
ছবি: প্রতীকী
আমাদের প্রত্যেকের প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে, বিশেষ করে ভালোবাসার সম্পর্কে আমরা শৈশবের অভিজ্ঞতার একটা "সুটকেস" নিয়ে ঢুকি। এতে যেমন থাকে বিশ্বাস, স্নেহ বা সহানুভূতির মতো ইতিবাচক অভ্যাস, তেমনি থাকে মানসিক চাপ থেকে বাঁচার জন্য গড়ে তোলা কিছু কৌশল—যা তখন কাজে দিলেও এখনকার সম্পর্কে তা হয়ে উঠতে পারে জটিলতার কারণ।
এই লেখায় মনোবিজ্ঞানী মার্ক ট্র্যাভার্স তুলে ধরেছেন শৈশব থেকে আসা এমন চারটি ‘চরিত্র’ যেগুলো প্রাপ্তবয়স্ক ভালোবাসার সম্পর্কে এসে নতুন সমস্যা তৈরি করতে পারে, এবং কীভাবে এই চরিত্রগুলো থেকে বেরিয়ে এসে আমরা আরও গভীর, সৎ সংযোগ তৈরি করতে পারি।
১. শান্তিরক্ষক — যখন দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলাটাই ছিল বাঁচার উপায়
যদি আপনি এমন পরিবেশে বড় হন যেখানে ঝগড়া মানেই ভয়, চিৎকার বা শাস্তি, তাহলে আপনি হয়ত শিখেছেন কীভাবে নিজের অনুভূতিগুলো চেপে রাখতে হয়। আপনি হয়তো "না" বলতে পারতেন না, ছোট ছোট ঝগড়ায় কথা বলা বন্ধ করে দিতেন—এই অভ্যাসই প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে এসে আপনাকে আত্মপ্রকাশে বাধা দিচ্ছে।
২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত নিজের আবেগ দমন করে, তারা বেশি হতাশাগ্রস্ত, ক্লান্ত ও আত্মমর্যাদাহীনতায় ভোগে। আসলে, দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলা নয়—তা বোঝাপড়ার মাধ্যমেই সমাধান সম্ভব।
২. অতিরিক্ত পারফর্মার — যখন ভালোবাসা অর্জন করতে হতো
যদি আপনার শৈশব কেটেছে এমন অভিভাবকদের সঙ্গে, যারা দূরত্ব বজায় রাখতেন বা অতিরিক্ত প্রত্যাশা করতেন, তাহলে আপনি হয়ত শিখেছেন যে ভালোবাসা পাওয়া যায় "যোগ্যতা" দিয়ে—ভালো নম্বর, নিখুঁত আচরণ বা সাহায্যের মাধ্যমে।
এই অভ্যাস প্রাপ্তবয়স্ক সম্পর্কে এসে আপনাকে করে তোলে সবকিছুর দায়িত্ব নেওয়া একজন "ম্যানেজার"। কিন্তু আপনার ভিতরে একটা ভয় কাজ করে: "আমি যদি সবসময় কিছু না করি, তাহলে কি আমাকে আর পছন্দ করা হবে?"
২০২১ সালের এক গবেষণা বলছে, পারস্পরিক যত্ন-আত্তি সম্পর্কের মানসিক চাপ কমায় এবং উভয়ের মস্তিষ্কের কাজের দক্ষতা বাড়ায়। তাই নিজের যত্ন নিতে শেখা, ‘না’ বলার সাহস রাখা, এবং অন্যের কাছ থেকে যত্ন গ্রহণ করাও সম্পর্কের জন্য জরুরি।
৩. অতিসতর্ক পর্যবেক্ষক — যখন পরিস্থিতি আঁচ করতে পারাটাই ছিল নিয়ন্ত্রণের উপায়
যারা অস্থির, আবেগপ্রবণ পরিবেশে বড় হয়েছে, তারা প্রায়ই চারপাশের মানুষের আবেগ খুব ভালোভাবে ধরতে শেখে—এটা একটা বেঁচে থাকার কৌশল। প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে, এটি রূপ নেয় অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা আর ভুল বোঝাবুঝিতে।
সঙ্গীর একটু চুপ থাকা বা দেরিতে রিপ্লাই দেওয়াতেও আপনি ভেবে বসেন, “সে আমাকে আর চায় না।” এতে তৈরি হয় মানসিক টানাপোড়েন, যা সম্পর্ককে আরও দুর্বল করে তোলে।
এ থেকে মুক্তি পেতে হলে নিজের অনুভূতি নিজেই সামলানোর কৌশল শিখতে হবে। ছোট ছোট কথায় জিজ্ঞেস করতে পারেন, “তুমি একটু চুপ ছিলে, সব ঠিক আছে তো?”—এই সরল ভঙ্গি সম্পর্কে অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে।
৪. আত্মনির্ভরশীল শিশু — যখন আবেগ প্রকাশ ছিল ঝুঁকিপূর্ণ
যদি ছোটবেলায় আপনার অনুভূতিগুলো অবহেলা করা হতো বা আপনাকে বলা হতো, “তুমি খুব বেশি সংবেদনশীল”, তাহলে আপনি হয়ত শিখেছেন নিজের আবেগকে দমন করতে। প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে আপনি হয়ে উঠেছেন ‘কম চাহিদার’ মানুষ, অথচ ভিতরে ভিতরে নিজেকে অস্পষ্ট আর একা মনে করেন।
২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা আবেগগত অবহেলার শিকার হন, তাদের অনেকেই নিজের অনুভূতি সনাক্ত করতে পারেন না (alexithymia)। সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
এই বাধা কাটাতে হলে আপনাকে ধীরে ধীরে নিজের ভিতরের জগৎ অন্য কারও সামনে উন্মুক্ত করতে হবে। ছোট করে বলতে শুরু করুন, “আমি জানি না ঠিক কী অনুভব করছি, কিন্তু বলার চেষ্টা করছি”—এই সত্যতা সম্পর্ককে গভীর করে তোলে।
আপনার ভিতরের সেই ছোট্ট শিশুটি আপনার শত্রু নয়। বরং সে তখন যা করেছিল, তা ছিল বাঁচার জন্য তার বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ। এখন আপনি প্রাপ্তবয়স্ক—নিজের সেই শিশুকে নিরাপত্তা, ভালোবাসা আর সংযোগ উপহার দেওয়ার সময় এসেছে। আত্মসচেতনতা আর মানসিক নম্রতা দিয়েই আপনি সেই পুরনো অভ্যাসগুলোকে বদলাতে পারেন।
সূত্র: https://www.forbes.com/sites/traversmark/2025/04/18/4-childhood-roles-carry-into-your-love-life-by-a-psychologist/
রবিউল হাসান