
আমরা এখন মহিমান্বিত মার্চের সুবর্ণ সময় অতিক্রম করছি। এই মার্চ মাস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকাল থেকে নয় মাসের অতৃপ্ত অস্থিরতার দোলাচল। স্বাধীনতা অর্জনের আগে মার্চের রক্তাক্ত যাত্রাপথ কোনোভাবেই সুস্থির আর স্বস্তিদায়ক ছিলই না। আবার ২৫ মার্চের কালরাত্রির চরম আস্ফালনও ছিল হানাদার বাহিনীর জঘন্যতম বিভীষিকা। স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যকে ছিনিয়ে আনার মহানব্রতে আপামর বাঙালি যে মাত্রায় মরণযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেখানে সমসংখ্যক নারীর ওপর পাশবিকতার কঠিন বাতাবরণ তাও ইতিহাসের জঘন্যতম অধ্যায়। সভ্যতা সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ার দুরবস্থায়। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ৩০ লাখ শহীদানের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে যে পঙ্কিল যাত্রাপথ তৈরি করে সেটাও আর এক মর্মস্পশী করুণ আখ্যান। তাই স্বাধীনতার মাস মার্চ আসলেই বাঙালিরা স্মৃতিকাতরতায় স্মরণে, বরণে আপ্লুত আর হৃদয়বিদারক অসহনীয় দুর্ভোগকে গভীর বেদনায় জিইয়ে রাখে। রক্তস্নাত স্বদেশভূমি ইতিহাসের পাতাকে ক্ষত-বিক্ষতই করেনি বরং পরম গৌরব আর প্রাপ্তির নিশানাও হাতের মুঠোয় এনে দেয়। তাই মার্চ মাস অর্জন-বিসর্জনের যে দ্বৈত পালাক্রম তাও ইতিহাসের অনন্য যোগসাজশ। এমন রক্তে প্লাবিত মুক্তিযুদ্ধে নারীর সচেতন অংশগ্রহণ সমতার আলোকে সমন্বিত পথযাত্রা তো বটেই। ২৬ মার্চ থেকেই স্বাধীনতার মহারণে আপামর বাঙালি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের সম্মুখ সমরে মোকাবিলায় যে অসম সাহসিকতার নজির স্থাপন করে তাও এক দুঃসাহসিক অভিগমন। আর নারীরা শুধু লড়াকু মনোশক্তিতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়াই নয়, মুক্তিসেনাদের সাহায্য-সহযোগিতায় যেভাবে পাশে দাঁড়ায় তাও ইতিহাসের পরম অংশীদারিত্ব। রণকৌশলে নিরস্ত্র অনভিজ্ঞ নারীরা বীর দর্পে পাকিস্তানি জঙ্গি বাহিনীর মারণাস্ত্রের সামনে নির্ভীক চিত্ত আর দেশপ্রেমের অনন্য নজিরে এগিয়ে যায় তাও বীর বাঙালির আর এক অর্জন তো বটেই। যুদ্ধের ময়দানে শরিক না হয়ে সহযোদ্ধা ভাইদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রেরণা থেকে হরেক কর্মযোগে তাদের সহগামী হতে মোটেও পেছন ফিরে তাকায়নি পর্যন্ত। শুধু কি সংগ্রামে সম্পৃক্ত হওয়া? বরং যাপিত জীবনের আহার সংস্থান থেকে আশ্রয়দানÑ সবই করতে হয় স্নেহময়ী লড়াকু নারীদের। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা আর মায়া-মমতায় যেভাবে সুরক্ষা দেয়া সেটাও সংগ্রামী অভিযাত্রার কঠিন কর্মযোগ। বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তূপের শেষ কিনারায় নিয়ে আসা হয়। তেমন অভিঘাতের পরিক্রমায় দেশের মা-বোনেরা কিভাবে যে কঠিন দায়-দায়িত্ব পালন করে শুধু মুক্তিযুদ্ধকে সক্রিয় নয় বরং দেশকে শত্রুমুক্ত করাও ছিল যেন জীবনের আরাধ্য বিষয়। যুদ্ধে অংশ নেওয়া, সহযোদ্ধা মুক্তিসেনাদের নিকটবর্তী থেকে সর্ববিধ সহায়তা করা আবহমান বাঙালি নারীর যেন মমতাঘন এক রূপশৌর্য। ইতিহাসের রক্ত মাখানো পাতায় এক সঙ্গে মিলে মিশে স্বাধীনতাকে আরও বেশি মহীয়ান করেছে। নারীর মূল্যবান ঐশ^র্য তার সম্মান সেখানে যখন আঁচড় বসে তা রণক্ষেত্র থেকেও অনেক বেশি জ্বালাময়ী, নৃশংস হয়। ভাবলেও শিউরে উঠতে হয় মুক্তিযুদ্ধে নারীদের বহুমাত্রিক কর্মসাধনায়। সঙ্গে লাঞ্ছনার অবিনাশী জ্বালা। এমন দহন জ্বালা বুকে ধারণ করে নারীরা মুক্তিযুদ্ধে তাদের সচেতন অংশগ্রহণ থেকে মোটেও হটে যায়নি। গণমাধ্যম কর্মী সেলিনা পারভিন। ১৯৩১ সালে জন্ম নেওয়া এই লড়াকু সাংবাদিক ১৯৭১ সালে ১৪ ডিসেম্বর দেশের স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী নিধনের শিকার হন। সে সময়ের হাতে গোনা কয়েক নারী সাংবাদিকের একজন। সাপ্তাহিক বেগম ও ললনার সম্পাদক ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন পরিপূর্ণ এক মানুষের মর্যাদায়। সেলিনা পারভিন শিলালিপি নামে আর এক কাগজের সম্পাদক হওয়ারও কৃতিত্ব অর্জন করেন। কিন্তু পাকিস্তানি বর্বর সৈন্য যেভাবে তাকে অসম্মানে ক্ষত-বিক্ষত করে সেখান থেকে তিনি আর মুক্তিও পাননি। বিজয়ের পর ১৮ ডিসেম্বর তার ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ পাওয়া যায়। কাঁকন বিবিও ১৯৭১ সালের আর এক মুক্তি সংগ্রামী বীর বাঙালি নারী। যুদ্ধক্ষেত্রে তার দুর্দমনীয় লড়াকু অভিগমনে ময়দানই নাকি কেঁপে উঠত। তবে এসব বিপন্ন নারীকে সামাজিকভাবে নিগৃহীতও হতে হয়েছে। ক্ষত-বিক্ষত সংগ্রামী কাঁকন বিবি গুপ্তচরের কাজ করতেন বিভিন্ন শিবিরে গিয়ে। সঙ্গত কারণে উৎসর্গ করতে হয়েছে নিজের মূল্যবান, সম্ভ্রম, শক্তি, সাহস সবই। তাই মহিমান্বিত মার্চ মাস আসলেই মনে পড়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী অভিযাত্রার মর্মস্পশী ঘটনাক্রম। সেখানে সমসংখ্যক নারীর ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ভূমিকা স্বাধীনতার অনন্য সোপান তো বটেই। জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সম্ভব সহায়, সম্বল, কাছের মানুষÑ সবই অকাতরে বিলিয়ে দেয় দেশের অস্তিত্ব আর সম্ভ্রম রক্ষার তাগিদে। সীতারা বেগম, তারামন বিবির সম্মুখ সমরের বীরগাথা কাহিনী আজও স্বাধীনতার ইতিহাসে পরম নির্মাল্য।
অপরাজিতা প্রতিবেদক