
৮ মার্চ পালিত হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবস। যদিও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কোনোভাবেই দিন ক্ষণে আটকে থাকে না। প্রতিদিনের যন্ত্রণা, ধকল, বিপরীত স্রোত মোকাবিলা করে নারীর যে ক্লান্তি আর অবসাদ তা যুগ যুগান্তরের দুর্বিপাক।
আলাপ করছিলাম একজন সুশিক্ষিত নারী লায়েকা বশীরের সঙ্গে। পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছেন ‘ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক’-এর শিক্ষক। পিতার নাম বশীর আলহেলাল। মাতা ফিরোজা বেগম। এক পুত্র আর কন্যা সন্তানের প্রতি তেমন কোনো বৈষম্য তৈরি না করার বিষয়টিও লায়েকা বশীরের জীবনে পরম পাওয়া। সমতার বন্ধনে নির্মল পারিবারিক পরিবেশে শৈশব কৈশোর অতিক্রান্ত করা জীবন পরিপূর্ণ হয়ে ওঠা। তেমন ধারাবাহিকতায় শিক্ষাজীবনও হয়েছে সমৃদ্ধ, যুগোপযোগী আর সময়ের নির্মাল্যে। ঢাকা শহরের মোহাম্মদপুরে আদি নিবাস। সংগতকারণে প্রিপারেটরি গার্লস হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক করেন সফলতার সঙ্গে। ফলে ভর্তি হয়েছেন রাজধানীর আর এক স্বনামধন্য কলেজ হলিক্রসে। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একেবারেই প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হতে পারা শিক্ষাজীবনের পরম পাওয়া। নারী দিবসের আলোচনায় উঠে আসে সমাজে সমসংখ্যকের অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ। নিজের তৈরি হওয়া যতই অনুকূল হোক ছোট বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে নারীর অবদমন, অধিকারহীনতা, অভিঘাত এসব নিয়েও ভাবেন। মর্মাহত হন। কেন সমাজে নারী-পুরুষের ফারাক তারতম্য আজও ঘোচানো গেল না? বহুতল ভবন, স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘেরা রাজধানীর জীবন আর সিংহভাগ গ্রামীণ মানুষের প্রতিদিনের ঘটনাপঞ্জি এক নয়। ঐতিহ্যিক বিভিন্ন সংস্কারে আবদ্ধ চিরায়িত প্রচলিত আবেষ্টনী। সেখানে শারীরিকভাবে কমনীয় নারী বাধা বিঘ্নতায় প্রতিনিয়ত কিভাবে বিপন্ন হচ্ছে সেটাও কঠিন বাস্তবতা আর বিচলিত হওয়ার মতোই। নারীর অধিকার, স্বাধীনতার প্রথম বিভেদের পাহাড় তৈরি করে পরিবার। যেখানে কন্যা সন্তানের জন্মই যেন আজন্মের পাপ। তার ওপর আছে বাল্য বিয়ের মতো চরম দুরবস্থা। শুধু কি বাল্য বিয়ে? তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য অকাল মাতৃত্বও। কিন্তু পুত্র সন্তানের বেলায় সে সব কোনো সামাজিক বিধি কেন প্রয়োগ করা যায় না যা আজও কঠিন শৃঙ্খল। জন্মের সময় গর্ভবতী মাও শঙ্কিত থাকে তার কন্যা না পুত্র সন্তান পৃথিবীর আলো দেখবে। লায়েকা বশীর ভাবছেন দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা এমন রুদ্ধতার জাল থেকে নারীদের কিভাবে মুক্তি মিলবে? শুধু শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে? নাকি পুরুষের মতোই কোনো পেশায় সম্পৃক্ত হয়ে উপার্জনক্ষম হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করা। সমাজ বিজ্ঞানী কার্ল মার্কসও বলেছেন অর্থনীতিই সমাজের মূল কাঠামো। তার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে সেই সমাজের পরিবার, শিক্ষা, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ। নিজের জীবন আর চারপাশের প্রতিবেশ পরিস্থিতি তাকে উপলব্ধি করায় আসলেই আর্থিক ক্ষমতা সম্পন্ন নারীই সচেতন দায়বদ্ধতায় সব অর্জন করে। বংশানুক্রমিকভাবে অর্পিত অনেক কিছুর ওপর কন্যার সমঅধিকার থাকেই না। যেখানে বিভেদ বিভাজন অযৌক্তিক অপ্রাসঙ্গিকই নয় অযাচিতও বটে। এমনকি নারীর জন্য বৈষম্যনিরোধক সনদ সিডিও পর্যন্ত পিতার সম্পত্তিতে কন্যার সমঅধিকার বিষয়ে কোনো সুরাহা করতে পারেইনি। ক্ষোভ আর কষ্টের সঙ্গে ব্যক্ত করলেন শুধু কি সম্পত্তি? শ্রমিক হিসেবেও পুরুষের চাইতে নারীরা কম বেতন পায়। যা আন্তর্জাতিক শ্রম আইন অনুমোদনই দেয়নি। কর্মজীবী যে কোনো নারী তিনি শিক্ষক, উকিল, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, চিকিৎসক, প্রকৌশলীকে সংসার সামলিয়ে তার পেশাগত জীবন বয়ে নিয়ে যেতে হয়।
এছাড়াও আছে নারীদের মাতৃত্বকালীন সময়। পরবর্তীতে কোলের শিশুকে যত্ন-আত্তিরে বড় করা। বাসায় যদি বৃদ্ধ পিতা-মাতা থাকেন তাদের দেখভালও যেন এক পালনীয় কর্তব্য। কিন্তু পুরুষের বেলায় সেটাও সচরাচর দৃশ্যমান হয় না। তবে এমন সব অপরিহার্য শ্রম বিনিয়োগ সেভাবে ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না। ধরেই নেওয়া হয় মাতৃত্ব যেন মেয়েদের সহজা। সেভাবে সার্বিক দায়বদ্ধতাও যেন মায়েরই পালনীয় কর্তব্য। এমন অসাম্য-বৈষম্যের বোঝা বয়ে বেড়ানো নারীরা ক্ষমতা প্রয়োগে কতখানি স্বাচ্ছন্দ্য আর সক্ষম তাও পাদ প্রদীপের আড়ালে থাকেই না। আক্ষেপের সুরে বলছেনÑ এসব নিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সভা-সমিতি, সেমিনার, সম্মেলন দৃষ্টিনন্দনভাবে দৃশ্যমান। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো ইতিবাচক ফলপ্রসূ সমাধান আজও অদৃশ্য এক বাতাবরণ। নারীরা শিক্ষিত হচ্ছেন। বৈচিত্র্যময় পেশায় নিজেদের সম্পৃক্তও করছেন। ব্যবসাবাণিজ্যেও তাদের সফল অভিগমন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে নারীরা এখন বেশ এগিয়ে। কিন্তু ক্ষমতা অর্জন আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় সেই পুরাকালের সংস্কৃতিকে লালন করে নিজেদের মতামত প্রকাশেও ধূম্রজাল তৈরি হয়। কিভাবে এর অবসান তাও অজানা এক জগৎ। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের মধ্যাহ্নে দাঁড়িয়েও এই শিক্ষক কোনো আশার আলো দেখতে কেন যেন পিছু হটছেন। সর্বশেষ মন্তব্যে অর্থনীতিকেই মূল নির্ণায়ক ধরে নারীকে নিজের পায়ের ওপর ভর করতেই হবে বলে জানান। উপার্জনক্ষম নারীই শেষ অবধি তার ক্ষমতা, সিদ্ধান্ত, পারিবারিক সম্পত্তিতে সমান অংশীদারত্ব সবই পেতে পারে বলে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ^াস করেন। উপার্জনের দিক থেকে শিক্ষিত নারীরা খুব একটা পিছিয়ে নেই। সেখানেও কত বাধা-বিপত্তি, বিঘ্নতায় তাদের নিত্যজীবন অতিষ্ঠ হয় সেটাও যেন সমসংখ্যকের এক অবধারিত দুর্ভোগ।
বর্তমানে বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে নতুন সমাজ গঠন প্রক্রিয়ায় আধুনিক এক বৈষম্যহীন পরিবেশ গড়ার মহতি লক্ষ্যে। সেখানে সংস্কারের মাধ্যমে অনেক কিছু রদবদল ও আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। চিরায়ত অবরুদ্ধতার জাল বিচ্ছিন্ন করতে নারীদের জন্যও নতুন সময়ের সংস্কার অত্যাবশ্যক। কন্যা, জায়া, জননীকে তার যথার্থ অধিকার আর মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে গেলে মানুষের কাতারে তাকে দাঁড় করানো জরুরি। কবিগুরুও বলেছেন তাঁর ‘নারী’ প্রবন্ধে মঙ্গল আর মাধুরি নিয়ে নারী পুরোপুরিই মানুষের সম্মানে বেঁচে থাকা বাঞ্ছনীয়। বিধাতা নাকি নারীর মধ্যেই সৃষ্টির বেদনা যেমন দিয়েছেন তেমনি জীবন চলার সার্বিক সক্ষমতাও নাকি নারীর দেহ-মনে। বিশেষ করে যোগাযোগ উপন্যাসে কুমুর যে চারিত্র্যিক দৃঢ়তা তা স্বামী মধুসূদনের ঐশ^র্যকেও অতিক্রম করে যায়। নারী দিবসের তাৎপর্যে নারীরাই শক্ত হাতে নিজের মতো করে এগিযে যাবে তার সক্ষমতা, অধিকার, মানুষ ভাবার প্রত্যয় নিয়ে।
অপরাজিতা প্রতিবেদক