
ছবি: সংগৃহীত
ইনভারনেস থেকে ব্রিটেনের সর্বউত্তরের সংযোগস্থল পর্যন্ত ছুটে চলা ফার নর্থ লাইন পাড়ি দেয় মেষ চারণভূমি, ঐতিহ্যবাহী গ্রাম এবং বিশ্বের একমাত্র ইউনেস্কো স্বীকৃত ব্ল্যাংকেট পিট-বগের মাঝ দিয়ে।
ট্রেনটি ইনভারনেস স্টেশন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, স্কটিশ হাইল্যান্ডসের চূড়ান্ত প্রান্তের দিকে রওনা দিয়ে, আমার আঙুলের ডগায় এক পরিচিত রোমাঞ্চ অনুভূত হয়। এক সময় গ্রীষ্মের চারটি কাজের মৌসুমে এ এলাকায় বসবাস করেছিলাম বলে, এখনো এই দুর্গম, অবাধ্য প্রকৃতির সঙ্গে আমার অটুট এক বন্ধন রয়েছে। আর এবার, অবশেষে আমি ফিরে এসেছি আমার দুই প্রিয় জগত — রেলভ্রমণের রোমাঞ্চ আর উত্তর স্কটল্যান্ডের পিটময় মালভূমি — একসঙ্গে অনুভব করতে।
এখন সকাল ৭টা। আমি ফার নর্থ লাইনে আছি, যা ইনভারনেস থেকে থারসো এবং উইকের দিকে ব্রিটেনের মূল ভূখণ্ডের একেবারে উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রায় ১৬৮ মাইল পেরিয়ে, চার ঘণ্টা সময় নেয় এই যাত্রা। এটি স্কটল্যান্ডের সর্বউত্তরের রেলপথ, যা ফ্লো কান্ট্রি অঞ্চল অতিক্রম করে — উত্তর হাইল্যান্ডের বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এক ধরনের পিটময় ভূমি। অসংখ্য জলাভূমি আর অনন্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল এই ফ্লো কান্ট্রি, যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে অক্ষত পিট-ব্যবস্থা। ২০২৪ সালে এটি বিশ্বের প্রথম ও একমাত্র পিটল্যান্ড ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা পায়। তবে, আমার কাছে ফ্লো কান্ট্রির আসল আকর্ষণ এর অপার্থিব নিঃসঙ্গতা।
আমার ভ্রমণের অধিকাংশ সময়জুড়ে হাইল্যান্ডস ছিল উজ্জ্বল রোদে স্নাত, তবে এখন মাটি আবৃত হালকা তুষারের মতো জমাটবাঁধা তুষারকণায়, যা সকালের আলোয় মিটমিট করে ঝিলমিল করছে। ট্রেন যখন কোনন ব্রিজ গ্রাম আর ছোট্ট সমুদ্রবন্দর শহর ইনভারগর্ডন অতিক্রম করে, তখন চারপাশের দৃশ্যপট থাকে কোমল — ঢেউ খেলানো পাহাড় আর কৃষিজমি জানালার পাশে গড়িয়ে চলেছে। আশপাশে কোনো প্রাণবন্ত আলাপ নেই; স্কটল্যান্ডের উত্তরের সকাল মানেই, মানুষ চুপচাপ তাদের কফির কাপ আঁকড়ে ধরে আছে, মনে মনে দিনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি, বিপরীত দিকে ইনভারনেস অভিমুখী একটি ট্রেন যাচ্ছে। আর আমি চলেছি উল্টো দিকে — হাইল্যান্ডের গভীরে, যেখানে সময়ের তাড়া মুছে যায়।
১৯ শতকের শেষভাগে ধাপে ধাপে নির্মিত হয় ফার নর্থ লাইন, যদিও এটি নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল আমার মতো প্রকৃতিপ্রেমের জন্য নয়, বরং বাণিজ্যিক প্রয়োজনে, বিশেষ করে মাছধরা আর কৃষির উন্নতির জন্য। ১৮৬২ সালে ডিংওয়াল প্রথম টার্মিনাস হিসেবে খোলা হয়, পরের বছর ইনভারগর্ডন, এরপর ১৮৬৮ সালে গোলস্পি, তিন বছর পর হেলমসডেল, আর ১৮৭৪ সালে থারসো ও উইক পর্যন্ত পৌঁছে যায় এই লাইন।
তবে এই লাইন নির্মাণ ছিল নানা প্রতিবন্ধকতায় ভরা — বৈরী আবহাওয়া, কঠিন ভূপ্রকৃতি আর আর্থিক সংকট।
এই সময় হাজির হন সাদারল্যান্ডের তৃতীয় ডিউক। মাইকেল উইলিয়াম তাঁর বই On the Slow Train Again-এ লেখেন, ডিউক ছিলেন এক নিবেদিত রেলপ্রেমী, যিনি একসময় লন্ডন অ্যান্ড নর্থ ওয়েস্টার্ন রেলওয়ের সাথে ইঞ্জিনের কাজ শিখেছিলেন।
ডিউক চাইতেন তার বাসভবন ডানরবিন ক্যাসলের নিকট দিয়ে একটি রেললাইন নির্মাণ হোক। ১৮৭০ সালের ২০ জুন, এক আইন পাশের মাধ্যমে তাকে গোলস্পি থেকে ব্রোরা ও হেলমসডেল পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু নির্মাণকাজ অনুমতির আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং সেই বছরের ১ নভেম্বর, ডানরবিন-থেকে-হেলমসডেল অংশ চালু হয়ে যায়।
আজও, ডানরবিন ক্যাসল স্টেশন ফার নর্থ লাইনের সবচেয়ে মুগ্ধকর এক স্টপ। এল. বিসেট ১৯০২ সালে এটি ডিজাইন করেন। আল্পাইন কটেজের মতো এর স্থাপত্য রূপ গ্রিম ভ্রাতৃদ্বয়ের রূপকথার গল্প মনে করায়। তবে আমার যাত্রায় ট্রেন স্টেশনটি পার হয়ে যায়; এটি একটি অনুরোধমূলক স্টপ, যেখানে যাত্রীরা বোতাম চেপে সিগন্যাল দিলে ট্রেন থামে।
ডানরবিনের পরপরই ট্রেন সমুদ্রের ধার ঘেঁষে চলতে থাকে। ব্রোরা থেকে হেলমসডেলের মাঝের ১০ মাইল পথ যাত্রার অন্যতম দৃশ্যপট। দেখলাম, ঢেউ ভাঙছে কালো পাথুরে উপকূলে, সবুজ ঘাসের মাঠে ভেড়া চরে বেড়াচ্ছে, আর একজন ব্যক্তি দুইটি বর্ডার কোলি কুকুর নিয়ে সকালে হাঁটছেন। এরপর হেলমসডেল ছাড়িয়ে রেললাইন মোড় নেয় ভেতরের দিকে, আরও গভীরে হাইল্যান্ডসের।
এখন আমরা পৌঁছে যাচ্ছি ফ্লো কান্ট্রিতে।
১,৫৪৪ বর্গমাইল জুড়ে বিস্তৃত এই ব্ল্যাংকেট বগ, যা লন্ডনের মহানগর এলাকার প্রায় ২.৫ গুণ বড়। ইউনেস্কোর ভাষায়, এটি "বিশেষ কিছু পাখির আবাসস্থল এবং এমন বৈচিত্র্যময় ভূ-প্রকৃতি ধারণ করে, যা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না" — এই কারণেই এটি অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ আর গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের মতো নিসর্গিক বিস্ময়গুলোর পাশে স্থান পেয়েছে।
সপ্তাহের শুরুতে আমি লোচিনভার গ্রামে ইউনিভার্সিটি অব দ্য হাইল্যান্ডস অ্যান্ড আইল্যান্ডসের পিটল্যান্ড সায়েন্সের অধ্যাপক ড. রোক্সানে আন্দারসেনের সাথে দেখা করি, যিনি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই এলাকা নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং ইউনেস্কো স্বীকৃতি আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
তিনি বলেন, "ফ্লো কান্ট্রি যেমন রহস্যময় এবং অপার্থিব সুন্দর, তেমনি এটি বিশ্বজুড়ে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে অপরিহার্য ভূমিকা রাখে। এটি ধীরে ধীরে বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে মৃত উদ্ভিদ বা পিট হিসেবে হাজার হাজার বছর ধরে জমা রাখে। এর ফলে পৃথিবীর জলবায়ু ঠাণ্ডা হয়।"
ফার নর্থ লাইনের পথে ফর্সিনার্ড স্টেশন হলো এই অনন্য প্রাকৃতিক দৃশ্যপট অন্বেষণের শ্রেষ্ঠ জায়গা। পুরনো রেলস্টেশনটি এখন ফর্সিনার্ড ফ্লোজ ভিজিটর সেন্টারে রূপান্তরিত হয়েছে (এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত খোলা থাকে)। এখান থেকে আমি ১ মাইল দীর্ঘ 'ডাব লোখান ট্রেইল'-এ হাঁটলাম, কাঠের তৈরি এক সরু পথ ধরে ফ্লোজ লুকআউট টাওয়ারের দিকে। পথে পথে দেয়া রয়েছে নানা তথ্যফলক — এখানে আগে কী ধরনের গাছ ছিল, পুকুর-ব্যবস্থার কাজ কীভাবে চলে তা বিস্তারিত বলা আছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও ট্যুর গাইড গ্রাহাম থম্পসন বলেন, "এমন জায়গা আছে যেখানে আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁটতে পারবেন — কোনো মানুষ দেখবেন না, কোনো রাস্তা অতিক্রম করতে হবে না। যুক্তরাজ্যে এখনো এমন অভিজ্ঞতা পাওয়া সত্যিই অসাধারণ।"
শহীদ