ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩০ ভাদ্র ১৪৩১

অগ্রসর গারো কন্যা

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ০১:৩০, ৩০ আগস্ট ২০২৪

অগ্রসর গারো কন্যা

গারো সমাজ। পরিচিত আদিম জনগোষ্ঠীর অন্যতম পাহাড়ি এক জাতিসত্তা

গারো সমাজ। পরিচিত আদিম জনগোষ্ঠীর অন্যতম পাহাড়ি এক জাতিসত্তা। যেখানে শুরুতেই মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের গঠন প্রক্রিয়ায় অধিকার সচেতনতাও ছিল জীবন এগিয়ে নেওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়। টাঙ্গাইলের মধুপুর অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে গারো নারীদের জীবন লড়াই চিরায়ত এক করুণ আখ্যান। বেঁচে থাকার তাগিদে দিনমজুরির পেশাই ছিল তাদের অন্যতম আর্থিক উপায় অবলম্বন। যেখানে গ্রামের মাতব্বর, মহাজনদের অমানবিক নিপীড়ন মুখ বুজে সহ্য করাও ছিল এক দলিত অপসংস্কার। দলিতই বটে।

শোষণ, বঞ্চনার ইতিবৃত্তে নারীকেন্দ্রিক মাতৃতান্ত্রিক পরিবারও তাদের যথার্থ মর্যাদা আর কায়িক শ্রমে বরাবরই নিষ্পেশিত এক নৃগোষ্ঠীর চরম আকাল। যুগ-যুগান্তরের পাহাড়ি এমন সব জাতিসত্তার জীবন-আচার-আচরণ অপরিবর্তিত থেকেছে বিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নেও। যেহেতু পরিবার, বংশপঞ্জি এমন কি সম্পত্তি সমর্পণও মায়ের দিক থেকে হয় সেখানে মাতৃত্বের অধিকারও দৃশ্যমান হয়েছে বহুযুগ ধরে। সেই বংশ পরম্পরা অধিকার স্বাধীনতার মাত্রায় গারো নারীদের জীবন ও কর্মে এসেছে আধুনিকতার নবদ্যুতির আলোকিত অধ্যায়।

আর প্রচলিত প্রবাদে বারবার উচ্চারিত শিক্ষা জাতির মেরুদ-। সেটা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য। আদিম নৃগোষ্ঠীর বেলায়ও তা ক্রমান্বয়ে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। একজন মাঠে হাল চাষ করা কৃষিজীবী নিরক্ষর মা আজ তার কন্যা সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে এগিয়ে আসছেন। যা তিনি নিজেই পারেননি। তেমন আলোকিত বলয় কন্যাদের কাছে নিয়ে যেতে আনন্দ আবেগে এগিয়ে আসার তথ্য উপাত্ত গণমাধ্যমের খবর হচ্ছে।

এখন সক্ষম কর্মজীবী গারো মা তার সংসার খরচ থেকে সামান্য অংশ বাঁচিয়ে কন্যা সন্তানদের শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যয় করার দৃশ্য সত্যিই  চমকপ্রদ। গারো সমাজ এখনো দারিদ্র্যপীড়িত পিছিয়ে পড়া এক নৃ-গোষ্ঠী। তার পরও সারা মাসের যে যৎসামান্য আয় সেখান থেকেই তারা সন্তানদের শিক্ষার আলো দিতে উদগ্রীব ও উৎসাহিত। ফলে টাঙ্গাইলের হরেক গ্রামের গারো সমাজের মধ্যে নারী শিক্ষার আধুনিক বলয় নিয়ত সম্প্রসারিত হওয়ার চিত্র সত্যিই সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের এক নিত্যনতুন পরিধি তো বটেই।

এক সামাজিক জরিপে উঠে আসে মধুপুর অঞ্চলের অর্ধশত গ্রামে ২০ হাজার গারো পরিবার অবস্থান করে। সেখানে নাকি ৯৩%ই শিক্ষায়, নতুন সংস্কৃতিতে এগিয়ে যাচ্ছে পুরনো হরেক জঞ্জাল পশ্চাদগামী করে। সফলতাও আসছে পালাক্রমে। সিংহভাগ পরিবারই দারিদ্র্য সীমায় অবস্থান করছে। কিন্তু শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়ছে ৯৩% মানুষের জীবনে।

নারী-পুরুষ এক সঙ্গে। শিক্ষার হার বাড়লে সেখানে আর্থিক সক্ষমতাও নজরকাড়া হয়। অনুষঙ্গ হিসেবে ক্ষমতায়নও দৃষ্টিনন্দন। নারী শিক্ষার হার ঊর্ধ্বগতি হওয়ার ফলে কর্মযোগে তাদের অংশ নেওয়া আজ হাতেগোনার অবস্থায় না থাকাও পরিস্থিতির ন্যায্যতা। এমনিতে পাহাড়ি নৃগোষ্ঠী সমতল ভূমির মানুষদের থেকে নানা কারণে আলাদা। পরিবেশ, ভাষা, নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি সবটাই ভিন্নধারার অন্যরকম গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনাচরণ।

আরও চমকৃৎ বিষয় নানামাত্রিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গারো সমাজের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বলয়ে আধুনিকতার অনন্য যাত্রা। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের মূল দ্যোতনা ঝংকৃতই শুধু নয় বরং সময়ের পালাক্রমে তা আধুনিকতার বলয়েও সম্পৃক্ত হচ্ছে। মিশনারি, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৪ হাজার গারো শিশু পড়াশোনা করছে। যেখানে মেয়ে শিশুর সংখ্যাও চোখে পড়ার মতো।

সংখ্যায় নাকি ৫৮%। জানা যায় গত শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নেও গারো কন্যা শিশুরা লেখাপড়ায় খুব বেশি আগ্রহী না হওয়ার অপদৃশ্যও হতাশ হওয়ার মতোই। কৃষি প্রধান গারো সমাজের  মূল অর্থনীতি চাষাবাদেই গারো নারীরা তাদের মূল্যবান শ্রম বিনিয়োগ করছে। তা নিজের স্বল্প জমি হোক কিংবা মহাজন-জোতদারদের বৃহদাকার ভূমি ও হালচাষে জীবন চালানো গারো নারীরা আজ অন্য আলোকে নিজেদের প্রমাণ করে সমাজ সভ্যতায় অবদান রেখে যাচ্ছে।

খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী গারো সমাজের প্রয়াত ধর্মযাজক ফাদার ইউজিন হোমরিক দুর্গম এই জনপদে দুটি মিশনারি স্কুল প্রতিষ্ঠান করেন। সঙ্গে অর্ধশতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় তৈরি করে শিক্ষা সম্প্রসারণে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখেন। শিক্ষার তেমন সূতিকাগার আজ গারো সমাজের নতুন আলোর পথ প্রদর্শক। সেখান থেকে লেখাপড়ার মহতি কার্যক্রমেরও শুভযাত্রা। আর আধুনিক প্রযুক্তির বলয়ে তার মাহাত্ম্য বিকিরণ করে যাচ্ছে।

কন্যা শিশুরাও তেমন পাঠক্রম থেকে কোনোভাবেই বঞ্চিত হচ্ছে না। শুধু তাই নয় দরিদ্র মেয়েদের জন্য শিক্ষাবৃত্তির সুবন্দোবস্ত গারো কন্যাদের এগিয়ে যাওয়ার আর এক মহতি উদ্যোগ তো বটেই। তার ওপর আছে থাকার জন্য নিবাস হোস্টেল।

×