কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা সাহিত্যিক। রক্ষণশীল সমাজের নিগড় ভেঙে সংস্কারমুক্ত প্রগতিশীল সমাজ গঠন ছিল এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য। আর এই আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য কলকাতায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সৃষ্টি হয় ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’। উক্ত সময় বিশেষ করে মুসলমানরা সমাজের সর্বক্ষেত্রে বেশি গোঁড়ামি মনোভাবাপন্ন হওয়ায় তাদের মধ্যে সুমননশীল মানসিকতা সৃষ্টির জন্য বেশ কয়েকজন মুক্ত মনের সাহিত্যিক রক্ষণশীল সমাজের প্রাতিরোধ উপেক্ষা করে এ আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী ইমদাদুল হক, কাজী গোলাম মোস্তফা, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, মোহিতলাল মজুমদার, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, শশাঙ্কমোহন সেন প্রমুখ। কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন এঁদেরই দলে। শুধু দলে নয়, এঁদের সবার চেয়ে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যময় একাগ্রতায়। দেখা যায় নামে ‘মুসলমান মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ হলেও সমকালীন অনেক খ্যাতিমান হিন্দু সাহিত্যিকরাও এর সদস্য ছিলেন। এর কারণ হচ্ছে, ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’টি ছিল একটি সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক আন্দোলন। আর এ প্রতিষ্ঠানটিও তাই। হিন্দু-মুসলমান সকল সাহিত্যিক মিলে এ আন্দোলনকে গতিশীল করেন।
এরই অনুষঙ্গ হিসেবে ১৯২৫ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পরিমণ্ডলে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। এর মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হতে থাকে ‘শিখা’ নামে একটি বার্ষিক সাহিত্যপত্র। ‘শিখা’র আদর্শ হিসেবে এর প্রতিটি সংখ্যার প্রতিটি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠায় লেখা থাকতো, ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব’। এ লেখাটির উদ্ভাবক ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ। পুর্বোক্ত সাহিত্যিকগণই এতে লিখতেন। তাঁদের সঙ্গে নতুনভাবে যুক্ত হলেন মোতাহার হোসেন চৌধুরী, আবুল ফজল, কাজী মোতাহার হোসেন, কাজী আনোয়ারুল কাদির প্রমুখ। অবশ্য সব লেখকদের মধ্যমণি ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ। তাঁরই নির্দেশিত আদর্শে পত্রিকার লেখা সংগৃহীত হতে থাকে।
‘বুদ্ধির মুক্তি’র আদর্শে অন্যান্য লেখকদের লেখা ছিল তাঁদের সৃষ্টির একাংশ। অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন চিন্তাধারার লেখা তাঁরা লিখতেন। ‘শিখা’র জন্য যা তাঁরা লিখতেন, তা ছিল কাজী আবদুল ওদুদের অনুুরোধে। অর্থাৎ অনেকটা ফরমায়েশি লেখার মতো।
কিন্তু কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন তাঁদের থেকে স্বতন্ত্র। সম্পূর্ণ ‘বুদ্ধির মুক্তি’র আদর্শই ছিল তাঁর লেখার রসদ। এ চিন্তাধারার বাইরে একটি লেখাও তিনি লেখেননি।
মূলত তিনি ছিলেন গদ্য লেখক। তাঁর সে গদ্যের ভাষাও ছিল অন্যের থেকে স্বতন্ত্র। ভারিক্কি আর তেজক্রিয়তায় সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী। কোনো আয়েশী অথবা হালকা বর্ণনা কিংবা অপ্রয়োজনীয় বিন্যাস তাঁর সাহিত্যে নেই। এটা তাঁর সম্পূর্ণ নিজস্ব রচনাশৈলী। পড়লেই বোঝা যায় যে, এটা কাজী আবদুল ওদুদের লেখা। যেমন বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের গদ্য। কাজী আবদুল ওদুদের গদ্যকে তেমনি আমরা নাম দিতে পারি ‘ওদুদী গদ্য’ বলে। সকল লেখকই তাঁর আদর্শের কিংবা সম্মানের পাত্র ছিলেন না। বিনোদনমূলক রচনাকে তিনি সাহিত্যের পদবাচ্য মনে করতেন না। যে সাহিত্যের মধ্যে মুক্তবুদ্ধির চর্চা নেই, তেমন সাহিত্যকে লেখকের পণ্ডশ্রম বলে মনে করতেন তিনি। সস্তা কাহিনীর আবেগী উপন্যাস তাঁর কাছে কখনো শ্রেয় সাহিত্যের মর্যাদা পায়নি। এটাকে তিনি মনে করতেন ক্ষণিকের অপ্রয়োজনীয় আয়োজন। স্বল্পকালজীবী। কখনো দীর্ঘস্থায়ী সাহিত্য নয়। তাঁর মতে, এসবের মধ্যে মুক্তজীবনের কথা হয়তো থাকতেও পারে; কিন্তু তা প্রচ্ছন্নভাবে। প্রচ্ছন্নতাকে তিনি সাহিত্যের বিষয়বস্তু বলে মানতে রাজি ছিলেন না। তাঁর সাহিত্যসংজ্ঞা ছিল খোলাখুলিভাবে মুক্ত জীবনের দৃপ্ত আহ্বান। সংস্কার আর রক্ষণশীলতামুক্ত সৃষ্টির উপকরণ। এ জন্য তিনি শ্রদ্ধা করতেন বাংলা সাহিত্যের রামমোহন আর রবীন্দ্রনাথকে, যদিও তাঁদের ভাষাকে তিনি কখনো অনুসরণ করেননি। তাঁদের আদর্শই ছিল কাজী আবদুল ওদুদের শ্রদ্ধার বিষয়। সংস্কৃত কবি কালিদাসও তাঁর আদর্শ। বিদেশীদের মধ্যে পারস্যের কবি শেখ সাদী এবং জার্মান কবি গ্যেটে ছিল তাঁর প্রিয়। বিশেষ করে গ্যাটের প্রতি তাঁর অসম্ভব ভালোবাসা ছিল। গ্যেটের ওপর তিনি বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছেন। ‘কবিগুরু গ্যেটে’ নামে দু’খণ্ডের দুটি গ্রন্থ লিখেছেন ১৩৫৩ বঙ্গাব্দে। গ্রন্থের নামকরণে গ্যেটের প্রতি তাঁর ভক্তির প্রমাণ মেলে। গ্রন্থটি রচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘... এই মহাজীবনের প্রতি আমার ঘনীভূত অনুরাগ যে মন্দীভূত হয়নি, এজন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। গ্যেটে সম্বন্ধে বাংলাভাষায় কোনো গ্রন্থ নেই বললেই চলেÑ তেমন বিষয় আলোচনাও নেই। কিন্তু বাংলার জীবন ও সাহিত্যের সঙ্গে গ্যেটের যোগ নিবিড়।... কালে কালে সবাই হয়তো এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হবেন যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপের যে নবমানসিকতার সাধনা ঘবি যঁসধহরংস -পাশ্চাত্যে তার শ্রেষ্ঠ মূল গ্যেটে, আর প্রাচ্যে তার শ্রেষ্ঠ ফল ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার জাগরণ তার ব্যাপকতম প্রমাণ রবীন্দ্রনাথে।’ প্রসঙ্গত এভাবেই তিনি গ্যেটের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে মিলিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথও ছিলেন তাঁর ভালোবাসার মানুষ। তার কারণ হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের মুক্তবুদ্ধি ও সাহিত্যাদর্শ ছিল তাঁর চিন্তাধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই রবীন্দ্র-রচনা পড়েছেন অতি আগ্রহের সঙ্গে। অনেক ভাবনা-চিন্তা করেছেন রবীন্দ্র-সাহিত্য নিয়ে। রবীন্দ্র-সাহিত্যের ওপর একখানা গ্রন্থও লিখেছেন। ‘মাসিক জাগরণী’ পত্রিকার ১৩৩৫ সনের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যাতে গ্রন্থটির আলোচনায় বলা হয়Ñ ‘রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন এবার শক্ত হাতে।... এই পুস্তকখানি আকারে ছোট কিন্তু এর মধ্যে যে অধ্যবসায়, পরিশ্রম, মস্তিষ্ক শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়, তা অতীব বিস্ময়কর। আর এর প্রত্যেক শব্দই এক একটি মনোহর সৃষ্টি।’
আলোচনাটি রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ হলেও এতে কাজী আবদুল ওদুদের সাহিত্যশৈলীর পরিচয় মেলে।
তিনি লিখেছেন ‘নজরুল প্রতিভা’ নামে একখানা গ্রন্থ। যেটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ’ নামে দু’খণ্ডে তিনি আরও দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থ দুটির প্রকাশকাল যথাক্রমে ১৩৬৯ ও ১৩৭৬ বঙ্গাব্দে। এ দুটি গ্রন্থে রবীন্দ্র-সাহিত্যের জীবনবাদিতা সম্পর্কে বিশদ আলোচিত হয়েছে।
রবীন্দ্র-সাহিত্যের ওপর তাঁর একটি ইংরেজি গ্রন্থের নাম ‘ঞধমড়ৎ’ং জড়ষব রহ ঃযব জবপড়হংঃৎঁপঃরড়হ ড়ভ ওহফরধহ ঞযড়ঁমযঃ’ এটি রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর একটি লিখিত বক্তৃতার বিষয়বস্তু ও মানব জীবনবাদিতামূলক। ভাষা নয়, বিষয় বিচারে এটি কাজী আবদুল ওদুদের চিন্তাধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য-ভাষা নয়, তাঁর ভাবাদর্শ, নির্জীব পুরনো সবকিছুকে ভেঙে নতুন করে গড়ার তাঁর দুর্বার সাহস, দুরন্ত স্পর্ধা কাজী আবদুল ওদুদকে আকর্ষণ করেছিল। নজরুলের ব্যক্তি-মানস তাঁকে করেছিল মুগ্ধ। সেই মুগ্ধতার কৃতজ্ঞতায় তিনি লিখেছেন ‘নজরুল প্রতিভা’ নামে একখানি আলোচনা-গ্রন্থ, যেটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে। গ্রন্থটি লেখার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘...আমি নিজে অনেকখানি খুশি হতে পেরেছি কবির কাব্য প্রতিভার একটি নতুন ছটা উপলব্ধি পেরেছি বলে।’ বলাবাহুল্য, এই ‘ছটা’ই তো সেই বস্তু, যার সাধনা ওদুদ সাহেব করেছেন ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনে।’
সমাজের অচলায়তনকে অস্বীকার করে নতুন যাত্রার পথ নির্দেশ আছে শরৎচন্দ্রের বিভিন্ন লেখায়, তাঁর উপন্যাসে। উপন্যাস হলেও লেখকের বক্তব্য অত্যন্ত শক্তিশালী। প্রচলিত সমাজের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ অনমনীয়। এটা মুগ্ধ করেছে কাজী আবদুল ওদুদকে। তাঁর সেই মুগ্ধতার স্বীকৃতি ‘শরৎচন্দ্র ও তারপর’ গ্রন্থটি। এটির প্রকাশকাল ১৯৬১।
পবিত্র আল-কোরআন বিশ^ মানবতাবাদের পরম নির্দেশিকা গ্রন্থ। কাজী আবদুল ওদুদ মনেপ্রাণে তা বিশ^াস করতেন। আল-কোরআনের শিক্ষা মানুষকে তার ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। এ প্রত্যয় থেকেই তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন আল-কোরআন। ভাষা সরল হলেও তেজোদীপ্ত। তিনি এ কথা অতি দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করতেন, তাঁর ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ এবং আল-কোরআনের বাণীর মধ্যে কোনো আদর্শগত বিরোধ নেই। এ বিশ^াস থেকেই তাঁর এ অনুবাদ।
বিশ^নবী হযরত মোহাম্মদের (সা.) নবুয়তির চেয়ে তাঁর মানবতাবাদী আদর্শ অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করতেন। তাই তাঁর সেই মানবতার বিশ্লেষণ করে তাঁর শিক্ষা ও আদর্শকে ধারণ করে জীবনের ন্যায্য অধিকারকে অর্জন করে নেওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়ে তিনি রচনা করেন ‘হযরত মোহাম্মদ ও ইসলাম’ গ্রন্থখানি।
জাতীয় জাগরণমূলক তাঁর রচিত প্রবন্ধ গ্রন্থগুলো হচ্ছেÑ ‘নব পর্যায় : প্রথম খণ্ড’ (১৩৩৩ বঙ্গাব্দ), ‘নব পর্যায় : দ্বিতীয় খণ্ড’ (১৩৩৬ বঙ্গাব্দ), ‘সমাজ ও সাহিত্য’ (১৩৪১ বঙ্গাব্দ), ‘হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ’ (১৩৪২ বঙ্গাব্দ), ‘আজকের কথা’ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ), ‘স্বাধীনতা দিনের উপহার’ (১৯৫১ খিস্টাব্দ), ‘শাশ^ত বঙ্গ’ (১৩৫৮ বঙ্গাব্দ) ও ‘বাংলার জাগরণ’ (১৩৬৩ বঙ্গাব্দ)। এ ছাড়া সমাজ গঠন ও দেশ মুক্তিমূলক উপন্যাস লিখেছেন দুটিÑ ‘নদীবক্ষে’ (১৯১৯) ও ‘আজাদ’ (১৯৪৮)। দুটি গল্পগ্রন্ধÑ মীর পরিবার’ (১৯১৮) ও ‘তরুণ’ (১৩৫৫ বঙ্গাব্দ)। ‘পথ ও বিপথ’ (১৩৪৬ বঙ্গাব্দ) নামে একটি একাঙ্কিকাও লিখেছেন তিনি।
এসব গ্রন্থের বিস্তারিত বর্ণনা না দিয়ে স্বল্প কথায় একসঙ্গে বলা যায়, কাজী আবদুল ওদুদের যে জীবনসাধনা, যে মনন আবেদন, সমাজ পরিবর্তনের দুর্জয়ী প্রত্যয়Ñ তার সবকিছুরই রসদ আর শক্তি আছে তাঁর এ সবগুলো রচনাতে। অত্যন্ত শক্তিশালী ভাষা আর আবেগে তিনি কলম ধরেছিলেন তাঁর যে কোনো লেখাতে।
কাজী আবদুল ওদুদের সাহিত্য ও রচনাশৈলী সম্পর্কে আবুল ফজল বলেন, ‘বাংলাদেশের এ যুগের চিন্তাশীলদের মধ্যে নিঃসন্দেহে কাজী আবদুল ওদুদের স্থান প্রথম সারিতে। রচনার বৈচিত্র্য ও গভীরতার দিক দিয়ে প্রবন্ধ সাহিত্যিকদের মধ্যে তাঁর জুড়ি মেলা ভার।’
তাঁর সাহিত্য মনন সম্পর্কে আবুল ফজল আরও বলেন, ‘... বুদ্ধির মুক্তির কথাটার মধ্যে কাজী আবদুল ওদুদের সম্স্ত চিন্তাধারার বীজ নিহিত রয়েছে। তাই যেখানে যত বুদ্ধির মুক্তি-মন্ত্রের সাধকের পরিচয় তিনি পেয়েছেন, তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পারেননি।’
তাঁর রচনাশৈলী সম্মর্কে আবুল ফজলেরই অভিমত, ‘তিনি যতখানি লেখেন, তার অনেক বেশি ভাবেন এবং লিখতে বসার আগেই তিনি সেই ভাবনা সেরে ফেলেন। লেখা নিয়ে তিনি এত বেশি ভাবেন যে লেখার আগেই তার ভাষা ও ভাব তাঁর মনের ভিতর কাগজ কলমে রূপ নেওয়ার আগে এত বেশি পুনরাবৃত্তি হতে থাকে যে, তা তাঁর প্রায় মুখস্থ হয়ে পড়ে। ফলে এমনকি তাঁর সুদীর্ঘ প্রবন্ধও তিনি মুখে মুখে শুনিয়ে দিতে পারেন। এভাবে ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর ভাষা গড়ে ওঠে, মনে মনেই চলতে থাকে তার মাজঘষা। তাঁর বিশিষ্ট রচনাশৈলী এই ভাবেই রূপ গ্রহণ করে।
কাজী আবদুল ওদুদের ব্যক্তি-মানস সাহিত্যকর্মের বিভিন্ন দিক নিয়ে সমকালীন অন্যান্য আরও খ্যাতিমান সাত্যি-সমালোচকগণ বিভিন্ন ধরনের প্রশংসামূলক মন্তব্য করেছেন। অন্নদাশঙ্কর রায় বলেন, ‘ ... আজকের বাংলাসাহিত্যে সমালোচনা বিভাগে ওদুদ সাহেবের চেয়ে শক্তিমান ব্যক্তিত্ব দু’একজন আছেন, কিন্তু তাঁর মতো জীবন অধ্যয়নে সুনিপুণ স্থিধি সুধী আর একজনও আছেন কিনা সন্দেহ। তিনি কেবল বই পড়ে বইয়ের বিচার করেন না, মানুষের ভিতরে যে আছে, তাকে দেখেই চিনতে পারেন। গভীর অনুসন্ধিৎসা তাঁকে নিয়ে গেছে এমন এক স্তরে যেখানে নেই কোনো সাম্প্রদায়িকতা বা দলীয়তা বা মতবাদদৃষ্ট বৈজ্ঞানিকতা।’
এস. এন. কিউ. জুলফিকার আলী বলেন, ‘তাঁর (আবদুল ওদুদের) বলার ভঙ্গি ছিল অদ্ভুত, সাহিত্য বিচারে ছিল অতি সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি।’
কবি আবদুল কাদির বলেন, ‘তাঁহার উদার আদর্শ সুন্দর শিল্পমূর্তিই লাভ করিয়াছে।’
সর্বোপরি তাঁর সম্পর্কে বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুধাবন, ‘তাঁর মনের জোর, বুদ্ধির জোর, কলমের জোর একসঙ্গে মিশেছে।’
ঊনবিংশ শতকের নবজাগরণের অন্যতম অগ্রদূত সাহিত্যসাধক কাজী আবদুল ওদুদের সার্বিক স্বীকৃতি অল্প কথায় এরচেয়ে বড় আর কি হতে পারে?