ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১

মাদক সমাধান নয়

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ০১:৩৪, ৫ জুলাই ২০২৪

মাদক সমাধান নয়

মাদকাসক্তি ভয়ংকর এক নেশা

 মাদকাসক্তি ভয়ংকর এক নেশা। বিশেষ করে উদীয়মান প্রজন্ম এমন নেশায় কেমন জড়িয়েও পড়ে। যেখানে কিশোর-কিশোরীরা নির্বিশেষে নিজেদের মূল্যবান জীবনকে বেশ অস্থির করে তোলে। শুধু মাদকাসক্তই নয় সঙ্গে কিশোর অপরাধের যে প্রাবল্য সেটাও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয়। সম্প্রতি মাদক ও ধূমপান বিরোধী সংগঠন ‘মানস’ এবং ঢাকা আহ্্ছানিয়া মিশন দুটি আলাদা গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সংখ্যাতাত্ত্বিক এমন বিশ্লেষণে উঠে আসে কিশোরীরা মাদকাসক্তের দিকে ঝুঁকে পড়ছে নিজেদের আকর্ষণীয় করে তোলার অনন্য আগ্রহে।

বিশেষ করে প্রতি ৫ জনের ৩ জন মেয়েই নাকি ইয়াবার নেশায় আসক্ত। এখানে প্রযুক্তির আঙিনায় যাদের অবাধ বিচরণ তেমন মেয়েরাই মাদকের প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। সেখানে হরেক মাত্রার হয়রানির শিকার হচ্ছে উদীয়মান মেয়ে প্রজন্ম। যা তাদের যাপিত জীবনকে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে। বিশেষ করে বিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেয়েরাই ন্যক্কারজনকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে তাদের সমবয়সী ছেলে বন্ধুদের কাছ থেকে।

তেমন অসহনীয় দুর্ভোগকে সামলাতে তাদের সামনে নেশাগ্রস্ত হওয়া ছাড়া স্বাভাবিক, সহজ পথও নাকি ঘোলাটে হয়ে যায়। অবধারিত এক চরম মানসিক বিপত্তি তো বটেই। স্বাভাবিক অবস্থায় জীবনযাপনও যেখানে অস্থিরতার দুঃসময়ে আক্রান্ত হয় সেখানে সবকিছুই যেন গোলমেলে অবস্থায় থেকে সুস্থ, স্বাচ্ছন্দ্য জীবন যখন সুস্থির থাকে না তেমন অসময়ে কিশোরী মেয়েরা হরেক প্রলোভনেও আক্রান্ত হয়। অতি স্বাভাবিক জীবন ধারণ স্খলনের আবর্তে পড়ে যায়। বয়সটা কিন্তু একেবারেই বয়ঃসন্ধিকালের স্পর্শকাতর এক নব অনুভূতি। সবকিছুকে হয় ভালো নতুবা মন্দের দুরবস্থার শিকারই বলা যায়। বয়সটা যদি আঠারো ধরা যায় তা কিন্তু এক পরম দোলাচলের ভিন্ন মাত্রার কাঁপন।
যা থেকে সহজে মুক্তি মেলাও ভার। সুবিদিত জার্মান মহাকবি গ্যাটে অনুভব করেন তার বয়স যখন আঠারো সে সময় পুরো জার্মানি যেন আলোয় ঝলমল করছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও তার প্রিয় মহাকবির সুরে সুর মেলান। কবিগুরুরও মনে হয় আঠারোয় পা দিয়েই অনুভব করলেন সমগ্র বাংলা যেন আলোর ঝলকানিতে দীপ্যমান হয়ে ওঠে। বিষয়টা মোটেও ছেলেমেয়ের নয়। বরং বয়ঃসন্ধিকালের এক পরম অনুভব আর নিত্য নতুন ভাবনার দ্বার খোলার অনিন্দ্য সময়।

কিন্তু সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন সময় নয়- অসময়ই উদীয়মান তরুণ-তরুণীকে বিভ্রান্তির জালে আটকে দিচ্ছে। ভালো-মন্দের জ্ঞান বিলুপ্ত, ন্যায়-অন্যায় বোধগম্যের অতীত। সব মিলিয়ে নতুন প্রজন্মের যে অস্বস্তি সেটাই তাকে অপরাধ জগতের সঙ্গে যুক্ত করে। মাদকাসক্তও এক সমাজ, বিধিবহির্ভূত অপরাধ যা সবচেয়ে আগ্রাসীভাবে জড়িয়ে নেয় কিশোরীদের। সেখানে অনুপ্রবেশ যত সহজ, ততোধিক কঠিন নির্গমনের স্বচ্ছ পথ। সত্যিই এক ভয়ানক অস্বস্তিকর শারীরিক-মানসিক দুরবস্থা। একজন মাদকাসক্ত হওয়া কিশোরী অতি অবশ্যই কোনো এক পরিবারের সন্তান।

পিতা-মাতা, ভাই-বোন নিয়ে এক সুখের অবারিত বলয়। সেখানে যখন কোনো মেয়ে ক্ষতিকারক নেশায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েÑ প্রভাবটা পুরো পরিবারকে আচ্ছন্ন করে রাখে। সবার আগে দায়িত্বটা এসে বর্তায় সর্বংসহা জন্মদাত্রী জননীর ওপর। মাকেই সার্বক্ষণিক নজরদারিতে সন্তানদের আগলে রাখা সমাজ সংস্কারের যুগ-যুগান্তরের নিয়মবিধি। সুগৃহিণী মায়েরা দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক আলয়ে শুধু সুখস্বাচ্ছন্দ্য নয় বরং হরেক নিরাপত্তার বলয় ও নির্বিঘœ করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকেন। তেমন সুগৃহিণী মায়ের গর্ভেই শুধু নয় গড়ে তোলার অনন্য সফলতায় দেশের বীরশ্রেষ্ঠ সন্তানদের জীবন ধন্য হয়েছে। দেশমাতৃকাও পেয়েছে বরেণ্য সন্তানদের মহাসম্মিলন, যা সব দেশ ও কালের অনন্য উপহারও বটে।
তবে মাদকাসক্তি আর উদীয়মান প্রজন্মের হরেক বিচ্ছিন্নতা বোধ নাকি প্রাক শিল্প যুগে ছিলই না। ১৭৬০ সালের ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব সারা দুনিয়াকে এক নতুন জগতের দ্বার উন্মোচন করে দেয়। আধুনিক সময়ের নিত্যনতুন প্রযুক্তি সামাজিক গতি বাড়ায় বহুদূর। কিন্তু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে কত বিপরীত আবহ তৈরি করে তাও অষ্টাদশ শতাব্দীর এক অসহনীয় ক্রান্তিকাল। নারী নির্যাতন বেড়ে যায়, কিশোর অপরাধ মাথাচাড়া দেয় সঙ্গে পেশী শক্তির অশুভ, উন্মত্ত আস্ফালনও সমাজের গভীরে আস্তানা গাড়ে।

যা উন্নয়ন গতিবেগের বৈরিতার চরম দাপট। তবে সঙ্গত কারণে উদীয়মানী নারীরা বিভিন্ন অপরাধ জগতে ঢুকে পড়লেও বের হওয়ার রাস্তা থাকে অতি সরু। থাকেই না। তাই পারিবারিক দায়বদ্ধতা অনেক বেশি জরুরি। ¯েœহশীল মাকেই মায়া, মমতায় তার মাদকাসক্ত কন্যাকে ধীরে ধীরে দুর্বিষহ বলয় থেকে বের করে আনা মাতৃত্বের পরম দায়বদ্ধতা। অন্যদিকে বলা যায় শিশু কন্যাটির বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক নিরাপত্তার বলয় দেওয়াও এক সচেতন মায়ের পরম দায়িত্ব। কন্যাকে নেশা পর্যন্ত যেতে দেওয়া থেকে বিচ্ছিন্ন বিরত রাখাই সমস্যা নিরসনের প্রাথমিক ধাপ।

পরবর্তী সময়ে গড়ে তোলার মহান ব্রতে সামাজিক অপসংস্কার থেকে দূরে রাখাও পিতামাতার সম্মিলিত কর্তব্যনিষ্ঠা। সুস্থ সংস্কৃতি  চর্চা, সহজাত ধর্মীয় বোধ, পারিবারিক নির্মল আবহ সন্তানের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ গড়ার নিয়ামক শক্তি। সন্তানরা ভুল-ভ্রান্তির জালে আটকে যাওয়াও এক অনির্ধারিত দুঃসময়। সেখান থেকেও তাদের সন্তর্পণে, সযতেœ, মানবিক দায়বদ্ধতা আর ¯েœহাতিশয্যের যৌক্তিক মমতাঘন পরিবেশে বের করে এনে নতুন আর এক স্বাচ্ছন্দ্য বলয়ে নির্বিঘœ-নিরাপদ করাও সময়ের অপরিহার্য ন্যায্যতা। আজকের উদীয়মান প্রজন্ম আগামীর বাংলাদেশের ভাবী কারিগর। জীবন বিপন্ন করার সব ধরনের আসক্তি তাদের থামাতে হবে।

×