ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩০ ভাদ্র ১৪৩১

বন্যায় দুর্ভোগ

রাজু মোস্তাফিজ

প্রকাশিত: ০১:২৪, ৩০ আগস্ট ২০২৪

বন্যায় দুর্ভোগ

স্মরণ কালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে দেশের একটি অংশ

স্মরণ কালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে দেশের একটি অংশ। হঠাৎ অতিবৃষ্টি ও উজানের ঢলে তলিয়ে গেছে দেশের উত্তর-পূর্ব, পূর্ব-দক্ষিণ পূর্বের জেলাগুলো। এগুলো হচ্ছে ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার, লক্ষ্মীপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ। এর মধ্যে ফেনীর পশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করেছে।

ভারি বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলের কারণে এসব অঞ্চলের মেঘনা, মুহুরী কহুয়, মনু, মাইনি, ধলাই, কাচালং, সাঙ্গু, শিষক, সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রায় ৩৬ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। চরম দুর্ভোগে পড়েছে এসব এলাকার মানুষ। সবচেয়ে কষ্টে আছে নারী এবং শিশুরা। তাদের সঙ্গে বাড়ির গবাদি পশুগুলোও।

উজানের ঢল আর নদীর প্রবল ¯্রােতে ভেসে গেছে তাদের শত শত গরু, ছাগল, মহিষ আর হাজার হাজার হাঁস-মুরগি। বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে মানুষের সঙ্গে তাদের গবাদি পশুগুলোও আশ্রয় নিয়ে আছে। শুধু জীবন বাঁচানোর জন্য। টানা এক সপ্তাহ থেকে মানুষ পানিবন্দি হয়ে চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। নিরন্ন নিরাশ্রয় মানুষগুলোর পর্যাপ্ত ত্রাণ নেই, নেই কাজের ব্যবস্থা, ঘরে ঘরে প্রচ- খাদ্যাভাব। 
বন্যাপর্যুস্থ এবং অকাল কবলিত মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে থাকতে শুকিয়ে কঙ্কালের মতো হয়ে যাচ্ছে। শিশুরা হয়ে পড়েছে দারুণ অপুষ্টি আক্রান্ত। দুস্থ মাতা মহিলারা একটানা অভুক্ত থাকতে থাকতে শারীরিকভাবে কাহিল হয়ে পড়েছে। ঘরে ঘরে করছে অখাদ্য-কুখাদ্য ভক্ষণ। প্রতিটি ঘরে ডায়রিয়া, রক্ত আমাশয় ও জ্বরে আক্রান্ত শিশু এবং নারীরা। পানিতে থাকতে থাকতে তাদের হাত-পায়ে ঘা দেখা দিয়েছে।

এই হলো বন্যাকবলিত নারী আর শিশুসহ সব মানুষের চিত্র। কি যে এক দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে ওই অঞ্চলের মানুষ না দেখলে বিশ^াস করা যাবে না। ১২ জেলায় বন্যাকবলিত হয়েছে কমপক্ষে প্রায় ১০ লাখ নারী ও শিশু। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে অমানবিক জীবনযাপন করছে বহু নারী ও শিশু। কি দুর্গতিতে তারা দুঃসহ দিনরাত অতিক্রম করছে।

পানি নেমে গেলেও এদের অনেকের বাড়িঘরে ফিরতে হবে দেরি। অনেকের ঘর বন্যার প্রবল ¯্রােতে ভেসে গেছে। কারও কাঁচা টিনের ঘর বসে পড়েছে। সরকার যদি তাদের ঘর তৈরির ব্যবস্থা না নেয় তা হলে এসব ঘরের নারী ও শিশুসহ পরিবারের লোকজন খোলা আকাশে রাত কাটাবে। এ জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা লক্ষ্মীপুর ও ফেনী জেলা।

লক্ষ্মীপুর জেলার প্রায় ১শ’ ৫০ গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। লক্ষ্মীপুরের কোমলনগর, রামগতি, রায়পুর রামগঞ্জ উপজেলা, নোয়াখালী জেলার সেনবাগ বেগমগঞ্জ, উপজেলা কক্সবাজারের রামু উপজেলার গর্জনিয়ার, ক্যাজরবিল, ডেঙ্গারচর, পশ্চিম বোমাংখিল, জুমাপাড়া, রাজঘাট, জাউচপাড়া, ম্যারিচ্যাচার জুমছড়ি, পূর্ব জুমছড়ি এলাকাসহ অসংখ্য গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে আছে। 
 নোয়াখালীর দত্তেরহাট সংলগ্ন মাস্টারপাড়া এলাকার কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক শিরীন আক্তার, চরজবারদ্দি ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হাজরা সুলতানা জানান অবিরাম বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলের কারণে মাত্র তিন দিনের মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলায় স্মরণ কালের বন্যা চলছে। তাদের বাড়ি শহরের হলেও অধিকাংশ বাড়িতে হাঁটুপানি। এমন পরিস্থিতি কোনো দিনই তারাা দেখেননি।

তারা সরকারসহ দেশবাসীর কাছে বন্যাকবলিত মানুষের সহায়তার অনুরোধ করেন। তারা আরও জানান পুরুষ মানুষরা দুর্যোগ কিছুটা মোকাবিলা করলেও নারী ও শিশুরা চরম কষ্টে পড়েছে। অনেকের ঘরে খাবার থাকলেও রান্না করার মতো কোনো অবস্থা নেই। এ মুহূর্তে তাদের শুকনা খাবার জরুরি। পাশাপাশি গবাদিপশুর খাবারও চরম সংকট। মানুষের পাশাপাশি গবাদি পশুর খাবার জরুরি। ইতোমধ্যে খাবারের অভাবে অনেক গরু ছাগল ও মহিষ মারা গেছে। 
এত কষ্টেও এসব বন্যাকবলিত এলাকার নারীদের জীবন থেমে নেই। তাদের ছুটতে হচ্ছে। কারও ঘরে এক হাঁটুপানি। আবার কেউ বন্যা আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। কক্সবাজারের রামু উপজেলার ডেঙ্গারচর গ্রামের আকলিমা বিবি ও ময়না খাতুন ডিঙি নৌকায় ছাগলগুলোকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে গাছের পাতা সংগ্রহ করার জন্য। নানা লাঞ্ছনা সহ্য করেও গ্রামবাসীদের বাড়ি থেকে পাতা সংগ্রহ করতে হয়। উপায় যে নেই।

এমনিতে নিজেরাই চরম খাদ্য কষ্টে দিন কাটাচ্ছে তার ওপর তাদের গৃহপালিত পশুদের খাবার সংগ্রহ।  চারদিকের চারণ ভূমিতে শুধু পানি আর পানি। বাঁশগাছের পাতাসহ বিভিন্ন গাছের পাতায় একমাত্র খাদ্য এই গৃহপালিত প্রাণীগুলোর। দুই নারীসহ দেশের বন্যাকবলিত জেলাগুলোর গ্রামীণ চিত্র প্রায় একই রকম। কারণ তাদের বিপদে একমাত্র অবলম্বন এই গৃহপালিত পশুগুলো। কারণ বাড়ির গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি মহিলারাই লালন পালন করে থাকেন। সংসারের একমাত্র সম্পদ বলতে এগুলো।

জরুরি কোনো প্রয়োজনে গরু-ছাগল বিক্রি করেই তাদের প্রয়োজন মেটায়।
বন্যা আমাদের দেশে নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এবারের চটগ্রাম বিভাগের বন্যা অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে পানির তোড়ে সব কিছু ডুবে আছে। শুকনা জায়গা খুঁজে পাওয়া কঠিন।

×