ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

মৎস্যশিল্পে মেয়েরা

শিউলী আহমেদ

প্রকাশিত: ০১:১৬, ৯ আগস্ট ২০২৪

মৎস্যশিল্পে মেয়েরা

মৎস্যশিল্পে মেয়েরা

ইচ্ছে শক্তি মানুষকে অনেক দূর নিয়ে যেতে পারে। ঘরে ঘরে মেয়েরা তার প্রমাণ দিচ্ছে। তারা শিক্ষিত হচ্ছে, উপার্জন করছে, সংসার সামলাচ্ছে, সন্তানও পালন করছে। আর উপার্জন শুধু চাকরির মাধ্যমেই নয় বরং নিজে উদ্যোক্তা হচ্ছেন। ফলে, নিজের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অন্যের জন্যও কাজের ব্যবস্থা করছেন। এমনকি মাছ বিক্রিও করছেন।

আমাদের এই পরনিন্দার সমাজে একটা শিক্ষিত মেয়ের মাছের ব্যবসা করা দুঃসাহসী পদক্ষেপই। কুমিল্লার মেয়ে রোমানা আগানগর ডিগ্রী কলেজ থেকে ২০১০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকায় একটি আইটি ফার্মে রিসিপশনে চাকরি নেন। আইটিতে কাজ করার আগ্রহ থেকে কম্পিউটার সাইন্সে ৪ বছরের ডিপ্লোমা এবং একই প্রতিষ্ঠানে ৫ বছর ‘ক্লাইন্ট সাপোর্ট’ বিভাগে চাকরি করেন। কোভিডের সময় প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খুব হতাশ হয়ে যান পরিবারের ভরণপোষণ নিয়ে।
রোমানার বিয়ে হয় ২০১৮ সালে, চাঁদপুরে। ঢাকায় এসে কখনো মাছ কিনে খেতে হয়নি তাকে। সব সময় শশুর বাড়ি থেকেই মাছ নিয়ে আসেন। ঠিক করলেন মাছ নিয়েই কাজ করবেন। রোমানা বলেন,‘আমার বর শুনে হাসে- বলে পাগল নাকি! মাছ বাজারে গিয়ে দেখে কেনার জিনিস। অনলাইনে শুধু ছবি দেখে মাছ কিনবে কে?’ স্বামীর কথায় একটু হতাশ হলেও দমে যাননি রোমানা। মাথায় ঘুরঘুর করছে রেডি-টু-কুক সার্ভিস।

অনলাইনে পেজ খুলেন- ‘মাছ আছে’। সেখানে নিজের বাসার জন্য কেনা কিছু মাছের ছবি পোস্ট দিলেন। ৩ দিন পর প্রথম অর্ডার পেয়ে গেলেন। কিন্তু ডেলিভারি, প্যাকেজিং সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা নেই তার। রোমানা বলেন, ‘প্রথম অর্ডারের সেই অনুভূতি কখনোই কাউকে বলে প্রকাশ করতে পারব না। সেদিন লাভ ছিল টাকার অংকে শূন্য। বরং নিজের পকেট থেকে ৬৫ টাকা গচ্চা দিতে হলো। কিন্তু ক্রেতা বুঝতেই পারেননি যে, উনি আমার প্রথম গ্রাহক। উনার ফিডব্যাক মনে হলে আজো মন খুশিতে কেঁদে ওঠে।

সেই আপু এরপর আমার থেকে মাছ নিয়েছেন আরো ১৭-১৮ বার। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আমার পুলিশ বর শুরুতে একটু লজ্জা পেলেও পরবর্তীতে সাপোর্ট দিয়েছেন। মাছ ওজন দেওয়ার মেশিনটা সেই আমাকে ২৩০০ টাকায় কিনে দিয়েছিল। আমার উদ্যোগের প্রথম ইনভেস্ট। এখন কোথাও গেলে তিনি নিজেই সবার আগে বলেন, আমার বউ উদ্যোক্তা। অনলাইনে নদীর মাছ বিক্রি করে।’
মাছওয়ালি, জাইল্লা আরও অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে রোমানাকে। তবু থেমে যাননি। সিংগাপুর, লন্ডন, আমেরিকা, সৌদি আরব, দুবাই, কাতারে ৭০ কেজি মাছ-মাংস রপ্তানিও করেছেন। ঢাকা ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় মাছ সরবরাহ করে যাচ্ছেন রোমানা। তিনি বলেন, ‘আমার শাশুড়ি আমার সঙ্গে ভোর ৪ টায় ওঠে মাছের ঘাটে যান। আত্মীয়স্বজন যারা কটু কথা বলেছেন, আজ তারাও আমার কাছ থেকে মাছ কিনে। লেগে ছিলাম বলেই আজ আমার অর্জন সবার কাছে গল্প করার মতো, গর্বের রসদ।’

রোমানা উপহারস্বরূপ আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে ‘স্মার্ট নারী উদ্যোক্তা’ হিসেবে পেয়েছেন প্রণোদনা। প্রত্যেকটা কাজেই বাধা বিপত্তি আসবে। দেখার বিষয় সেই বাধা বিপত্তিকে আপনি কিভাবে নিচ্ছেন। হতাশ হয়ে থেমে গেলে হবে না। লড়াই করে এগিয়ে যেতে হবে। রোমানা আড়ত থেকে মাছ এনে বিক্রি করে, নিজের লভ্যাংশ রেখে আড়তদারকে টাকা দেন। নিজের উদ্যোগের টাকায় এখন মা-ভাইয়ের দেখাশোনা করতে পারেন।

শাশুড়িকেও বাড়িতে ফ্রিজ কিনে দিয়েছেন। অনেক নতুন পণ্যও সংযোজন করেছেন ক্রেতাদের চাহিদানুসারে। ঘরে বসেই এখন মাসে তার লাখ টাকার পণ্য বিক্রি হয়। ইলিশের মৌসুমে দৈনিক লাখ টাকার ইলিশ বিক্রি হয়। রোমানা বলেন, ‘আমাকে এখন ৯টা-৫টা অফিস করতে হয় না। আমার সন্তান এখন ২৪ ঘণ্টা তার মা’কে কাছে পায়। আমার সংসারে নিজের যা প্রয়োজন আনন্দচিত্তে কেনাকাটা করি।’
উদ্যোক্তার জীবনে শেখার কোনো শেষ নেই। দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য রোমানা অনলাইনে ক্লাস, বিভিন্ন ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ এবং ‘উই’ থেকে মাস্টার ক্লাসও করেছেন- যা তাকে একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়ার সব খুঁটিনাটি শিখিয়েছে। আবেগ্লাপ্লুত হয়ে জানান, ‘আমার ঝুলিতে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে কিছু অ্যাওয়ার্ডও যোগ হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ।

আমি এখনো শিখছি। সফলতার কোনো শেষ নেই। তাই সফল হওয়ার জন্য এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ স্বামী আর ২ ছেলেকে নিয়ে সুখের সংসার তার। একটা সময় অনেক কষ্ট করেছেন। এখন ভালো আছেন। দুই সন্তানকেই জন্ম দেয়ার ১ সপ্তাহ আগে পর্যন্ত তিনি কাজ করে গেছেন। আবার ১৫ দিন পর থেকে আবার কাজ শুরু করে দেন। রোমানার পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে- লোকাল চাঁদপুরের ইলিশ ও মেঘনা নদীর সব তাজা মাছ।

সঙ্গে আছে সামুদ্রিক মাছ, ঘরে পালা কবুতরের বাচ্চা, দেশি হাঁস, রাজ হাঁস, চিনা হাঁস, দেশী মুরগি, টার্কি মুরগি, গরুর মাথা, মগজ, বট, কুমিল্লা মাতৃভান্ডারের রসমালাই, দেশী গরুর খাঁটি দুধ, খাঁটি গুড়। প্রতিটা পণ্য রোমানা নিজে বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে দেখে বেছে কিনে আনেন। আর ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী রেডি টু কুক করে দেন। তার অনলাইন পেজ ‘মাছ আছে’ নিয়ে আরো দূরে এগিয়ে যাক রোমানা।

×