
ছবি: প্রতীকী
একটি শান্ত, ধীর এবং সচেতন জীবনযাপন—জাপানের মানুষের দীর্ঘায়ু ও মানসিক শান্তির পেছনে লুকিয়ে আছে এমনই এক জীবনদর্শনের নাম ‘ইউটোরি’। বর্তমান দুনিয়ায়, যেখানে সব কিছুই দ্রুতগতির, সেখানে জাপান তুলে ধরেছে এক বিপরীত দর্শন। ‘ইউটোরি’ নামক এই জাপানি অভ্যাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—ধীরগতি অলসতা নয়, বরং এটি এক শক্তি, যা সুস্থতা ও সুখের পথে নিয়ে যেতে পারে।
ইউটোরির উৎপত্তি ও তাৎপর্য
‘ইউটোরি’ শব্দটি এসেছে জাপানি ভাষা থেকে, যার অর্থ 'স্বাচ্ছন্দ্য' বা 'প্রশস্ততা'। ২০০০ সালের গোড়ার দিকে জাপানে শিক্ষার্থীদের উপর চাপ কমানোর উদ্দেশ্যে প্রথমবারের মতো শিক্ষা ব্যবস্থায় এই ধারণার প্রয়োগ করা হয়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শনে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে বহু জাপানি মানুষ এই ধারণাকে প্রতিদিনের জীবনে বাস্তবায়ন করছেন, যাতে সাধারণ কাজেও শান্তি, ভারসাম্য এবং আত্মসন্তুষ্টি খুঁজে পাওয়া যায়।
ইউটোরি মানেই নিষ্ক্রিয়তা নয়
ইউটোরি মানে শুধু কাজ কমিয়ে দেওয়া নয়, বরং মানসিক ও সময়গত প্রশস্ততা তৈরি করা। উদাহরণস্বরূপ, মিটিংয়ের আগে পাঁচ মিনিট নিজেকে প্রস্তুত করার সময় নেওয়া বা রাতের খাবারের পরে ফোন ছাড়াই শান্ত হাঁটাহাঁটি করাও ইউটোরির চর্চা। এটি জীবনের তাড়াহুড়োর মধ্যে একটুখানি 'জায়গা' তৈরি করে, যেটি মানসিক চাপ কমায় এবং আরও পরিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করে।
মস্তিষ্কের জন্য ইউটোরির উপকারিতা
গবেষণায় দেখা গেছে, ছোট ছোট বিরতি মস্তিষ্কের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। 'কগনিশন' নামক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঘনঘন ছোট বিরতি মনোযোগ বৃদ্ধি ও কর্মক্ষমতা উন্নত করতে সাহায্য করে। ইউটোরি কর্টিসল হরমোনের মাত্রা হ্রাস করে, যা দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপের জন্য দায়ী। এটি বার্নআউট, স্মৃতিভ্রংশের মতো মানসিক সমস্যাগুলো প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
দীর্ঘায়ুর সাথে ইউটোরির সম্পর্ক
জাপানের অনেক অঞ্চল, বিশেষত ওকিনাওয়া, শতবর্ষী মানুষের জন্য বিখ্যাত। গবেষণায় দেখা গেছে, ইকিগাই, বনস্নান এবং ইউটোরির মতো জীবনযাপন পদ্ধতিগুলো তাদের দীর্ঘায়ুর পেছনে বড় ভূমিকা রাখে। এই অভ্যাসগুলো স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত রাখে, ঘুমের মান উন্নত করে এবং শরীরে প্রদাহ কমায়—যা দীর্ঘজীবনের জন্য অপরিহার্য।
পারিবারিক জীবনে ইউটোরির ভূমিকা
বিশেষ করে অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে ইউটোরি অত্যন্ত কার্যকর। এটি শেখায়, ছোট ছোট বিরতির মাধ্যমে শিশুর সঙ্গে আরও ভালো সংযোগ গড়ে তোলা যায়। উদাহরণস্বরূপ, শিশুকে তার নিজের গতিতে জুতা পরতে দেওয়া বা ধীর গতিতে সকালের নাস্তা ভাগ করে নেওয়া—এসব ছোট ছোট মুহূর্ত শিশুর মানসিক নিরাপত্তা ও ধৈর্য গঠনে সহায়তা করে।
একক কাজের গুরুত্ব
বর্তমান সময়ে মাল্টিটাস্কিং এক সাধারণ অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এটি মানসিক চাপ বাড়ায় ও ক্লান্তি ডেকে আনে। ইউটোরি শেখায়, একসাথে একটিমাত্র কাজ করাই শ্রেয়। এক কাপ চা ধীরে ধীরে উপভোগ করা, ফোন ছাড়া হাঁটা বা নির্ভেজাল কোনো কাজ—এসবই মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। এই ছোট ছোট পছন্দগুলোই দিনের মানসিক ছন্দ বদলে দিতে পারে।
ইউটোরি আমাদের শেখায়, জীবনে সাময়িক থেমে যাওয়া মানে পিছিয়ে পড়া নয়। বরং, এই ধীর গতি ও সচেতন উপস্থিতি আমাদের মানসিক প্রশান্তি, দীর্ঘায়ু এবং গভীর সম্পর্ক তৈরিতে সহায়ক হতে পারে। একটি ব্যস্ত ও চাপপূর্ণ পৃথিবীতে, ইউটোরি হতে পারে আত্মসুখ এবং সুস্থতার এক শক্তিশালী পথ।
সূত্র: https://timesofindia.indiatimes.com/life-style/health-fitness/health-news/how-to-master-yutori-the-japanese-secret-of-longevity-and-happiness/articleshow/120451147.cms
রবিউল হাসান