ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ২ বৈশাখ ১৪৩২

সাতটি বাক্য যা আপনাকে বলবে

আপনার বাবা- মা দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত ছিল না

প্রকাশিত: ২৩:৫৩, ১৫ এপ্রিল ২০২৫

আপনার বাবা- মা দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত ছিল না

ছবি: প্রতীকী

 


 

শৈশবে আমাদের বাবা- মা আমাদেরকে যা যা বলতেন তার প্রায় সবই আমাদের মনে আছে। তারমধ্যে কিছু যেমন আমাদের আনন্দ দেয়, স্মৃতিকাতর করে তেমন কিছু মনে বিষাদ আনে। 

 

আপনি কি কখনো সেসব স্মৃতির পিছনে বলা কথার অর্থ নিয়ে ভেবেছেন?  

 

এই ভাবনা চিন্তার কারণ শৈশব জীবনে তাদের ব্যবহার করা এই বাক্যগুলো আমাদের বেড়ে ওঠায় গভীর প্রভাব ফেলে। হ্যাঁ, স্বাভাবিকভাবেই সব বাক্য খারাপ ছিল না বরং মিষ্টিমধুর এবং হাস্যরসাত্মক ছিল। কিন্তু বাকি কথাগুলো?

 

আপনি যদি এমন কিছু বাক্যের সাথে পরিচিত থাকেন যেখানে আপনার মনে হয়েছে আপনার কথা কেউ শুনলো না, আপনার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হলো না, বা আপনাকে গোনায় ধরা হচ্ছে না, হতে পারে আপনাকে যারা লালন পালন করেছে তারা এই দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না। 

 

এই নিবন্ধে আমরা এমন সাতটি বাক্যকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করবো। দোষ দেওয়া বা কটাক্ষ করার জন্য নয় বরং আপনার বোঝার জন্য যে এই বাক্যগুলো আপনার বেড়ে ওঠায় কেমন প্রভাব ফেলেছে এবং এই ব্যাপারগুলো জেনে আপনার যৌবন বয়সে কীভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।    

 

কারণ কোন দুঃসময় কাটিয়ে ওঠার প্রথম ধাপই হলো সে সম্পর্কে বুঝে ওঠা। তাই নয় কি? 

 

তাহলে জেনে নেওয়া যাক সাতটি বাক্য এবং এগুলো আমাদের জীবনে কী ধরনের ইঙ্গিত বহন করে। 

 

১. কারণ আমি বলেছি তাই

আমরা সবাই এই বাক্যের সাথে পরিচিত তাই না? এটা হল বাবা- মার সেই চিরচেনা ক্ষমতার ব্যবহার। যে বাক্যের মাধ্যমে আলোচনা শেষ হয়ে যেতে বাধ্য। 

 

কিন্তু এই বাক্যটি কোন ধরনের অর্থ বহন করে? মূলত এটা দিয়ে তারা বোঝায়, ‘আমি তোমার বস। তোমাকে কোন কিছুর ব্যাখ্যা দিতে আমি বাধ্য নয়’। এটা দিয়ে আপনার উৎসাহ, কোন কিছু জানার আগ্রহকে নষ্ট করে দেওয়া হয়। হ্যাঁ, শিশু যখন অবাধ্য আচরণ করে, বা তাদের নিরাপত্তার ব্যাপার থাকে তখন বাবা-মা এই বাক্যের ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু যখন বারবার অসাবধানতা বশত এই বাক্য ব্যবহার করা হয় তখন একটি শিশু মনে করে তার কোন ক্ষমতা নেই, তাকে কেউ শুনছে না। এই মনস্তাত্বিক চাপ তাকে সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে বাঁধা দেয়। 

 

আমরা সময় নিয়ে আমাদের সন্তানকে বোঝানোর মাধ্যমে তার মধ্যে যুক্তি, সহানুভূতি, এবং আলোচনার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বিকশিত হয়। এরপর থেকে যখন আমাদের ‘আমি বলেছি তাই’ বলে আলোচনা থামিয়ে দিতে ইচ্ছে করবে, তখন এই বাক্যের ব্যবহার না করে সহনশীল কোন বাক্যের কথা চিন্তা করতে হবে। 

 

২. কাঁদা বন্ধ কর নাহলে তোমাকে কাঁদার জন্য কোন কারণ দেব

এই বাক্যটা আমার শৈশবে এত স্পষ্টভাবে শুনেছিলাম যে আমার এখনো মনে আছে। এই বাক্যের অর্থ এমন না যে আপনাকে থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে বরং আপনাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। 

 

আমার মনে আছে, আমার বয়স যখন সাত তখন আমি সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে আমার হাঁটু বাজেভাবে ছিলে ফেলি। আমি কাঁদছিলাম কিন্তু আমি আদর পাওয়ার বদলে এই বাক্যটি শুনতে পায়। আমরা না কাঁদতে শিখে যায় কারন যদি কাঁদি তাহলে পরিণাম হয়ত ভাল হবে না। 

 

কিন্তু আবেগ অনুভূতি মানবজীবনের অংশ। আমাদের আবেগ অনুভূতিগুলো প্রকাশ করার মাধ্যমে আমরা মানসিক শান্তি পায় এবং কিভাবে এই আবেগকে মানিয়ে নিয়ে চলতে পারি তা শেখা যায়। এজন্য আমাদের সন্তানদের অনুভূতিকে দমন না করে বরং তাদের বোঝাতে হবে মন খারাপ হওয়া, কষ্ট পাওয়া, ব্যথা পাওয়া স্বাভাবিক ব্যপার। এর মাধ্যমে শিশুরা তাদের আবেগ অনুভূতি না লুকিয়ে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারবে।  

 

৩. আমি তোমার জন্য সব করি

এই একটি বাক্য খুব গভীরভাবে দাগ ফেলে, না? এই বাক্যের মাধ্যমে আমাদের শিশু মন অপরাধবোধে ভরে যায়। এটা এমন যে তারা স্বাভাবিক কথার মাধ্যমে আমাদের দোষারোপ করছে। 

 

আমরা কোন না কোন সময় এই বাক্যটি আমাদের বাবা- মার থেকে শুনেছি। হয়ত রুম পরিষ্কার করতে বলার পর করিনি এজন্য অথবা বাসন গুছিয়ে রাখতে ভুলে গিয়েছি  এজন্য। এরপর হঠাৎ করেই আমরা শুনি, ‘আমি যা করি সব তোমার জন্য করি’। ব্যাপারটা এমন হয়ে যায় যে তাদের সব ভালোবাসা, আদর, সাহায্য ব্লাকমেইল হিসাবে ব্যবহার করছে। একটি শিশুর জন্য এই জিনিস হজম করা বেশ কষ্টসাধ্য।

 

সত্য কথা বলতে, বাবা- মা হওয়া মানে সন্তানদের দেখভাল করা, তাদের আদর- যত্ন করা, সাহায্য- সহযোগিতা করা। এগুলো করার জন্য তাদের কথা শোনানো নয়। এটা বাবা-মার দায়িত্ব, করুণা নয়। এজন্য আমাদের সবসময় খেয়াল রাখতে হবে আমাদের সন্তানদের যেন আমরা অপরাধবোধে না ভোগায়। তাদেরকে জন্য যেন স্বাভাবিকভাবেই আদর- ভালোবাসা দিয়ে বড় করি।  

 

৪. তুমি একদম তোমার (বাবা/ মা/ ভাই/ বোনের) মত

তুলনা করা মানুষের বৈশিষ্ট্য কিন্তু এই তুলনা যখন সন্তান লালন- পালনে করা হয় তখন সেটা ভালোর থেকে মন্দ হয় বেশি। 

 

নিজের ভাই/ বোনের সাথে তুলনা করলে তাও আবার যদি হয় নেতিবাচক অর্থে, তা শিশুর আত্মসম্মানবোধকে ক্ষুণ্ণ করে। এই বাক্য এমন অর্থ প্রকাশ করে যে আপনি আলাদা কেউ না। আপনি আর পাঁচটা মানুষের মতোই, যাদের মধ্যে ভালো গুন কম। 

 

মনে রাখবেন প্রত্যেক শিশুই তাদের নিজস্ব দিক দিয়ে স্বতন্ত্র। তাদের নিজস্ব সবলতা এবং দুর্বলতা আছে। তারা যেমন তেমন গুনের ভিত্তিতে সম্মান পাওয়ার অধিকার তাদের আছে। এজন্য তাদের ব্যর্থতা যদি আপনাকে কোন নেতিবাচক ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয় তা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকুন। 

 

৫. তোমার বাবা/ মা বাড়ি না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর

আরেকটি বাক্য যা শোনার সাথে সাথে আমাদের শিশু মনে ভয় ধরে যায়। 

 

কখনো ভেবে দেখেছেন এই বাক্যটা সম্পর্কের ভারসাম্য কিভাবে নষ্ট করে? 

 

এর অর্থ হচ্ছে একজন অভিভাবক নিয়ম প্রণীত করবেন এবং অন্যজন কোন মতামত ছাড়া তাতে সম্মতি দেবেন। যে দায়িত্বটা আপনার পালন করার কথা তা আপনি আপনার পার্টনারের হাতে তুলে দিচ্ছেন। 

 

আপনি জানলে অবাক হবেন, গবেষণা বলে, যেসকল পরিবারে দুজন অভিভাবিকেরই সমান কর্তৃত্ব ছিল সে পরিবারের শিশুদের অন্যদের থেকে সামাজিক দক্ষতা বেশি এবং আচরণগত অসঙ্গতি কম।  

 

এজন্য বাবা- মা উভয়কেই সমানভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। 

 

৬. তুমি কেন ওর ( আপনার পরিচিত কেউ) মত হতে পারো না

এই বাক্যটি আমাদের শৈশবে আমরা সবাই শুনেছি এবং নিজেকে নিজের কাছে ছোট মনে করেছি। এই তুলনা দেওয়ার বিষয়টা কষ্ট দেয় শিশু মনে। এটা শুনে আমাদের মনে হয়েছে আমরা তাদের জন্য যথেষ্ট ভালো না। 

 

সব শিশুদেরই কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে এবং বাবা- মার উচিত তাদের সেই বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রশংসা করা, মূল্যায়ন করা। 

 

৭. আমার কথার পাল্টা উত্তর দেবে না

এই বাক্যটি স্পষ্ট বার্তা দেয় যে আপনার মতামত, অনুভূতি, কথা কোন গুরুত্ব রাখে না। 

কিন্তু রাখে। আসলেই রাখে।  

 

শিশুদের সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে তাদের কথা শোনা, তাদেরকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেওয়া, তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা তাদেরকে তাদের নিজের জন্য কথা বলতে, তাদের মতামতকে প্রকাশ করতে সাহায্য করে। আমাদের উচিত আমাদের সন্তানদের উৎসাহ প্রদান করা যেন তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, আবেগ- অনুভূতি আমাদেরকে জানায়। 


 

শৈশবের এই স্মৃতিগুলো বুঝতে পারা হয়ত আপনাকে বিমর্ষ করবে, আপনি বিভ্রান্ত হয়ে যাবেন, আপনাকে কষ্ট দেবে এবং এটা স্বাভাবিক। কোন সমস্যা নেই। এটা দোষারোপ করা বা অভিমান পুষে রাখার কোন বিষয় না।

 

এই জিনিস বোঝার সুন্দরতা হল আপনি যেন আপনার জমে থাকা অভিমান দূর করতে পারেন এবং চিরন্তন চলে আসা এই রীতি ভাঙতে পারেন। আপনি এবং আপনার সন্তান যেন একটি সুন্দর জীবন অতিবাহিত করতে পারেন। 

 

মনে রাখবেন, সন্তান লালন- পালন একটি যাত্রা, কোন গন্তব্য নয়। এটি শেখার, শেখানোর, ভুল করার, এবং আবার চেষ্টা করার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এজন্য কিভাবে কোন কথা বললে আপনার সন্তানের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না তা চর্চা করুন এবং আপনি যেমন বাবা- মা চেয়েছিলেন তেমন বাবা- মা হয়ে উঠুন। 

 

সুরাইয়া

×