
আপনি কি কখনও ভেবেছেন, কিছু মানুষ এত শৃঙ্খলাবদ্ধ হয় কীভাবে? তাদের দেখলেই মনে হয় সবসময় সময়মতো পৌঁছে যান, লক্ষ্য ঠিক রাখেন, আর গোছানো জীবনযাপন করেন। শৃঙ্খলা কোনো জাদু নয়, বা জন্মগত প্রতিভাও নয়। এটি গড়ে ওঠে কিছু নির্দিষ্ট দৈনন্দিন অভ্যাসের মাধ্যমে, যা চাইলে আপনিও আয়ত্ত করতে পারেন।
আজকের যুগে, যেখানে সর্বক্ষণ মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, সেখানে শৃঙ্খলা অর্জন আগের চেয়ে আরও মূল্যবান হয়ে উঠেছে। সুখবর হলো, অতীতে যদি আপনি শৃঙ্খলার অভাবে ভুগেও থাকেন, তবুও এখন থেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যক্তিদের দৈনন্দিন অভ্যাস অনুসরণ করে নিজেকে গড়ে তুলতে পারেন। চলুন জেনে নিই সেই ৫টি গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাস যা শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যক্তিদের আলাদা করে এবং কীভাবে এগুলো নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করবেন।
১. দিনের শুরুতেই একটি ‘জয়’ অর্জন করেন
শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যক্তিরা ঘুম থেকে উঠে সঙ্গে সঙ্গে ফোনে মগ্ন হন না। বরং তারা দিনের শুরুতেই কোনো অর্থপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেন। এটি হতে পারে বিছানা গুছিয়ে রাখা, একটি শরীরচর্চা সেশন শেষ করা অথবা প্রাতঃরাশের আগেই কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করা।
দিনের শুরুতে এমন ছোট্ট একটি সাফল্য ইতিবাচক গতি তৈরি করে, যা সারাদিনের মনোভাবকে প্রভাবিত করে। মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসরণ হয়, আপনি ভালো বোধ করেন এবং আরও কাজ করতে অনুপ্রাণিত হন। মূল কথা হলো নিয়মিত এই ‘ছোট জয়’ অর্জনকে অভ্যাসে পরিণত করা।
২. নিরবিচ্ছিন্ন রুটিন তৈরি ও বজায় রাখেন
যে কোনো শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যক্তির দিকে তাকান, দেখবেন তারা একটি নির্ভরযোগ্য রুটিন অনুসরণ করেন। এটি কোনো একঘেয়ে ছক নয়; বরং এমন একটি গঠন, যা সিদ্ধান্ত ক্লান্তি দূর করে দেয়। পরবর্তী কাজ কী হবে বা কখন হবে, তা নিয়ে ভাবতে না হলে মানসিক শক্তি বাঁচে এবং সৃষ্টিশীলতা বাড়ে।
এ ধরনের রুটিন কেবল দৈনিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ করে না, বরং শরীরের অভ্যন্তরীণ ঘড়ি ও শক্তি-স্তরকেও সুসংহত করে। শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যান, নির্দিষ্ট সময়ে ওঠেন, নিয়মিত আহার করেন এবং অনিয়মিত কাজ এড়িয়ে চলেন। প্রথমে ছোট ছোট সকাল-সন্ধ্যার রুটিন দিয়ে শুরু করুন এবং ধীরে ধীরে প্রসারিত করুন। মনে রাখবেন, শতভাগ নিখুঁত না হলেও ধারাবাহিকতাই আসল চাবিকাঠি।
৩. অস্বস্তিকে স্বাগত জানান এবং প্রলোভন এড়িয়ে চলেন
শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যক্তিরা জানেন, প্রকৃত বিকাশ ঘটে নিরাপদ বলয়ের বাইরে। তারা কঠিন বা অস্বস্তিকর কাজ এড়িয়ে চলেন না বরং ইচ্ছাকৃতভাবে এগুলোর মুখোমুখি হন। হোক সেটা ঠান্ডা পানিতে গোসল, কঠিন কাজ প্রথমে শেষ করা অথবা কষ্টকর ব্যায়াম চালিয়ে যাওয়া—তারা অস্বস্তিকে শক্তির মতো ব্যবহার করেন।
একইসঙ্গে, তারা অপ্রয়োজনীয় প্রলোভন এড়াতে পরিবেশকেই এমনভাবে সাজান, যাতে ভুল পথে যাওয়ার সুযোগ কমে। উদাহরণস্বরূপ, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখতে বাসায় ফাস্টফুড রাখেন না বা মনোযোগ ধরে রাখতে কাজের সময় ফোন দূরে রাখেন। এই দ্বিমুখী কৌশল প্রয়োজনীয় অস্বস্তিকে গ্রহণ ও অপ্রয়োজনীয় প্রলোভন এড়িয়ে চলা,শৃঙ্খলাকে দিনে দিনে আরও শক্তিশালী করে।
৪. সচেতনতা ও আত্মক্ষমার চর্চা করেন
শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যক্তিরা নিজেদের চিন্তাভাবনা ও আচরণের প্রতি সচেতন থাকেন। তারা প্রায়শই কোনো না কোনোভাবে মননশীলতার চর্চা করেন,মেডিটেশন, সচেতনভাবে খাওয়া অথবা কয়েক মিনিট নিঃশ্বাসে মনোযোগ দেওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে। এই সচেতনতা তাদের পুরনো অভ্যাসে ফিরে যাওয়ার আগেই নিজেদের ধরতে সহায়তা করে।
আর যদি কখনও ব্যর্থও হন যা সবার ক্ষেত্রেই ঘটে,তারা আত্মসমালোচনায় ডুবে যান না। বরং আত্মক্ষমা করে পরের মুহূর্ত থেকেই নতুন করে শুরু করেন। তারা জানেন, উন্নতির পথ কখনোই সরলরেখা নয়। এই ভারসাম্যমূলক মনোভাব অনেকের মতো "সব অথবা কিছুই না" ধরনের ভাবনা থেকে তাদের রক্ষা করে।
৫. বড় কাজগুলো ভেঙে ছোট করেন এবং একটিতে মনোযোগ দেন
বড় কোনো প্রকল্প বা উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য সামনে এলে শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যক্তিরা বিচলিত হন না। বরং তারা কাজগুলো ছোট ছোট ধাপে ভাগ করে একবারে একটি করে সম্পন্ন করেন। এভাবে কাজ করা সহজ হয় এবং ছোট ছোট সফলতা কাজের প্রতি উৎসাহ ধরে রাখে।
তারা একসঙ্গে অনেক কাজ করার মিথও প্রত্যাখ্যান করেন। জানেন, একাগ্র হয়ে একটিমাত্র কাজ শেষ করাই বেশি ফলদায়ক। প্রতিদিনের শুরুতেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি নির্ধারণ করুন এবং নিরবিচারে একটানা কাজ করুন। কাজ শেষ হলে পরবর্তী অগ্রাধিকারের দিকে এগিয়ে যান। এই পদ্ধতি আপনাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে তুলবে এবং কর্মদক্ষতা বাড়াবে।
নিজেকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা মানে ঘৃণিত কাজ জোর করে করা বা ভুলের জন্য নিজেকে শাস্তি দেওয়া নয়। বরং এটি এমন ব্যবস্থা ও অভ্যাস তৈরি করা, যা সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়াকে সহজ এবং স্বয়ংক্রিয় করে তোলে।
আজ আলোচিত পাঁচটি অভ্যাস,দিনের শুরুতে একটি 'জয়', ধারাবাহিক রুটিন, অস্বস্তিকে আলিঙ্গন ও প্রলোভন এড়ানো, মননশীলতা ও আত্মক্ষমা এবং বড় কাজ ভেঙে একটিতে মনোযোগ,আপনাকে এই পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
মনে রাখবেন, শৃঙ্খলা অর্জন কোনো গন্তব্য নয়, একটি চলমান যাত্রা। এমনকি সবচেয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যক্তিরাও মাঝেমধ্যে সংগ্রাম করেন। পার্থক্য হলো,তারা এমন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন, যা কঠিন সময়েও তাদের এগিয়ে রাখে। আপনি যদি আজ থেকে মাত্র একটি অভ্যাস নিয়মিত শুরু করেন, দেখবেন কীভাবে আপনার জীবন বদলে যাচ্ছে কেবল আপনার কর্মে নয়, নিজেকে নিয়েও আপনার উপলব্ধিতে।
সূত্র:https://tinyurl.com/3yfy3sej
আফরোজা