ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১ আশ্বিন ১৪৩১

নারীকে মানুষ ভাবুন

অপরাজিতা প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০১:০৬, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

নারীকে মানুষ ভাবুন

সমতাভিত্তিক সমাজ তৈরিতে নারী-পুরুষের সমঅধিকার

সমতাভিত্তিক সমাজ তৈরিতে নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রাসঙ্গিক এবং যৌক্তিক। যা আধুনিকতার পরম চাওয়া-পাওয়া। বহুবার দাবি করা আরও এক বিষয় সামনে চলে আসেÑ নারীকে মানুষ ভাবাও বাঞ্ছনীয় এবং জরুরি। দেশের নারী সংগঠন মহিলা পরিষদ নারীর সর্ববিধ অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাকে মানুষ ভাবার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় এনেছে। পুরুষ কিংবা পিতৃতান্ত্রিক যেই সমাজই হোক না কেন নারীদের পশ্চাৎবর্তিতার করুণ দৃশ্য উঠে আসাও চরম বিপন্নতা। চলে আসা সামাজিক প্রচলিত রীতিতে শুধু কন্যা, জায়া, জননীর আড়ালে মানুষ শব্দটি যে ঢাকা পড়ে। তেমন অনাকাক্সিক্ষত খোলস থেকে নারীর বের হয়ে আসা যেন সময়ের ইঙ্গিত।

সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাষ্ট্রতন্ত্রের মূল ভিত নড়ে উঠলে জমে থাকা হরেক আবর্জনা এখন মুছে ফেলার অপেক্ষায় পুরো জাতি। সেখানে সমাজের সমসংখ্যক নারী ও তাদের মানুষ হিসেবে যথার্থ অধিকার দাবি আদায়ে জোরেশোরে আওয়াজ তুলে যাচ্ছেন। জন্মগতভাবে নারী পুরুষ সবাই স্বাধীন সত্তা নিয়ে জীবন চালনা করাও পরিস্থিতির ন্যায্যতা। কিন্তু মানুষের গড়া সামাজিক নিয়ম কানুন সেখানে যে বিভেদের প্রাচীর  তৈরি করে সেখানে সবার আগে আটকে যায় নারী সমাজ। তেমন তারতম্যের কঠিন যাত্রা শুরু তো সেই পরিবার থেকে।

মহিলা পরিষদের নেত্রীরা সুউচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদের ভাষায় বললেনÑ মানুষের অধিকার, দাবি সবার ন্যায্য পাওয়া। সেখানে কোনো ভেদবুদ্ধি অপ্রাসঙ্গিক, অযৌক্তিক, নীতির নৈতিকতা বহির্ভূত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও ছাত্রীদের বৈপ্লবিক ভূমিকা, সরব উপস্থিতি সামনে আসতে সময়ও লাগেনি। সম্মিলিতভাবে সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে যখন প্রতিকারের দাবি ওঠে সেখানে লিঙ্গ বৈষম্য কোনো মতেই গ্রহণযোগ্যতা পায় না। যে কোনো সমাজ সংগঠিত হয়, এগিয়ে যায় তার সহজাত মূল্যবোধ আর প্রচলিত নিয়মমাফিক। সেখানেই জগদ্দল পাথরের মতো চাপা পড়ে আছে নারীর প্রতি অসাম্য আর বিভেদের করুণ ইতিবৃত্ত। অধিকার ও স্বাধীনতা হরণের হরেক অপসংস্কার।

উল্লেখ করতে চাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ আর সাম্যের কবি নজরুলের পরম স্পর্শকাতর অনুভব আর গভীর মমত্ববোধ। কবি গুরু ১৯৩৬ সালে ৭৫ বছর বয়সে লিখলেন ‘কালান্তর’ প্রবন্ধ সংকলন। কবির মনন বৃত্তির এমন সব বাক্য চয়নে সব ধরনের অসাম্য বিভেদের ওপর যেন কড়া প্রতিবাদ। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পকেও উড়িয়ে দিলেন অন্তর্নিহিত বোধে। বলতে দ্বিধা করলেন নাÑ ‘যে দেশে শুধু ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায় সে দেশ হতভাগ্য। অন্য কোনো বাধন যদি তাকে বাধতে না পারে সেটা আরও মর্মান্তিক। তেমন বন্ধন জালকে কবি বলেছেনÑ মানুষ হিসেবে।

আর ‘নারী’ প্রবন্ধে তাদের নিয়ে ভাবলেন গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে, বললেন সৃষ্টির আদিতম বেদনা নাকি নারীর মধ্যে। রূপ, রস, গন্ধে তেমন বেদনা নারীর মধ্যে বিধাতা দিয়েছেন অকৃপণ হস্তে। শুধু তাই নয় এই সেই বন্ধন যা সকল সমাজের সকল সভ্যতার মূলভিত্তি। সমাজ বন্ধনের এই কাজটির একচ্ছত্র অধিপতি নাকি মেয়েরাই। আর সাম্য দ্রোহের কবি নজরুল জোরেশোরে উদাত্ত কণ্ঠে কাঁপিয়ে দিলেন অবিভক্ত বাংলার নরম কোমল পলিমাটি। ‘নারী’ কবিতায় নজরুল যেভাবে নারী জাতির জয়গানে উচ্ছ্বসিত মুখরিত সেটা আজও সমসংখ্যকের জন্য পরম নির্মাল্য। বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’
তেমন সময় থেকে আজ অবধি নারীদের চলার পথ সহজ, স্বাভাবিক আর নির্বিঘœ না হওয়াও পরিবেশ, পরিস্থিতির নির্মম পালাক্রম। এমন বিভেদের বেড়াজাল কঠিন প্রত্যয়ে ভাঙতে হবে ছোট পরিবার থেকেই। যা বৃহত্তর আকারে পুরো সমাজকে নাড়া দিতে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করবে। নারীদের অধিকারহীনতাকে সমূলে নস্যাৎ করতে নারীকেই তার মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানো সবার আগে জরুরি।

কবি গুরু আরও একটি অসাধারণ বাক্য নিবেদন করেছেন নারী সমাজের জন্য। যেমন যৌক্তিক, আধুনিক আর প্রচলিত অপসংস্কারবিরোধী। বিশ্ব কবির মতে, সভ্যতার যা কিছু অসঙ্গতি, দৈন্য, সংকট তার অনেকটা নারীকে যথার্থ স্থান আর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত না করার বিপরীত প্রতিক্রিয়া। সমাজের সমসংখ্যক যদি শৃঙ্খলিত অধিকার রহিত, স্বাধীনতা বঞ্চিত ও মর্যাদাহীনতায় আটকে পড়ে সেখানে বিভিন্ন স্থানে রুদ্ধতার জাল বিস্তৃত হবেই। যা সামাজিক শৃঙ্খলা, স্থিরতা আর স্বাভাবিক গতিপথকে ব্যাহত করবেই। মহিলা পরিষদের আরও দাবি সামনে আনা হয়।

নারীদের সফলতা নজরকাড়া হচ্ছে সন্দেহ নেই। কিন্তু যথাযথ সামাজিক ও পারিবারিক স্বীকৃতি না পাওয়াও সমাজ সংস্কারের বিপন্নতা। আর এখানেই সমসংখ্যক কেমন যেন থমকে যাচ্ছে, হোঁচট খাচ্ছে আর পেছনের দিকে হটছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কঠিন কঠোর সমাজ বাস্তবতায় নারী নিগ্রহ চিরাচরিত এক জুলুম। বর্তমানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুগে তেমন নির্যাতন অন-লাইনেও হচ্ছে নানামাত্রিক অপমান আর অসম্মানে। সংগত কারণে অধিকার, স্বাধীনতাই শুধু নয় বরং তার কর্ম সাফল্যের যথাযথ মর্যাদা  স্বীকৃতিও নারীদের এক জন্মগত অধিকার, পাওনা। সিদ্ধান্ত গ্রহণ আর রাজনীতিতেও তাদের এগিয়ে আসা জরুরি।

অপরাজিতা প্রতিবেদক

×