ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১

যমুনার চরে জীবন হাসে

নীলিমা জাহান

প্রকাশিত: ০১:৪০, ৫ জুলাই ২০২৪

যমুনার চরে জীবন হাসে

যমুনা নদীর বিস্তীর্ণ চরে বসবাসকারী নারীরা এখনো আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া পায়নি

যমুনা নদীর বিস্তীর্ণ চরে বসবাসকারী নারীরা এখনো আধুনিক সভ্যতার ছোঁয়া পায়নি। তাদের জীবন-যাপন সেকেলে।  এখনো অনেক বিধবা, মধ্য বয়সি এবং প্রায় বুদ্ধ নারীরা ব্লাউজ পরেন না। শুধু মোটা শাড়ি পরে শরীর আবৃত করে সংসারের যাবতীয় কাজ করেন। এ সব মহিলার কাছে  আধুনিক পোশাক, কসমেটিক দ্রব্যাদি অচেনা। তবে কসমেটিক দ্রব্যাদির মধ্যে ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী ¯েœা-পাউডার ও নারিকেল তেল তাদের কাছে কসমেটিক হিসেবে পরিচিত। পারিবারিক আচার অনুষ্ঠানে এসব কসমেটিকই তাদের ব্যবহার করতে হয়। শহরের বিউটি পার্লার, দামি শাড়ি ব্লাউজ চরের নারীদের কাছে স্বপ্ন।
কৃষক পরিবারের নারীরা যেমন উদয়-অস্ত পরিশ্রম করেন। কখনো কখনো গভীর রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করেন। চরের নারীরাও ঠিক তেমন। তাদের পরিশ্রম পরিবার প্রধান কৃষক পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। বরং ক্ষেত্র বিশেষে পরিশ্রম বেশি হয়ে থাকে। বন্যা ভাঙন, খরা ফসল তোলার মৌসুমে নাওয়া-খাওয়ার সময় পান না। তবে পরিবারের সদস্যদের জন্য নিত্যদিন রান্না করে তিন বেলা খাবারের জোগান নারীরাই দেন। 
প্রবল ভাঙন, ভূমি ক্ষয়, বার বার বন্যা, ঝড়, ক্ষুধা-বঞ্চনা আর দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত সিরাজগঞ্জের যমুনা চরের মানুষ। তারা সংগ্রাম করে বেঁচে আছেন। প্রতিনিয়তই অভাব আর সীমাহীন দারিদ্র্যতার কবলে কেবলই তাদের হাহাকার। এর সঙ্গে প্রকৃতির আরেক দুর্যোগ শোক-জ্বরা-ব্যাধি জীবনকে দুর্বিষহ করলেও থেমে থাকে না হাজেরা, তফুরা, খোদেজা, চানভানু, করিমন বেগমদের মতো হাজারো নারীর জীবন। তবে অবিরাম জীবন সংগ্রামী যমুনা চরের নারীরা জীবনের কাছে হার মানতে শিখেনি। 
বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলের হাজার হাজার ঘরবাড়ি, শস্যখেত বানের পানিতে তলিয়ে যায়। আয়-রোজগারহীন দরিদ্র ভূমিহীন হাজার হাজার নারী-পুরুষের জীবন হয়ে পড়ে বিপন্ন। নিরুপায় অনেকেই ঘরের টিন, গৃহে পালিত গরু-ছাগল, ভেড়া হাঁস-মুরগি বিক্রি করে কিছুদিন সংসারের চাকাকে সচল রাখে। ভূমিহীন নিঃস্ব দিনমজুররা অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবনযাপন করে। অপুষ্টিজনিত কারণে এ সময় রোগাক্রান্ত হয়ে অনেক নারী, শিশু ও বয়স্করা অকাল মৃত্যুর শিকার হয়। নদী ভাঙনে বার বার বসতবাড়ি স্থানান্তর ওদের নিত্যসঙ্গী। তবুও তারা চরের মাটি কামড়ে পড়ে আছে। নারীরাই বেশি বঞ্চনার শিকার। 
যমুনার চরে নারীদের বেঁচে থাকার সংগ্রামী জীবন কাহিনী বড়ই বিচিত্র। জীবনের অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত যমুনার চরের হাজার হাজার নারী নানা সামাজিক বঞ্চনায় দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে। অসুখে নেই চিকিৎসা। ঝাড়-ফুঁক আর কবিরাজের নির্দেশনা ওদের বেঁচে থাকার দাওয়াই। গর্ভবর্তী ও প্রসূতি মায়েদের অবস্থা সেই আদিম সভ্যতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। সারাদিনে যা রোজগার হয়, তাতে চালিয়ে নিতে হয় সংসার। বার বার যমুনার সঙ্গে লড়াই করে চরের নারীরা ক্লান্ত-বিপর্যস্ত। ওদের জীবন মান নিয়ে তেমন কেউ কাজ করে না। 
আর এসবকিছু চিন্তা করেই সিরাজগঞ্জে গৃহিত হয়েছিল উপজেলা পর্যায়ে ইউজেডজিপি আর ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউপিজিপি প্রকল্প। ইউএনডিপির সহায়তায় স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে এসব প্রকল্প নারীদের উন্নয়নে কাজ করেছে। এক্ষেত্রে সচল হয়েছে ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদ। তারা চরের নারীদের ভাগ্যোন্নয়নে নানামুখী প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে। সেলাই প্রশিক্ষণ, ধাত্রী প্রশিক্ষণ, ঠোঙ্গা বানানো, ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের মতো প্রকল্পগুলো ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল, ভেড়া প্রতিপালনসহ আরও নানা প্রকল্প শুরু করেছে। এগুলো বাস্তবায়নে ওদের সংগ্রামী জীবন স্বনির্ভরতার আলোয় ভরপুর হয়ে উঠবে। 
আন্তর্জাতিক সংগঠন অক্সাম বাংলাদেশ চরাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে কাজ করে। তাদের প্রতিবেদনেও নারীদের জীবন সংগ্রাম উঠে এসেছে। ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, অবস্থান ও প্রতিকূল পরিবেশের কারণে বাংলাদেশ অত্যন্ত দুর্যোগ প্রবণ দেশ হিসেবে পরিচিত। প্রতিনিয়ত সংঘটিত বিভিন্ন দুর্যোগ মানুষকে, বিশেষ করে নারীদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সমাজে নারীদের অবস্থা ও অবস্থানগত পার্থক্য এবং বৈষম্যের কারণে পুরুষের তুলনায় নারীদের জীবন বিপদাপন্নতা অনেকাংশে বেশি।

আবার এটাও ঠিক যে, নারীর এমন কিছু সক্ষমতা রয়েছে যা গোটা পরিবারের দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়ক হয়ে থাকে। বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নারীরা দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য বিভিন্ন পূর্ব প্রস্তুতিমূলক কাজ করে থাকে। দুর্যোগের সময় দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি আহত ও পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের সেবা করা, পরিবারের সদস্যদের সহমর্মিতা জানানো, ত্রাণ সংগ্রহ করা, খাদ্য ও জ্বালানি সংগ্রহ করা প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রধান দায়িত্ব পালনকারী হিসেবে নারীরা কাজ করে। সাধারণত: নারীরা তাদের এ অবদানের স্বীকৃতি খুব কমই পেয়ে থাকে। তবে বিগত কয়েক বছরে দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় নারীর অবদান কিছুটা স্বীকার করা শুরু হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠন অক্সফাম, যারা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে জেন্ডার সমতা এবং দুর্যোগ পূর্বপ্রস্তুতি বিষয়ক কাজ করে থাকে। তারা দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি অংশ নারীর ভূমিকাকে আরও কার্যকর করার পদক্ষেপ নিয়েছে। দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় নারীদের এই কার্যকর অংশগ্রহণ পারিবারিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

×