
সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেট কিন, মজুরি বৈষম্যের দাবি
আগামীকাল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিবসটিকে পালন করা হয় ৮ মার্চ। যদিও নিত্যজীবনাচরণ, কর্মযোগ, শিক্ষায় এগিয়ে চলা, অবরুদ্ধতার জাল ছিন্ন করা কোনোদিন বা তারিখে আটকে থাকে না। নিয়ত জীবনযুদ্ধ যেখানে অপরিহার্য সেখানে দিন সময় নয় বরং প্রতিদিনের অর্জন, লড়াই ও সামনে এসে যাওয়া পরিস্থিতির ন্যায্যতা। সাংগঠনিক পালাক্রম থেকে শুরু করে সচেতন নারী সমাজ যে মাত্রায় দিবসটি পালনে উদ্বুদ্ধ প্রাণিত আর নানাবিধ অনুষ্ঠানমালায় স্মরণ-বরণের ডালা সাজানো গোছানো হয় তা একেবারেই প্রাতিষ্ঠানিক। নিত্য অর্জন, বিসর্জনের ধারাবাহিকতায় কি মাত্রায় হাতের মুঠোয় এলো কিংবা কোথায় পেছনে হটানো সবই এক বিনিসূতার অবিচ্ছিন্নমালা। আমরা উৎসব আর অনুষ্ঠান প্রিয় জাতি। তাই আড়ম্বর আর আয়োজন সর্বস্ব আনুষ্ঠানিকতা আমাদেরকে নানা মাত্রিকে উজ্জীবিত আর উদ্দীপ্ত চেতনায় মহিমান্বিত করে। কন্যা, জায়া, জননী যেন নড়েচড়ে বসেন দিবসটির প্রতিপাদ্য আর মাহাত্ম্য উপলব্ধিতে। যেভাবে বৃহত্তর সামাজিক অঙ্গন একইভাবে ক্ষুদ্র পারিবারিক আলয়টিও আয়োজনে, চেতনাসিদ্ধ অনুভবে নিজের যাপিত জীবনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ-বেদনার হিসাব কষেও কোন কূলকিনারা না পাওয়া পরিস্থিতির অপরিহার্যতা। সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে নারীদের সচেতন অভিব্যক্তি কিংবা নিজেকে মানুষ ভাবার প্রত্যয় নতুনভাবে জেগে উঠে। সেই পুরনো বোতলের নতুন মদ ঢাকার মতো। সৃষ্টির উষালগ্ন থেকে যে অভেদ্য বৈষম্য সমাজের মর্মমূলে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো তা হলো নারী-পুরুষের তারতম্য। যা বন্য, বর্বর থেকে আধুনিক সভ্য সমাজে উপনীত হয়েও যেন লড়াই সংগ্রামের কোনো ব্যত্যয়ই ঘটে না। আমরা একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের মধ্য গগনে। কিন্তু আজো লিঙ্গ সমতা অর্জন-বিসর্জনের গোলকধাঁধায় যেন অধরা এক দূর জগৎ। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির উন্নত বিশ্ব থেকে বাংলাদেশে যে মাত্রায় নারীরা বৈষম্য আর নিপীড়নের শিকার তা যেন সভ্যতা সূর্যের অসমিত হওয়ার চরম দুর্ভাগ্য। তাই সেখানেই বিশেষ দিনটি তার যথার্থ মর্যাদায় কতখানি নিত্য জীবনের অনুষঙ্গ হয়Ñ তেমন প্রশ্নের জবাব আজও মিলছে না। কিন্তু প্রতি বছর দিবসটির মাহাত্ম্য আর তাৎপর্যে আলাপ, আলোচনা, অনুষ্ঠানমালায় যেভাবে নন্দিত হয় সেখানে চলমান লড়াই, সংগ্রাম ধামাচাপা পড়ার সুযোগ কিন্তু শূন্যের কোঠায়। দিবসটি তাৎপর্য উপস্থাপন করতে যেয়ে প্রতিদিনের অপঘাত, অপমান, অসাম্য, বঞ্চনা কোনটাই পিছু হটছে না। বরং বেশি করেই সামনে আসছে আজও নারী সমাজ মানুষ হিসেবে নিজের পরিচয় কেন তুলে ধরতে বারবার হোঁচট খাচ্ছে? তেমন প্রশ্নের সহনীয় সমাধান কোন গহিন বনে তাও দিবসটির জন্য আর এক অপঘাত-অপশক্তি যাই বলি না কেন। তা যেন গভীরতর শিকড়ে প্রোথিত। সেটা ভেদ করতে গেলে ঐক্যবদ্ধ লড়াই-বিপ্লবের চাইতেও বেশি জরুরি সচেতন মনোশক্তিতে আপন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হওয়া। সংবিধান কিংবা ধর্ম যা সব মানুষের অপরিহার্য অধিকার সেখানে কিন্তু নারী-পুরুষের নজর কাড়া ফারাকÑতারতম্য তেমন দৃশ্যমানই নয়। উনবিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে জন্ম নেওয়া নারী জাগরণের যথার্থ দিশারী বেগম রোকেয়া যেভাবে রুদ্ধতার জাল ভেঙে অবরোধবাসিনীদের অর্গল ভেঙে স্বাধীন পথের নিশানা দিলেন তা আজও নারীদের জন্য এক অভাবনীয় অরুণোদয়ের আলোক বিচ্ছুরণ। যত সহজে লেখা হলো কঠিন যাত্রা পথ ছিল আরও দুর্ভেদ্য, অন্ধকারাচ্ছন্ন। তেমন শেকল ভাঙার গান সমসংখ্যকদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া সত্যিই এক দুর্জয় সাহসের সময়োপযুগী নির্মাল্য। অবশ্য তার আগে নারী শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করার অনন্য কৃতিত্ব উনিশ শতকের আর এক প্রাণ পুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। নিজ উদ্যোগে বহু বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে নারী জাতির রুদ্ধতার কঠিন অর্গলকে যেভাবে নাড়া দিলেন সেটা এই পণ্ডিত্যের অবিস্মরণীর কর্মযোগ তোা বটেই। সাধনা বললেও বেশি বলা হয় না। তবে শুধু নারী শিক্ষার দ্বার উন্মোচন হলেই সব সমস্যার সমাধান হয় না। শিকড়ের অভ্যন্তরে যে জগদ্দল পাথরে চাপা পড়ে আছে নারী অধিকার, স্বাধীনতা কিংবা মানুষ ভাবার সচেতন প্রত্যয় সেখানেও ভাঙনের খেলা শুরু করাও ছিল সমকালীন পরিবেশ, পরিস্থিতির জন্য অপরিহার্য এক দৃপ্ত অঙ্গীকার। তাই ৮ মার্চের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শুরুতেই আলোকপাত করতে হয়েছে সমসংখ্যকের শিক্ষার সূতিকাগার এবং তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য, প্রয়োজনীয় কর্মযোগও। সেখানে শুধু অধিকার আদায়ই নয় বরং যোগ্যতা আর সক্ষমতায় নেতৃত্বের স্থান অলঙ্কৃত করাও যেন সামাজিক দায়বদ্ধতা। এই দিবসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হয় বহুমাত্রিক আয়োজন, বিবিধ কার্যক্রম। কর্মস্পৃহায় নারীদের সংঘবদ্ধ আর ঐকমত্যের আলোকে আধুনিক ও নতুন বিশ্ব গড়ার প্রতিটি পদক্ষেপে নারীদের অংশীদারত্ব। দেশের সার্বিক উন্নয়নের ধারাবাহিক পর্যায়ে যে কোনো সমান অংশ যদি কর্মযোগে স্বাচ্ছন্দ্য। আর অবারিত হতে পিছুহটে তাহলে দৃশ্যমান প্রবৃদ্ধি আয়ত্তে আনা সুদূর পরাহত হতে বাধ্য। আমেরিকার কারখানার নারী শ্রমিকরা অধিকার আদায়ও প্রাপ্য মজুরির দাবিতে মালিকের বিপক্ষে সংঘবদ্ধ আন্দোলনে একাত্ম হয়। সেখান থেকেই নারী লড়াই সংগ্রামের ইতিবৃত্তে ৮ মার্চ নারী দিবসের ঘোষণা আসে। জার্মানির সংগ্রামী নেত্রী ক্লারা জেটকিন নারী দিবসের তাৎপর্যে আজও ইতিহাসের পাতায় নিজের আসন অক্ষয় ঐশ্বর্যে প্রমাণ করে যাচ্ছেন। নারী হিসেবে নয় মানুষের ভাবনায় নারীকে মূল্যায়ন করাই দিবসটির যথার্থ প্রতিপাদ্য। যে কোনো মানুষের দক্ষতা, যোগ্যতা পারদর্শিতায় নিজের স্থান তৈরি করা সঙ্গত। তিনি পুরুষ নারী যেন হোন না কেন।