ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

গ্রামীণ কন্যা-জায়া-জননী দিন যায় স্বপ্ন বুনে

শিউলী আহমেদ

প্রকাশিত: ২০:১৬, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

গ্রামীণ কন্যা-জায়া-জননী দিন যায় স্বপ্ন বুনে

খুব ছোটবেলায় যখন গ্রামে যেতাম, সেখানে দেখতাম ছোট ছোট লাল বউ। কারণ তারা লাল টুকটুকে শাড়ি পরে ঘোমটা দিয়ে থাকত। মুগ্ধ হয়ে তাদের দেখতাম। তখনো বাল্যবধূ বা বাল্যবিবাহ বিষয়টা বুঝতাম না। তাদের দেখতাম বাড়ির কত কাজ করছে! ছোটমনে অবাক হতাম- এত ছোট মেয়ে কি করে এত কাজ করতে পারে! সময় বদলেছে। এখন আর গ্রামে গেলে অত ছোট বউ দেখা যায় না। অন্তত ১৬-১৭ বছর হলে অভিভাবকরা মেয়েদের বিয়ে দেন। আরও বেশি যারা সচেতন, তারা ১৮ পার করেন। তবু বিস্ময় কাটে না। গ্রামের বাড়িতে ধান সেদ্ধ থেকে শুরু করে সমস্ত কাজই বাড়ির বউদের করতে হয়। এই ছোট ছোট মেয়েরা কত কঠিন কাজ অনায়াসে করছে। কৃষকরা খেত থেকেই ধান কেটে মেশিনে মাড়াই করে বাড়ি নিয়ে আসে। গৃহিণীরা তা সেদ্ধ করে শুকিয়ে আবার পাঠিয়ে দিচ্ছে চাল করে আনতে। ফ্যান ছেড়ে ধান উড়িয়ে কুড়া পরিষ্কার করে নিচ্ছে। এ কাজগুলো বাড়ির বৌরা খুব আনন্দের সঙ্গেই করছে।
সোমার বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর বয়সে। এখন তার বয়স ২৭। চমৎকার গৃহিণী হয়েছে সে। গ্রামে এখন আটাশ ধান উঠেছে। শ্বশুর বাড়ির জমি এখনো ভাগ না হওয়ায় শাশুড়ি দুই বৌকে ৪ মণ করে ধান সমান ভাগ করে দিয়েছেন। দুই বৌ খুব সকালে উঠে ধান সেদ্ধ করে বেলা ১১টার আগেই উঠানে ছড়িয়ে দিয়েছে। সোমার জা বয়সে তার চেয়ে ছোট। কিন্তু দুই বৌ খুব খুশিমনে কাজগুলো করছে। কড়া রোদ থাকলে দুপুর ২টার মধ্যেই ধান শুকিয়ে যাবে। না হয় পরদিন আরেকবার শুকাতে হবে। সোমা এর মাঝে রান্নাও শেষ করেছে। আবার ছেলে-মেয়েদের খাইয়ে স্কুলেও পাঠিয়েছে। ঢাকা থেকে তার ফুপু এসেছে বেড়াতে। সোমার ধান সেদ্ধ দেখতে গিয়েছিল। তাকেও সকালের নাস্তা খাইয়ে গ্রাম ঘুরিয়ে দেখিয়ে এনেছে। দুপুরে ধান উঠিয়ে, ছেলে-মেয়েদের তৈরি করে বিকেলে আবার পাশেই মায়ের বাড়ি, সেখানেও ঘুরতে গেল। মনে হলো চোখের পলকে কাজগুলো সোমা করে নিল। চোখেমুখে ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই।
পাশের পাড়াতে বসবাস কোহিনুরের। ছেলে, বউ, নাতি নিয়ে তার সংসার। পাশেই নতুন বাড়িও করছে। তার মুরগির খামারও রয়েছে। তার যেহেতু পুরানো সংসার, ধানের পরিমাণ বেশি। মাত্রই খামারের মুরগি বিক্রি শেষ করেছে কোহিনুর। মুরগির এ ঘরটাই ভালো করে পরিষ্কার করে নিয়েছে ধান শুকানোর জন্য। পরের সপ্তাহে মুরগি উঠানোর আগেই তার ধান গুছানো হয়ে যাবে। তখন তার ব্যস্ততা বাড়বে মুরগি নিয়ে। ১/২ দিনের বাচ্চা মুরগি এনে তা ২৭/২৮ দিন পর বিক্রি করে। তারপর আরও ধান আসবে। আর তখন মুরগির এ ঘরখানা খালি হয়ে যাবে। এখানেই ধান রাখবে। আর বাড়িতে বিভিন্ন ফল ও সবজির গাছ তো রয়েছেই। সেগুলোও কোহিনুরই দেখাশোনা করেন। কারণ তার স্বামী বিদেশে আর ছেলেরা ঢাকায় থাকে। এর মাঝে পাতা-খড়ি কুড়িয়ে এনে সেগুলো গুছিয়ে রাখছে রান্নার জন্য।
মাসুর বয়স ৩২ বছর। ৩ মেয়ের মা। বড় মেয়ের বয়স ১৩ বছর। মাসু জানাল, একটু বড় হয়ে উঠায় মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব আসছে। কিন্তু এখনই মেয়ের বিয়ে দেবে না মাসু। ১৮ পার হলে পরে ভাববে। স্বামী বিদেশে থাকায় আপাতত বাবার বাড়িতেই দোতালায় ৩ মেয়ে নিয়ে থাকে মাসু। শ্বশুর বাড়িতে তারও বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। বাড়ি তৈরি হলেই চলে যাবে। দাদার বাড়িতে গাড়ি যাওয়ার সুবিধা না থাকায় প্রায় ১০-১২ বছর আগে ওপাড়ে রাস্তার কাছে জায়গা কিনে বাড়ি করেছে মাসুর বাবা। এপাড়ে পুরানো বাড়ি প্রায় ভেঙে পড়ছে। প্রচুর গাছ থাকায় পাতা পড়ে পুরনো বাড়ি উপচে পড়েছে। দুপুরে মাকে নিয়ে মাসু দাদার বাড়ি গেল পাতা কুড়াতে।
নরসিংদীর শিবপুরের এদিকটাকে পাহাড়ি এলাকা বলে। গ্রাম্য ভাষায় বলে পাওড়া অঞ্চল। এখানে গ্রামগুলো সব টিলার উপরে। প্রতিটা বাড়িতে অনেক গাছ। সারা বছরের বেশির ভাগ জ্বালানি তারা নিজেদের এসব গাছ আর বাগান থেকেই পায়। আর ধানের জমিগুলো সব ঢালুতে। এক টিলা থেকে নেমে খেতের আইল দিয়ে আরেক টিলায় উঠতে হয়। তাই গ্রাম এক হলেও কারও বাড়ি গেলে সবাই বলে ওপাড়ে ওমুকের বাড়ি যাই।
ছোটবেলায় যখন গ্রামে যেতাম, ক্ষুধা না লাগলেও সন্ধ্যায় খেয়ে নিতে হতো। রাত ৮টা মানে তখন মনে হতো গভীর রাত। লিচুর সময়ে খালাকে দেখেছি রাত জেগে গাছ পাহারা দিতেন। সেই মগডালে একটা মুড়ির টিন বেঁধে তার মধ্যে একটি কাঠি বেঁধে দেওয়া হতো। দড়ি ধরে টান দিলে টং টং করে বাজত। বাদুড় ভয়ে চলে যেত। পাশের বাড়ির বউকেও খালা ঘুমাতে পাঠিয়ে দিতেন।
গ্রামের বৌ-ঝিরা বাড়ির সব কাজ শেষ করে নিজেরাও বেলাশেষে অনেক পরিপাটি হয়ে থাকে। এ বিষয়টা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সত্যি দিন বদলেছে! আগের দিনের মা-খালা-নানিদের মতো হয়তো তাদের হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়না। কিন্তু প্রায় সব কাজই তারা পারে এবং খুব খুশি মনে সমস্ত কাজ তারা গুছিয়ে করে সন্তান ও নিজেদের পরিপাটি করেও রাখছে। ছেলে-মেয়েদের খুব যে শাসন করছে, তাও না। ওরা নিজেদের মতো খেলছে, সন্ধ্যায় এসে হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসছে। তাদের হালকা কিছু নাস্তা খাইয়ে পড়তে বসাচ্ছে। আবার রাতের খাবার খাইয়ে রাত ১০টার মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। আগে মেয়েদের পড়াশোনা ছিল- স্বামীকে চিঠি লিখতে পারলেই হবে। এখন অনেক মেয়েরাই ঢাকায় সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। আজকের গ্রাম আর গাঁয়ের মানুষদের চিন্ত-ভাবনা অনেক উন্নত এবং আধুনিক। মেয়েরা গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে উচ্চ শিক্ষিত হয়ে চাকরি করে স্বালম্বীও হচ্ছে।

×