
আপনি কি প্রায়ই ভাবেন, যদি তখন ওভাবে করতাম, জীবনটা অন্যরকম হতো?এই ভাবনাটা একবার-দুবার হলে সমস্যা নেই। কিন্তু যখন এই চিন্তাই হয়ে ওঠে মনের স্থায়ী বাসিন্দা, তখন সেটাই ডেকে আনে এক ভয়ঙ্কর মানসিক জাল-যার নাম ‘প্যারালাল লাইফ এফেক্ট’।
এটি এমন এক মানসিক অবস্থা, যেখানে আপনি আপনার অতীতকে ‘নতুনভাবে’ কল্পনা করতে থাকেন যেখানে সবকিছু নিখুঁতভাবে ঘটে।‘যদি ওর সঙ্গে বিয়ে করতাম’, ‘যদি তখন ওই সিদ্ধান্তটা না নিতাম’, ‘যদি আমার পরিবারটা আরেকটু সাপোর্টিভ হতো’? যদি এমন চিন্তা আপনার মাথায় প্রায়ই আসে, তবে আপনি হয়তো "প্যারালাল লাইফ ইফেক্ট"-এর ফাঁদে আটকে পড়েছেন।
এটি এক ধরনের মানসিক প্রবণতা, যেখানে আমরা অতীতের ভুল বা অনিশ্চয়তার জায়গাগুলোতে বারবার ফিরে যাই এবং কল্পনা করি,সব ঠিকঠাক হলে আমাদের জীবনটা কী দারুণ হতে পারত! কিন্তু বাস্তবে এই ‘ভিন্ন একটা জীবন’ ভাবনার খরচ অনেক বড়। মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা বলছে, অতীতের ঘটনাগুলো বারবার নতুনভাবে সাজানোর এই প্রবণতা হতাশা, অপরাধবোধ, বিষণ্ণতা, এমনকি ভবিষ্যৎ নিয়েও বাড়তি উৎকণ্ঠার জন্ম দেয়।
এই মানসিক ফাঁদের তিনটি ভয়ংকর দিক রয়েছে, যা আপনার অজান্তেই আপনাকে গ্রাস করে ফেলতে পারে।
১. অতৃপ্তির বুদবুদে জড়িয়ে পড়ে থেমে যায় বর্তমান
অতীতের ভুল বা ‘ভিন্নভাবে হতে পারত’ এমন কল্পনা যখন ঘুরে-ফিরে মাথায় আসে, তখন আপনি বাস্তবিক কিছু করতে সাহস পান না।২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, অতীতকে কল্পনায় নতুনভাবে সাজানো মানুষদের মধ্যে হতাশা ও আত্মগ্লানির প্রবণতা অনেক বেশি থাকে।
প্রথমত, এটি এমন এক ধরনের আক্ষেপ তৈরি করে যা আপনাকে ভবিষ্যতের কোনো পদক্ষেপ নিতে বাধা দেয়। গবেষণা বলছে, অতীত নিয়ে বেশি ভাবনাচিন্তা করলে আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়, নিজেকে দোষারোপ করার প্রবণতা বাড়ে, এবং হতাশা গভীর হতে থাকে। আপনি বারবার মনে করতে থাকেন,'তখন ওটা করলে আজকের দিনটা অন্যরকম হতো'—এবং সেখানেই আপনি থেমে যান।ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি আর মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেলেন।
২. বাস্তবতা হয়ে ওঠে বিবর্ণ, কল্পনার জীবনই লাগে সুন্দর
যখন আপনি আপনার মনে গড়ে তোলা ‘আদর্শ অতীত’ নিয়ে পড়ে থাকেন, তখন বর্তমান জীবনটা ফ্যাকাশে আর অসার মনে হয়।এই কল্পিত বিকল্প জীবনের চিত্র বাস্তবতাকে ছোট ও দুর্বল করে তোলে। আপনি মনে করেন, বাস্তব জীবনটা যেন একঘেয়ে, নিষ্প্রাণ-যখন মাথার ভেতরে গড়ে ওঠে রঙিন, পারফেক্ট এক জীবনচিত্র। গবেষণায় দেখা গেছে, এমন চিন্তায় অভ্যস্ত ব্যক্তিরা অনেক সময় বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাদের বর্তমান জীবন নিয়ে তৃপ্তি কমে যায়, মানুষের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, এবং জীবনের লক্ষ্যগুলোকেও গুরুত্বহীন মনে হয়।
৩. আপনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়
“যদি আমি সেদিন এটা বলতাম...”, “যদি তখন ওইভাবে করতাম...”—এইসব ভাবতে ভাবতে একসময় আপনি বিশ্বাস করতেই শুরু করেন যে ভবিষ্যতেও আপনি কিছু পরিবর্তন করতে পারবেন না।
এভাবে নিজেকে ‘অক্ষম’ মনে করতে করতে আপনি বর্তমান সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নেন। সম্পর্ক ভেঙে গেলেও আর যোগাযোগ করতে সাহস হয় না, কারণ মনে হয় আবার একই ভুল হবে।এই মানসিকতা ধীরে ধীরে আপনার নিজের নিয়ন্ত্রণবোধকে দুর্বল করে তোলে।
আপনি মনে করতে শুরু করেন—'তখন কিছু করতে পারিনি, এখনো পারব না।’ এই ভাবনা আপনাকে জীবনের চালকের আসন থেকে সরিয়ে দেয়। আপনি ছোট ছোট সিদ্ধান্তেও পিছিয়ে যান, আর নিজেকে দোষারোপ করতে থাকেন—যার ফলে জীবনে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
তবে এই অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় আছে। আপনি যদি অতীত নিয়ে ভাবতেই চান, তাহলে ভাবুন—“এখন আমি কী করতে পারি?” সেই ব্যর্থতা বা আক্ষেপ থেকে কী শিখলেন, সেটি খুঁজে বের করুন।মনে রাখবেন, কল্পিত অতীত বদলানো সম্ভব নয়, কিন্তু এখনকার সিদ্ধান্ত আপনার ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারে। ছোট ছোট পদক্ষেপ যেমন,দিনে পাঁচ মিনিট নিজের অনুভূতি লিখে রাখা, কাউকে একটা পুরনো মেসেজ পাঠানো, বা কাউন্সেলিংয়ের সময় নির্ধারণ করাও আপনাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
আপনার জীবনের সিনেমাটা হয়তো পারফেক্ট নয়, কিন্তু এটি এখনো চলছে। তাই বারবার ভাববেন না ‘কি হতে পারত’, বরং ভাবুন—‘এখন আমি কী করতে পারি আমার বর্তমানকে আরও অর্থবহ করে তুলতে।’
সূত্র:https://tinyurl.com/mksw7dwj
আফরোজা