কেন কাল রাতে এই আত্নহননের সিদ্ধান্ত নিল। ওর হৃদয়ে যেন একটু আলো জ¦লে ওঠে। বিষয়টি ও ছাড়া তো আর কেউ জানেনা। আবার কি চেষ্টা করে দেখতে পারেনা-ও কি তার ভাগ্য ফেরাতে পারে কিনা! শুরুতে কি কষ্টের জীবন ছিল ওর-সেই কষ্টটা যখন জয় করতে পেরেছিল-এখন কেন ওর মনোবল ভেঙ্গে গেল! তাছাড়া ওর বর্তমান স্ত্রী ওকে মনপ্রান দিয়ে ভালবাসে-ওর একার আয়ে সংসার চলছে না-তারপরেও বেচারী আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ও চলে গেলে সে খুব কষ্ট পাবে। এই শোক কাটিয়ে ওঠা তার পক্ষে কি সম্ভব হবে? হয়তো নয়। আমেরিকা থেকে ঢাকায় নেমেই এক বন্ধুর বাড়িতে এক পার্টি হচ্ছিল-সেখানেই আলাপ হয় ওর বর্তমান স্ত্রী অনামিকার সঙ্গে। ভাললাগা ভালবাসা তারপরে গিয়ে গড়ায় পরিণয়ে। অনামিকা ওকে সাহস জুগিয়েছে,প্রেরণা জুগিয়েছে তার বুকটা এভাবে ভেঙ্গে দেয়ার কি অধিকার আছে তার! সে তার সিদ্ধন্তে অটল থাকতে পারছেনা। একটু একটু করে সংশয় দেখা দিচ্ছে। গৌতম বুদ্ধু বলেছেন, আত্নহত্যা মহা পাপ। আফতাব আপন মনেই হেসে ওঠে। সে এখন পাপপূণ্যের অনেক উর্দ্ধে। সে একজন পুরুষ মানুষ-সে বরং এখন সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলেই বরং কাপুরুষ হয়ে যাবে। গুণী লোকেরা অবশ্য বলে, আত্নহত্যা কাপুরুষিত কাজ। আফতাবের মাথায় ব্যথাটা আবার চারা দিয়ে ওঠতে শুরু করেছে। সে আবার বারে গিয়ে বসে। বিয়ারটা পান করার পর একটু ধাতস্থ হলো। নিজের মনেই হিন্দী সিনেমার সংলাপ আওড়ায়-সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছি তখন চলেই যাব। কেউ আমাকে আটকিয়ে রাখতে পারবেনা। এলিভেটরে ওঠার আগ মুহূর্তে একটা নারী কন্ঠ শুনতে পেল। ওর নাম ধরে ডাকছে। ও ভয় পেয়ে পা চালায়-কেউ নিশ্চয়ই চিনে ফেলেছে। এই শালার টক শোতে গিয়েই সব ঝামেলা হয়েছে। এখন শান্তিমতো মরতেও পারবোনা। মহিলাটা এসে ওর সামনে দাঁড়ায়। এক ঝটকায় চিনতে পারে-নীলুফার জাহান। নীলুফার অবাক হয়ে বলে, আমি কিন্তু আপনাকে সেই দুপুরে দেখেই চিনতে পেরেছি। বিকেলে দেখলাম বেরিয়ে গেলেন। আমি তো লবিতেই আছি আপনার গতি বিধি লক্ষ্য করছি। আপনি বেশ ক’বার আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। আপনাকে একবার লন্ডনে আসতেও বলেছিলাম। পরে দেশে এসে শুনলাম,আপনি আমেরিকায় চলে গিয়েছেন। নীলুফারের কথা শুনতে আফতাবের ভাল লাগছেনা। মাতালের ভান করে আফতাব বলে, খুব ভাল লাগলো, আপনার সঙ্গে দেখা হলো। নীলুফার অবাক হয়। বলে, একজন সাইক্রিয়াটিস্ট হিসেবে আমার বেশ নাম ডাক হয়েছে। আপনি আমার পুরণো বন্ধু-আপনার সঙ্গে এসব নিয়ে শেয়ার করবো না? কি বলেন, আপনি ছিলেন একজন প্রমিজিং ইয়ং জার্নালিস্ট অথচ আপনাকে এখন কেউ চেনেনা। আমি তো এখানে ফিরে এসেছি তা বছর দুয়েক হলো-আপনাকে দেখার আমার খুব ইচ্ছে,কি করছেন,কেমন আছেন বা আপনার কোন সাহায্যে আমি আসতে পারি কিনা-এসব আমার মনে আছে। কিন্তু কোথায় পাবো-আপনাকে? আই এ্যাম সিঙ্গল-স্টিল ইজ লাভ উইথ ইউ..আফতাব ভেতরে ভেতরে ভাঙতে শুরু করলেও পরিস্থিতি সামলাতে চেষ্টা করে। বলে, দেখুন, আমি একটা কাজে ভীষণ ব্যস্ত..আপনি তো ঢাকায়ই আছেন। নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে। নীলুফার কৌতুহলী ভঙ্গিতে বলে, কি কাজে ব্যস্ত আছেন আপনি-না তুমি করেই বলছি। আমরা তো পরস্পরকে তুমি বলেই সম্বোধন করতাম। আফতাব কিছুটা অসহিষ্ণু কন্ঠে বলে, বিষয়টা আমার ব্যক্তিগত। আর তাছাড়া আপনার আর কোন কিছুই আমার মনের ভেতর নেই। আর আমি সিঙ্গলও নই। আমার স্ত্রী আছে। তাকে ছেড়ে তো আপনার গলায় ঝুলে পড়তে পারিনা। আফতাবের ইঙ্গিতটা খুবই কদর্য। তারপরেও নীলুফার রাগেনা বলে, তুমি রুমে যাচ্ছো? আমিও যাবো। আফতাব এবারে রেগে যায়। বলে, আপনি কিন্তু সত্যিই মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। নীলুফার নিস্পৃহ কন্ঠে বলে, একটুও না। আমি মানুষের মনের কারবারী। ইউর বিহেভিয়ার ইজ নট নরমাল। আমি রিসিপশনে খবর নিয়েছি। তুমি সেখানে বলেছো তুমি এসেছো ইভেন্ট কভার করতে-কিন্তু ওখানে তোমাকে দেখা যায়নি। নীলুফার আফতাবের হাত ধরে। বলে, তুমি কি ডিনার করেছো? আফতাব বলে, আমার ক্ষিধে নেই। নীলুফার অবাক হয়। কেন ক্ষিধে থাকবেনা কেন? নীলুফার আফতাবের হাত ধরে টানতে টানতে লবির এক কোণে গিয়ে বসে। সাপ যেমন মানুষের দু’পা পেচিয়ে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। নীলুফারও তেমনি আফতাবকে পেচিয়ে ধরেছে। ছাড়ছেনা। আফতাব শেষ চেষ্টা করে বলে, আপনিই তো অর্গানাইজার-আমাকে নিয়ে পড়েছেন কেন? আপনার তো ওখানেই থাকা উচিত। ওখানের চেয়ে এখন তোমাকেই আমার সময় দেয়াটা বেশী জরুরী। আফতাব অবাক হয়। বলে, এসব আপনি কি বলছেন? আমাকে কেন আপনি সময় দেবেন? কেন? নীলুফার অবাক বলে, তোমাকে কেন সময় দেব বা দেওয়াটা কেন আমার জন্যে জরুরী তা তুমি নিজেকেই জিগ্যেস করনা কেন! আফতাব বিরক্ত হয়। বলে, আপনার কথা কিন্তু আমি বুঝতে পারছিনা। এবারে নীলুফার সরাসরি আফতাবের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, হোটেলে তুমি কি করতে এসেছো? আস্ক ইউর সেলফ। ইউ আর লাকি-ইউর ওয়াইফ অলসো লাকি তুমি উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে তোমাকে ধরে ফেলেছি। আফতাব নিজে কে আর সামলাতে পারেনা। ওর গা গুলিয়ে আসছে। নাড়ি ভুড়ি ছিড়ে কি যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে। আফতাব ঘাড়টা এলিয়ে দেয়। নীলুফার সিকুরিটির লোকজনের সাহায্যে আফতাবকে তার রুমে নিয়ে যায়। রুমে বসিয়ে আফতাবকে একটা ট্যাবলেট খাইয়ে দেয়। আফতাব ঘুমিয়ে যায়। মর্টিনের কৌটাটা নীলুফার সিকিউরিটির লোকদের দিয়ে দেয়। নীলুফার সিকিউরিটির লোকদের সাবধান করে দিয়ে বলে,বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে তাদের জন্যে ভাল হবেনা। তারা বলে, ঘটনাটা ঘটলে তো নিশ্চয়ই তাদের হোটেলের সুনাম ক্ষুন্ন হতো। যদিও তারা এর সাথে কোন ভাবেই জড়িত নয়। পরের দিন সকালে আফতাবের স্ত্রীকেও নীলুফার ডেকে নিয়ে আসে হোটেলে। বলে, আমরা ডেঞ্জারাস টাইমটা ওভার কাম করেছি। ও এখন ইচ্ছে করলেও ওটা করতে পারবেনা। ইট’স ব্লকড। আর আমি তো আছিই। নীলুফার আফতাবের স্ত্রীকে বলে,  বেশীরভাগ মানুষই মানবেতর জীবন যাপন করেও বেঁচে থাকার আকাংখা জাগিয়ে রাখে আবার কিছু লোক সামাণ্যতেই ভেঙ্গে পড়ে। এবং বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। মানুষ যখন একা হয়ে যায়,তখন তার মাথায় আত্নহত্যার ভ ূত চেপে বসে। আফতাবের স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে নীলুফার বলে,  তোমার অবশ্য এসব বোঝা ও জানার কথা নয়। যা হোক ওকে এখন থেকে চোখে চোখে রাখবে। প্রেরণা জোগাবে। মেয়েরা অবশ্য এ কাজটি ভাল জানে। গুড লাক ফর ইউ। এনি ওয়ে হি ইজ নট লিভিং আস। বলে আফতাবের বউয়ের কাঁধে চাপড় মারে। এবং আফতাব যদি সত্যি সত্যি ঘটনা-টা ঘটাতো তাহ’লে মিডিয়া বিশেষ কওে ইরেকট্রনিক মিডিয়া যেভাবে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো তার থেকে রক্ষা নীলুফার জাহান ওকে যেভাবে রক্ষা করলো সেই কৃতজ্ঞতায় নীলুফাকে সে জড়িয়ে ধরে ঢুকরে কেঁদে ওঠে। নীলুফার ওকে কাঁদতে দেয়। কিছু বলেনা। [email protected] [RTF bookmark start: }_GoBack[RTF bookmark end: }_GoBack

জ্ঞানচর্চার দিগন্ত প্রসারি ব্যক্তিত্ব

জ্ঞানচর্চার দিগন্ত প্রসারি ব্যক্তিত্ব

অক্ষরজ্ঞানঅলা মানুষই যে সবসময় প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠবে এমনটি নাও হতে পারে। মানুষের ভেতরের পাঠশালার যদি দরজা, জানালা খোলা না থাকে তাহলে বাইরের অক্ষরজ্ঞান দিয়ে আসল মানুষ হয়ে ওঠা যায় না। আরজ আলী মাতুব্বর। তিনি একজন প্রবীণ দার্শনিক, চিন্তাবিদ এবং মননশীল লেখক ছিলেন। তিনি একাডেমিক শিক্ষা খুব বেশি গ্রহণ করতে পারেননি বটে কিন্তু স্বশিক্ষিত। দক্ষিণবঙ্গের মাঠে-ঘাটে, প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে ফসলি জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থেকেও সত্যের সন্ধানে, সৃষ্টির রহস্য খুঁজতে মনের পথে হেঁটেছেন আজীবন। তাঁর প্রকৃত নাম আরজ আলী। আঞ্চলিক ভূস্বামী হওয়ার সুবাদে তিনি ‘মাতুব্বর’ নাম ধারণ করেন। গ্রামের মক্তবে কিছুকাল পড়ালেখা করেন। যেখানে শুধু কুরআন ও অন্যান্য ইসলামিক ইতিহাসের ওপর শিক্ষা দেওয়া হতো। এখানেই কী একজন জ্ঞানপিপাসুর পৃথিবী সম্পর্কে জানা থেমে যায়? থেমে যায় শিল্প-সাহিত্য চর্চার অগাধ ইচ্ছা? সবার ক্ষেত্রে তা হয় না। তিনি নিজেকে জানতে, জগতের মানুষদের জানতে, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম ও দর্শনসহ নানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য ৮৬ বছরের জীবনকালে ৭০ বছরই লাইব্রেরিতে কাটিয়েছেন। জানার আগ্রহ তাকে ইতিহাসের বিস্ময়কর ব্যক্তিতে পরিণত করেছে। তিনি একটা কিছু জানতে যারা জানে তাদের জিজ্ঞাসা করতেন। জানার প্রবল ইচ্ছে ছিল তাঁর। তিনি নিজেকে প্রশ্ন করতেন। তিনি কে? আসলে মানুষ কেন পৃথিবীতে আসে? মানুষে মানুষে এত দ্বন্দ্ব কেন? পথ ও মতে এত পার্থক্য কেন? কেন জাতিতে জাতিতে এত ভাগ? তাহলে এত জাতপাতের সৃষ্টিকর্তা কে? মাটির মানুষ তৈরি করে তাতে কে ব্যাটারি যুক্ত করে? মানুষ কেন বাঁচে? ব্যাটারির চার্জ শেষ হলেই কি তার জীবনাবসান হয়? নানা প্রশ্নে তাঁকে সবসময় জড়জড়িত করতেন। পৃথিবীতে কত মনীষী এসেছেন। যুগে যুগে পৃথিবীতে মনীষীর  আগমন ঘটে। কিন্তু মুক্ত-মনা হয় কয়জনা? মনের দিক থেকে যিনি দরিদ্র তিনিই তো প্রকৃত দরিদ্র। ধর্মের দোহাই দিয়ে উত্তেজিত মানুষদের শান্ত করে রাখেন অনেকে। তিনি বলেন, ‘ধর্মের আচার-প্রথারূপী আগাছা-পরগাছাগুলো দোলা দিয়েছেন অন্ধবিশ্বাস কুসংস্কাররূপী বিষবৃক্ষের শাখা-প্রশাখায় এবং যুক্তি যাদের কুঠারাঘাত করেছেন তার মূলে; তাঁরা সকলেই হচ্ছেন শক্তিমান পুরুষ, সুযোগ্য ব্যক্তি। তাঁদের খোঁচাটা, চিমটিটা নীরবে সহ্য করে যাচ্ছেন শাস্ত্রারণ্যের প্রহরীগণ, হজম করে যাচ্ছেন তাঁদের চপেটাঘাতও।’ বরিশালের চরবাড়িয়ার লামছড়ির সন্তান হয়েও তিনি তাঁর যোগ্যতায় বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছেন। ১৯৮২ সালে “AROJ ALI THE INSURRECTIONIST (বিদ্রোহী আরজ আলী)’ শিরনামে নিউইয়র্কের The Icono-clast, Newyork, September সংখ্যায় তাঁকে নিয়ে প্রবন্ধ ছাপা হয়। তিনি দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও মনের দিক থেকে ধীরে ধীরে ধনী হতে থাকেন। জানার ইচ্ছাই তাঁকে ধনী বনে নিয়ে গেছে। শিক্ষার প্রস্তর শেষ করলেও তাঁকে নিয়ে মানুষ আজ গবেষণা করেন। তাঁকে নিয়ে ভাবেন। দর্শন ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। গ্রামে বা আশপাশে এত দর্শনের বই পাবে কোথায়? দেখা হয়ে যায় ব্রজমোহন কলেজের দর্শনের শিক্ষক কাজী গোলাম কাদিরের সঙ্গে। তিনি আরজ আলী মাতুব্বরকে চিনতে পারেন। তাঁর জ্ঞানের তৃষ্ণায় কাজী গোলাম কাদিরও তৃষ্ণিত হয়ে ওঠেন। গোলাম কাদির স্যার কলেজের পাঠাগার থেকে বই ধার দিতে থাকেন। মাতুব্বর মহাখুশি। আর ধীরে ধীরে মাতুব্বর তার মানসিক আকৃতি বাড়াতে থাকেন। নিজ চেষ্টা ও সাধনায় বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম ও দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন। তাঁর মনের জানালার শার্সিতে দাঁড়ায় জ্ঞানের দেবদূত। তাঁকে অনেক বিষয় জানাতে সাহায্য করে। ধর্মজগৎ ও জীবন সম্পর্কে নানামুখী দিক তাঁর লেখায় উঠে আসে। আঞ্চলিক ভূস্বামী, কৃষিকাজের আয়, আমিনি পেশার আয় দিয়ে সংসার চালিয়েও দারিদ্র্যতা দূর করতে পারেননি তিনি। তাই আর্থিক সংকটের কারণে বড় বড় ডিগ্রি নিতে পারেননি। শুধু তাঁর বেলাতেই নয়, বাংলাদেশের এমন অনেক কবি-সাহিত্যিক, দার্শনিক, বাউল, সাধক- ক’জন বড় বড় ডিগ্রি নিয়েছেন? বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল, লালন ফকির, শাহ আবদুল করিমসহ অনেক গুণীদেরই বড় ডিগ্রি ছিল না। আসলে একাডেমিক পড়ালেখায় কী থাকে? মানব জীবনে চলার পথে কতটুকুই বা কাজে লাগে একাডেমিক শিক্ষা। যে একাডেমিক শিক্ষার সঙ্গে চাকরিজীবীদের কোনো যোগসূত্র নেই। অথচ কবি-সাহিত্যিক, দার্শনিকদের কথা-ভাবনাগুলোই পাঠ্যসূচিতে লিপিবদ্ধ থাকে। আমরা তাঁদের ভাবনাগুলো খোরাক করে, পড়েই জ্ঞান অর্জন করি। আরজ আলী মূলত বস্তুবাদী দর্শনে বিশ^াসী ছিলেন। তিনি অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোড়ামির বিরুদ্ধে লেখালেখি করেছেন সবসময়। তাঁর রচনায় মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবাদী দার্শনিক প্রজ্ঞার ছাপ রয়েছে। তিনি সম্পাদনায় আগ্রহী ছিলেন না। তিনি বলেন, ‘সংকলন সম্পাদনা মানেই হলো নকলনবীশী মাত্র।’ তারপরও মাঝেমধ্যে সম্পাদনা করতে হয়। লিখতে হয় ভূমিকা। লেখালেখি করতে গিয়ে তাঁকে ফৌজদারি মামলার আসামিও হতে হয়েছে। তবুও তাঁর দুঃখ ছিল না। প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তায় ফিরে গেছেন যৌবনের প্রথম দিনে। এখানেই একজন লেখক বা দার্শনিকের সার্থকতা। তিনি ‘পুরান শাস্ত্র’পুরীর পর্দাসীমার ভেতরে অনধিকার চর্চার অপরাধে এক প্রহরীর গলা ধাক্কাও খেতে হয়েছিল। সেই ঘটনায় মনোকষ্টে ভোগেন মাতুব্বর। কলম ধরেন। তৈরি করেন ‘সত্যের-সন্ধান’ নামক পাণ্ডুলিপি। প্রকাশ হলো না। আবার নিরন্তর চেষ্টা করা হলো ১৯৭৩ সালে। কিন্তু শাস্ত্রীয় মতবাদের পরিপন্থি বলে পাণ্ডুলিপিটি বই আকারে প্রকাশ করার জন্য প্রকাশক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে বইটি ব্রজমোহন কলেজের দর্শনের অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদিরের সহায়তায় ১৯৭৩ সালে ‘সত্যের-সন্ধান’ প্রকাশ পেলেই দেশের সুধীমহলে সমাদৃত হয়। এবং বহু পত্রিকায় প্রশংসামূলক সমালোচনা প্রচারিত হয়। বাংলাদেশ লেখক শিবির ‘সত্যের-সন্ধান’ বইটির জন্য আরজ আলীকে হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করে ১৯৭৭ সালে। আরজ আলী রচিত পাণ্ডুলিপির সংখ্যা ১৫টি। তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছিল ৪টি। বইগুলো হলো- সত্যের-সন্ধান (১৯৭৩), সৃষ্টি রহস্য (১৯৭৭), স্মরণিকা (১৯৮২) ও অনুমান (১৯৮৩)। প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদও করেন তিনি। টাকা-পয়সা, দালানকোঠা, শারীরিক যোগ্যতা দিয়ে সবসময় মানুষ মাপা যায় না। জগৎ, জীবন-চেতনা সম্বন্ধে কথা বলার অধিকার অনেকের থাকে না। এমনটাই বলেন সাধারণত জ্ঞানীরা। যারা তাঁদের চিনেন সাদরে গ্রহণ করেন। তাঁদের কর্মের মাঝে নিজেদের মেলে ধরতে চান। আজকের উত্তর আধুনিক সময়ে এসেও কী মানুষ সভ্য হতে পেরেছে? দেশে দেশে স্নায়ুযুদ্ধ, মাঠে মাঠে তর্কযুদ্ধ লেগেই আছে। ক্ষমতার লোভে কত কিছু করছে উচ্চশ্রেণির লোকেরা। নিম্নশ্রেণির লোকেরা মার খেয়েই চলছে। জীবনের গতি প্রতি পদে পদে থেমে যায় যেন। মনের দিক থেকে কতটা শিক্ষিত হতে পেরেছে মানুষ? প্রাবন্ধিক মোতাহের হোসেন চৌধুরী ‘সংস্কৃতি কথা’য় বলেন, ‘সমাজ মাত্রেই সাধারণত দু’প্রকারের মানুষের বাস দেখতে পাওয়া যায়। এক প্রকার আদেশপন্থি ও আরেক প্রকার অনুপ্রেরণাপন্থি। আদেশপন্থি যারা তাদের জন্য দরকার একটা ধরা-বাঁধা পথ। অন্তরের সহজ উপলব্ধি বিসর্জন দিয়ে তারা একান্ত করে আঁকড়িয়ে ধরে সংস্কার অথবা শাস্ত্রের আদেশকে।’ আরজ আলী তাঁর অসামান্য যুক্তি এবং চিন্তা-ভাবনার সংমিশ্রণে সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে সত্যসন্ধানী দার্শনিকতায় তাঁর লেখনির কলম চালিয়ে গেছেন। মুক্তবুদ্ধির চর্চাকারক ছিলেন তিনি। ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও সাহসী চিন্তক। আবুল হুসেনের রচনাবলী থেকে জানা যায়, এ জগতে জীবনের ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ ও প্রকৃতি চরিতার্থ যেমন করে হোক করা যেতে পারে। প্রায় সমস্ত ধর্মাবলম্বী মানুষই এইরূপে ধর্মানুষ্ঠান পালন ও অন্য কাজ, দুটি পৃথক করে ফেলেছেন। মানুষই সেরা। মানুষের জন্যই ধর্ম। ধর্মের জন্য মানুষ নয়। আরজ আলী মনোকষ্টের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছেন। থেমে থাকেননি। সমাজ থেকে অন্ধবিশ্বাস দূর করার জন্য দীর্ঘ এক অভিযান শুরু করেছিলেন। কতটুকু সফল হয়েছেন তার বিচারের ভার তিনি পাঠকের হাতে দিয়ে গেছেন। মানুষ যখন প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে না পারে তাহলে পদে পদে হোঁচট খেতে হয়। বিশেষ করে ধর্মব্যবসায়ীর ধর্মের বানে বধ করতে চায় জ্ঞানী-গুণীদের। ধর্মব্যবসায়ীদের বাজার এখন খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। কারণ মানুষ আগের চেয়ে অনেক সচেতন। কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস থেকে মানুষ অনেক দূরে সরে এসেছে। আরজ আলী মাতুব্বর বলেন, ‘মানুষের আমিত্ববোধ যত আদিম ও প্রবল তত আর কিছু নহে। আমি সুখী, আমি দুঃখী, আমি দেখিতেছি, আমি শুনিতেছি, আমি বাঁচিয়া আছি, আমি মরিব ইত্যাদি হাজার হাজার রূপে আমি আমাকে উপলব্ধি করিতেছি। মৃত্যুর পরে যখন দেহের উপাদানসমূহ পচিয়া-গলিয়া অর্থাৎ রাসায়নিক পরিবর্তনে কতগুলো মৌলিক পদার্থে রূপান্তরিত হইবে, তখন কি আমার আমিত্ব থাকিবে না?’ এই যে তাঁর চিন্তার প্রসারতা, তাঁর ভাবনা- এই ভাবনা তাঁকে নতুন এক জগতে নিয়ে যেত সবসময়। তাই তিনি একাডেমিক শিক্ষার বেশি দূর না গিয়েও তাঁর ভেতরে-বাইরে আরেক নতুন জগৎ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সম্পর্কে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আরজ আলী মাতুব্বর প্রথম ও নির্মম যে অন্ধকার সূচির কাল ধরে স্থায়ী আছে এই বাংলাদেশে, তার কথাই বলেছেন তাঁর বইতে। বর্ণনা করে নয়, প্রশ্ন করে।’ তাঁর জীবন খুব সহজ ছিল না। বন্ধুর পথে হেঁটেছেন। সাধনা থেকে সরে দাঁড়াননি কখনো। সাধনার পাশাপাশি গড়ে তোলেন ব্যক্তিগত লাইব্রেরি। একবার সাইক্লোনে কয়েক হাজার বই বিলীন হয়ে যায়। তাতেও তিনি দমে যাননি। দিন দিন তাঁর জানার আগ্রহ আরও বেড়েছে। তাঁর সম্পাদনায় মুক্ত-মন সংকলনে আবুল ফজল ‘মানবতন্ত্র’ (পৃষ্ঠা ৫২-৬৮) গ্রন্থের এক জায়গায় বলেছেন, ‘ঈশ্বরকে আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু ঈশ^রভক্ত পাদ্রিকে দেখতে পাই। তিনি এবং তাঁর অনুরূপ পেশার লোকেরা ঈশ্বরের স্বনির্বাচিত প্রতিনিধি। ঈশ্বরের বিপরীতে শয়তানকে না দাঁড় করালে চিত্রটি পূর্ণাঙ্গ হয় না। তাই ঈশ্বররূপী কল্পমূর্তির স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে বিপরীত কল্পমূর্তি শয়তানের আবির্ভাবও অপরিহার্য।’ আরজ আলী ‘ভিখারীর আত্মকাহিনী’ (দ্বিতীয় খণ্ড, রচনাকাল ৮ শ্রাবণ ১৩৮১-১৯ ভাদ্র ১৩৮২)-তে লিখেছেন, ‘মৎস্য শিকারের আর একটি উত্তম শ্রেণির যন্ত্র ‘ধর্মজাল’। ওটা বুনা আমি শিক্ষা করেছি। চরমোনাই নিবাসী অছিমদ্দিন হাং এর বাড়িতে গিয়ে, তাঁর জামাতা কাজেম আলী কাজী সাবের নিকট হ’তে। তিনি আমাকে ‘ধর্মজাল’ বুনিয়ে বা কোনো পুরনো জাল দেখাতে পারেননি। তবে তিনি বোনার প্রণালীসমূহ বলে দিচ্ছেন এবং তাঁর কথার ভিত্তিতে পরে আমি ধর্মজাল বুনেছিলাম।’ আরজ আলী ধর্মজালের মাধ্যমে অত্যন্ত গভীরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। মানুষরূপী মৎস্য শিকার করতে চেয়েছেন। সন্ধান করতে চেয়েছেন মৎস্যগুলোর ভেতর-বাহির। মানুষ মুখোশের আড়ালে ছদ্মবেশ ধরে সমাজে অপকর্ম করে, তার মোড়ক উন্মোচন করতে চেয়েছেন ধর্মজালের মাধ্যমে মৎস্য শিকার করে। মাতুব্বর বারবার একটি প্রশ্নই করেছেন- আমি কে? আমরাও যদি এই প্রশ্নটি করি তাহলে সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যেতে পারি। দুটি রূপে একটি মানুষ গড়ে ওঠে। ভালো আর খারাপ । খারাপ-কে বধ করতে না পারলে সত্যিকার মানুষ হওয়া যায় না। এই সত্যটি মনে-প্রাণে ধারণ করেছেন মুক্তমনা মানুষ আরজ আলী মাতুব্বর। তিনি বাঙালি দার্শনিক, মুক্তচিন্তক ও সাদা মনের লেখক ছিলেন। ধরতে গেলে পুরো জীবনটাই ব্যয় করেছেন নিজেকে জানতে, লেখনির মাধ্যমে মানুষদের জানাতে। তাঁর মূল্যবান উক্তিতে বুঝা যায়- ‘বিদ্যা শিক্ষার ডিগ্রি আছে, জ্ঞানের কোনো ডিগ্রি নেই; জ্ঞান ডিগ্রিবিহীন ও সীমাহীন।’ বাংলাসাহিত্যের এই জ্ঞানমনীষা বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে ১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। রেখে যান মুক্তবুদ্ধির চর্চা, সুযুক্তির প্রবহমান ধারা...।