ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

শেকল ভাঙার যাত্রা

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ০০:৫০, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

শেকল ভাঙার যাত্রা

সাম্য আর দ্রোহের কবি নজরুলই ‘নারী’ কবিতায় শেকল

সাম্য আর দ্রোহের কবি নজরুলই ‘নারী’ কবিতায় শেকল ভাঙার গানের সচকিত সমাজের সমসংখ্যক নারীর জন্য। দীপ্ত কণ্ঠে আওয়াজ তোলেন- ‘মাথার ঘোমটা ছিঁড়ে ফেল নারী ভেঙে ফেল ও শেকল।’ বাঙালি নারীর অতি সাধারণ জীবনযাপন আশৈশব এক বঞ্চনার ইতিবৃত্ত। ক্ষুদ্র পারিবারিক আলয় থেকে বৃহত্তর সামাজিক আঙিনায় এমন সব অপদৃশ্য দেখতে আমরা অভ্যস্ত। তাই বলা যায় শেকল ভাঙার গান তো জন্মই যেন আজন্মের পাপের দম্ভ। নিপীড়নের চিত্র বহুবিধ এবং নিয়ত যন্ত্রণাদায়ক।

ব্র্যাকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দৃশ্যমান হয় একজন কন্যা শিশু প্রথমেই তার পারিবারিক আলয়েই বঞ্চনার শিকার হয়। গর্ভধারিণী আর জন্মদাত্রী জননীই তার কন্যাটিকে পুত্রের চাইতে কেমন যেন হাল্কা চোখে দেখেন। তেমন করুণ দৃশ্য বাসার খাবার টেবিল থেকে পারিবারিক হরেক ঘটনায় তারতম্যের ব্যাপারটি স্পষ্ট হওয়াও নিত্য দিনের যন্ত্রণাকাতর অনুভব। অবশ্য অবোধ কন্যাটি বুঝতেই পারে না ফারাকের বিষয়টি। ধরেই নেয় এটাই সামাজিক ও পারিবারিক ন্যায্যতা।

সেটা আমলে নিয়েই কন্যা শিশু যেমন বড় হতে থাকে সেভাবে পুত্রও কিছু বিষয়ে অগ্রগামী হতে বাধা পায় না। মেয়ের বেলায় এটা করা যাবে না সেটা অনুচিত। হরেক মাত্রার বিধিনিষেধে স্বাধীন মনোবৃত্তিতে গড়ে ওঠাও যেন পিছু হটে যাওয়া। আর সব সুবিধা পাওয়া পুত্র সন্তান ভেতরের বোধে এক ধরনের সৌভাগ্যের বলয় বৃত্তিতে নিজেকে বেশ অগ্রগামী ভাবতেও পিছপা হয় না। কিন্তু কোনো এক সময় কন্যার।

যখন বৃহত্তর সামাজিক আঙিনায় নিজেদের অবস্থান জানান দেয় তখন থেকেই বুঝতে শিখে যায় তার সহোদর ভাইটির সঙ্গে আসলে তার কোনো ফারাকই নেই। মনন-মেধায় তো নয়ই। বরং শারীরিকভাবে অপেক্ষাকৃত কোমল আর মানসিকভাবে হৃদয় বৃত্তির স্পর্শকাতর অনুভূতিই তারতম্যের কঠিন বেড়াজাল। যেমন বোঝা-তেমনই নিজের অধিকার সচেতন হওয়া।

তাই পরিবারই বুঝিয়ে দেয় পুত্র-কন্যার প্রভেদ-ফারাক। পরবর্তীতে সামাজিক অপসংস্কার তো দুই পা বাড়িয়েই থাকে সমসংখ্যক নারীর ন্যায্য অধিকার হরণের হরেক মাত্রার দুর্ভোগে। সম্প্রতি বাংলাদেশে এক অপ্রতিরোধ্য ছাত্রশক্তির উদাত্ত আহ্বানে পুরনো সমাজের ভিত নড়ে ওঠে। পাশাপাশি বদলে যাওয়া এক নতুন বাংলাদেশের নব সূর্যোদয় কেমন যেন আলোকের উজ্জ্বলতম শিখায় অনন্য দিগন্ত সামনে নিয়ে এলো।

সেখানেও অগ্রণী সারিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমাজ। লিঙ্গ সমতায় জোর আওয়াজ তোলার বার্তায় নতুন করে হরেক বৈষম্য সামনের পথ রোধ করে। শুরু হয় আর এক গণজাগরণের নব অধ্যায়। তেমন উদাত্ত বিপ্লবী কণ্ঠে বাংলাদেশে যে জোয়ার তাতে ভেসে যায় নানামাত্রিক অতি পুরনো অপসংস্কারও। নারীরাও বসে থাকেনি। সমান তালে এগিয়ে চলে এতদিনের বঞ্চনার প্রতিকারে সোচ্চার হয়ে সংঘবদ্ধ হতেও সময় লাগেনি। তারই সচিত্র প্রতিবেদন মধ্যরাতে শাহবাগে নারী সমাজের শেকল ভাঙার ধ্বনি প্রতিধ্বনি।

গত শুক্রবার রাতে নারীরা একসঙ্গে সম ব্যানারে মধ্যরাতে শাহবাগে জড়ো হন। রাত ১১টা ৫৯ মিনিটে শুরু করা হয় এর শুভ পদযাত্রা, হাতে মশাল, বিভিন্ন সমতাভিত্তিক স্লেøাগানে শোভা যাত্রাটি তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য আর কর্মকে সকলের মাঝে তুলে ধরে। ১৫ বছরের স্বেচ্ছাচারী শাসকের অবসান জাতির জন্য শুভ কর্ম পথে ধর নির্ভয় গান’ নতুন সময়কে উদ্দীপ্ত করে দেয়। সমস্বরে উচ্চারিত হয় স্বাধীন দেশে পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা নারীদের জন্য এক অনমনিয় ইচ্ছা আর কর্মস্পৃহা। 
২০২০ সালে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ‘শেকল ভাঙার পদযাত্রা’র যে দাবিগুলো তুলে ধরা হয়েছিল নতুন সরকারের কাছে, আমরা সেসব দাবিই তুলে ধরছি। এর মধ্যে রয়েছে- সারা দেশে ধর্ষণ-যৌন সহিংসতায় যুক্তদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক ও ন্যায্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। হাইকোর্টের নির্দেশনাযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি, বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে যৌন নির্যাতনবিরোধী সেল কার্যকর ও পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।

×