
‘শোনো নারী/তুমি চাইলেই পারো সব/চোখ বুজে কেন?/ কেন রবে মুখ চেপে অঁাঁচলে/তোমরাই তো জলতরঙ্গে সুর-তাল-লয় এনেছো’ ... যেখানে পুরুষরা ব্যর্থ, সেখানে নারীরা সফল। সারাদেশের মতো জেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে এ্যাথলেটিস সাম্প্রতিক যেখানে বারবার মুখ থুবড়ে পড়ছে, আসছে না কোনো সাফল্য, সেখানে কুড়িগ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদের একটি দ্বীপচরে বেড়ে ওঠা ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী সুবর্ণা খাতুন ৫৩তম শীতকালীন জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দীর্ঘ লাফ ও ৪০০ মিটার রিলে দৌড় প্রতিযোগিতায় জাতীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। তার অভাবনীয় সাফল্য সত্যিই তাক লাগিয়ে দিয়েছে কুড়িগ্রাম জেলার মানুষদের। প্রশংসায় ভাসছে সারা জেলার মানুষের কাছে। মাত্র কয়েক বছর আগেও এ অঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকার মেয়েদের খেলাধুলা তো দূরের কথা পড়াশোনা করতে বাইরেও যেতে দিত না। অথচ আজ এ অঞ্চলের মেয়েরা জাতীয় পর্যায়ে সফলতা নিয়ে আসছে।
চরম দারিদ্র্যতায় বেড়ে ওঠা সুবর্ণা খাতুন। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া এই শিক্ষার্থী পড়ালেখার পাশাপাশি ক্রীড়াক্ষেত্রেও চমক দেখিয়েছে। প্রতিদিন বিকেল নামতেই মাঠে অনুশীলন শুরু করে সে। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে তার কঠোর অনুশীলন। গ্রামবাসী ও স্কুলের সহপাঠীরা প্রতিদিন এ চিত্র দেখে। গ্রামবাসী হাসাহাসি আর টিটকারী করলেও কখনোই কিছু মনে করেনি সুবর্ণা। একনিষ্ঠভাবে সে তার কাজ করতে থাকে। চলতে থাকে তার অনুশীলন। ফকিরেরহাট স্কুল মাঠে অথবা কোন বালুর চরে তার অনুশীলন। তার অক্লান্ত পরিশ্রম আর বুদ্ধিমত্তায় আজকের এ সাফল্য ধরা দিয়েছে।
সুবর্ণার এই অসামান্য সম্মান অর্জন করায় সহপাঠী ও শিক্ষকরা উচ্ছ্বসিত। তার এমন কৃতিত্বে দুদিন ধরে এলাকায় মিষ্টি বিতরণ ও আনন্দ র্যালি করেছে সুবর্ণার সহপাঠীরা। সুবর্ণার বাড়ি কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রানীগঞ্জ ইউনিয়নের ফকিরেরহাট বাজার এলাকায়। সে ফকিরেরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী।
সুবর্ণা জানায়, আমি খেলাধুলা অনেক পছন্দ করি। আমাদের স্কুলে খেলাধুলার প্রতিযোগিতা হলে আমি অংশগ্রহণ করি। এবারেও শীতকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেই। উপজেলা, জেলা ও বিভাগ পর্যায়ে খেলে জাতীয় পর্যায় গেছি। সেখানেও আমি দীর্ঘ লাফ (লং জাম্প) ও ৪০০ মিটার রিলে দৌড়ে প্রথম হয়েছি। অনেক ভালো লাগছে, সরকারিভাবে সহায়তা পেলে শুধু জাতীয় পর্যায় না আন্তর্জাতিকভাবে খেলে দেশের সুনাম অর্জন করতে চাই।
সুবর্ণার বাবা বাচ্চা মিয়া জানান, আমরা নদী ভাঙা মানুষ। পড়ালেখা বুঝি না। কিন্তু আমার মেয়েটি পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলাতেও ভালো। স্কুলের শিক্ষকরা তাকে জানিয়েছে সুবর্ণা জাতীয় পর্যায় খেলে নাকি প্রথম হয়েছে। খুব খুশি হয়েছি। তিনি আরও বলেন, মেয়েটি প্রতিদিন মাঠে অক্লান্ত পরিশ্রম করে। কিন্তু চাহিদা মতো পুষ্টিকর খাবার খেতে দিতে পারি না। এ জন্য খুব খারাপ লাগে। নিজের সামান্য আয়ে কোনো রকমে সংসার চলে।
সুবর্ণার ফকিরেরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রুহুল আমিন জানান, আমি খুব খুশি হয়েছি, সুবর্ণা দীর্ঘ জাম্প ও ৪০০ মিটার দৌড়ে দেশসেরা হয়েছে। তার এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। তার এই সাফল্যে জেলার চর-দ্বীপচরের মেয়ে শিক্ষার্থীরা আরও উৎসাহিত হবে। তিনি সরকারের কাছে অনুরোধ করেন সুবর্ণাকে যেন উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্রীড়াবিদ হিসেবে তৈরি করার ব্যবস্থা করেন।
দেশের অধিকাংশ মেয়ে খেলাধুলায় উঠে এসেছে অবহেলিত গ্রামগঞ্জ ও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। তাদের পরিবারগুলো একেবারেই হতদরিদ্র। চর-দ্বীপচরের বিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত খেলার মাঠ নেই, প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও প্রশিক্ষণের প্রকট অভাব সর্বোপরি প্রতিনিয়ত নিত্যসঙ্গী দারিদ্র্যের কশাঘাত। জেলার চর-দ্বীপচরের অনেক অঞ্চলে এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎও পৌঁছেনি। সে অবস্থায় অদম্য ও অপরাজেয় সুবর্ণার সাফল্য পুরো জেলায় আনন্দের জোয়ার বইছে। প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন করানোর ব্যবস্থা করা হলে দেশে ও বিদেশের মাটিতে সুবর্ণা একদিন আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বিজয় গৌরব ও সুনাম ছিনিয়ে আনতে সমর্থ হবে। তার কীর্তিগাথায় মোড়ানো এ রকম আরও স্বর্ণালী সাফল্য নিশ্চয়ই অবলোকন করা যাবে।