
নারী নির্যাতন সমাজ ব্যবস্থার এক অনিঃশেষ যাতনা। যা কোনোভাবেই থামানো গেল না। যুগ-যুগান্তরের এমন দুর্বিপাককে সম্মুখ সমরে মোকাবিলা করেই সমসংখ্যক নারী আজও তেমন সংকট থেকে মুক্তি না পাওয়াও এক চরম সর্বনাশা যাত্রা। কন্যা শিশু ও নির্যাতন, নিপীড়ন থেকে নিরাপদ, নির্বিঘ্ন থাকছে না। সম্প্রতি মাগুরার আট বছরের শিশু ধর্ষণ করার যে সহিংস আঁচড় সারাদেশকে উত্তাল আর বিক্ষুব্ধ করে দেয়। সেটাও নারী সমাজকে নিরাপত্তাহীনতার সংকটে নিয়ে যায়। কন্যা শিশু, উদীয়মান কিশোরী, যুবতী থেকে মধ্য বয়সী নারী কেউই বাদ যাচ্ছে না এমন অসহনীয় কোপালন থেকে। সবার আগে সামনে চলে আসছে নারীকে মানুষ হিসেবে গণ্য না করার কুরুচিতার অপসংস্কৃতি। ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ক্ষোভ আর কষ্টে, বেদনায় এমন পাশবিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। সব সময় ঘটে যাওয়া এই অমানবিক দুর্বৃত্তায়ন নতুন কিছু নয়। অভিশাপ, অপঘাতের মতো তা রুদ্ধ করাও যাচ্ছে না। উত্তাল উচ্চ শিক্ষার পাদপীঠের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জঘন্য এই ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদে লাঠি হাতে রাস্তায় নেমে আসেন। সবার কণ্ঠে একটাই উচ্চারণ ধর্ষকদের অবিলম্বে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা জরুরি। এই মুহূর্তে রাজধানীসহ সারা বাংলাদেশ প্রতিবাদের ঝড়ে ফেটে পড়ার দুর্বিষহ অবস্থা। মিছিল, সড়ক অবরোধসহ হরেক প্রতিবন্ধকতার বেষ্টনী তৈরি করছে। উন্মুুক্ত, বিক্ষুব্ধ, রাগে, দুঃখে, অপমানে সারাদেশ যেন ফুঁসে উঠেছে। খুন, ধর্ষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্যানাারে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, আপামর জনতার যেন চোখের ঘুম হারানোর দুরাবস্থা। সরকারি, বেসরকারি সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একযোগে আন্দোলনে সরব হয়ে জড়িতদের গ্রেপ্তারসহ কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তির দাবি করে যাচ্ছে রাস্তাঘাটে, পথে-প্রান্তরে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড আইনি বিধানে লিপিবদ্ধ করা আছে। সেটাই বিধিমতে যথাযথ প্রক্রিয়ায় এগিয়ে নেওয়ারও জোর দাবি তোলা হচ্ছে সর্বজনের পক্ষ থেকে। ধর্ষণ, নিপীড়ন বহু যুগ ধরেই চলে আসা এক সহিংসতার ছোবল। আধুনিকতার তথ্য-প্রযুক্তির যুগে তা যেন আরও বাড়-বাড়ন্ত অবস্থায় চলে গেছে। তথ্য-প্রযুক্তির আঙিনায় উদীয়মান, কিশোরী, যুবতী নারীদের হেনস্তা করার বিষয়টি গণমাধ্যমকে বিচলিত করেই যাচ্ছে। ভাবার অবকাশই থাকছে না এমন চিরস্থায়ী দুর্ভোগ, দুর্যোগের শেষ পরিণতি কোথায়? উত্তাল প্রতিবাদমুখর অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত জঘন্য অমানুষদের আটক করলেও শেষ রক্ষা কতখানি হবে তা বলা মুশকিল। কারণ ইতোমধ্যে আটক দুষ্কৃতকারীর জামিনে মুক্তি পাওয়ার দুর্বিষহ তথ্য কেউই মানতেই পারছে না। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না সমাজের প্রভাবশালীর দাপটে সাধারণ মানুষকে যেন চুপ করিয়ে বসিয়ে রাখা হয়। সমস্ত দোষ গিয়ে বর্তাচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ওপর। সেই পুরানো বিধি অপরাধীর ছাড় পেয়ে যাওয়া। এবার উচ্চ কণ্ঠে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় কোনোভাবেই তা হবে না। প্রয়োজনে জনগণ আরও কঠিন লড়াইয়ে নামতে দ্বিধা করবে না। এই মুহূর্তে সারাদেশ তেমন অসহনীয় এক পরিবেশ, পরিস্থিতিকে সামলিয়ে দিন যাপন করা স্বস্তিকর কোনো বিষয়ই নয়। এবার যেন কোনো অভিযুক্ত পার কিংবা খালাস পেতে না পারে সে ব্যাপারে কঠোর সাবধান বাণী আসে বিক্ষুব্ধ জনরোষ থেকে। এমন পাশবিক নির্যাতন থামার কোনো লক্ষণ নেই কেন? সেই প্রশ্নও বারবার উঠে আসছে। গত ফেব্রুয়ারিতেই নাকি দিনে গড়ে ১২টি মামলা হয় নির্যাতন আর অসহনীয় ধর্ষণের দুর্বিপাকে। সবদিক বিবেচনায় আমলে নিলে মনে হয় দেশের কন্যা, জায়া, জননী কোথাও নিরাপদ নয়? ঘরে-বইরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তার বেষ্টনী কেন থাকছে না তাও বহুবার প্রশ্ন ওঠা আর এক লাগাতার লাঞ্চনা, যাতনা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী মর্মাহত হয়ে তাঁর অভিব্যক্তি জানালেন। তাঁর মতে প্রাথমিকভাবে সরকারের নিষ্ক্রিয়তায় শিক্ষার্থীরা যুদ্ধের ময়দানে নেমে আসলেন। পরের বিষয় সরকারের নড়েচড়ে বসা উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনে, কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ। সমস্ত অপরাধ, দুর্বৃত্তায়নের এক সুশৃঙ্খল চেইন নাকি বিদ্যমান সেই বাজার সিন্ডিকেটের মতো। সেখানে সব দুর্বিপাক, অনিঃশেষ যাতনা যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা। তারপর আছে সমাজের পেশিশক্তির অপকৌশল, অভিজ্ঞতা। দাবি ঊঠছে নারী-শিশুর প্রতি সহিংসতারোধে প্রচলিত আইন ও বিচার ব্যবস্থার সংস্কার, আধুনিকায়ন জরুরি। তা ছাড়া ক্রমাগত বেড়ে যাওয়া এমন জঘন্য অপরাধের মূল শেকড় অনুসন্ধানও পরিস্থিতির ন্যায্যতা।
ইতোমধ্যে বিচারিক সর্বোচ্চ ব্যবস্থা হাইকোর্ট নির্দেশ জারি করেন বিরতিহীনভাবে বিচার কার্যক্রম চলবে। তা ১৮০ দিনের মধ্যেই সম্পন্ন করে রায় প্রকাশও পরিস্থিতির দাবি। আইন ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালকে এমন নির্দেশনা দিয়েছেন মাননীয় হাইকোর্ট। তা ছাড়া মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে সেই অসহায় নিপীড়িত শিশুটির সব ছবি, ভিডিও গণমাধ্যমও অনলাইন থেকে সরিয়ে ফেলার আদেশও অসে সর্বোচ্চ আইনি ব্যবস্থাপনা থেকে। তবে বিচারহীনতার অপসংস্কৃতিকে রুখতে এবার কঠোর গণআন্দোলনও জরুরি ছিল। এমন আন্দোলন, বিক্ষোভ তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে চিরতরে সমাজ থেকে দুঃসহ দুর্বৃত্তায়নকে ঝেড়ে ফেলাও নিতান্ত জরুরি। খুন, ধর্ষণ, নারী নিপীড়ন থেকে দেশ এবং সমাজ মুক্তি পেতে যা যা করণীয় সবটাই করা উদ্ভূত পরিস্থিতির নিতান্ত অনিবার্যতা।
তবে শিশুটি আজো লাইফ সাপোর্টে। আটককৃত আসামিরা রিমান্ডে। বিচার কার্যক্রম কতদূর গড়াবে সেটাও সময়ের হাতে।