ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ৩০ জুন ২০২৪, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১

শঙ্খচিল কুটির স্বাবলম্বী হচ্ছেন নারীরা

তাহমিন হক ববী

প্রকাশিত: ০১:২২, ২৮ জুন ২০২৪

শঙ্খচিল কুটির স্বাবলম্বী হচ্ছেন নারীরা

গত মার্চে পাট মন্ত্রণালয় আয়োজিত পাটমেলায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জারিন তাসনিম

উত্তরাঞ্চলের নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলা শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের দক্ষিণ বেরুবন্দ গ্রাম। এই গ্রামে নারীদের পাটজাত পণ্যসহ নকশিপণ্য তৈরির কারখানা শঙ্খচিল কুটির গড়ে তুলেছেন জারিন তাসনিম নামের এক উদ্যোক্তা গৃহবধূ। তার সফলতার ঝুড়ি অনেক। চলতি বছরে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) জাতীয় পাট দিবস-২০২৪ উপলক্ষে আয়োজিত বহুমুখী পাটপণ্য প্রদর্শনী ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

১৪ মার্চ থেকে ১৬ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য ওই মেলায় স্টল দিয়েছিলেন নীলফামারীর শঙ্খচিল কুটিরের উদ্যোক্তা জারিন তাসনিম। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী স্টল পরিদর্শনের জন্য জারিন তাসনিমের স্টলে এসে বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী যখন জানতে পারেন ভূমিহীন ও  গৃহহীন আশ্রায়ণ প্রকল্পের ঘরে বসবাসকারী নারীরা শঙ্খচিল কুটিরে হাতের কারুকাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেনÑ তখন এই উদ্যোক্তাকে বঙ্গবন্ধুর সোনার দেশ, স্মার্ট পাটশিল্পের বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য জারিন তাসনিমের প্রশংসা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
জারিন তাসনিম প্রধানমন্ত্রীকে কথা দিয়ে এসেছিলেন পাটের নতুন নতুন পণ্য আবিষ্কার করে নতুন বাজার খুঁজে বের করে  রপ্তানি করবেন। প্রধানমন্ত্রীর সেই উৎসাহে জারিন তাসনিম সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তার শঙ্খচিল কুটিরকে নিয়ে।
২০১৯ সালে জারিন তাসনিম বিয়ে করেন নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার দক্ষিণ বেরুবন্দ গ্রামের গোলাম মোস্তফা ও মেজোয়ারা বেগমের ছেলে সাদ্দাম হোসেনকে। তাদের একটি সন্তানও রয়েছে।
এ বিষয়ে কথা হয় জারিন তাসনিমের সঙ্গে। তিনি বলেন- আমার জন্মস্থান ঠাকুরগাঁও। আমার বাবা মরহুম আসাদুল আলম বিমান বাহিনীর অফিসার ছিলেন। মা ফেরদৌসী বেগম ছিলেন গৃহিণী। বাবার কাজের সুবাদে ছোট থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করা হয়। ছোট থেকেই শহরে বেড়ে ওঠা হলেও গ্রামীণ মানুষের প্রতি, আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা এবং আগ্রহ।

মেধাবী ছাত্রী হিসেবে সকল পরীক্ষায় ভালো ফলাফল থাকলেও চাকরি করে শুধু আত্মকেন্দ্রিক সাফল্য লাভের ইচ্ছা কোনোকালেই আমার ছিল না। আমার হৃদয় শুধু গ্রামীণ মানুষের জন্য ছুটে যেত, সবসময় ইচ্ছা ছিল তাদের জন্য কিছু একটা করার, আমার এলাকার উন্নয়নে নিয়োজিত করার। এইচএসসির পর আমার নতুন জীবনের শুরু হয়। আমি আমার স্বপ্ন পূরণের সাথী হিসেবে আমার স্বামী সাদ্দাম হোসেনকে পেয়ে যাই। তার, আর আমার স্বপ্ন মিলে যায়। এসব কাজের উৎসাহ দেন আমার মা জননী। কারণ মা ছিলেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনী  কর্তৃক পরিচালিত বাফওয়ার বিভিন্ন হস্তশিল্পের প্রশিক্ষক।
এর মাঝে আমার কোল আলো করে আমার ছেলেসন্তান।  আমার বাবা ঢাকা বিমানবাহিনী হেড কোয়ার্টারে কর্মরত অবস্থায় করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আমিও প্রচুর ভেঙে পরি।  প্রচুর মানুষ কর্মহীন হয়ে গ্রামে চলে আসে। দারিদ্র্যতা, কর্মহীনতায় তাদের অবস্থা অনেক শোচনীয় পর্যায়ে চলে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে স্বামীসহ আমি পরিকল্পনা করি  গ্রামীণ নারীদের জন্য কিছু একটা করার। নিজের এবং প্রত্যন্ত এলাকার সুবিধাবঞ্চিত নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি কিছু সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য আমরা উদ্যোগ নেই।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে আমরা প্রাথমিক অবস্থায় কিছু নারীকে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ প্রদান করে তাদের মাধ্যমে কিছু নকশিপণ্য বানিয়ে অনলাইনে বিক্রি করি। এভাবে চাহিদা বুঝে আমরা আমাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম  বাড়াতে থাকি সেই সঙ্গে পণ্যের পরিধিও। বর্তমানে আমরা ১৩টি ক্যাম্পে প্রায় ৭০০-এর বেশি নারীর প্রশিক্ষণ দিয়েছি এবং এদের মাঝে প্রায় ৫০০ নারী আমাদের সঙ্গে কাজ করছে। আমরা নকশিকাঁথা, শাড়ি,  পাঞ্জাবি, থ্রি-পিচ, পাটের বিভিন্ন নান্দনিক ডিজাইনের শোপিচ, ম্যাক্রামের শোপিচ, হোগলা পাতার পণ্য বানাচ্ছি।

দেশে এবং বিদেশে পাইকারি এবং খুচরা বিক্রি করছি। আমাদের কার্যক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে অসংখ্য নারীর ঘরে বসেই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে। আমরা দারিদ্র্যের কারণে ড্রপ আউটের শিকার, মেয়েদের বাসায় বসে পড়াশোনার পাশাপাশি অর্থ উপার্জনের সুযোগ করে দিচ্ছি। 
এতে তারা তাদের পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে পারছে। এছাড়া দারিদ্র্যের জন্য দেওয়া বাল্যবিয়ে রোধ সম্ভব হচ্ছে। নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পেও আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।
জারিন তাসনিম জানান, ২০২২ সালে উদ্যোক্তাদের নিয়ে উদ্যোক্তাবান্ধব এনজিও ইণঊঅঐ-ইধহমষধফবংয ণড়ঁঃয ঊহঃবৎঢ়ৎরংব অফারপব ধহফ ঐবষঢ় ংবহঃবৎ আয়োজিত  ইণঊঈ ১. এতে অংশগ্রহণ করি এবং সারা বাংলাদেশের ২৭০০ উদ্যোক্তার মাঝে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিজয়ী হয়ে তিন লাখ টাকা প্রাইজ মানি পাই। সে অর্থে কারখানার ভবনের কাজ শুরু করি।

এছাড়াও আমরা রংপুর বিভাগীয় এসএম-ই মেলাসহ বিভিন্ন মেলায় অংশ নিয়ে আমাদের নারীদের পণ্য প্রদর্শন করে প্রথম পুরস্কার পাই।  গত মার্চে পাট মন্ত্রণালয় আয়োজিত পাটমেলায় প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ লাভের এবং আমাদের নারীদের কাজের গল্প শোনানোর এবং সেই সঙ্গে পণ্য প্রদর্শনের সুযোগ হয়।  দেশনেত্রী আমাদের কার্যক্রমের বিষয়ে জেনে অত্যন্ত খুশি হন এবং আমাদের অগ্রযাত্রার জন্য দোয়া কামনা করেন।

×