
হার্ট অ্যাটাক
৪০ থেকে ৫০ এই বয়স সীমায় হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধির পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ বা ‘রিস্ক ফ্যাক্টর’ কাজ করে। এছাড়া খুব স্বাভাবিকভাবেই বয়স বাড়ার সাথে শরীরের ভেতরে নানান পরিবর্তন ঘটে, যা হৃদযন্ত্রের ওপর প্রভাব ফেলে। ধমনীর সংকোচন ও ব্লকেজ: বয়স বাড়ার সাথে সাথে ধমনীতে কোলেস্টেরল জমতে থাকে, যা ধমনীকে ধীরে ধীরে সংকুচিত করে ফেলে। রক্তের মধ্যে অনেক ধরনের উপাদান থাকে যা ধমনীর মধ্যে অল্প অল্প করে জমতে থাকে ফলে রক্ত চলাচলের রাস্তা সরু হয়ে যায়। তৈরি হয় ‘ব্লকেজ’।
“এই প্রক্রিয়াকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস’। এর ফলে হৃদযন্ত্র পর্যাপ্ত রক্ত ও অক্সিজেন পায় না, যা ‘হার্ট অ্যাটাক’য়ের অন্যতম কারণ”- বলছিলেন সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান কামরুল হাসান। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস: বেশিরভাগ মানুষই চল্লিশের পর উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন, যা হার্ট বা হৃদযন্ত্রের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করে। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ ধমনীগুলোকে শক্ত ও সরু করতে থাকে। ফলে রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয় এবং হার্ট অ্যাটাকেরও ঝুঁকি বাড়ে। মানসিক চাপ ও উদ্বেগ: মানসিক চাপকে হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম ঝুঁকির কারণ হিসেবে দেখেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কামরুল হাসান।
এই বয়সে কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত জীবনের নানান চাপে মানুষ মানসিকভাবে বেশি বিপর্যস্ত থাকে। অতিরিক্ত মানসিক চাপের ফলে ‘স্ট্রেস হরমোন’ (কর্টিসল ও অ্যাড্রেনালিন) নিঃসৃত হয়, যা রক্তচাপ বাড়ায় ও হৃদরোগের ঝুঁকি সৃষ্টি করে।
জিনগত কারণ: পরিবারে যদি কারও হৃদরোগের সমস্যা থাকে, তবে সেই ঝুঁকি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হতে পারে। বিশেষ করে বাবা-মা যদি পঞ্চাশের আগে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক করে থাকেন, তাহলে সন্তানদেরও একই ধরনের ঝুঁকি থাকে। জিনগত সমস্যা থাকলে হার্ট অ্যাটাক খুব হঠাৎ করেই হয়। আগে থেকে এর লক্ষণও খুব বেশি বোঝা যায় না। “তাই হার্টঅ্যাটাকের বংশগত ইতিহাস থাকলে, এমন ব্যক্তিদের আমরা চার বা ছয় মাসে একবার হার্ট পরীক্ষা করাতে পরামর্শ দেই”- বলছিলেন এই চিকিৎসক।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন: চল্লিশের পর অনেকেই ব্যস্ততার কারণে খাবারের দিকে খেয়াল রাখেন না। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত, প্রক্রিয়াজাত, উচ্চ লবণ ও চিনিযুক্ত খাবার গ্রহণ ধমনীগুলোর সংকোচন ঘটাতে পারে, যা হৃদরোগের কারণ।
অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা: বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের বিপাক ক্রিয়া ধীর হয়ে যায়, ফলে ওজন বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত ওজন হৃদযন্ত্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, যা হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা বাড়ায়।
ধূমপান ও অ্যালকোহল গ্রহণ: এই দুটি অভ্যাস ধমনীর স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট করার পাশাপাশি রক্তচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে হার্টের কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে।
অনেক সময় দেখা যায় নিয়মিত ব্যায়াম করা বা খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত মানুষও হার্ট অ্যাটাকের শিকার হচ্ছেন। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ কামরুল হাসান।
হঠাৎ অতিরিক্ত ব্যায়াম: অনেকেই নিজেদের ‘ফিট’ বা সবল রাখতে চরম মাত্রার ব্যায়াম বা ‘ওয়ার্কআউট’ করেন, যা হৃদযন্ত্রের ওপর অতিরিক্ত চাপ ফেলে এবং হৃৎপিণ্ডের পেশিগুলোর ক্ষতি করতে পারে।
অপ্রকাশিত হৃদরোগ: অনেক ক্রীড়াবিদ বা ফিটনেসপ্রেমী হয়ত বুঝতেই পারেন না যে, তাদের ধমনীতে ‘ব্লকেজ’ তৈরি হয়েছে। ফলে তারা স্বাভাবিক জীবনযাপনের মধ্যেই হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন।
ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা: অতিরিক্ত ঘামের মাধ্যমে দেহ থেকে সোডিয়াম (লবণ), পটাসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম বেরিয়ে যায়। যা হৃদযন্ত্রের অনিয়মিত স্পন্দনের কারণ হতে পারে।
অতিরিক্ত ক্যাফিন বা এনার্জি ড্রিংকস: অনেকেই ব্যায়ামের আগে বেশি পরিমাণে ক্যাফিন বা এনার্জি ড্রিংকস গ্রহণ করেন, যা হঠাৎ রক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে পারে। এতে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে।
অনেক সময় হার্ট অ্যাটাকের আগে শরীর কিছু সংকেত দেয়। এগুলো খেয়াল করলে এবং দ্রুত ব্যবস্থা নিলে বড় বিপদ এড়ানো সম্ভব।
বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি, যা কয়েক মিনিট ধরে থাকে বা কমে গিয়েও আবার ফিরে আসে।
- কাঁধ, বাহু, ঘাড়, চোয়াল বা পিঠে ব্যথা অনুভব করা
- অতিরিক্ত ঘাম হওয়া
- শ্বাসকষ্ট বা হাঁপিয়ে যাওয়া
- মাথা ঘোরা বা বমি বমি ভাব
- দুর্বলতা বা অস্বাভাবিক ক্লান্তি অনুভব করা
- অনিয়মিত বা দ্রুত হৃদস্পন্দন (হার্ট বিট)
- হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে করণীয়
হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমাতে কিছু নিয়ম মেনে চলার পরামর্শ দেন ডাক্তাররা
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা
প্রতিদিন প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল, বাদাম ও আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে। চর্বি ও ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
কোনো ভাবেই লবণ ও চিনি খাওয়া মাত্রা বাড়ানো যাবে না। সম্ভব হলে লবণ ও চিনি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
নিয়মিত ব্যায়াম করা
প্রতিদিন অন্তত ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট হাঁটাহাঁটি, দৌড়ানো বা সাইক্লিং করা উচিত। তবে কোনো ভাবেই অতিরিক্ত ব্যায়াম করা যাবে না বরং পরিমিত মাত্রায় শরীরচর্চা করা উচিত।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
উচ্চতা অনুযায়ী ওজন নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। অতিরিক্ত ওজন থাকলে তা ধীরে ধীরে কমানোর চেষ্টা করতে হবে।
ধূমপান ও অ্যালকোহল ত্যাগ করা
ধূমপান ও অ্যালকোহল হৃদরোগের বড় কারণ। তাই এগুলোর অভ্যাস থাকলে পরিহার করতে হবে।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা
ধ্যান, যোগব্যায়াম ও পর্যাপ্ত ঘুমের মাধ্যমে মানসিক চাপ কমাতে হবে। এছাড়াও অবশ্যই কাজের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা
বছরে অন্তত একবার রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, রক্তের শর্করা (সুগার) পরীক্ষা করতে হবে। ইসিজি বা ইকোকার্ডিওগ্রাম করিয়ে হৃদযন্ত্রের অবস্থা জানা একান্ত দরকার।
শহীদ