নারীরাই তৈরি করছেন স্যানিটারি ন্যাপকিন
কুড়িগ্রামের কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের জোতগোবর্ধন গ্রামের উদ্যোক্তা খাদিজা পারভীন খুশি। খুব ছোট বেলায় বিয়ে হয় তার। স্বামী-সংসার দেখাশোনার পরও পড়াশোনা চালিয়ে যান। অভাবের কারণেই পড়াশোনার পাশাপাশি একটি বেসরকারি সংস্থায় স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজে যোগ দেন। দুই বছর পর তার প্রজেক্টের মেয়াদ শেষ হয়।
এর নিজ এলাকার প্রান্তিক অসচ্ছল ২০ জন মহিলাকে নিয়ে ‘কল্যাণী নারী কল্যাণ সমবায় সমিতি গড়ে তোলেন।’ পরে ইউএনসিডিএফ-এর স্বপ্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি শুরু করেন। বর্তমানে তাঁর কারখানায় ১২৪ জন নারী স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছে।
শহরের ত্রিমোহনী এলাকায় তৈরি হয়েছে কল্যাণী স্যানিটারি ন্যাপকিন কারখানা। নারীরা কারখানায় আলাদা আলাদা ভাগে বিভক্ত হয়ে কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ মেডিসিন কটন দিয়ে রোল তৈরি করছেন, কেউ তৈরি রোলে নেট পেঁচিয়ে প্যাড তৈরি করছেন, কেউ প্যাডগুলোকে অটোক্লেভ মেশিনে জীবাণুমুক্ত করছেন।
খাদিজা পারভীন জানান, উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় ডিস ব্যবসায়ী মো. মাহবুব মিলনের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। পরিবারে অভাবের কারণে একটি বেসরকারি সংস্থায় স্বাস্থ্যকর্মী হিসাবে চাকরিতে যোগদান করি। ২০১৯ সালে ওই সংস্থার প্রজেক্ট শেষ হয়ে গেলে আমি আবার বেকার হয়ে পড়ি। পরে এলাকার অসচ্ছল, বিধবা ও তালাকপ্রাপ্ত নারীদের নিয়ে কল্যাণী নারী কল্যাণ সমবায় সমিতি গঠন করি।
শুরুর দিকে শুধু সঞ্চয় করবার মানসিকতা থেকেই এই সমিতি গড়ে উঠলেও পরবর্তী সময়ে ইউএনসিডিএফ এর স্বপ্ন প্রজেক্ট তাদের ১৫ দিনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তাদের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের ৫০ হাজার টাকা ও সমিতির ২০ জন সদস্য প্রত্যেকের পাঁচ হাজার করে টাকার শেয়ার নিয়ে মোট দেড় লাখ টাকায় শুরু করেন কল্যাণী স্যানিটারি ন্যাপকিন কারখানা।
তিনি নিজে ন্যাপকিন প্যাড তৈরির কাঁচামাল ঢাকা থেকে ক্রয় করে নিয়ে আসেন। সে সময় ইএসডিএফ নামের একটি এনজিও তাঁদের কাজে সহযোগিতা করার জন্য ১০টি সেলাই মেশিন প্রদান করেন। শুরু হয় কল্যাণী স্যানিটারি ন্যাপকিন কারখানার।
তিনি জানান, শুরুর দিকে কারখানায় স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি শেষ হলে বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল। তার কারখানায় কোনো পুরুষ কর্মী নেই। একজন নারী বাজারে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রি করছে এটি সমাজের অনেকেই সহজভাবে নেয়নি। এছাড়াও প্রতিযোগী অন্যান্য পুরুষ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে হুমকি আসতে থাকল। সেই সময় আমার সহকর্মীরা আমাকে সাহস জুগিয়েছিল।
এরপর নিজেই একজন সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়েই মার্কেটিং শুরু করলাম। প্রথম কিছুদিন মানুষের কটুকথা, বাঁকা দৃষ্টিতে তাকানো এসব খুবেই বিব্রত লাগতো। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল আমি পারব। আমি কাজটা বন্ধ করে দিলে এই ২০ জন নারী চরম সংকটে পড়বে। এই দিয়ে তাদের পরিবার চলতো। এখন আমার কারখানায় ১২৪ জন নারী কাজ করছেন।
তিনি বলেন, আমরা শুরু থেকেই কোয়ালিটিতে কোনো ছাড় দেইনি। সাধারণত অন্যান্য স্যানিটারি ন্যাপকিন প্যাড অনেকেই গার্মেন্টসের ঝুট কাপড় দিয়ে তৈরি করেন। সেখানে স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে তাই আমরা মেডিসিন কটন, নরমাল কটন দিয়ে প্যাড বানাতে শুরু করি। আমাদের স্যানিটারি প্যাড নরম ও দীর্ঘ সময় পানি শোষণ করতে সক্ষম হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আমরা কারখানায় কর্মী বাড়াতে থাকলাম।
বর্তমানে কারখানায় ১২৪ জন কর্মী কাজ করছেন। এরা কারখানায় চক্রাকারে কাজ করেন। কেউ সপ্তাহে তিনদিন কাজ করেন, কেউ করেন দুইদিন। কারণ একসঙ্গে ১২৪ জন কর্মীর বসবার ব্যবস্থা নেই। একজন কর্মী দৈনিক ৮০০ থেকে ১২০০ পর্যন্ত প্যাডরোল তৈরি করতে পারে। প্রতিটি প্যাডরোল তৈরি বাবদ তাঁকে ২০ টাকা করে দেওয়া হয়। দশটি ন্যাপকিন প্যাড বিশিষ্ট একটি প্যাকেটের উৎপাদন ব্যয় ৩৫ থেকে ৩৮ টাকা।
আমরা বাজারে পাইকারি বিক্রি করি ৪৫টাকা দরে। তারা সেটিকে ৭০ টাকা থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি করে। বর্তমানে কারখানার এসকল নারী কর্মীরা মাসে ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা আয় করে। সব খরচ বাদ দিয়ে এই কারখানা থেকে মাসে আমার ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় হয়।