
ধনধান্য পুষ্প ভরাই শুধু নয় নদ-নদী আর সমুদ্র পরিবেষ্টিত আবহমান বাংলা উপকূলীয় এক উর্বর পলিমাটির দেশ। এই দেশের সাধারণ মানুষের যাপিত জীবন লড়াই-সংগ্রামের ইতিবৃত্ত। ঝড়-ঝঞ্ঝা, অতি বৃষ্টি, খরা- এমন সব প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে সামলিয়ে অস্ট্রিক জাতি-গোষ্ঠীর সামনে এগিয়ে চলা। শ্রেণি বিভক্ত সমাজে শুধু বিত্ত-নির্বিত্তই নয় আভিজাত্যের গৌরব, মর্যাদার লড়াই ছাড়াও সবচেয়ে বেশি কঠিনভাবে সামনে দাঁড়ায় নারী-পুরুষের বিভেদ, বিভাজন। তেমন বৈষম্যে শারীরিকভাবে অপেক্ষাকৃত কোমল কমনীয় নারীরাই এগিয়ে থাকে দৃষ্টিকটুভাবে। তা ছাড়া সামাজিক আর নৈসর্গিক ঝড়-ঝাপটায় রমণীয় নারীরাই পড়ে বেশি বিপাকে। তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য শিশুদের জীবনও শঙ্কাহীন থাকে না। যুগ-যুগান্তরের এক নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম বলাই যায়। পরিবর্তন, পরিবর্ধন বিপর্যয়, দুর্যোগ যখনই হানা দিয়েছে এই পলিমাটির বরেন্দ্র অঞ্চলে সেই বিষণ্ন প্রতিবেশে নারীদের লড়াই নিত্য জীবনকে অসহনীয় করে তুলতে এগিয়েই থেকেছে। এখনো তার বিরাম-বিরতি নেই। এটাই বিশ^ সৃষ্টি আর টানাপোড়েনে সর্বমানুষের দুর্ভোগ সামনে এসে যায়। কৃষিজীবী উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবন নিরাপদ আর নির্বিঘ্ন না থাকার অপদৃশ্য ভাবিয়ে তোলার মতো। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মানুষরা লড়াকু অভিগমনে যাত্রা পথকে যে মাত্রায় সহনীয় করে তোলে তাও এই অঞ্চলের এক নির্ভীক জাতি-গোষ্ঠীর চলমান জীবনের হরেক দুর্ভোগ। শুধু কি নৈসর্গিক আঁচড়? তার সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন সমাজের প্রভাবশালী ও পেশিশক্তির ক্রমাগত দাপট আর জবর দখলদারিত্ব। যা কি না মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো উপকূলীয়দের যাপিত জীবন দুর্বিষহ করে তোলে।
সেখানে সামাজিক আর পারিপাশির্^ক দুর্বৃত্তায়নে নারীদের জীবন হয় অসহনীয় এক দাবানলের প্রতিক্রিয়া। সুস্থির আর স্বাভাবিক পথ চলা জীবন থেকে অপসৃত হওয়া উদ্ভূত পরিবেশের চরম নৃশংসতা। একে যুদ্ধ আর হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবী সর্বমানুষের জীবনে যে ঘাত-প্রতিঘাতের হরেক বীভৎসতা চাপিয়ে দেয় সেটারও কোনো কূল-কিনারা থাকে না। আর অষ্টাদশ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবে যান্ত্রিক কলা-কৌশলের যে কার্বন নিঃসরণ তা সহজাত সবুজ প্রকৃতিকে নয়-ছয় করে দিতে আগ্রাসী ভূমিকা পালন করে। নিসর্গ বিজ্ঞানীরা ঊপনবিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্ন থেকেই আওয়াজ তুলছেন বিজ্ঞানের উদ্ভাবনে পৃথিবী গতিময় হয়েছে কিন্তু শ্যামল সহজাত নৈসর্গ তার যথার্থ রূপ থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হতে সময় নিচ্ছে না। পরামর্শ এসেছে প্রকৃতি সহায়ক যন্ত্র উদ্ভাবনে। সেটাও কতখানি দৃশ্যমান তা আজও অজানা। আমরা এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে নিত্য জীবন প্রবাহ চালিয়ে যেতে অভ্যস্ত। বিভিন্ন সময় উপকূলীয় তাণ্ডবে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর ওপর যে মরণ কামড় সেখানে সমসংখ্যক নারীর জীবন হয় দুর্বিষহ, আশঙ্কাজনক। তার ওপর আছে বাল্য বিয়ের মতো প্রচলিত নির্মম বিধি। সঙ্গে অকাল মাতৃত্বের চরম ছোবল। যা কি না এক কন্যা শিশুকে মা হওয়ার আনন্দ থেকে দুঃসহ প্রতিকূলতার শিকারে বিপর্যস্ত করে দেয়। এক সময়ের পদ্মা, যমুনা, মেঘনার ভরা যৌবনে নদ-নদীর পানি থৈ থৈ করা। নির্মল পানির ধারায় আজ কোন অভিশাপে তেমন প্রকৃতির অবারিত দানে নৃশংসতার চরম কোপানল? লাগাতার বৃষ্টিস্নাত বাংলায় যেমন বন্যার ছোবলে জনগোষ্ঠীকে হিমশিম অবস্থায়ে দাঁড় করায়। বিপরীত অবস্থায় শুষ্ক মৌসুমে খরাও দেশের চিরায়িত কৃষি সম্ভারকে ভাঙনের খেলায় উত্ত্যক্ত করে দেয়। নারী ও শিশুরা পড়ে চরম অনাসৃষ্টির অনাকাক্সিক্ষত দুর্বিপাকে। শুধু কি নারী-পুরুষের দুর্বিপাক? বন্যায় কত বসতি পানির নিচে তলিয়ে যায় সেটাও প্রকৃতির ভাঙনের খেলা। আর নারী যদি গর্ভবতী হন কিংবা কোলের শিশুদের নিয়ে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হতে হতে কোনো মতে রক্ষা পেলেও পরিণতি হয় আরও ভয়াবহ। যা বর্ণনারও অতীত। নতুন করে শুধু বসতি নির্মাণই নয় শুরু করতে হয় জীবনের পালাক্রমে আর এক নির্মম পরিবেশের ক্রমাগত লাঞ্ছনা। তেমন ঝড়-ঝাপটায় উপবাসও করা যায় না। কোনোমতে চাল আর আলু ফুটিয়ে দুবেলা দুমুঠো আহারের সংস্থানও যে করতে হয় নারীদেরই। তেমন দুর্বিষহ চিত্র গণমাধ্যমের পাতা ভারি করলেও সংশ্লিষ্টদের জীবনযুদ্ধে তার কোনো ছায়াও পড়ে না। সংসার যাপনের স্বপ্ন ধূলিসাত হয়। সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়া আকাশ কুসুম স্বপ্নের পর্যায়ে চলে যায়। তেমন আশা-আকাক্সক্ষায় বারবার হোঁচট খেতে হয় উপকূলীয় নারী ও শিশুদের। মাছে ভাতে বাঙালির মৎস্যজীবীরাও নিরাপদ নির্বিঘ্নে থাকেই না। সেখানেও লোকসান গোনার চিত্র সত্যিই বেদনাদায়ক। লাভ- লোকসানের হিসাব শিকেয় রাখতে হয়। নজর দিতে হয় কিভাবে ভয়ভীতি, বাধা বিপত্তি কাটিয়ে সামনের চলার পথ অবারিত করলেও এ জীবনও ক্ষণস্থায়ী। কখনো উপকূলীয় ঝড় উঠবে কিংবা খরায় ফসলি খেতের ওপর অনাবশ্যক চাপ পড়বে তেমন দুশ্চিন্তায় গর্ভবতী আর শিশু সন্তানের মায়েরা স্বস্তি আর নিরাপদ পরিবেশকে বারবার আলিঙ্গন করতে হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর পেশিশক্তির জবর দখলদারিত্বের দুর্বিষহ দাবানল।