ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১

বাল্যবিয়ে বন্ধে সামাজিক আন্দোলন

রাজু মোস্তাফিজ

প্রকাশিত: ০১:১৯, ১১ অক্টোবর ২০২৪

বাল্যবিয়ে বন্ধে সামাজিক আন্দোলন

বাল্যবিয়ে বন্ধে জোরদার করছে সামাজিক আন্দোলন

কুড়িগ্রামের কিশোর-কিশোরীরা বাল্যবিয়ে বন্ধে জোরদার করছে সামাজিক আন্দোলন। অনেক সময় নিজেদের চেষ্টা ব্যর্থ হলে তারা প্রশাসনের সহায়তায় বাল্যবিয়ে বন্ধ করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয় তারা এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে অভিভাবকদের নিয়ে বৈঠক করছে এর ক্ষতিকারক দিকগুলো  বোঝাচ্ছে তাদের। পড়াশোনার পাশাপাশি এই সামাজিক দায়িত্ব পালন করে। তারা চায় এ জেলায় থাকবে না কোনো বাল্যবিয়ে আর বৈষম্য। 
 জেলার চিলমারী উপজেলার চর পাত্রখাতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মনিষা আক্তার (১১)। সে ওই চরের সবুজপাড়া গ্রামের ঝালমুড়ি বিক্রেতা মহুবর আলীর মেয়ে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের ২৫ তারিখ পারিবারিকভাবে তার বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু মনিষার ইচ্ছে সে পড়ালেখা করে শিক্ষক হবে। গত ২৩ জানুয়ারি মনিষার বিয়ের কথা চিলমারীর ‘কিশোরী ব্রিগেড ফোর্সে’ জানতে পারে। তারা চর পাত্রখাতায় মনিষার বাড়িতে গিয়ে বাল্যবিয়ে বন্ধের জন্য অনুরোধ করেন। কিশোরী মেয়েদের অনুরোধ উপেক্ষা করে চলে বিয়ের আয়োজন। এবারে কিশোরী ব্রিগেড ফোর্সের কিশোরীরা চিলমারী মডেল থানা পুলিশ ও উপজেলার চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় মনিষা আক্তারের বিয়ে বন্ধ করে।
উলিপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী কলি রাণী (১৭)। উপজেলার তবকপুর ইউনিয়নের বামনহাট গ্রামের দর্জি শ্যামল রায়ের মেয়ে। ২০১৯ সালে অষ্টম  শ্রেণিতে পড়ার সময় তার অমতে বিয়ে ঠিক করে পরিবার। কলি রাণী ছেলে পক্ষকে বলে তার বিয়ে ভেঙে দেন। এরপর ২০২২ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর পরিবার আবারও কলি রাণীর বিয়ে ঠিক করেন। কিন্তু এবারে কলি রাণীর কথায়  থেমে যায়নি পরিবার। জোর করে চলে বিয়ের আয়োজন। অবশেষে বাধ্য হয়ে কলি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আরডিআরএসের ‘ইউনিয়ন যুব সংগঠন’ সদস্যদের বিষয়টি জানায়।

তারা পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বিয়ে বন্ধ করে। শুধু নিজের বিয়ে বন্ধ করে থামেনি কলি রাণী। ২০২২ সালের পর থেকে সে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের সহযোগিতায় ২০টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছে।
কলি রাণীর মতো চিলমারী নয়ারহাট ইউনিয়নের হালিমা আকতার, বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের সুইটি আকতার, রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাটি ইউনিয়নের মোরশেদা আক্তার মীম (১৭), রৌমারী উপজেলার দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের সানজিদা পারভিন শিউলী (২০) ও রাজারহাট উপজেলার রিপা আক্তার বাঁধন এবং চিলমারী উপজেলার কিশোরী ব্রিগেড ফোর্স নিজেদের বাল্যবিয়ে বন্ধ করার পাশাপাশি শতাধিক বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছে।
কিশোরী কনে ও তাদের সহপাঠীরা মিলে এসব বাল্যবিয়ে  ঠেকিয়ে দিচ্ছে। তাদের মাধ্যমে দিন দিন বাল্যবিয়ে বন্ধে  জোরদার হচ্ছে সামাজিক আন্দোলন। প্রশাসনের সমর্থন ও  বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আরডিআরএসের ‘চাইল্ড নট ব্রাইড’ প্রজেক্টের সহযোগিতায় জেলার ৭৩টি ইউনিয়ন ও ৩টি  পৌরসভায় গড়ে উঠছে বাল্যবিয়েবিরোধী যুব সংগঠন। এসব যুব সংগঠনের কিশোর-কিশোরীরা গ্রামের অভিভাবকদের সঙ্গে বাল্যবিয়ের নেতিবাচক প্রভাব ও বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনের বিধিবিধান নিয়ে আলোচনা করে। ফলে জেলায় বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের হারও বাড়ছে।
চাইল্ড নট ব্রাইড (সিএনবি) প্রজেক্ট সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) জেলায় ১ হাজার ৪৩৪টি বিয়ে হয়। এরমধ্যে নিবন্ধিত বিয়ে ১ হাজার ৩৭১টি এবং বাল্যবিয়ে ঘটে ৬৩টি। এছাড়াও জেলার ৬টি উপজেলায় গত এক বছরে জেলার ৬টি উপজেলার ৪৫টি ইউনিয়নের যুব সংগঠনের কিশোর-কিশোরীরা শতাধিক বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছে। চলতি বছরে তারা মোট ১১টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে চিলমারী উপজেলার ‘কিশোরী ব্রিগেড ফোর্স’ তিনটি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছে। এই সংগঠনের সকল সদস্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রাইয়াদ মারিয়া সরশী জানায়, আমি যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী তখন আমার এক বান্ধবীর বিয়ে হয়ে যায়। বছর না যেতেই তার  কোলজুড়ে আসে শিশু সন্তান। তার স্বাস্থ্য ভেঙে দুর্বল হয়ে যায়। নিজে শিশু হয়ে তার কোলে আর একটি শিশু। জীবন জগৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাতৃত্বের স্বাদ নিতে হয়েছে। যা খুব কষ্টের।

তার করুণ অবস্থা দেখে আমি আমার বিদ্যালয়ের কয়েকজন সহপাঠী মিলে গঠন করি কিশোরী ব্রিগেড ফোর্স। ২০২২ সালে এই সংগঠন গঠনের পর থেকে আমরা মোট ২৬টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছি। আমরা চেষ্টা করছি একদিন চিলমারী উপজেলার বাল্যবিয়ে মুক্ত করব।
নিজেদের বাল্যবিয়ে নিজেরা বন্ধ করা কয়েকজন কিশোরীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানায়, বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন-২০১৭ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। বিশেষ করে তারা বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনের ১৯ ধারায় বিশেষ বিধানে আদালতের নির্দেশ ও অভিভাবকের সম্মতিতে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের বিয়ের বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তারা জানান, কোনো অবস্থাতেই বাল্যবিয়ে আইনসিদ্ধ করা যুক্তিযুক্ত নয়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কুড়িগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক প্রতিমা চৌধুরী জানান, বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতন বন্ধে সরকার বিভিন্ন আইন তৈরি করেছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে কিছু অসাধু কাজী সেই আইনের তোয়াক্কা না করে বাল্যবিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ফলে দিন দিন কুড়িগ্রামে বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতনের সংখ্যা বাড়ছে। চলতি বছরে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কুড়িগ্রাম জেলা শাখার উদ্যোগে ১০টি বাল্যবিয়ে বন্ধ ও ১৫টি সালিশি বৈঠক করেছি।

আশার কথা আমাদের কিশোরী মেয়েরা বাল্যবিয়ে বন্ধে আওয়াজ তুলতে শুরু করেছে। তারা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলে নিজেদের বাল্যবিয়ে নিজেরাই ঠেকাচ্ছে। তাদের সঙ্গে প্রশাসন, ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও অভিভাবকরা একজোট হলে তবেই বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক ব্যাধি দূর করা সম্ভব।

×