
নারীদের হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে উচ্চমানে পাদুকা বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে
এক সময় নুন আন্তে পান্থা ফুরিয়ে যাওয়ার অবস্থা ছিল উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগে। যে প্রান্তিক নারীরা স্বামীর ঘরে সংসার করতে এসে অভাব-অনটন ও নির্যাতনের বিভীষিকাময় জীবনকে ভুলে গিয়ে আজ তারাই দুর্বার শক্তিতে জেগে উঠেছেন। সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে প্রান্তিক নারীরা তৈরি করছেন নামি-দামি উচ্চমানের জুতা। পাদুকাকে আমরা সচরাচর জুতা বলেই উচ্চারণ করি। একজন নারী পুরুষের পায়ের সৌন্দর্য বহন করে এই পাদুকা। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে দেশের উত্তরাঞ্চলের পল্লীতে গড়ে তোলা হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ শতভাগ রপ্তানিকারক জুতা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ব্লিং লেদার প্রোডাক্টস লিমিটেড। রংপুর ও নীলফামারীর মাঝামাঝি একটি উপজেলা তারাগঞ্জ। উপজেলার মহাসড়কের পাশে ঘনিরামপুর গ্রামে সাড়ে ৯ একর জমির ওপর ওই জুতা কারখানা গড়ে তোলা হয়।
আয়শা বেগম, সুলতানা আক্তার, লিপি বেগম, আরজিনা খাতুনের মতো শত শত প্রান্তিক নারীরা ভুলে গেছেন তাদের অভাব অনটন ও স্বামীর নির্যাতনের কথা। এখন আর না খেয়ে থাকতে হয় না। ভালো বেতনের পাশাপাশি বছর শেষে খেলাধুলার পুরস্কারও পেয়ে যান তারা।
এই কারখানায় কাজ করছেন আশি ভাগ প্রান্তিক নারী। যাদের হাতে তৈরি নান্দনিক ডিজাইয়ের পাদুকা তৈরি হচ্ছে। যা শতভাগ উৎপাদিত পাদুকা বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। শুধু শ্রমিক হিসাবে নয়, জুতা কারখানার মালিক পক্ষ এই প্রান্তি নারীদের প্রতি বছর আনন্দ উৎসব ও মিলন মেলারও আয়োজন করে থাকেন। এবার খেলাধুলা প্রতিযোগিতার পাশাপাশি রাফেল ড্রতে প্রথম পুরস্কার ৫০ ইঞ্চি স্মার্ট টিভি পেয়েছেন কারখানার সুইং বিভাগের কর্মী শ্রীমতি সুমিত্রা, দ্বিতীয় পুরস্কার দুটি স্মার্টফোন পেয়েছেন মৌসুমি এবং ময়না। তৃতীয় পুরস্কার ছিল পাঁচটি কমফোর্টার, চতুর্থ পুরস্কার ছিল দশটি মোবাইল ফোনসহ আরও অনেক আকর্ষণীয় পুরস্কার। এ ছাড়াও নিয়মানুবর্তিতা, কর্ম দক্ষতা ও অন্য গুণাবলির আলোকে সাতজন কর্মীকে বর্ষসেরা কর্মীর পুরস্কার প্রদান করা হয়। এটি এই কারখানার নারী শ্রমিকদের দক্ষ কাজের উৎসাহ জুগিয়েছে। ফলে দিন দিন এই পাদুকা কারখানার পরিধিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি এলাকার অসহায় মানুষজনদের মাঝে বিতরণ করা হয় শীতবস্ত্র।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় কারও স্বামী দিনমজুর, হোটেলের কর্মচারী, কেউ রিক্সা চালায়, কেউ কৃষি জমিতে কাজ করেন। স্বামীর আয়ে সংসার চলে না। এজন্যই সংসারে অশান্তি বেড়ে যায়। এই জুতা কারখানায় প্রশিক্ষণের পর কাজ পেয়ে সংসারে এনেছে সুবাতাস। কারণ এখন সংসারে অর্থ জোগান দিচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের হাতে তৈরি জুতা ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
এক সময় রংপুর অঞ্চল ছিল মঙ্গাপিরিত এলাকা। অভাবের কারণে অনেক গৃহবধূর সংসার ভেঙে যাচ্ছে, কেউ নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। এমন বিষয়টি নিয়ে মূলত ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন করা যায় কিনা তা নিয়ে ভাবতে থাকতেন নীলফামারী শহরের বাবুপাড়া মহল্লার দুই সহোদর মো. হাসানুজ্জামান হাসান ও মোহাম্মদ সেলিম। অসহায় প্রান্তি নারীদের প্রাধান্য দিয়ে তাঁরা ওই জুতা কারখানা। কারখানার শ্রমিকরা জানান, জুতা কারখানা গড়ে ওঠায় কর্মহীনতা ঘুচেছে। ৫/৬ বছরে উপার্জন বেড়েছে, বেড়েছে জীবনযাত্রার মান। ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের মার্জিনা খাতুন (৩১) জানান, ভিটামাটি ছাড়া কিছু ছিল না। এখন টিনের ঘর ও নিজের ৪ শতাংশ জমি আছে। গাছগাছালি ঘেরা বাড়িতে হাঁস-মুরগি, ছাগল ও গাভি পালন করছেন। জুতা তৈরির কাজ করে মাসে ১০/১৫ হাজার টাকা আয় করছেন। সন্তানরা স্কুলে যাচ্ছে সংসারে তাঁর (মর্জিনা) মতামত এখন স্বামীর কাছে গুরুত্ব পায়। সীতা রানীর (২৫) নামের আরেক নারীশ্রমিক বলেন, স্বামী ছেড়ে গেছে তিন বছর আগে। খুব সমস্যায় ছিলাম। পরে ব্লিং লেদার জুতা তৈরি কারখানায় এসে প্রশিক্ষণ নেই। তারপর এখানে চাকরি করছি। এখন আর কোনো চিন্তা নেই। মাস গেলেই বেতন পাচ্ছি। মালিক পক্ষ আমাদের নিজেদের বোন সন্তান মনে করে আগলে রেখেছেন।
সরেজমিন গেলে জানা যায়, ১৪ ফেব্রুয়ারি ওই প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় ইউনিটের উদ্বোধন করা হয়েছে। রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও কাজী মো. ওয়াহিদুল ইসলাম ফিতা কেটে এই ইউনিটের উদ্বোধন করেন। ৩০০ শ্রমিকের থাকার জন্য আবাসিক ভবন রয়েছে এ কারখানায়। তাইওয়ান থেকে আনা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে কারখানার ভেতরে জুতা তৈরি করেন শ্রমিকরা। শ্রমিকদের ১০ ভাগ পুরুষ ও ৯০ ভাগ নারী।
জুতা কারখানার পরিচালক, হাসানুজ্জামান হাসান বলেন, আশির দশকে তাঁরা দুই ভাই বিদেশে পাড়ি জমান।
আমেরিকায় শুরু করেন আবাসন ব্যবসা। সেখানে ব্যবসায় সফলতা আসে। এরপর দেশের মাটিতে বিনিয়োগের চিন্তা করেন। সেই চিন্তা থেকেই ২০০৯ সালে নীলফামারীতে ও ২০১২ সালে মিঠাপুকুর উপজেলা কৃষকদের জন্য বীজ ও আলু সংরক্ষণরে জন্য হিমাগার স্থাপন করেন। এরপর ২০১৭ সালে তৈরি করে এই জুতা কারখানা। এখানকার জুতা এখন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৮০০ মানুষের। ২০২৩ সালে বড় ভাই মোহাম্মদ সেলিম হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। হাসানুজ্জামান হাসান বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান।
প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আরও বলেন, দেশে নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বড় ভাই সেলিমের উদ্যোগে নিভৃতপল্লীতে কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। কারখানাটি পরিচালনা করার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষের সহযোগিতা পাচ্ছি। গ্রামীণ প্রান্তিক নারীদের কর্মদক্ষতায় প্রতিদিন ৩০০ জোড়া থেকে এখন ১০ হাজার জোড়া জুতা উৎপাদন হচ্ছে। আশা করছি ২০২৬ সালের শেষে দৈনিক ৫০ হাজার জোড়া জুতা উৎপাদনের ইচ্ছে আছে। সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। এতে আরও নারী শ্রমিক কাজের সুযোগ পাবেন।