ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২

সাহিত্য

"গোলাপের কাঁটায় রক্তক্ষরণ"

আকাশের রাগী সূর্যটা মজিদ মিয়ার মাথার ওপর দাপিয়ে বেড়ায়। কপাল বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। মাজায় পেঁচানো গামছা খুলে ঘাম মুছতে থাকে। বুকে জমাট বেঁধে থাকা ঘন-নিঃশ্বাসকে কিছুটা বিশ্রাম দেয়। এতটুকু ক্লান্তি নেই। মুখে বিসমিল্লাহ বলে বাম হাতে লাঙ্গলের গুটি মাটিতে ঠেসে ধরে। বলদ দুটির শক্তি বাড়াতে হাঁক ছাড়ে। ‘আরে চল চল, হেই যা!’ এই বাক্যটি তার জীবন-জীবিকার সাথে মিশে আছে।  অন্যের জমিতে কামলা খেটে খেটে সময় ও শক্তি দুটোই শেষ হবার পথে। তবুও পূর্ব পুরুষের জীবিকার ধারা বদলাতে না পারার আপসোস তার রয়েই গেছে।  এ তল্লাটে মজিদ মিয়ার খুব কদর। সত্যিই হাতে জাদু আছে। তার চাষ দেয়া জমিতে ফসল ফলে দ্বিগুণ। নিজের এলাকা ছেড়ে সে কোথাও যায় না। এসব উঁচু জমিতে দীর্ঘদিন বন্যা না হবার কারণে মাটির উর্বরতা শক্তির হ্রাস পেয়েছে। আগের মতো ভাল পাট না ফলায় মালিকদের সে ধান রোপণের পরামর্শ দেয়। মজিদের কথায় মালিকেরা জমির সীমানা নির্ধারণ করে নতুন আল বাঁধে। স্যালো মেশিন বসায়। এসব জমিতে এখন প্রতিবছর কার্তিক সাইল, মধুসাইল, পরাঙ্গী ধানের বাম্পার ফলন হচ্ছে।  মজিদ মিয়া জমির আলের ওপর বসে বিশ্রাম নেয়। কপালে বাম হাতের চার আঙ্গুল ঠেকিয়ে সূর্যের গতিবিধি লক্ষ্য করে। সূর্যের অবস্থান দেখে সে সময় বুঝতে পারে। মাঠের অন্য চাষিরাও তার কাছে সময় জানতে দূর থেকে হাঁক ছাড়ে- ‘ও মজিদ ভাই,কতো বাজে?’ মজিদ মিয়া জগ উঁচু করে ঢক ঢক শব্দে পানি গিলে খায়। সে লক্ষ্য করে লাঙ্গলের জোয়াল টানতে টানতে দুটো গরুই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মজিদের পানি খাওয়া দেখে ওরা জিহ্বা চেটে তৃষ্ণার্ত হবার ইঙ্গিত দেয়। সামনে ডোবার পানির দিকে ফ্যাল ফ্যাল চোখে চেয়ে থাকে। কিন্তু জোয়াল কাঁধে নিয়ে দু-কদমের বেশি এগোতে পারে না। মজিদ মিয়া বুঝতে পেরে জগের অবশিষ্ট পানি গরুর মুখ ফাঁক করে ঢেলে দেয়। সেই পানিতে ওদের গলা ভিজে মাত্র, কিন্তু তৃষ্ণা মেটে না।  চৈত্রের তাপে মাটি শুকিয়ে পাথর যেন! লাঙ্গলের তীক্ষ্ণ ফলা নরম মাটির তল খুঁজতে ভারি বেগ পেতে হয়। গরু নিজের কাঁধের ক্ষুদ্র জোয়ালকে পাহাড়সম ওজন মনে করে। লাঙ্গলের গুটি ঠেসে ধরতে ধরতে মজিদের কব্জি ব্যথা হয়ে আসে। তখন রাজ্যের রাগ ঢালে গরুর ওপর। ওদের আরও জোরে হাঁটার জন্য লেজে মোচড় দেয়। কঞ্চি দিয়ে আঘাত করে। মজিদ লক্ষ্য করে হালচাষের সময় বুড়ো গরুটা মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে যায়। কখনো ধপাস শুয়ে পড়ে। চোখ বেয়ে জল ঝরে। সঙ্গীর সাথে মুখ ঘষে কথা বলে। এদিকে বেলা মাথার উপর থেকে হেলে পড়ে। এসব তামাশা দেখার সময় মজিদের নেই। দিন শেষে ওদের কাছ থেকে কড়ায়-গণ্ডায় কাজের হিসেব মিলিয়ে নেয়াটাই তার কাজ। 

সাহিত্য বিভাগের সব খবর

আশার ঘুড়ি

আশার ঘুড়ি

গাজা শহরের সরু গলি। সেখানে অনুচ্চ ভবনগুলোর ছাদে সূর্যের সোনালি আলো লুটোপুটি খাচ্ছে। দূরে তাকালে সাগর। তাতে নীল পানি এসে যেন পা ধুয়ে দিচ্ছে গাজার। বাইরে সরু গলিতে ছোট ছোট বাচ্চারা খেলা করছে। কোথাও একটু ফাঁকা জায়গায় তারা আনন্দে মেতে আছে। এরই মাঝে একটি ভবনের ছাদে ইউসুফ নামের একটি বালক দাঁড়িয়ে আছে। ঘরেই সে বানিয়ে নিয়েছে একটি ঘুড়ি। তা হাতে ধরা ইউসুফ। তার বয়স নয় বছর। তীক্ষè চোখ তার। মাথায় কোঁকড়ানো চুল। দোকানে পিতাকে কাজে সাহায্য করায় রুক্ষ হয়ে আছে হাত। ইউসুফ পুরনো প্লাস্টিকের ব্যাগ আর খবরের কাগজ দিয়ে বানিয়েছে তার ঘুড়ি। এর রং লাল, সবুজ, কালো আর সাদা। এই রং ফিলিস্তিনের। তাই এই ঘুড়িটি ইউসুফের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। স্কুল শেষে এবং কাজ শেষে প্রতিদিন ভবনের ছাদে ওঠে ইউসুফ। সেখানে দাঁড়িয়ে চারদিক তাকায়। দূরে ধুলোয় ঢাকা জায়গাগুলোতে ফুটবল খেলছে বাচ্চারা। কোথাও উড়ছে ফিলিস্তিনের পতাকা। আরও দূরে নীল সমুদ্র। বিশাল সেই সমুদ্রের বুক। কংক্রিটের ফাটল ধরা ছাদে পা ঠোকাঠুকি করে ইউসুফ। ঘুড়ি বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে দৌড় দেয়। নিচে উঠোন থেকে তার দাদু মায়াভরা কণ্ঠে বলে ওঠেন- আরও উপরে, হাবিবি। আরও উপরে। ঘুড়িটা আকাশকে ছুঁয়ে যাক! আকাশকে ইউসুফ খুব ভালোবাসে। তার কাছে একমাত্র মুক্ত, স্বাধীন জায়গা হলো ফিলিস্তিন আর ওই দূরের আকাশ। তাই ঘুড়ি হয়ে আকাশের খুব কাছে চলে যেতে চায় সে।   একটি সংকীর্ণ, ভাঙাচোরা এপার্টমেন্টে পিতামাতা, দুই বোন এবং দাদার সঙ্গে বসবাস করে ইউসুফ। প্রায়ই তার দাদা নানা গল্প করেন সবাইকে নিয়ে। অনেক আগে তাদের বড় বড় বাগান ছিল। জলপাই চাষ করতেন। গ্রামের পর গ্রাম ছিল। সবার মধ্যে ভালোবাসা ছিল। একের কষ্টে অন্যে এগিয়ে আসতেন। এখনো আসেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। যেকোনো মুহূর্তে ঠুনকো অজুহাতে গাজার ওপর বোমা হামলা চালানো হয়। তাতে নিহত হন নিরীহ মানুষ। ঘরবাড়ি, দালানকোঠা সব মাটিতে মিশে গেছে। চারদিকে শুধু হাহাকার। দাদুর এ গল্প শুনে চোখ ভিজে ওঠে সবার। এখন ইচ্ছে হলেই তাদের বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়া হয়। পানি থাকে না। ওষুধ থাকে না। খাবার থাকে না। মানুষের অতি দরকারি জিনিসের সরবরাহ নেই। চোখের সামনে কত মানুষ মারা যাচ্ছেন। এই যে হতাশা, এর পরেও ইউসুফ স্বপ্ন দেখে। তার স্বপ্নকে তো কেউ কেড়ে নিতে পারে না। তার স্বপ্ন ছিল ঘুড়ি নিয়ে। স্বপ্ন ছিল রকেট নিয়ে। এই রকেট দিয়ে কোনো হামলা নয়, মানুষ হত্যা নয়। সে স্বপ্ন দেখে রকেট নিয়ে চাঁদের দেশে পাড়ি দেবে। দেশ, জাতি ও মানুষের জন্য বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করবে। ইউসুফ একজন ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। এমন জিনিস বানাতে চায়, যা তার ঘুড়ির মতো ওড়ে। এমন জিনিস বানাতে চায়, যা সব কাঁটাতারের বেড়াকে অতিক্রম করবে। সব সীমান্তকে অতিক্রম করবে। উড়বে বিশ্বময়। কিন্তু গাজায় বসে এই স্বপ্ন দেখা ছিল অনেকটা অলিক কল্পনা। একদিন সকালে ইউসুফ তার স্কুলব্যাগ গোছাচ্ছে। ঠিক এ সময় মৃদু একটি গর্জনে দেয়াল কেঁপে ওঠে। ইউসুফ নিথর হয়ে পড়ে গেল। তার বোনেরা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। বাইরে তখন সাইরেনের শব্দ। তার মা জোর গলায় চিৎকার করে বললেন- ঘরের ভিতর থাকো। জানালা থেকে একটু দূরে করিডোরে জড়ো হলো সবাই। ঠিক তখনই আকাশে যুদ্ধবিমানের শব্দ। তারপর আরেকটা শব্দ। আরেকটা শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে মাটি কেঁপে উঠলো। ইউসুফদের ছাদ থেকে উড়ে পড়তে লাগলো ধুলো। এভাবে কেটে গেল কিছু সময়। আসলে এই কয়েকটি মিনিটকে তাদের কাছে মনে হচ্ছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। চারদিকে নিস্তব্ধতা ফিরে এলো। পরের দিন তারা জানতে পারলো বাজারের সড়কটিতে বোমা হামলা চালানো হয়েছে। আবারও ইউসুফের স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ওই সপ্তাহে আর ঘুড়ি উড়াতে পারলো না ইউসুফ। ড্রোনে ভরে গেল আকাশ। পোকামাকড়ের মতো ড্রোনের গুঞ্জন শোনা যেতে লাগলো। প্রতিবেশী একটি বাড়ি মোমের মতো ধসে পড়ল। বাতাসে তখন ধোঁয়া। সবার মনে ভয় আর আতঙ্ক। সেই ধ্বংসস্তূপ সরাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করলেন ইউসুফের পিতা। পাশাপাশি মসজিদ থেকে মানুষের মাঝে খাবার পৌঁছে দিতে লাগলেন। সেই কাজে সাহায্যের হাত বাড়াল ইউসুফও। স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে পানির বোতল এগিয়ে দিতে লাগল সে। পুরানো কাপড় থেকে কাঁথা সেলাইতে মাকে সাহায্য করতে লাগলো। কখনো ঘুড়ি হাতে ছাদে উঠে যায়। যেন, সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছিল বাতাস। দূরে সমুদ্রের দিকে তাকালো ইউসুফ। ভাবতে লাগলো তার ঘুড়ি কি ওই ভারি মেঘের নিচ দিয়ে উড়ে যেতে পারবে? যদি কেউ এটাকে ভয়ানক কিছু মনে করে? তারা যদি মনে করে এই ঘুড়ির মাধ্যমে সে কোনো বার্তা পাঠাচ্ছে, তখন কী হবে। তবে তাকে ঘুড়ি ওড়াতেই হবে। হাতে ঘুড়ি ধরে দৌড় দিল। প্রথমে ঘুড়িটি কাঁপল। তারপর আস্তে আস্তে আকাশের ওপরে উঠে যেতে লাগল। আরও উপরে, আরও উপরে উঠে যেতে লাগল। সে ঘুড়ির সুতা ধরে টান দিল। তাতে সর্পিলভাবে, এদিক-ওদিক দুলে দুলে ঘুড়িটি উপরে উঠে যেতে লাগল। ইউসুফ কল্পনা করতে লাগল- ঘুড়িটি একটি মহাকাশযান। অজস্র তারার ভেতর দিয়ে তা ছুটে চলেছে। আর তা পরিচালনা করছে সে। এমন সময় কিছু একটা লক্ষ্য করলো সে। দেখলো আরেকটা ছাদ থেকে দ্বিতীয় আরেকটি ঘুড়ি বাতাসে নাচানাচি করছে। এর রং নীল আর সাদা। দেখতে পাখির মতো। বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করলো ইউসুফ। যে ভবন থেকে ঘুড়িটি উড়ছে তা তো কয়েক সপ্তাহ ধরে ফাঁকা। সেখানে দাঁড়ানো একটি মেয়ে। দেখে মনে হয় তার বয়স ইউসুফের মতোই। তার পরনে ফ্যাকাশে সবুজ রঙের একটি পোশাক। বাতাসে উড়ছে তার স্কার্ফ। মেয়েটি তার ঘুড়ির সুতা ধরে আছে। ইউসুফকে দেখে হেসে দিল। জবাবে ইউসুফও হাসল। তারপর ঘুড়ির সুতা ধরে টান দিল। মাথা নিচু করে তাকে শুভেচ্ছা জানালো। একই কাজ করলো মেয়েটিও। এরপরই তাদের মধ্যে নীরব ভাষা বিনিময় হয়। তারা ঘুড়িতে লুপ সৃষ্টি করে। ডাইভ দেয়। দৌড়ায়। তাদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি। শুধু অঙ্গভঙ্গি আর হাসি বাতাসে মিলিয়ে গেল। সেই হাসির রেণু যেন গাজার প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে দিল মৃদু বাতাস। এরপর প্রতিদিন বিকেলে যতক্ষণ আকাশ পরিষ্কার থাকে এবং ড্রোনগুলো দূরে থাকে, ততক্ষণ তারা ঘুড়ি ওড়ায়। ইটের দেয়ালে নানারকম আঁকিবুকি করে মেয়েটি। চক দিয়ে তার পাশে একটি শব্দ লেখা ছিল। তা দেখে ইউসুফ বুঝতে পারে মেয়েটির নাম আমিরা। দেয়ালে একটি হৃদয় আর একটি ঘুড়ির পাশে আরবিতে নিজের নাম লিখেছিল আমিরা। পরের দিন জবাবে নিজের ঘুড়িতে নিজের নাম লিখে আমিরাকে ইউসুফ জানালো তার নাম ইউসুফ। মাঝে মাঝেই তারা পানির ট্যাংকে নানারকম বার্তা লিখে রাখে। কখনো কাগজের ক্রেন, রকেট এঁকে রাখে। কখনো কাগজে মোড়ানো ক্যান্ডি বারের ছবি।   ইউসুফ জানতে পারে খালা ও এক ছোট ভাইয়ের সঙ্গে থাকে আমিরা। দুই বছর আগে রাতের বেলা তাদের বাড়ি ঘেরাও দেয় শত্রুপক্ষ। সে অভিযানে তারা আমিরার পিতামাতাকে হত্যা করে। কখনো স্কুলে যেতে পারেনি আমিরা। তবে সে অনেক বই পড়ে। তার কাছে কয়েক ডজন বই আছে। তা পড়ে পড়ে নিজে পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখে আমিরা। এ কথা জানার পর একদিন আমিরাকে চিঠি লেখে ইউসুফ। তাতে জানতে চায়- তুমি পাইলট হতে চাও? কিন্তু এখানে তো মেয়েরা বিমান চালায় না। ‘আমিই হবো প্রথম’, বলল আমিরা। ‘আমি পাইলট হয়ে তোমাকে আমার বিমানে চড়াবো।’ একদিন সকালে আবার আকাশে গর্জন শুরু হলো। জোর থেকে জোরে হতে লাগলো সে শব্দ। একটানা শব্দ। সেদিন আর কেউ ঘুড়ি উড়াতে যায়নি। এর পরের সপ্তাহে যুদ্ধ শুরু হয় সীমান্তের কাছে। আবার বোমাবৃষ্টি। আবার ভবনগুলোর জানালা ভেঙে যায়। ধসে পড়ে অনেক ভবন। মারা যায় ইউসুফ-আমিরা বা তার চেয়েও কম বয়সী অনেক শিশু। তিনদিন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তারা। পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে ছাদে ওঠে ইউসুফ। চারদিকের বাতাস কেমন যেন গুমোট মনে হয় তার কাছে। পাশের সেই ভবনে আমিরা নেই। তার নীল ঘুড়িটিও নেই। আমিরার জন্য প্রতিটি দিন অপেক্ষায় থাকে ইউসুফ। কিন্তু চারদিকে যেসব ছাদ দেখা যায়, সেখানে নেই আমিরা। সব ফাঁকা। তারপর এক সন্ধ্যায় আকাশ কমলা রং ধারণ করলো। ইউসুফ দেখতে পেল একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে একটি ছোট্ট শিশু। শিশুটি পিছনের দিকে তাকিয়ে তার ছোট্ট হাতে কিছু একটা ধরে আছে। তার দিকে চোখ টিপে তাকালো ইউসুফ। দেখলো সেটা ছিল কাগজে তৈরি একটি ক্রেন। সে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। দরজাটি অর্ধেকটা ভাঙা। সে নেমে যাওয়ার সময় সিঁড়িতে মচমচ শব্দ হলো। ছাদের ওপরে ছোট্ট শিশুটি এককোণে কিছু একটা ইশরা করেছে। ভাঙা পানির ট্যাংকের পাশে কাপড়ে বাঁধা ছোট্ট একটি নোটবুক আর একটি ঘুড়ি। এসব আমিরার। নোটবুকটিতে বিভিন্ন জিনিস আঁকা- বিমান, পাখি, তারকা আর একটি গল্প। নির্ভেজাল ও পরিষ্কার আরবিতে লেখা- আমার নাম আমিরা। আমি উড়তে চাই। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা এতে তার স্বপ্ন, ভয় আর স্মৃতিকথা লেখা। ইউসুফকে নিয়েও লিখেছে- ইউসুফ এত ভালো ঘুড়ি উড়ায়। অন্য কেউ তার মতো ঘুড়ি ওড়াতে পারে না। এমনিতে আকাশ থাকে নিঃসঙ্গ, একা। কিন্তু ইউসুফ যখন ঘুড়ি ওড়ায় আকাশ তখন আর একা থাকে না। আকাশের সঙ্গী হয়ে ওঠে তার ঘুড়ি। শেষ পৃষ্ঠায় আমিরা লিখেছে- যদি আমি চলে যাই, কথা দাও তুমি আমাদের দুটো ঘুড়িই উড়াবে। কথা দাও তুমি মনে রাখবে আকাশটাও আমাদের।

ফুজান

ফুজান

যেই ভুল করে গন্ধম ফল খেয়ে আদম আর হাওয়া পৃথিবীতে পদচিহ্ন রেখেছিল, সেই চিহ্ন ধরেই ফুজান হেঁটে চলছে, আমরাও চলছি। ফুজান আমাদের কোথায় নেবে জানি না। তবু তাকে অনুসরণ করছি। ফুজানের পিছু চলার মজাই এটা। সবকিছুতে একটা রহস্য রহস্য ভাব থাকে। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছি। আমাদের ফেলে অনেকটা এগিয়ে গেছে ঐ যে ঐ দীর্ঘদেহী নারী, তাকে আমরা ফুজান বলে ডাকি। ছোটবেলায় ফুপু ডাক বের হওয়ার আগে ফু করে হাওয়া ছাড়তে হতো অনেকটা, ফুপুর ‘ফু’ জোরালো হয়ে ওঠে ‘পু’ টা হাওয়া হয়ে যেতো। আর তাই ফুপুজান ডাকটা হয়ে যেতো ফুজান। এখন ফোকলা দাঁত নেই কারও, তবু ফুজান ডেকে আমরা প্রাণে আরাম পাই। ফুজান শুধু আমার বা ওর একার ফুজান না, হলাইজানা গ্রামের চুমকি, ছিমকি, বুলবুলি, বীনা, লিপি, সাজ্জাদ, ফারুক, কাদের, শফি সবার ফুজান। আমাদের ফুজানের নাম হাওয়া বিবি। আমাদের কারও বাড়ির কোনো মুরুব্বিই চায় না আমরা ফুজানের সঙ্গে কথা বলি বা ফুজানের পিছু পিছু ঘুরি। কিন্তু ফুজান আমাদেরকে টানে। তার কথা, স্পর্শ, হাসি সবকিছু আমাদের সবাইকে একেবারে টেনে ধরে রাখে। তাই যে যতই না করুক না কেন, আমরা কখনো ফুজানের পিছু ছাড়ি না। সবচেয়ে রহস্যময় ফুজানের হাসি। হাসলে তার পান খাওয়া দাঁতের সারির প্রায় সবই দেখা যায়, আবার কী যেন কী একটা দেখা যায় না। পিছু ফিরে ঠিক তেমনি করে হেসে ঠোঁটের ফাঁকে বিড়ি গোঁজে ফুজান। পেশাদারিত্বের সঙ্গে ধোঁয়া ছেড়ে মানুষটা সামনে এগোয়। আমরাও এগোই। সামনে দীপ রাজার দীঘি। দীঘির আধ খাওয়া নামের মতো দীঘিরও একই অবস্থা। সন্দ্বীপ রাজার নাম কালে কালে দীপ রাজা হয়ে গেছে আর দীঘি হয়ে গেছে পুকুর। রাজা রাজ্য ছেড়ে ওপারে চলে যাওয়ার পর দীঘিটা খতিয়ানে সরকারি খাস সম্পত্তি হিসেবে রেকর্ড হয়েছে। অনেক বছর হলো প্রামাণিকরা দীপ দীঘি লিজ নিয়েছে। বছর বছর মাছ ছাড়া হচ্ছে দীঘিতে। এই বছর বিষ দিয়ে কারা যেন দীঘির মাছ মেরে ফেলেছে। আমরা দেখেছি বড় বড় রুই, কাতলা, তেলাপিয়া ভেসে উঠেছিল। ছেলেপেলেরা টানাটানি করছিল মাছ নেওয়ার জন্য, প্রশাসনের লোকেরা কাউকে একটা মাছে হাত লাগাতে দেয়নি। ওদের কথামতো কামলারা জাল টেনে মাছ তুলে মাটিতে গর্ত করে পুঁতে ফেলেছে। পরে অজ্ঞাতনামা আট দশজনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে ছোট প্রামাণিক। মামলার তদন্ত চলছে, কারও নাম এখনো সামনে আসেনি, কেউ ধরাও পড়েনি। ছোট প্রামাণিকের নিজের নামেও একই ধরনের মামলা আছে। গত আষাঢ়ে হিন্দুপাড়ার রিপন সাধুর আম বাগানের দুশ’ চারা এক রাতের মধ্যে কেটে নিয়েছিল কারা যেন। রিপন সাধু পরের দিন থানায় ছোট প্রামাণিকের নামে এজাহার দিতে গিয়েছিল। থানা মামলা নেয়নি। পরে আদালতে গিয়ে মামলা করে রিপন সাধু নালিশে লিখেছে, ঐ আম বাগানের সীমানা নিয়ে গণ্ডগোল বাঁধায় দেওয়ানী আদালতে মামলা করেছিল রিপন সাধু তাই ক্ষিপ্ত হয়ে রাতের আঁধারে ছোট প্রামাণিক গাছগুলো কেটে ফেলেছে। এরপর আদালতে আত্মসমর্পণ করে অনেক টাকা খরচ করে বড় উকিল ধরে জামিন নিয়েছে ছোট প্রামাণিক। এসব নিয়ে হলাইজানা গ্রামে অশান্তির শেষ নেই। শত অশান্তির মাঝেও দীপ রাজার দীঘির পাড়ে এসে দাঁড়ালে শান্তি শান্তি লাগে। ফুজান দীঘির ঘাটলায় নেমে পানি ছুঁয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা এতক্ষণ খেয়াল করিনি ফুজান কুলি করে মুখ ধুয়ে নিচ্ছে। এরপর আঁচলের খুঁট থেকে একটা পান তুলে মুখেও দিয়েছে। বুঝি বিড়ির গন্ধ দূর করতে চায় ফুজান। আরও বুঝতে পারি, ফুজান কোথায় যাবে। ফুজান প্রামাণিক পাড়ার দক্ষিণমুড়া কবরস্থানের দিকে যাচ্ছে। এখানে আগেও এসেছি আমরা। ফুজানের পিছু পিছু। অবশ্য কবরস্থানের ভাঙাচোরা গেটের সামনেই থামতে হয়েছে। নারীদের এই কবরস্থানে ঢুকতে দেওয়া হয় না। কমিটির অনুমোদন নেই। ফুজান অবশ্য না শোনার মানুষ না। তবু এই নিষেধাজ্ঞা ফুজান শোনে। কারণ যার কবরের জন্য এখানে ফুজান আসে তার কবরটা কবরস্থানের একেবারে পশ্চিম সীমানা ঘেঁষা। আর সীমানার বাঁশের বেষ্টনীও আধভাঙা। চাইলেই কবরের কাছাকাছি দাঁড়ানো যায়। এই কবরে কোনো ফলক নেই। শুধু নজর আন্দাজেই আমরা বুঝে নেই ঐখানে ফুজানের মায়ের কবর। হাত বাড়ালেই কবর সংলগ্ন সফেদা গাছটা ছোঁয়া যায়। গাছটা ছুঁয়েই আমাদের শরীর শিরশির করে। ফুজানেরও হয়তো একই হাল হয়। সে শব্দহীন কাঁদে খানিকক্ষণ। আমরা তাকে থামানোর চেষ্টা করি না। ফুজান তার মায়ের জন্য কাঁদবে, আমরা থামানোর কে? তবু ফুজান থামে। আমাদের হাত ধরে বলে, ‘চল যাই।’ ‘কই যাইবা?’ ‘রাজার দীঘিত।’ ‘ক্যান? আবার বিড়ি খাইছো নি?’ আমাদের কথার ঠেসে ফুজান শব্দ করে হাসে। পুকুরের পানি টলমল টলমল ঝলমল ঝলমল করে। থেকে থেকে বুড়বুড়ি ওঠে পানিতে। একটা, দুটা মাছ এখনো আছে নাকি! মাথা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করি। একটা মাছও সাঁতার কাটে না। মনে আফসোস জাগে। ‘প্রামাণিকগো ছাড়া মাছগুলারে কোনো শয়তানরা যে বিষ খাওয়ায় মারলো!’ ‘মারছে ভালা করছে।’ ফুজানের উত্তরটা এত অপ্রত্যাশিত ছিল যে আমরা ঘাটলার ধারে এসে হোঁচট খাই। ফুজান আমাদের হাত ধরে টান দিয়ে দাঁড়ায়। ‘ঐ মাছ আমি মাগনা দিলেও খাই না। রাজাকারগো পাইলাপুইষা বড় করা মাছ, আমার ঘিন্না লাগে।’ ফুজানের মুখচোখ বিকৃত হয়ে ওঠে। তরতর করে ঘাটলার সিঁড়ি ধরে নামে ফুজান। ফের অনেকটা সময় নিয়ে কুলি করে, মুখ ধোয়। আমরা সমস্বরে জানতে চাই, ‘ও ফুজান, পানিতে ঘিন্না লাগে না?’ ‘দুরো যা, এই দীঘি রাজার দীঘি, পানিও রাজার। এই দীঘির পানি মিঠা, খাইয়া দ্যাখ। আমার মা কইছে, রাজা রাজ্যের পাইক পেয়াদা দিয়া মনকে মন গুড়, চিনি ঢালছে এই পানিতে।’ আমরা ফুজানের আজগুবি গল্প শুনে হাসি। তারপর সুরেলা কণ্ঠে জানতে চাই, ‘তোমার মায়ের নামটা কী গো ফুজান?’ ফুজান হেসে উঠে বলে, ‘আমার মায়ের নামটি মা লো আমার মায়ের নামটি মা।’ আমরা এবার দুলে দুলে হাসি আর ফুজানের ঢঙে আবৃত্তি করি, ‘আমার মায়ের নামটি মা, তাহার নেই কো তুলনা।’ ॥ দুই ॥ ফুজানকে ঘরে দেখছি না। কোথায় গেল সকাল সকাল? ঘরে তো নেই। ঘরটা কেমন যেন, নিঃসঙ্গ, রূঢ়, দমবন্ধ করা। এই  ঘরে চার দেওয়ালই আছে শুধু আর কিছু নেই, ফুজানের মা বেঁচে থাকতেও আসতাম এখানে। মা-মেয়ের সংসারও নিস্তরঙ্গ ছিল। ওদের দুজনকে একঘরে বলা যেত না তবু কেমন যেন সতর্কতা ছিল সবার। এই ঘরে দাবি-দাওয়া নিয়ে হুট করে কেউ ঢুকতো না, এখনো ঢোকে না। আমরা ফুজানের ঘর দেখি। দেখি ফুজানের একটা ছোট ঘর আছে, বর নেই। শুনেছি অনেক অনেক বছর আগে ফুজানের একবার গায়ে হলুদ হয়েছিল। কাঁচা হলুদ আর মেহেদি পাতা বেটে হাওয়া বিবির মা হাওয়া বিবির গায়ে হলুদের আয়োজন (এরপর ১১ পৃষ্ঠায়)  করেছিল। ঐ আয়োজনে তেমন কোনো অতিথি আসেনি। তবু মা- মেয়ের হাসিতে ঝলমল করে উঠেছিল এই ঘরদোর। পরের দিন শুক্রবার বরযাত্রী আসার শুভদিন ছিল। কিন্তু হাওয়া বিবির শরীরে হলুদ ছুঁইয়ে গোসল করানোর আগে অশুভ সংবাদটা এসেছিল। বরপক্ষ বিয়ে ভেঙে দিয়েছিল। এরপর হাওয়া বিবির মা মেয়েকে বিয়ে দিতে কতজনের কাছে যে গেছে। পাত্র পায়নি। একবার এক সত্তর বছরের বুড়ো হাওয়া বিবিকে দ্বিতীয় বিবি করতে রাজি হয়েছিল, হাওয়া বিবি রাজি হয়নি। মায়ের সঙ্গে কাজিয়া-ফ্যাসাদ করে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যাবে কোথায়? বাপ মরা মেয়ের তো মা-ই সব। ঐ মেয়ের বাপই বা কে? ঐ প্রশ্ন তুললে হাওয়া বিবির মা ঝিম ধরে থাকতো বহুক্ষণ। হাওয়া বিবিও ঝিম ধরে থাকে। ঝিম ধরা ফুজানকে আমরা খুঁজে পাই দীপ রাজার দীঘির ধারে। ফুজান মানুষটাই এমন। দীঘলে পাথালে মানুষটা যেমন আসমান ছুঁই ছুঁই তার মেজাজ-মর্জিও তেমন আসমানের মতো থৈহীন। যখন যা মন চায় করে, যেখানে মন চায় যায়। কোনো শিকল নেই পায়ে। এমন একটা শিকলহীন জীবনের জন্য কত তড়পাই আমরা আর ফুজান তড়পায় নিজের স্বাধীনতার বাড়াবাড়ির জন্য। পান খাওয়া দাঁতের হাসি দেখলে বোঝার উপায় নেই ঐ স্বাধীনতাই ফুজানের পায়ের বেড়ি। একা ঘরে স্বাধীন থেকে থেকে ফুজান যখন হাঁপিয়ে ওঠে তখনই সে এমন করে ঘর ছাড়া হয়। ঘর ছেড়ে দীপ রাজার দীঘির ঘাটলা ছাড়া আর যাবে কোথায়? দীঘিটা প্রামাণিকদের ভিটা থেকে অনেকটা দূরে। একসময় এই দীঘি হলাইজানার সব মানুষের ছিল। ছোট প্রামাণিক লিজ নেওয়ার পর থেকে মালিকানা বদল হয়েছে। দীঘির মাছ মরে যাওয়ার পর পাহারাও জোরদার হয়েছে। পাড় থেকে গজ শ’ দূরে একটা টঙঘরে দুজন দশাসই পাহারাদার থাকে, আশপাশে কাউকে দেখলে লাঠি হাতে তেড়ে আসে। আজ আমাদের দেখে ওরা উসখুস করছিল। তখনই বুঝেছি ফুজান এখানে আছে। ফুজানকে দেখলে পাহারাদাররা চুপসে যায়। একদিন ফুজানকে ঘাটলায় নামতে দেবে না বলে ওরা লাঠি হাতে তেড়ে এসেছিল। ফুজান সপাটে বুক চাপড়ে ‘আয় দেখি আমারে সরা’ বলতে বলতে ঘাটলায় শুয়ে পড়েছিল। আজও ফুজান শুয়ে আছে। আমরা কাছে এগিয়ে দেখি ফুজানের বয়সী চোখ দুটি ভেজা। কানের দুপাশে পানি গড়ানোর চিহ্ন লেগে আছে। মুখটিতেও যন্ত্রণার ছাপ। ফুজানের পাশে বসে চমকে উঠি। তার শরীরের দুপাশে ছড়ানো হাত দুটির আঙুলগুলো রক্তাক্ত, আঙুলের ভাঁজে ভাঁজে কাচা ক্ষত। এমন ক্ষত ফুজানের হাতে আগেও দেখেছি। কী হয়েছে জানতে চাইলে ফুজান উত্তর না দিয়ে রহস্যময় হেসেছে। মাকে, বাবাকে প্রশ্ন করলে ধমক শুনেছি, শুনেছি, যুদ্ধের কালে নষ্ট হয়েছে ফুজানের মা, ফুজানের জন্মেরও ঠিক নেই। অমন বেজন্মা মেয়েমানুষের সঙ্গে না মেশাই ভালো। আমরা তবু ফুজানের সঙ্গে মিশি, মিশে মিশে ঢল বৃষ্টিতে ভেজা মাটি-কাদার মতো মাখামাখি হয়ে যাই। ফুজানের রক্তমাখা হাতে শান্ত চুমু খেতে খেতে জানতে চাই, ‘ফুজান তোমার কী হইছে?’ সত্যি সত্যি আজ কী যেন হয়েছে ফুজানের। ফুজান বিড়বিড় করছে। নিজেকে ভাঙছে। কাঁপছে। কাঁদছে। থই পাচ্ছি না কোনো। মনে হচ্ছে কেউ আমাদের দীপ রাজার দীঘির কেন্দ্রে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমাদের পায়ের নিচে জল কিছু নেই। ও জলও দাপুটে, থির হতে দিচ্ছে না। ছলবল ছলবল করে অতলে টেনে নিতে চাইছে। ফুজানই আমাদের টেনে তোলে। নরম স্বরে শোনায় ফুজানের মায়ের কিসসা। যেই কিসসার সঙ্গে জলেরই মিতালি। ‘পাকিস্তানি মিলিটারিরা, রাজাকারের বাচ্চারা আমার মায়ের হাত পা বাইন্ধা এই দীঘিত ফালায় রাখতো। মায়ের আঙুলের চিপায় চিপায় ইটের টুকরা রাইখা চাপ মারতো, বেয়োনেট দিয়া সমানে খোঁচাইতো। আহারে...শইলের বেদনায় আমার মায় চিক্কুর পাইড়া কত কানছে! কোনো জালিম আমার মায়ের কান্না শোনে নাই...মা, ও মা রে...আমারে একলা ফালায়ে কই গেলি মা...’ উদলা আকাশের নিচে হাওয়া কাঁপে থরোথরো। হাওয়া বিবিও কাঁপে। কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসে আমাদের এক ঝলক দেখে নেয়। তারপর দীঘির দিকে মুখ করে বসে। ‘বড় প্রামাণিক ছিল শান্তি কমিটির মেম্বার। আমার মারে ওই বড় প্রামাণিকই টাইনা ক্যাম্পে তুলছিল। একমাস বিশ দিন ছিল মা ক্যাম্পে। আমি তখন আছিলাম আসমানের ম্যাঘ। মা কানলেই ম্যাঘ থেইকা পানি হইয়া টুপুরটুপুর পড়তাম।’ আসমানে সাদাকালো মেঘ ভাসে। আমাদের চোখে ভাসে দীপ দীঘির জল। আমাদের মনে পড়ে যায়, এখনও অনেকেই ফুজানকে দেখে খিকখিক করে হাসে আর বলে, ‘এ্যাই দ্যাখ দ্যাখ ওর বাপ না মিলিটারি, দ্যাখোস না কেমন শরীর স্বাস্থ্য। বাঙালির বীজে জন্ম না।’ আমরা ফুজানের হাতের আঙুলে হাত বুলাই। স্পর্শে স্পর্শে বেদনার ঢল নামে। ফুজান গুমরে ওঠে। আমরা ক্ষীণ স্বরে বলি, ‘একটু ধোঁয়া খাইবা ফুজান?’ ফুজান হাসে। এই হাসি দীপ রাজার দীঘির জলের মতো সবুজ। আমরা ফের হেঁয়ালিভরে জানতে চাই, ‘তোমার মায়ের নাম কী গো ফুজান?’ ফুজান হেসে উঠে বলে, ‘আমার মায়ের নামটি মা লো আমার মায়ের নামটি মা।’ আমরা এবার দুলে দুলে হাসি আর ফুজানের ঢঙে আবৃত্তি করি, ‘আমার মায়ের নামটি মা, তাহার নেই কো তুলনা।’

চর্যাপদে বাংলার সমাজচিত্র

চর্যাপদে বাংলার সমাজচিত্র

চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। এই পদসমূহ বাংলাসাহিত্যের মূল্যবান আধ্যাত্মিক সংগীত সমষ্টি। এগুলোর সঠিক বয়স আজ পর্যন্ত নিরুপন করা সম্ভব না হলেও এসব যে বাংলা সাহিত্যের আদি সম্পদ, একথা সকল ভাষা পণ্ডিতরাই স্বীকার করেছেন। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় শ্রী হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের পুথিশালা থেকে এর মূল পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেন। পাণ্ডুলিপিতে এর নাম ছিল ‘চর্যাচর্য বিনিশ্চয়’। কিন্তু শাস্ত্রী মহাশয় গ্রন্থটির নাম দেন ‘হাজার বছরের পুরান বাংলাভাষার বৌদ্ধ গান ও দোহা’। বলাবাহুল্য, এই সংগীতগুলো বৌদ্ধ আধ্যাত্মিক ভাবাপন্ন বিধায় শাস্ত্রী মহাশয গ্রন্থখানির অনুরূপ নামকরণ করেন। পরে ডক্টর প্রমোদচন্দ্র বাগচী চর্যাপদের অনুবাদের যে সংকলনটি নেপাল থেকে সংগ্রহ করেন, তাতে মোট ৫১টি সম্পূর্ণ পদ ছিল। এরপর আর নতুন কোনো সন্ধান পাওয়া না যাওয়ায় চর্যাপদের মোট সংখ্যা এটাই বলে পণ্ডিতরা ধরে নিয়েছিলেন। অবশ্য অনেক পরে ডক্টর শশীভূষণ দাসগুপ্ত, ডক্টর আর্নল্ড বাকে প্রমুখ পণ্ডিতবর্গ আরও কিছু চর্যাপদের সন্ধান পেলেও ভাব এবং ভাষার দিক দিয়ে সেগুলো পূর্ব সংগৃহীত সমূহের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় সেগুলোকে খাঁটি চর্যাপদ বলে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি; বরং ওগুলো চর্যাপদের অনুসৃষ্ট বলে বিশ^াস করা হয়েছে। চর্যাপদগুলো কাব্যাকারে রচিত। এগুলোর রচয়িতা হিসেবে যাঁদের নাম পাওয়া গেছে তাঁদের মধ্যে ভুসুকুপাদ, কাহ্নপাদ, সরহ পাদ, কলম্বপাদ, চাটিলপাদ, শান্তিপাদ, লুইপাদ, শবরপাদ, গুন্ডরীপাদ, মহীধরপাদ, বীনাপাদ, আর্যদেবপাদ, ঢেন্ডনপাদ. দারিকপাদ, আড়কপাদ, ধামপাদ, তান্তীপাদ, কক্কুরীপাদ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। পদের রচয়িতা বলে এঁদের নামের সঙ্গে ‘পাদ’ শব্দটি যুক্ত হয়েছে। আগেই বলা হয়েছে, চর্যাপদগুলো বৌদ্ধদের অধ্যাত্ম সংগীত সমষ্টি। এ সব সংগীত ইহকালের সমস্যা সংকুল জীবনযাত্রা এবং তা থেকে নির্বানলাভ পূর্বক মহাপ্রভুর সঙ্গে মিলনের আকাক্সক্ষা এবং তার উপায় বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু উল্লেখ্য যে, তা সরাসরিভাবে বর্ণনা না করে বিভিন্ন রূপকের মাধ্যমেই বলা হয়েছে। আর এই রূপক সমূহের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে তৎকালীন বাংলাদেশের এক নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। চর্যাপদে তৎকালীন বাঙালিদের যাতায়াতের জন্য প্রধান বাহন হিসেবে নৌকার ব্যবহার ছিল। বহুসংখ্যক পদে নৌকার নামোল্লেখ এবং এর ব্যবহারিকতার বর্ণনা রয়েছে। অনেক সময় দূরের যাত্রাপথে উজানগুণ টেনে নিয়ে নৌকা চালানো হতো। সে সময় নৌপথে দস্যুর ভয় ছিল। এমন একটা বর্ণনা আছে নরহপাদের ৩৮ সংখ্যক পদেÑ ‘কাএ নাবড়ি খানটিমন কাড় আল। সদগুরু বঅনে ধর পতবাল ॥ চীঅ থির করি ধরহুরে নাঙ্গ। আল উপাএ পারদ জাই ॥ নৌবাহী নৌকা টানই গুণে। মেলি মিন সহজে জানই আনত ॥ বাটত ভএ খান্ট বি বলআ। ভব উলোলে সরবি বেড়িয়া ॥ ফুল লই ঘরএ সোন্ত উজাই সর ভনই গঅনে সমাই ॥’ অর্থাৎ কায়ারূপ নৌকাতে মনবৈঠা ও সদগুরু বচনরূপ হাল ধরো। চিত্ত স্থির করে হাল ধরো। অন্য উপায়ে পারে যাওয়া যাবে না। নৌবাহী গুণে নৌকা টানে। সহজে মিলে যাও, অন্যপথে যেও না। পথে ভয়। দস্যু বলবান। তবে সমুদ্রের উল্লাসে সবই বিনষ্ট। সরহ বরলন, কূল ধরে খরস্রোতে উজান বেয়ে চললে (নৌকা) গগণে প্রবেশ করে। সাধারণত ডোম্বীরা কিছু পয়সার বিনিময়ে পারাপার করত। আবার অনেক সময় বিনে পয়সাতেও। পয়সা হিসেবে কড়ি, বুড়ির উল্লেখ আছে। যেমনÑ ‘কবড়ী লেই, কবড়ী নলেই কুচ্ছেল পর করেই।’ (ডোম্বীপদ : ১৪ সংখ্যক) অর্থাৎ ডোম্বী কড়িবুড়ি না নিয়ে স্বেচ্ছায় নৌকা পার করে দেয়। চর্যার বিভিন্ন পদে নৌকার বিভিন্ন অংশ এবং সরঞ্জামের উল্লেখ আছে। যেমনÑ  কেড় আল-দাঁড়, পতবাল-হাল, পুলিন্দা-মাস্তুন, মাঞ্জ-লুই ইত্যাদি। অনেক ক্ষেত্রে পারাপারের মাধ্যম হিসেবে ভেলাও ব্যবহৃত হয়েছে। শান্তিপাদের ১৫ সংখ্যক পদে আছেÑ ‘মাআ মোহ সমুদারে অন্তন বুঝসি যাহ্ াআগে ন বন ভেলা দীসইÑ ভান্তি ন পুছসি নাহা ॥’ অর্থাৎ মায়ামোহ রূপ সমুদ্রের অন্ত বুঝে না, গভীরতা বুঝে না। সামনে নৌকা বা ভেলা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ছোট নদী পারাপারের জন্য গাছ কেটে জোড়া দিয়ে সাঁকো তৈরি করা হতো। চাট্টিলাপাদের ৬ সংখ্যক পদে আছেÑ ‘ভবনই গহন গম্ভীরে বেগে বাহি। দু অন্তে চিখিল মাঝো থাহি ॥ ধামাথে চটি সবঙ্কম গঢ়ই । পারগামী লোঅ ভির তরই ॥ ফাড়ি মোহ তরু পাটি জোড়িঅ। অদঅ দিঢ়ি টাঙ্গি নিবানে কোড়িঅ ॥’ অর্থাৎ গহন ও গভীর ভবনদী বেগে বয়ে যাচ্ছে। এর দুধারে কাদা, মাঝখানে থই নেই। ধর্মসাধনার জন্য সাঁকো বানালেন (যাতে) পারগামী লোকেরা নির্ভয়ে পার হতে পারে। মহীতরু চিরে পাটি জোড়া দেওয়া হল। বর্তমানের মতো প্রাচীন বাঙালি সমাজেও অতি ধুমধামের সঙ্গে বিবাহকার্য সমাধা হতো। বর ঢাক-ঢোল, কাসি-ঘণ্টা ইত্যাদি বাজিয়ে বিয়ে করতে কনের বাড়িতে যেত। বিয়েতে যৌতুকপ্রথা ছিল। নববধূর বাসর যাপনের ব্যবস্থাও ছিল। কৃষ্ণপাদের ১৯ সংখ্যক পদে আমরা দেখিÑ ‘ভব নির্বানে পড়হ মাদলা। মন পবন বেনি করন্ড ফাসালো ॥ জয় জয় দুন্দহি সাছ উছলিআ। কাহ্ন ডোম্বি বিবাহে চলিলা ॥ ডোম্বি বিবাহিয়া আহারিউ জাম। জউতুকে কিঅ অনুত্তর ধাম ॥ অহনিশি ফুরআ প্রসঙ্গে জাইি। জেইনি জালে রঅনি পোহাই ॥ ডোয়ী এর সঙ্গে জো জোই রও। খনই দূরে ছাড়ই সহজ উন্মত্ত ॥’ অর্থাৎ ভব নির্মাণকে পটই ও মাদল, মন-পবনকে করন্ড ও ফাঁসি করা হল। দুন্দুভি শব্দে জয় জয় শব্দ উছলে উঠল। কাহ্নপাদ ডোম্বিকে বিয়ে করতে চললো। ডোম্বীকে বিয়ে করে জন্ম নাশ করল। যৌতুক হিসেবে পেল অনত্তর ধাম। দিনরাত সুরভ প্রসঙ্গে যায়। যোগিনী জালে রাত্রি পোহায়। ডোমীর সঙ্গে সঙ্গে যে যোগী অনুরক্ত, সে সহজও হয়ে ক্ষণমাত্রও ডোম্বীকে ছেড়ে যায় না। এপর স্বামীর সঙ্গে বধূ চলে আসতো স্বামীর বাড়িতে। শ^শুর-শাশুড়ি, ননদের সঙ্গে একই সংসারে সে ঘর করত। অসতী বধূর কথাও উল্লেখ আছে কুক্কুরিপাদের ২ সংখ্যক পদে+ ‘ছিবসহি বহড়ী কাউহি ডর ভাই। রাতি ভইলে কামরু ছাই ॥’ অর্থাৎ রাতে বধূ ঘরে ভয়ে ভীতা, রাতে সে কামরূপে যায়। এমন অসতী বধূকে কড়া শাসনে রাখার জন্য কড়া শাশুড়ির উল্লেখ আছে। মেয়েরা খোঁপা বাঁধত। নূপুর  (নেউর), মুক্তহার (মতিহার), কর্ণদুল (কানেরু) ইত্যাদি অলংকার ব্যবহার করত। শবরীপাদের ২৮ সংখ্যক পদে দেখা যায়, আধুনিককালের উপজাতিদের মতো প্রাচীনকালের অনেক বাঙালি নারীরা ময়ূরপুচ্ছ পরিধান করত। চর্যাপদ থেকে যতদূর জানা যায়, তাতে মনে হয় তখনকার বাঙালিদের প্রধান খাদ্য ছিল ভাত, মাছ এবং মাংস। তারমধ্যে হরিণের মাংসই ছিল প্রধান। অনেক চর্যাপদে গাভী-বলদের কথাও উল্লেখ আছে। গাভী দোহনের কথা আছে ঢেন্ডনপাদের ৩৬ সংখ্যক পদে। দুধ থেকে মাখন তোলার উল্লেখ আছে কাহ্নপাদের ৪২ সংখ্যক পদে। তাতে মনে হয় দুধ এবং মাখনও তারা খেত। মদ তাদের অত্যন্ত প্রিয় পানীয় ছিল। মদ্যপানের জন্য তারা শুড়িখানাতেও যেত। বিরুবাপাদের ৩ সংখ্যক পদে আছেÑ ‘এক সে শুন্ডিনি দুই ঘরে সান্ধই। চী অন বাকলও বনুনী বান্ধই ॥ সহজে থির থির করি বারুনী সান্ধ। জে আজরামের ছোই ছোই কান্ধ ॥ দশমি দুঅরেত চিহ্ন দেখিআ। আইল গরদেক আপনে বাই আ ॥ চউশঠী ঘড়িএ দেউ পসারা। পইবেন গরাহক নাহি নিসারা ॥ এক ঘড় লী সরুআ নালে। ভনন্তি, বিরুআ থির করি চালে ॥’ অর্থাৎ এক শুড়িনী দুই ঘরে প্রবেশ করে। চিকন থাকলে বারনী  (মদ) বাধে। সহজে স্থির করে বারনী চোলাই কর, যাতে তুমি অজয়-অমর এবং দৃঢ় হতে পার। দশম দুয়ারে চিহ্ন দেখে গ্রাহক নিজেই চলে এলো। চৌষট্টি ঘোড়ার পসরা (মদের) দেওয়া হল। গ্রাক ঢুকলো, তার আর নিষ্ক্রমণ নেই। একটি ছোট ঘড়া, সরু নল। বিরুবা বলছে, স্থিরভাবে চাল দাও। চর্যাপদে বিভিন্ন গৃহজীবীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে শিকারি মাঝি, নর্তকী, গায়ক, বেদে, কাপালিক, পসারি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ভুসুকুপাদের ৬ এবং ২৩ সংখ্যক হরিণ শিকারের উল্লেখ আছে। সাধারণত ডোম্বীরাই নৃত্য-গীতে বিশেষ পারদর্শী ছিল। তাদের এ পারদর্শিতার কথা ভুসুকুপাদের ১০ সংখ্যক পদেÑ ‘একসো পদমা ছৌষট্টি পাখড়ী। তা চড়ি নাচই ভোয়ী বাইড়ি।’ অর্থাৎ অর্থাৎ এক পদ্ম। তাতে চৌষট্টি পাপড়ি। তাতে চড়ে ভোয়া বেচারি নাচে। নাচ-গানের সঙ্গে অনেক বাদ্যযন্ত্রও বাজানে হতো। এগুলোর মধ্যে একতারা, বীণা, বাঁশী, ঘণ্টা, মাদল, গোপীযন্ত্র ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অনেকে তুলাধুনার কাজ করত। জাতিভেদ প্রথা তখনও ছিল। সমাজে ডোয়ারীই ছিল সর্বনিম্ন জাতের। কিন্তু তারাই ছিল সর্বগুণে গুণান্বিত। নাচ-গান ছাড়াও তারা তাঁত বুনত, চাঙারি তৈরি করে বিক্রি করত এবং নৌকা চালাত। নিম্নশ্রেণিভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও এসব গুণের জন্য তারা উচ্চশ্রেণির কাপালিক ব্রাহ্মণদেরও কাম্য ছিল। কাহ্নপাদের ১০ সংখ্যক পদে আছেÑ ‘নগর বাহিরিরে ডোম্বী তোহেরি কুড়িআ। ছোই ছোই জাহসো বামহন নাড়িআ ॥ আলো ডোম্বী তো এ সম করিব মো সাঙ্গে। নিঘিন কাহ্ন কাপালি, জোই লাঙ্গে ॥’ অর্থাৎ নগরের বাহিরে ডোম্বী তোমার কুঁড়েঘর। তুমি নেড়া ব্রাহ্মণকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাও। ওগো ডোম্বী, আমি তোমাকে সঙ্গী করব। আমি নিঘৃণ, উলংগ লাগী কাহ্ন কাপালিক। এই ডোম্বীরা নিচুজাতের হওয়াতে এ ঘরের মধ্যে বসবাস করার অধিকার তাদের ছিল না। তাই তারা নগরের বাইরে যেয়ে কুঁড়েঘরে বাস করত। উপরোক্ত চর্যাপদটি এ তথ্য আমরা জানতে পারি। সমাজে চন্ডাল নামে আর একটি নিচু সম্প্রদায় ছিল। অপরদিকে সবরি নামে একটি উচ্চসম্প্রদায় বর্তমান পর্বতের ওপর মহাসুখে বসবাস করত। শবরপাদের ২৮ সংখ্যক পদে আমরা দেখিÑ ‘উষ্ণ উষ্ণ পাবত তহি বসই সবরি বালী। মোরঙ্গী পীচ্ছ পরিবহান সবরী গীবত গুঞ্জরী  মালী ॥ উমত সবরো পাগল সবরো মা কর গুলি গুহারী। তোহারী নিঅ ঘরিনী নামে সহজ সুন্দরী ॥ নানা তরুবর শৌললরে গঅনত লাগেলী ডালী। এ কেলী সবরী এ বনহিগুই কর্ণ কুন্তল বজ্রধারী ॥ তিআ ধাড খাঁট পড়িলা সবরো মহাকুহে সেজি ছাইলি। সবরো ভুজঙ্গ নইরা মনি দারী পেখরতি পোহাইনি ॥ হিঅ তাঁবোলা মহাকুহে কাপুর খাই। মুন নৈরামনি কণ্ঠে লইআ মহাকুহে রাত পোহাই ॥’ অর্থাৎ উঁচা উঁচা পর্বত, সেখানে সবরী বালিকা বাস করে। সে ময়ূরপুচ্ছ পনিধান করে। সবরীর গলায় গুঞ্জরীমালা। উন্নত সবর, পাগল সর্বর, গোলমাল করো না। তোমার নিজ গৃহিণী সহজ সুন্দরী। নানা তরু মুকুলিত হল। আকাশে লাগল ভালো। কণ্ঠ কুন্তল বজ্রধারী সবরী একা এই বনেবিহার করে। তিন ধাতুর খাটপালংক হল। সবর মহাসুখে শয্যা বিছাল। সবর ভুজঙ্গ নৈরামনি রমন প্রেমে রাত কেটে গেল। হৃদয় তাম্বলে মহাসুখে কর্পূর খায় এবং শূন্য নৈরামনিকে কণ্ঠে নিয়ে মহাসুখে রাত্রিযাপন করে। বলাবাহুল্য, জীবনযাত্রার এ চিত্রের সঙ্গে বর্তমান সমাজচিত্রের অনেকখানি মিল রয়েছে। বর্তমানকালের মতো তখনও ব্রাহ্মণরা পূজাঅর্চনার কাজে রত থাকত। তারা বেদ পাঠও ও হেসে প্রদান করত। কাপালিকেরা গলায় হাড়ের মালা, কানে কুন্তল এবং পায়ে মল পরিধান করে গায়ে ছাই মেখে উলংগ অবস্থায় থাকত। কাহ্নপাদের ৪০ সংখ্যক এবং ভুসুকুপাদের ২১ সংখ্যক পদ থেকে আমার জানতে পারি যে, প্রাচীন বাঙালি সমাজেও গুরু-শিষ্য প্রথা প্রচলিত ছিল। তৎকালীন সমাজে শবদাহের উল্লেখ আছে শবরপাদের ৫০ সংখ্যক পদে। চিত্তবিনোদনের জন্যনয়বল বা দাবা খেলার প্রচলন ছিল। কাহ্নপাদের ১২ সংখ্যক পদে এ খেলার বিবরণ নিম্নরূপÑ ‘করুণা পীঢ়িহি খেলছ নঅবল। সদুগুরু বোহে জিতেল ভববল।। ফটিউ দুআ আদেসিরে ঠাকুর। উআরি উএসে কাহ্ন নিঅড় জিনউর ॥ গহিলে তেলিআ বড়িআ মরাড়িউ। গঅবরে তোলিআ পাঞ্চজনা খেলিউ ॥ অবস করিআ ভববল জিত্তা ॥ ভনই কাহ্ন আমহে তলি দাহ দেহুঁ চৌষটঠী কোঠা গুণিয়া   লেহু’

আত্মহত্যার আগে এবং পরের রূপালী মুহূর্ত

আত্মহত্যার আগে এবং পরের রূপালী মুহূর্ত

(পূর্ব প্রকাশের পর) ওর জীবনের শুরুটা ছিল বেশ বর্ণময়-এই মীনা কুমারী তাতে এসে সব ভন্ডুল করে দিল। ওর খপ্পর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে ছাড়তে হলো দেশ আর তাতেই ঘটলো ছন্দ পতন। সব কিছুই হয়ে গেল ওলট পালট। এই সুন্দর প্রানবন্ত পৃথিবীতে শুধু তারই ঠাঁই হলো না। নাভির থেকে একটা দীর্ঘশ^াস উঠে তা মাঝ পথে আটকে গেল। বিয়ার পানের পর সিগ্রেট বড়ই আরাম দায়ক। সিগ্রেট ধরালো-কিন্তু সেই সাধটা পেলনা। এসট্রেতে সিগ্রেটটা গুঁজে দিয়ে ও ভাবলো আরে মর্টিনই তো কেনা হয়নি। ও মর্টিন কেন কিনছে-দোকানীর যেন এ রকম কোন সন্দেহ না হয় এ রকম বোকা সোকা একজন দোকানী পেয়ে গেল। হাতে না নিয়ে মর্টিন টা পিঠের দিকে গেঞ্জির ভাজে রেখে দিল। হোটেলে ফিরে এসে আফতাব ভাবে সুইসাইডাল নোটটা লিখতে শুরু করবে কিনা! ভাবে নোটের কথা তো হবে খবুই সংক্ষিপ্ত। ঘটনাটা ঘটাবে ও মাঝ রাত্তিরের পর। এরমধ্যে হোটেলের হাউজ কিপিং-এর লোক যদি এসে পড়ে..মর্টিন আর নোট যদি দেখে ফেলে তহ’লে তো কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে। আত্নহত্যার বিষয়টি ধরা পড়ে গেলে সেটা হবে পরিবারের জন্যে খুবই লজ্জাজনক। বিছানায় শুয়ে শুয়ে এসব ভাবতে ভাবতে আফতাব ঘুমিয়ে যায়। ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখতে পায় ন’টা বেজে গেছে। জানালা দিয়ে দেখতে পায় নগরী আলোতে ভাসছে। অনেক দালান কোঠা। ধীরে ধীরে নগরী আধুনিক হয়ে ওঠেছে। একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে ভাবে এটা এখন তিলোত্তমা নগরী হলেও এখানে এখন আর তার হৃদয় বাঁধা থ্কবে না। হঠাৎ আফতাবের মনে হয়, সে কেন কাল রাতে এই আত্নহননের সিদ্ধান্ত নিল। ওর হৃদয়ে যেন একটু আলো জ¦লে ওঠে। বিষয়টি ও ছাড়া তো আর কেউ জানেনা। আবার কি চেষ্টা করে দেখতে পারেনা-ও কি তার ভাগ্য ফেরাতে পারে কিনা! শুরুতে কি কষ্টের জীবন ছিল ওর-সেই কষ্টটা যখন জয় করতে পেরেছিল-এখন কেন ওর মনোবল ভেঙ্গে গেল! তাছাড়া ওর বর্তমান স্ত্রী ওকে মনপ্রান দিয়ে ভালবাসে-ওর একার আয়ে সংসার চলছে না-তারপরেও বেচারী আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ও চলে গেলে সে খুব কষ্ট পাবে। এই শোক কাটিয়ে ওঠা তার পক্ষে কি সম্ভব হবে? হয়তো নয়। আমেরিকা থেকে ঢাকায় নেমেই এক বন্ধুর বাড়িতে এক পার্টি হচ্ছিল-সেখানেই আলাপ হয় ওর বর্তমান স্ত্রী অনামিকার সঙ্গে। ভাললাগা ভালবাসা তারপরে গিয়ে গড়ায় পরিণয়ে। অনামিকা ওকে সাহস জুগিয়েছে,প্রেরণা জুগিয়েছে তার বুকটা এভাবে ভেঙ্গে দেয়ার কি অধিকার আছে তার! সে তার সিদ্ধন্তে অটল থাকতে পারছেনা। একটু একটু করে সংশয় দেখা দিচ্ছে। গৌতম বুদ্ধু বলেছেন, আত্নহত্যা মহা পাপ। আফতাব আপন মনেই হেসে ওঠে। সে এখন পাপপূণ্যের অনেক উর্দ্ধে। সে একজন পুরুষ মানুষ-সে বরং এখন সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলেই বরং কাপুরুষ হয়ে যাবে। গুণী লোকেরা অবশ্য বলে, আত্নহত্যা কাপুরুষিত কাজ। আফতাবের মাথায় ব্যথাটা আবার চারা দিয়ে ওঠতে শুরু করেছে। সে আবার বারে গিয়ে বসে। বিয়ারটা পান করার পর একটু ধাতস্থ হলো। নিজের মনেই হিন্দী সিনেমার সংলাপ আওড়ায়-সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছি তখন চলেই যাব। কেউ আমাকে আটকিয়ে রাখতে পারবেনা। এলিভেটরে ওঠার আগ মুহূর্তে একটা নারী কন্ঠ শুনতে পেল। ওর নাম ধরে ডাকছে। ও ভয় পেয়ে পা চালায়-কেউ নিশ্চয়ই চিনে ফেলেছে। এই শালার টক শোতে গিয়েই সব ঝামেলা হয়েছে। এখন শান্তিমতো মরতেও পারবোনা। মহিলাটা এসে ওর সামনে দাঁড়ায়। এক ঝটকায় চিনতে পারে-নীলুফার জাহান। নীলুফার অবাক হয়ে বলে, আমি কিন্তু আপনাকে সেই দুপুরে দেখেই চিনতে পেরেছি। বিকেলে দেখলাম বেরিয়ে গেলেন। আমি তো লবিতেই আছি আপনার গতি বিধি লক্ষ্য করছি। আপনি বেশ ক’বার আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। আপনাকে একবার লন্ডনে আসতেও বলেছিলাম। পরে দেশে এসে শুনলাম,আপনি আমেরিকায় চলে গিয়েছেন। নীলুফারের কথা শুনতে আফতাবের ভাল লাগছেনা। মাতালের ভান করে আফতাব বলে, খুব ভাল লাগলো, আপনার সঙ্গে দেখা হলো। নীলুফার অবাক হয়। বলে, একজন সাইক্রিয়াটিস্ট হিসেবে আমার বেশ নাম ডাক হয়েছে। আপনি আমার পুরণো বন্ধু-আপনার সঙ্গে এসব নিয়ে শেয়ার করবো না? কি বলেন, আপনি ছিলেন একজন প্রমিজিং ইয়ং জার্নালিস্ট অথচ আপনাকে এখন কেউ চেনেনা। আমি তো এখানে ফিরে এসেছি তা বছর দুয়েক হলো-আপনাকে দেখার আমার খুব ইচ্ছে,কি করছেন,কেমন আছেন বা আপনার কোন সাহায্যে আমি আসতে পারি কিনা-এসব আমার মনে আছে। কিন্তু কোথায় পাবো-আপনাকে? আই এ্যাম সিঙ্গল-স্টিল ইজ লাভ উইথ ইউ..আফতাব ভেতরে ভেতরে ভাঙতে শুরু করলেও পরিস্থিতি সামলাতে চেষ্টা করে। বলে, দেখুন, আমি একটা কাজে ভীষণ ব্যস্ত..আপনি তো ঢাকায়ই আছেন। নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে। নীলুফার কৌতুহলী ভঙ্গিতে বলে, কি কাজে ব্যস্ত আছেন আপনি-না তুমি করেই বলছি। আমরা তো পরস্পরকে তুমি বলেই সম্বোধন করতাম। আফতাব কিছুটা অসহিষ্ণু কন্ঠে বলে, বিষয়টা আমার ব্যক্তিগত। আর তাছাড়া আপনার আর কোন কিছুই আমার মনের ভেতর নেই। আর আমি সিঙ্গলও নই। আমার স্ত্রী আছে। তাকে ছেড়ে তো আপনার গলায় ঝুলে পড়তে পারিনা। আফতাবের ইঙ্গিতটা খুবই কদর্য। তারপরেও নীলুফার রাগেনা বলে, তুমি রুমে যাচ্ছো? আমিও যাবো। আফতাব এবারে রেগে যায়। বলে, আপনি কিন্তু সত্যিই মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। নীলুফার নিস্পৃহ কন্ঠে বলে, একটুও না। আমি মানুষের মনের কারবারী। ইউর বিহেভিয়ার ইজ নট নরমাল। আমি রিসিপশনে খবর নিয়েছি। তুমি সেখানে বলেছো তুমি এসেছো ইভেন্ট কভার করতে-কিন্তু ওখানে তোমাকে দেখা যায়নি। নীলুফার আফতাবের হাত ধরে। বলে, তুমি কি ডিনার করেছো? আফতাব বলে, আমার ক্ষিধে নেই। নীলুফার অবাক হয়। কেন ক্ষিধে থাকবেনা কেন? নীলুফার আফতাবের হাত ধরে টানতে টানতে লবির এক কোণে গিয়ে বসে। সাপ যেমন মানুষের দু’পা পেচিয়ে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। নীলুফারও তেমনি আফতাবকে পেচিয়ে ধরেছে। ছাড়ছেনা। আফতাব শেষ চেষ্টা করে বলে, আপনিই তো অর্গানাইজার-আমাকে নিয়ে পড়েছেন কেন? আপনার তো ওখানেই থাকা উচিত। ওখানের চেয়ে এখন তোমাকেই আমার সময় দেয়াটা বেশী জরুরী। আফতাব অবাক হয়। বলে, এসব আপনি কি বলছেন? আমাকে কেন আপনি সময় দেবেন? কেন? নীলুফার অবাক বলে, তোমাকে কেন সময় দেব বা দেওয়াটা কেন আমার জন্যে জরুরী তা তুমি নিজেকেই জিগ্যেস করনা কেন! আফতাব বিরক্ত হয়। বলে, আপনার কথা কিন্তু আমি বুঝতে পারছিনা। এবারে নীলুফার সরাসরি আফতাবের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, হোটেলে তুমি কি করতে এসেছো? আস্ক ইউর সেলফ। ইউ আর লাকি-ইউর ওয়াইফ অলসো লাকি তুমি উপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে তোমাকে ধরে ফেলেছি। আফতাব নিজে কে আর সামলাতে পারেনা। ওর গা গুলিয়ে আসছে। নাড়ি ভুড়ি ছিড়ে কি যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে। আফতাব ঘাড়টা এলিয়ে দেয়। নীলুফার সিকুরিটির লোকজনের সাহায্যে আফতাবকে তার রুমে নিয়ে যায়। রুমে বসিয়ে আফতাবকে একটা ট্যাবলেট খাইয়ে দেয়। আফতাব ঘুমিয়ে যায়। মর্টিনের কৌটাটা নীলুফার সিকিউরিটির লোকদের দিয়ে দেয়। নীলুফার সিকিউরিটির লোকদের সাবধান করে দিয়ে বলে,বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে তাদের জন্যে ভাল হবেনা। তারা বলে, ঘটনাটা ঘটলে তো নিশ্চয়ই তাদের হোটেলের সুনাম ক্ষুন্ন হতো। যদিও তারা এর সাথে কোন ভাবেই জড়িত নয়। পরের দিন সকালে আফতাবের স্ত্রীকেও নীলুফার ডেকে নিয়ে আসে হোটেলে। বলে, আমরা ডেঞ্জারাস টাইমটা ওভার কাম করেছি। ও এখন ইচ্ছে করলেও ওটা করতে পারবেনা। ইট’স ব্লকড। আর আমি তো আছিই। নীলুফার আফতাবের স্ত্রীকে বলে,  বেশীরভাগ মানুষই মানবেতর জীবন যাপন করেও বেঁচে থাকার আকাংখা জাগিয়ে রাখে আবার কিছু লোক সামাণ্যতেই ভেঙ্গে পড়ে। এবং বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। মানুষ যখন একা হয়ে যায়,তখন তার মাথায় আত্নহত্যার ভ ূত চেপে বসে। আফতাবের স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে নীলুফার বলে,  তোমার অবশ্য এসব বোঝা ও জানার কথা নয়। যা হোক ওকে এখন থেকে চোখে চোখে রাখবে। প্রেরণা জোগাবে। মেয়েরা অবশ্য এ কাজটি ভাল জানে। গুড লাক ফর ইউ। এনি ওয়ে হি ইজ নট লিভিং আস। বলে আফতাবের বউয়ের কাঁধে চাপড় মারে। এবং আফতাব যদি সত্যি সত্যি ঘটনা-টা ঘটাতো তাহ’লে মিডিয়া বিশেষ কওে ইরেকট্রনিক মিডিয়া যেভাবে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো তার থেকে রক্ষা নীলুফার জাহান ওকে যেভাবে রক্ষা করলো সেই কৃতজ্ঞতায় নীলুফাকে সে জড়িয়ে ধরে ঢুকরে কেঁদে ওঠে। নীলুফার ওকে কাঁদতে দেয়। কিছু বলেনা। (শেষ)

অকালপ্রয়াত এক লেখক

অকালপ্রয়াত এক লেখক

তারেক মাহমুদ (১৯৭১-২০২৪) বিশ শতকের নব্বইয়ের দশকে আবির্ভূত হয়েছিলেন কবি হিসেবে। ছোট গল্প ও আলোচনাধর্মী কিছু গদ্যও লিখেছেন। ‘পথিক’ নামে একটি সাহিত্যপত্রের সম্পাদক ছিলেন। উপরন্তু ‘ছায়ালোক’ নামে তার একটি প্রকাশনীও ছিল। আমার প্রথম গল্পের বই ‘দূরবীনের ভিতর দিয়ে’-এর প্রকাশক ছিলেন তারেক। এই কবি ও গদ্যকারের ছ’সাতটি কবিতার বই বেরিয়েছিল। আমার সংগ্রহে আছে দুটি- ১. সুবর্ণার চোখ ২. পেরিয়ে যাচ্ছি সকল দরজা। এই বই দুটোর ভিত্তিতেই তার কবিতার গুণাগুণ বিচার করতে বসেছি আজ। তার আগে কয়েকটা কথা বলে নিতে চাই। ১৯৯৪-৯৫ সাল থেকে তারেক মাহমুদকে চিনতাম। ওই সময় আমাদের একটা নিয়মিত আড্ডা ছিল শাহবাগস্থ পিজি হাসপাতালের আমতলায় ও সংলগ্ন পাকা চত্বরে। আমার প্রজন্মের কবিদের মধ্যে রিফাত চৌধুরী, অমিতাভ পাল, জুয়েল মাজহার, রেজাউদ্দীন স্টালিন, মিজান রহমানসহ অনেকেই আসতেন। আসতেন কবি মাহবুব কবির, আশিক আকবর, গল্পকার ইচক দুয়েন্দে প্রমুখ। এখানেই পরিচয় হয় তারেক মাহমুদের সঙ্গে। তারেক তখন পাবনার অধ্যায় শেষ করে ঢাকায় নবাগত। দু’ তিন বছরের ভেতর তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ঢাকা শহরের ৫-৬টি জায়গায় থেকেছেন। দুটি জায়গায় আমি গিয়েছিলাম, রাতে আশ্রয় নেয়ার জন্য। তার মধ্যে একটা ঘরের কথা মনে পড়ে। গ্রিন রোড সংলগ্ন কোনো এক মহল্লার একটা ছোট্ট রুমে উনি কিছুদিন ছিলেন। রুমটা এতই ছোট যে, কোনোমতে একটা সিঙ্গল চৌকি বসানো গেছে। ঘরে হাঁটার জায়গা একদমই নেই। জানালাও নেই। সেই রাতে আমার মুখের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে তারেক স্মিত হেসে বলেছিলেন, “কবরের মতো না?” আর আমি ভেবেছি, কতটা আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে থাকলে মানুষ এমন একটা ঘর ভাড়া নিতে পারে। বিশুদ্ধ গদ্যে কবিতা লিখতেন তারেক। সেই গদ্য কখনো কখনো এতটাই গল্পঘেঁষা (তিনি গল্পও লিখতেন, সেজন্যই কি?) যে পাঠকের মনে হতে পারে, এ আবার কেমন কবিতা! কিন্তু সেটাই ছিল তার লেখার ধরন। অনেক বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কবিতায়, গ্রেট ব্রিটেনসহ ইউরোপের বহু দেশের কবিতায়, এমনকি আফ্রিকার আধুনিক কবিতায় গদ্যের ব্যাপক প্রয়োগ ঘটছে। ওইসব কবিতার অনেকগুলোতেই গল্পের মেজাজও দেখা যাচ্ছে। এই তথ্য জানা থাকলে তারেক মাহমুদের কবিতায় গদ্যের সংক্রামকে অস্বাভাবিক মনে হবে না। যাহোক, আমি এবার তার কবিতায় প্রবেশ করব। দেখা যাক তিনি সেখানে কী বলছেন, কীভাবে বলছেন। ‘সুবর্ণার চোখ’ কাব্যে ‘কাউকেই মিস করতে চাই না শিরোনামে একটি কবিতা আছে যার প্রথম অংশ এমন- ‘ঘরের জানালাগুলো খুলে দাও- মশারা আসুক/মশাদের সাথে অতিথি হয়ে কিছু বাতাসও আসুক/মশার ভয়ে কেন জানালা বন্ধ করে বাতাসকে রুদ্ধ করো?” এবার রচনাটির শেষ পাঁচ পঙক্তি পড়ুন- ‘ব্যাঙ এবং প্রাপকেও নিমন্ত্রণ জানাতে পারো/আরো যদি পারো/একপাল ধেড়ে ইঁদুরকে খবর দাও/আর কে কে বাদ পড়লো তালিকা করো/আমার জন্মদিনে কাউকেই মিস করতে চাই না।” বলবার এই ভঙি পাঠককে মজা দেয়। কিন্তু আনন্দপ্রদতাই এর শেষ কথা নয়। ব্যক্তিমনের বিশেষ মুহূর্তের আবেগ বিশিষ্টভঙ্গিতে ধরা পড়েছে এখানে। কবি হৃদয়ের ঔদার্য এই কবিতার থিম। এর সারল্যচিহ্নিত প্রকাশভঙ্গিটি মনে দাগ কাটে। “এইসব ভালো লাগে না- বুঝলে-একদম”...এমন আলাপচারিতার স্টাইলে শুরু হয়েছে ‘ব্লেড শেভ এবং চুম্বন বিষয়ক জটিলতা’ কবিতাটি। কবিতার মাঝখানে লেখক বলছেন, “ধারালো অস্ত্রের ছোবলে অপ্রস্তুত প্রতিদিন/প্রতিরাতে মসৃণতা দান করতে করতে/আমার ত্বক ক্রমশ হয়ে উঠছে কঠোরতর/একদিন তা হয়তো ইস্পাত কঠিন হয়ে যাবে/ততদিনে তোমার ওষ্ঠদ্বয় হয়ে যাবে মরা গাঙ।” পাঠক, এই স্তবকের ‘অপ্রস্তুত প্রতিদিন’ শব্দবন্ধটি লক্ষ্য করুন। এর ভেতর দিয়ে প্রাত্যহিক জীবনের বিরক্তি ও বিষাদ বাণীরূপ পেয়েছে। এবং ‘ততদিনে’ শব্দটি প্রতীক্ষারত প্রিয়তমার ইঙ্গিতবহ। রুটিনক্লান্ত নগরজীবনের নির্বেদী প্রাত্যহিকতা রোমান্টিক কবিমনে কেমন প্রভাব ফেলতে পারে তার একটা চিত্র উপহার দিয়েছে এই কবিতা। লেখাটি শেষ হয়েছে এভাবে- “তোমার ওষ্ঠদ্বয় আমাকে মুক্তি দেবে একদিন/আমিও রেহাই পাবো/ব্লেড আর শেভ-এর যন্ত্রণা থেকে।” শ্লেষকে উপজীব্য করে তারেক মাহমুদ একাধিক সফল কবিতা লিখতে পেরেছিলেন। সে রকম একটি কবিতা হচ্ছে পুষ্টিহীনতা অর্থাৎ রোগা হওয়া অর্থাৎ স্লিম হওয়া অর্থাৎ আধুনিক জীবন। দেখুন, শরীরের পুষ্টিহীনতাকে লেখক বিদ্রƒপের শরে বিদ্ধ করেছেন কীভাবে-“পুষ্টিহীন জীবনের অর্থ রোগা হওয়া/আর রোগা হওয়ার অর্থ স্লিম হওয়া/আর স্লিম মানে আধুনিক জীবন!” তারেকের কবিতার একটি প্রধান সুর রোমান্টিক অনুভব ও আকুতি। প্রেম-ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে তিনি অনেক ক্ষেত্রেই উচ্ছ্বাস সামলাতে পারেননি, হয়ে উঠেছেন অতিভাষী কিন্তু ‘রিমা বরাবর’ তার অল্প কিছু কবিতার মধ্যে অন্যতম যেখানে আবেগ যথেষ্ট সংহত এবং উচ্চারণ আবেশযুক্ত ও ইঙ্গিতময়- “সমুদ্রের ঢেউ/প্রজাপতির উড়ে যাওয়া/বিকেলের ম্লান আলোয় হঠাৎ থমকে দাঁড়ানো/একটি গোলাপের শব্দে তার কণ্ঠ শুনেছি।” আমি আরও খুশি হতাম যদি ‘গোলাপের’ পরে ‘শব্দে’ ব্যবহার না করে তিনি ‘ঠোঁটে’ লিখতেন। তার অনেক লেখা গন্তব্যহীনতার দোষে দুষ্ট। বেশ কিছু পঙক্তি ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি করে- “সেই দূর্বা ঘাসের বয়স তখন/একটুখানি ছোঁয়াতেই নুয়ে পড়ি/দাগ দিয়ে যায়/সেই দাগ কোলের মধ্যে নিয়ে বসে থাকি/বিড়াল ছানার মতো।” (জয়াকে মনে পড়ছে)। ‘পেরিয়ে যাচ্ছি সকল দরজা’র অধিকাংশ কবিতা আগের মতোই আবেগী উৎসারণের দৃষ্টান্ত। ফলে সেগুলো যোগাযোগসক্ষম- “আমার কাঁধে প্রিয়তমার কফিন/কফিনে সাদা কাফনে শুয়ে আছে আমার রঙিন ভালোবাসা।? তারেকের কবিতায় ভালোবাসা-মিলন-বিচ্ছেদ-এর অভিব্যক্ত স্বচ্ছ, অকপট ও প্রায়শই সরাসরি। ক্ষেত্র বিশেষে প্রতীক বা ইঙ্গিতের প্রয়োগ যথাযথ। সব মিলিয়ে চিন্তা করলে তারেক মাহমুদকে প্রেমের কবি আখ্যা দেয়া যায়। শব্দ প্রয়োগের বেলায়, কবিতাকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে এবং আরও কিছু বিষয়ে তার অনেক ত্রুটি আছে। আবার এও ঠিক যে, তারেকের কবি কল্পনা ভাবনায় ভিন্নতাও আছে। এই লেখক অনুভব করেছেন, “নতুন ধারণার রঙ অন্যরকম।” অন্য এক কবিতায় তিনি বলেছেন “মেয়েটি কাঁদছে/পার্কটিকে তাই ব্যর্থ মনে হচ্ছে,” কেননা তার মতে “পার্কে তো কেউ কাঁদে না।” সহজবোধ্য ভাষা ও সাবলীল প্রকাশভঙ্গি তারেক মাহমুদের কবিতার ইতিবাচক দিক। তাছাড়া কবিতায় প্রযুক্ত গদ্যে গল্পের ভঙি প্রয়োগ করেও ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করা সম্ভব। তা তিনি ‘গফুর স্যার’ শিরোনামের কবিতাটির মাধ্যমে দেখিয়েছেন। কখনো কখনো দার্শনিকসুলভ ভাবনা ও জিজ্ঞাসা এসেছে তার কাব্যে, শিল্পের সুষমা সঙ্গে নিয়েই- “মানুষ কি সংগঠিত নাকি একা/তুমুল বৃষ্টি ঝরছে- বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে গাঙের পানিতে/পানি আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে-/আঘাতপ্রাপ্ত পানি থেকে সৃষ্টি হচ্ছে শব্দ/এই শব্দ কিসের প্রতীক/শুদ্ধতার, ঘুমানোর নাকি জেগে উঠবার?” অনেক বছর আগে, কোন কবিতায় মনে নেই, তারেক লিখেছিলেন ‘পাহাড়গুলো পৃথিবীর পেপারওয়েট”। পড়ে চমৎকৃত হয়েছিলাম। এমন যার পরিকল্পনা আর এত স্বচ্ছ যার কাব্যভাষা তার তো বহুদূর এগোনোর কথা ছিল। তা হয়নি, কেননা যথেষ্ট সময় তিনি ব্যয় করতে পারেননি কবিতার পেছনে। জীবনের একটা পর্বে, শেষের দিকে, তিনি টেলিভিশন নাটকের সঙ্গে যুক্ত হন। সহজাত অভিনয় প্রতিভা ছিল তার। বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয়ও করেন। ‘চটপটি’ নামে একটি ছবি তৈরি করছেন, পয়সার অভাবে কাজটা শেষ করে উঠতে পারছেন না; এরকম শুনতাম লোকমুখে। শেষের কয়েক বছরে তারেকের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। ওই সময় তিনি আড্ডা দিতেন শিল্পকলা একাডেমিতে। কবি, অভিনেতা, নাকি নির্মাতা- কোন পরিচয়ে নিজেকে তুলে ধরতে চাইছেন তারেক? এ প্রশ্ন মাথায় এসেছিল। উত্তর পাইনি। সব জিজ্ঞাসা ও জটিলতার ঊর্ধ্বে চলে  গেছেন তিনি।

আমার এ ঘর বহু যতন করে...

আমার এ ঘর বহু যতন করে...

ড্রইংরুম : ড্রইংরুমে রাখতে পারেন বাঁশ বা বেতের তৈরি সোফা, বুকশেলফ। মেঝেতে রাখতে পারেন শতরঞ্জি। দেওয়ালে কাঁথার ফোঁড়ের ওয়ালম্যাট, হাতে আঁকা গ্রাম-বাংলার দৃশ্যও থাকতে পারে। ছোট ঘরের ড্রইংরুম : অনেক সময় ছোট বাসা হলে সোফা ও অন্যান্য আসবাব দিয়ে সাজানো কঠিন হয়ে পড়ে। অথবা যাদের নতুন সংসার, এখনই আসবাব কিনতে চাইছেন না- তারা ঘরের একটা কোনে দুই সিটের একটা সোফা অথবা অথবা দুটো চেয়ার দিয়ে সাজিয়ে নিতে পারেন। সামনে ছোট একটি টেবিলে ইনডোর প্ল্যান্ট বা ছোট ছোট শোপিস দেওয়া যেতে পারে। সিঁড়ির খোলা জায়গা : গৃহে প্রবেশ পথটিতে কিছু গাছ ও শোপিস দিয়ে সাজিয়ে রাখুন। দেখেই মন জুড়িয়ে যাবে। সিঁড়ির নিচে শুধু নিজেদের ব্যবহারের জায়গা থাকলে সেখানে দেওয়ালে প্রকৃতি বা গাছের ছবি এঁকে নিতে পারেন। একপাশে বেতের ফ্রেমে বাঁধানো আয়না অথবা অন্য কোনো পছন্দসই দেশীয় মোটিফের শোপিস রাখতে পারেন। ঘরের ভেতরে ডুপ্লেক্সের সিঁড়ি হলে সেখানে বসার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। গৃহে প্রবেশের খোলা জায়গা : কিছু বাসায় ভেতরে ঢুকেই লনের মতো খোলা একটু জায়গাটা থাকে। ওখানে সাধারণত আমরা জুতার আলমারি রেখে থাকি। আলমারির ওপর বাঁশ-বেতের ফ্রেমে বাঁধাই করা আয়না বসিয়ে দিতে পারেন, পাশে ছোট গাছ রাখতে পারেন। রিক্সা বা দেশীয় নক্সায় আঁকা কোনো শোপিসও রেখে দিতে পারেন। উপরে ঝুলিয়ে দিতে পারেন ল্যাম্পশ্যাড। ফ্যামিলি লিভিং : আজকাল প্রায় এপার্টমেন্টেই ড্রইংরুমের পাশাপাশি সিটিংরুম থাকে, যেখানে আড্ডায় মেতে উঠে সবাই। সিটিংরুমে আলাদা করে আসবাব না দিয়ে ফোম বা শতরঞ্জি বিছিয়ে, তার ওপর কুশন দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে নেয়া যেতে পারে। পাশের দেওয়ালে বিভিন্ন ঝালর, ওয়াল হ্যাঙ্গিং রাখতে পারেন। নানা নকশার টুল দিয়ে তার ওপর শোপিস বা বড় কুশন বসিয়ে দিতে পারেন। বড় পটারি দিয়ে তাতে শুকনো ফুল রেখে দিতে পারেন। সঙ্গে তাজা গাছও রাখতে পারেন। ড্রেসিং টেবিল : ড্রেসিং টেবিলের পাশে বাঁশ বা বেতের তৈরি রেক বা ফুলের টব রেখে তাতে গাছ ও ফুল রাখতে পারেন। পরিবেশটাই বদলে যাবে। তাছাড়া একরাশ সবুজ চোখে ও মনে প্রশান্তি বয়ে আনবে। আয়নার চারপাশে কৃত্রিম লতা গাছও জড়িয়ে দিতে পারেন। শোবার ঘর : বসার ঘর আর খাওয়ার ঘর সাজাতে গিয়ে অনেক সময় শোবার ঘরটি আড়ালেই থেকে যায়। গৃহের সব সাজ যে শুধু মেহমানদের জন্যে, তা কিন্তু নয়। খেয়াল করুন সম্পূর্ণ সাজ কিন্তু আপনি আপনার মনের মতোই করেছেন। তাহলে শোবার ঘরটি কেন বাদ যাবে! সারাদিনের ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখনই বিশ্রামের জন্যে শোবার ঘরে ঢুকবেন, ঘরটি যদি মনের মতো সাজানো থাকে, সঙ্গে সঙ্গে আপনার মনের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে। শুধু বৈশাখ নয়, গতানুগতিক সাজের বাইরে শোবার ঘরটি সাজিয়ে নিতে পারেন বাঙালি ঐতিহ্যে। এমন পাটের তৈরি ঝালর, ওয়ালম্যাট, তালপাতার খোলের তৈরি ওয়াল হ্যাঙ্গিং, কিছু লতা গাছ ইত্যাদি অল্প খরচে ছোট ছোট জিনিস দিয়ে মনের মতো করে সাজিয়ে নিতে পারেন। ঘরের পরিবেশটাই বদলে যাবে। দুই ধরনের পর্দা ব্যবহার করতে পারেন, ভারি আর পাতলা নেট। গরমে ভারি পর্দা টেনে রাখলে বাইরের গরম তাপ কম আসবে। আবার বিকেলে বা কোমল আবহাওয়ায় পাতলা পর্দাটি টেনে রাখলে মৃদু বাতাসে পর্দাটা যখন উড়বে, মনও কেমন দুলে উঠবে। হালকা বাতাসে ঘরের ভেতর শীতল পরিবেশ বিরাজ করবে।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

Bangla New Year has been celebrated with pomp and gaiety since late 1990 in vast areas of Queens and in Times Square, Manhattan since 2022; the day is celebrated with community singing and performances by 100+ groups from India, Bangladesh, and the United States; (Senate Resolution No. 234) রেজুলেশনে অভিবাসী বাঙালিদের নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাসকে তুলে ধরে শেষে বলা হয়েছে...his Legislative Body pause in its deliberations to memorialize Governor Kathy Hochul to proclaim April 14, 2025, as Bangla New Year Day in the State of New York, and to recognize the many contributions of Bangla speaking diasporas in New York;  (Senate Resolution No. J234) অর্থাৎ ‘নিউইয়র্কে বাংলাভাষী প্রবাসীদের অসংখ্য অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তাই এখন এই আইনসভা ১৪ এপ্রিলকে নিউইয়র্ক রাজ্যের জন্য বাংলা নববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করল।’ এভাবেই মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের অনুরোধে সিনেটর লুইস সেপুলভেদার ১৫ জানুয়ারি প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে অঙ্গরাজ্যের আইনসভার অধিবেশনে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দের ২২ জানুয়ারি আইনপ্রণেতারা সর্বসম্মতিক্রমে বাংলা নববর্ষকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই রেজুলেশন বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ‘সংবিধান’। এটি যেমন আনন্দের তেমনি গৌরবের। ১৪৩২ বঙ্গাব্দের আগমনে পুরাতন স্মৃতি মুছে যাক, দূরে চলে যাক ভুলে যাওয়া অনুধ্যান, অশ্রুঝরার দিনও সুদূরে মিলাক। নববর্ষে আমাদের জীবন থেকে বিগত বছরের ব্যর্থতার গ্লানি অপসৃত; পুরাতন বছরের আবর্জনা দূরে, অন্তর্ধানে। পবিত্র রমজান, স্বাধীনতা দিবস ও ঈদের পর দেশ-বিদেশের বাঙালি জীবনে আরও একটি উৎসবের ব্যস্ততায় উদ্ভাসিত। প্রবাস জীবনের সংকট আমাদের পরাস্ত করতে পারেনি কারণ সমস্যার উপত্যকা পেরিয়ে বৈশাখ এসেছে নতুন সাজে। ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ। মার্কিন কবি টি এস এলিয়টের ভাষায় ‘এপ্রিল নিষ্ঠুরতম মাস’, দেখা যাচ্ছে কবির কথাই সত্য। কেবল আবহাওয়াজনিত বাংলাদেশের তাপদাহ নয় বিশ্ব রাজনীতিতে এই এপ্রিলই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তবে খররৌদ্র আর তীব্র ঝড়ের মাস হলেও এই এপ্রিল আমাদেও বৈশাখি/বৈসাবি/বিজু উৎসবের মাস। অভিবাসী জীবনের নানাপ্রান্তের সংগ্রাম নিউইয়র্ক শহরের টাইমস স্কয়ারের বৈশাখি আয়োজনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেও আমরা স্বপ্ন সন্ধানী। প্রতিবছরের মতো অতি সহজ-সরল, প্রশান্ত কিন্তু উদ্দীপনাময় আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে এবারও। এখন আমরা অবিচলিত, আমাদের চিত্ত অবিক্ষিপ্ত এবং আমাদের চেষ্টা অব্যর্থ। হস্তশিল্পের পসরা সাজিয়ে বসেছে আয়োজক কর্মীরা, বৈশাখী মেলায় নাগরদোলা, পুতুলনাচের উৎসবে শিশুদের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। প্রতিবছর যেসব থিম অনুসারে দেশে মঙ্গলশোভা যাত্রা হয় তারই অনুসরণে এবার সাড়ম্বরে হচ্ছে আয়োজন। রমনার বটমূলের প্রত্যুষের ছায়ায় আয়োজিত ছায়ানটের অনুষ্ঠান বারো হাজার মাইল দূরের শহরে অনুপ্রেরণায় সমুজ্জ্বল। এ সময় দেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নতুন বছরকে বরণ করার জন্য তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানও চলছে। ‘পাচন’, ‘হালখাতা’ আর ‘পুণ্যাহে’র মতো নানাবিধ ব্রত ও বিধি পালনের সকল প্রথা এবার ১৪৩২ বঙ্গাব্দেও পালিত হচ্ছে। নববর্ষের সকল আনন্দ, উৎসব ও অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা স্মরণ করেও আমরা আজ বলতে হয়, প্রবাসী বাঙালি আজ নানা সংকটে আক্রান্ত। তাদের কাছে এখন বেঁচে থাকা, ভালো থাকার গৌরব অত্যন্ত বেশি। নিকট আত্মীয় হোক, দূরের বন্ধু হোক, দিনে হোক, দিনের অবসানে হোক, আমরা এখন ভালোভাবে বেঁচে থাকতে  চাই। বাণিজ্যপুঁজি ও শিল্পপুঁজির দাপটে আফ্রিকা আর দক্ষিণ-আমেরিকার প্রত্যন্ত দরিদ্র অঞ্চলেও আধুনিকতার নামে মৃত্তিকাসংলগ্ন সভ্যতার তিরোধান ঘটেছে। বিচিত্র কর্মের পিছনে মানুষের ছুটে চলার বিপরীতে রয়েছে নির্জন প্রকৃতির স্তব্ধতা। তার রূপ অক্লিষ্ট অক্লান্ত, তার সাজগোজ বিস্তীর্ণ নীলাকাশ থেকে অরণ্যের সবুজে প্রসারিত। প্রকৃতি নিজেকে চিরকাল প্রকাশমান রেখেছে, মানুষের মতো ঊর্ধ্বশ্বাস কর্মের বেগে নিজেকে অস্পষ্ট করে তোলেনি। মানুষের কর্মের চতুর্দিকে অবকাশ ও চাঞ্চল্যকে ধ্রুবশান্তির দ্বারা মথিত করে সে চিরনবীনের বার্তাবাহক। এই একুশ শতকেও গ্রামীণ জীবনের প্রাধান্যের মধ্যে প্রবাসী বাঙালি হিসেবে রাতদিনের কর্মযজ্ঞে ইউরোপ-আমেরিকার মতো নববর্ষে ব্যস্ত থাকার কথা নয়। তবু এখনো প্রকৃতির উদার শান্তি, বিশাল স্তব্ধতার মধ্যে আমরা পরিভ্রমণ করতে পছন্দ করি। এজন্যই  বৈশাখের তপ্ত আকাশ, তার শুষ্ক ধূসর প্রান্তরের নীরব মধ্যাহ্ন, নিঃশব্দ রাত্রি অথবা ঝড়ো হাওয়ার আলিঙ্গনের স্মৃতি আমাদের জীবন মুখরিত করে।  দেশে দেশে অন্যায়-অবিচারের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা সাহস নিয়ে বলছি- পুরাতন বর্ষের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা করো পুরাতন সব অপরাধ। আমরা এখন নতুন বছরে বেঁচে থাকার জন্য নতুন সংকল্প অন্তরে লালন করছি। বিস্তীর্ণ এ বিশ্বভূমি, তার তো কোনো সীমা নেই। কত দেশ আছে, কত বৈচিত্র্যময় মানুষের সংস্কৃতি। পরিচিত-অপরিচিত মানুষের সঙ্গে নববর্ষে প্রীতির বন্ধনে আমরা সংযুক্ত হই। ১৪৩১ বঙ্গাব্দের চৈত্রের শেষ দিনটি বিদায় নিয়েছে, এসেছে পহেলা বৈশাখ। এজন্য- ‘উড়ে যাক, দূরে যাক বিবর্ণ বিশীর্ণ জীর্ণ পাতা/বিপুল নিঃশ্বাসে।’ বাংলা নববর্ষের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির সকল কৃতিত্ব অভিবাসী বাঙালিদের। কারণ তাদের বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি প্রেমই বিশ্ব দরবারে অভিষিক্ত করেছে নববর্ষকে। উৎসব উপলক্ষে এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড প্রকাশিত ‘বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ স্মারকগ্রন্থে’র প্রকাশনা বিশ্ববাঙালিকে একটি সুতোয় বেঁধেছে। পরিশ্রমলব্ধ লেখাগুলো সত্যিই প্রশংসনীয়। প্রাণের অফুরন্ত আবেগে নিজস্ব কথনভঙ্গিতে নববর্ষের তাৎপর্যকে তুলে ধরেছেন লেখকরা। ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের আন্তর্জাতিক মহিমা অর্জনে নেপথ্যের কারিগর এবং টাইমস স্কয়ারে বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মূল নেতৃত্বে থাকা এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড-এর সভাপতি বিশ্বজিত সাহার দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে নিবিড় পরিচিতি ও মিথষ্ক্রিয়া সত্যিই প্রশংসনীয়। সাংগঠনিক দক্ষতায় তিনি বাংলা নববর্ষ উদযাপন সফল করার ক্ষেত্রে প্রাবাসী বাঙালিদের আস্থা অর্জন করেছেন। 

কালের আয়নায়

কালের আয়নায়

আবার ফিরে এসেছে বাংলা নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। নানা চড়াই-উৎরাই এর মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি মূল শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার মুহূর্তে জীবনাচরণ, বিশ্বাস, উৎস মুখে বিরাজিত বীক্ষণ থেকে বাঙালিত্ব পুনরুদ্ধারে প্রতিবছর একবার হলেও উপলব্ধির সরোবরে অবগাহিত হয় এ কম কী? আধুনিক প্রযুক্তির উন্নয়ন, জীবনব্যবস্থা ও প্রতিদিন যাপিত দিনে নানা ব্যস্ততার মধ্যে নববর্ষ উদযাপনের কর্মযজ্ঞে শেকড়লগ্ন হওয়ায় টান অনুভব করে বাঙালি প্রতিনিয়ত।  প্রাচীন জনপদ খনন, লেখামালা, শিলালিপির মাধ্যমে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস অল্প কিছু জানা যায়। চতুর্দশ শতকে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ শাহ-ই- বাঙালিয়া বা বাঙালিদের বাদশা বলে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন। সুলতানি আমলে আলাউদ্দীন হোসেন শাহ বেদ, উপনিষদ, রামায়ন, মহাভারত অনুবাদে উদ্যোগী হয়ে উঠেন। ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দী অবধি আরবীয় বণিকগণ বাংলায় আগমন করলে আরবী-বাংলা সংমিশ্রণে সংস্কৃতি পুষ্ট হয়ে ওঠে। ষোড়শ শতকে মুঘল মহামতি আকবর বাংলা দখল করলে বাংলাভাষা, সংস্কৃতি বিকাশে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। জনশ্রুতি আছে আকবর বাংলা সন প্রবর্তন করেন। এ তথ্য সঠিক না হলেও বলা যায় আকবর ইলাহী সন প্রবর্তন করেন। ইলাহী সনের পথ ধরে বাংলা সনের প্রবর্তন হয়। ইংরেজ শাসনামলে রবীন্দ্র পরিবারে শান্তি নিকেতনে বাংলা নববর্ষ আয়োজনের সূত্রপাত ঘটেছিল। মোঘল শাসকেরা ইরানের নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মিলিত হতো। মিনাবাজার আয়োজনে নারীদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয়। মুর্শিদকুলী খান, আলীবর্দী খাঁ, বেড়াভাসান, জমিদারদের পুণ্যাহ ও হালখাতা আয়োজনের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে খাজনা আদায় করা হতো। হিজরি সন গণনা চাঁদের উপর নির্ভরশীল ছিল। সম্রাট আকবরের সময় জ্যোর্তিবিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌরসন এবং হিজরি সনের ভিত্তিতে বাংলা সন’ গণনা শুরু করেন। ১৮৫৪ সালের ১০ মার্চ, মতান্তরে ১১ মার্চ বাংলাসন গণনা শুরু হয় ১৫৫৬ সনের ৫ নভেম্বর । বাংলাসন গণনা কার্যকর শুরু হয় প্রথমে ফসলি সন, বঙ্গাব্দ ও বাংলা নববর্ষ নামে। চৈত্র মাসের শেষ দিনে খাজনা পরিশোধ হতো। ১ বৈশাখ ভূমির মালিকেরা প্রতিবেশীদের মাঝে মিষ্টান্ন বিতরণ করত। ক্রমে বাংলা নববর্ষ উদযাপন সামাজিক উৎসবে পরিণত হয়। হালখাতা আয়োজন উল্লেখযোগ্য। এ সময় নতুন খাতায় হিসাব-নিকাশ লিপিবদ্ধ করে রাখার রেওয়াজ দেখতে পাওয়া যায়। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ শাসকদের বিজয় কীর্তন করে হোম কীর্তন ও পূজার আয়োজন করা হতো। ১৯৬৭ সাল থেকে নববর্ষ উৎসব আয়োজন আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। ক্রমে পূর্ব বঙ্গে বাঙালি জীবনাচরণে নববর্ষ উদযাপন উল্লেখযোগ্য উৎসবে পরিণত হয়। চৈত্রসংক্রান্তির রাতে কিষানী নতুন ঘটে আতপ চালের সঙ্গে আম গাছের কচি নতুন পাতা যুক্ত ডাল ভিজিয়ে রাখত, পরের দিন ঘরের চারপাশে পানি ছিটানো হতো। নববর্ষ উপলক্ষে মেলা, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়া বান্ধা, হাডুডু, লাঠিখেলা, মোরগ লড়াই, জারিসারি গান, পুতুল নাচ ও সার্কাসের ব্যবস্থা করা হতো। উৎসব শুরু হতো বৈশাখ মাসের ১ তারিখ থেকে। পুণ্যাহ ছিল রাজস্ব আদায়ের জন্য বার্ষিক বন্দ্যোবস্ত উৎসব। প্রাক ব্রিটিশ আমলে সরকার জমিদার তালুকদার ইজারাদারদের থেকে বছরের নির্দিষ্ট দিনে রাজস্ব আদায় করে নিত। এ ব্যবস্থাকে পুন্যাহ বলা হতো। এ ব্যবস্থায় পূর্ববর্তী বছর ও নতুন বছরের রাজস্ব উত্তোলন করা হতো। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় ১৯৫০ সাল থেকে পুন্যাহ উৎসব বন্ধ হয়ে যায়। ’৪৭-এর দেশভাগের পর  পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের অবহেলিত বাঙালি আত্মনুসন্ধানে ব্যাপৃত থাকে। ষাট দশকে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন ও চর্চার ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করা হয়। ‘ছায়ানট’ পঞ্চাশ দশক থেকে রবীন্দ্রসংগীত চর্চা ও নববর্ষ উদযাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ক্রমান্বয়ে সম্মিলিতভাবে নববর্ষ উদযাপন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।  বিভিন্ন সংগঠন একত্রে ও পৃথকভাবে  নববর্ষ উৎসব আয়োজন করে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর নববর্ষ নানা আঙ্গিকে পালিত হচ্ছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠী নববর্ষে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। নববর্ষে বাড়ি-ঘর-আঙ্গিনা পরিষ্কার করা হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। মেলা আয়োজন করা হয় ও সে মেলায় হস্ত ও কুটির শিল্পের বিকিকিনি চলে। এসব মেলায় লোকসংগীত পরিবেশনা ও সার্কাস, নাটক মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করা হয়। ঢাকায় মঙ্গল শোভাযাত্রা চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়। শোভাযাত্রা শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। বিভিন্ন রঙিন মুখোশ ও প্রাণীর প্রতিকৃতি মঙ্গল শোভাযাত্রায় স্থান পায়। ১৯৮৯ সাল থেকে  মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইউনেস্কো সংস্কৃতির অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ঢাকায় রমনার বটমূলে ছায়ানটের শিল্পীরা নববর্ষ আবাহনের মাধ্যমে বর্ষবরণ করে থাকেন। সাদাশাড়ি লালপাঁড় পরিহিত রমণীদের কলকাকলিতে রমনা সেদিন মুখর হয়ে ওঠে। পুরুষসঙ্গী সাদা পায়জামা, পাঞ্জাবি শিশু-পুত্র-কন্যারা রঙিন পোশাকে সজ্জিত হয়। পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ধুম লেগে যায়। রকমারি ফুল-বেলুন ও খাওয়ার মধ্যে বাঙালি উৎসবে প্রত্যাবর্তন করে। সোনারগাঁওতে বউমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এ মেলা বটতলার মেলা নামে অধিক পরিচিত। বটবৃক্ষের নিচে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পূজা করতেন। কুমারী, নববধূ ও নারীরা তাদের মনবাসনা পূরণের জন্য পূজা করতেন। সন্দেশ, মিষ্টি, ধান দূর্বা, ফলমূল পূজার অর্ঘ্য হিসেবে ব্যবহার করা হতো। শান্তির জন্য কপোত-কপোতি পায়রা উড়ানো হতো। একশত বছরের পুরনো মেলা আজও আদৃত। সোনারগাঁ থানার পেরবা গ্রামে ‘ঘোড়া মেলা’ অনুষ্ঠিত হতো। জনশ্রুতি আছে জামিনি সাধক ঘোড়ার আরোহণ করে নববর্ষে প্রসাদ বিতরণ করতেন। তার মৃত্যুর পর স্থাপিত স্মৃতিস্তম্ভে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ঘোড়া স্থাপন করেই সে মেলার সূচনা করতেন। এই মেলায় নৌকায় খিচুড়ি রান্না করে রাখা হতো। সবশ্রেণির মানুষেরা কলাপাতায় খিঁচুড়ি প্রসাদ গ্রহণ করে খেতেন। চট্টগ্রামের ডিসি হিল পার্কে নববর্ষ উৎসব আয়োজন করা হয়। ১৯৭৩, ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে ইস্পহানি পাহাড়ের পাদদেশে নববর্ষ উপলক্ষে মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। বর্তমানে তা বিস্তৃত হয়ে সি, আর, বি এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়েছে। নববর্ষ উপলক্ষে পার্বত্য  চট্টগ্রাম এলাকায় ত্রিপুরাদের  বৈশুখ মারমা সাংগ্রাই ও চাকমা বিজু উৎসব পালিত হয়। মারমাদের পানি উৎসব প্রসিদ্ধ। উংরেজী মাধ্যমে লেখাপড়া করা তরুণ প্রজন্মের কাছে নববর্ষ কতটুকু গ্রহণীয় হচ্ছে প্রশ্ন উঠতে পারে। ডিশ এন্টেনা, ইন্টারনেটের অবাধ অনুপ্রবেশের সময় আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির সমাবেশ ঘটেছে সত্য কিন্তু বাঙালিয়ানা ধরে রাখতে না পারলে সব অর্জন বৃথা হয়ে যাবে।