
পবিত্রতম শবেবরাতের ইবাদত-বন্দেগির রজনী পার করে আমাদের অপেক্ষা এখন আর এক নামাজ-রোজার পুণ্যতম প্রহর গোনার অনন্য ক্ষণ। শবেবরাতে গৃহিণীর কর্ম চঞ্চলতা যেমন দৃশ্যমান পাশাপাশি নামাজ-রোজায়ও চিন্তা-চেতনায় আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া সেও এক পরম আধ্যাত্ম দর্শন। সব মিলিয়ে এক ভিন্নমাত্রার আবেগ অনুভূতির পবিত্রতম স্পর্শকাতর সুসময়। সেখানে সবচেয়ে ব্যস্ততম সময় পার করতে হয় সর্বংসহা গৃহকর্ত্রীকে। বাড়তি ইবাদত যেন পরম করুণাময়ের নৈকট্য লাভের অনন্য আকুতি। তেমনি নিত্য খাবার সময় পরিবর্তনই শুধু নয় বরং অন্যমাত্রার স্বাদ-আস্বাদনও আর এক রসনা সংযোগ তো বটেই। পবিত্রতম মাসটির পরম নৈকট্য লাভ সংশ্লিষ্ট মানুষদের যে মাত্রায় পরম করুণাময়ের কাছাকাছি নিয়ে যায় তাও যেন এক অনাবিল আনন্দের অভাবনীয নির্মাল্য। প্রতিদিনের যাপিত জীবন হয়ে যায় শুধু ধর্মীয় ভাবাচ্ছন্ন নয় তার চেয়েও বেশি আহারের সময় রূপান্তরেও আসে আর এক মহিমান্বিত মনোসংযোগ। পরম করুণাময়ের প্রতি নিবেদনের স্বস্তিতে ৫ ওয়াক্ত নামাজ যেমন জরুরি তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সংযুক্ত থাকে ২০ রাকাতের তারাবির নামাজ। যা রমজান মাসের চাঁদ দেখার রাত থেকেই শুভ সূচনা হয়ে যায়। পরিবারের গৃহিণীরাও শুধু নামাজ-রোজায় ব্যস্ততম সময় কাটান তা কিন্তু নয়। বরং খাবারের আয়োজনেও থাকে নতুন সময়কে বরণ করার নানামাত্রিকহ উৎসব মেশানো আহারের বাহারি সম্ভার। সকালের নাশতা নয় বরং ভোররাতে ফজরের সুবাহ সাদেকের আগেই সর্বশেষ আহার রমজান মাসের ভিন্নমাত্রার খাদ্যাভ্যাস যা সংশ্লিষ্ট রোজাদারদের জন্য অনন্য এক পরম প্রাপ্তি ভোররাতে সেহরি খাবার উপলক্ষে ঘরের কর্ত্রীর যে অন্যরকম পসরা সাজানো খাদ্য সম্ভারের তা এই মাসটির এক পবিত্রতম সাড়া জাগানো বিষয় তো বটেই। আধ্যাত্ম চেতনায় মুমিন মুসলমানরা যেমন নিবেদনের স্তুতিতে নিমগ্ন থাকেন সেখানে গৃহিণীদের কর্মযোগ আরও চমকপ্রদ এবং প্রশংসনীয়। প্রাতঃরাশ কিংবা মধ্যাহ্ন ভোজনের অনুপস্থিতি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য শুধু উপোস করা নয় বরং আধ্যাত্ম চেতনার চিরস্থায়ী দ্যুতি তো বটেই। আহারের সময় পরিবর্তনের সঙ্গে মিলেমিশে একাত্ম হয় গৃহিণীর ভিন্নমাত্রার কর্মচাঞ্চল্যের অন্যরূপ। ভেররাতে সেহরির আয়োজন নিয়ে শুরু হয় রোজার প্রাথমিক শুভ সংযোগ। আর কর্মচাঞ্চল্যে গৃহকর্ত্রীর যাপিত জীবন ও হয়ে ওঠে অন্যমাত্রার উৎসব-আয়োজনে ভরপুর। বিশেষ প্রতীক্ষিত ইফতারের সময়টায় বাহারি খাদ্য আয়োজনে যে মাত্রায় রোজাদারদের সন্তুষ্টির শেষ ধাপে নিয়ে যায় তার সঙ্গে সারা বছরের ইবাদত-বন্দেগি পায় নতুন আর এক সময়ের যোগসাজশই নয়। আধ্যাত্মিক জীবনাচরণের অমূল্য এক সুসময়ের বাতাবরণও। খাদ্য রসিক বাঙালি যুগ-যুগান্তরের এক প্রবাদ বচন। বাহারি ইফতার আয়োজনের যে অভাবনীয় খাদ্য রসনা তা যেন পবিত্রতম অনুভবের অন্য মাত্রার ধর্মীয় চেতনা। সারাদিনে খাবারের ঝক্কিঝামেলা তেমন থাকেই না। বরং ইফতারের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়ে যায় শুভদিনের মঙ্গল প্রভাতে। সেটাই আবহমান বঙ্গললনার চিরস্থায়ীয় রূপ শৌর্য। ধর্মীয় প্রবল শক্তি আর সৌন্দর্যের অবিমিশ্র মিলনযজ্ঞে সারাদিনের আয়োজনে ইফতারের যে চমৎকার পরিবেশনতাও বঙ্গললনাদের শাশ্বত কর্মচাঞ্চল্যের অভাবনীয় দীপ্তি বলাই যায়। শুধু কি গৃহস্থালি কাজকর্ম সারা? রোজদার নারীদের মধ্যে পেশাগত অবস্থান সামলানোর সংখ্যাও হাতে গোনার অবস্থায় নেই। সঙ্গতকারণে সেহরি খেয়ে ফজরের নামাজ আদায় করে সময়মতো কর্মস্থলে ছুটে চলা নারীরা কিভাবে অফিস আর সংসার সামলান তাও এক দ্বৈত কর্মযোগের অভাবনীয় বলয়। সেহরি খেয়ে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়ার সময়ও থাকে না। কর্মজীবী নারীদের। তারপর তিনি যদি হন সন্তানের মা তা হলে ব্যস্ততম দিন কোনদিকে গড়িয়ে যায় টেরই পান না। মাতৃত্বের পরম মহিমান্বিত রূপ চিরায়ন বাঙালি রমণীর আর এক অবর্ণনীয় শৌর্য। সেখানেও থাকে মা হওয়ার দায়-দায়িত্বে সন্তানের প্রতি বাড়তি নজর দেওয়াও এখন রমজান মাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে না। সঙ্গতকারণে সন্তানদের স্কুল-কলেজে পাঠানোর দায়ভারও বর্তায় বাঙালি নারীর চিরায়ত কর্মযোগে। সন্তান যদি ছোট হয় কিংবা বিদ্যালয়গামী সেখানে মায়ের কর্তব্যনিষ্ঠা সবার আগে সামনে এসে দাঁড়ায়। সন্তানকে সকালের নাশতা পরিবেশ করে স্কুলের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া মায়েদের যেন অবধারিত এক কর্মযোগ। তিনি যদি কর্মজীবী হন তা হলেও তাকেই অনেক দায়ভার সামাল দিয়ে নিজের কাজের জায়গায় ছুটতে হয়। শুধু কি সন্তানের সকালের নাশতা? সঙ্গে দুপুরের টিফিন ও দিয়ে দেন সিংহভাগ মায়েরা। সন্তানের দেখভাল স্নেহমীয় সর্বংসহা জননীর আর এক ইবাদত-বন্দেগির মতো নিত্যনৈমিত্তিক অবশ্য পালনীয় কাজ। অফিসগামী নারীকে খেয়ালও রাখতে হয় বিকেলে বাসায় এসে নানামাত্রিক ইফতার আয়োজনের বাহারি খাদ্য পদের। সেখানে ছোলা, বেগুনি, পেঁয়াজু যেন চিরন্তন এক রমজান মাসের খাদ্য তালিকায় অন্যতম আহার। মুখরোচক সুস্বাদু খাবার তৈরিতে বঙ্গললনার জুরি নেই। খোনেও থাকে অনাবিল আধ্যাত্ম চেতনার আনন্দ আর কর্মযোগের পরম গ্রন্থি। সঙ্গতকারণে ধৈর্য, সহ্য করার শক্তি বিধাতা দিয়েছেন নারীর দেহে আর মনে। যেমন সন্তান ধারণ লালন করার শৌর্য একইভাবে সার্বিক পারিবারিক পরিস্থিতি নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসা বাংলার নারীদের শাশ^ত এক মাধুর্যতম চিরন্তন রূপ শৌর্য। সবাইকে সন্তুষ্ট রাখার যে প্রবল ইচ্ছাশক্তি সেখানে ধর্মীয় অনুভবের আধ্যাত্মবোধও যেন মিলে মিশে একাকার। যে অনন্য গর্বিত আর মহিমান্বিত রূপের আধার আমাদের বাঙালি নারীর মধ্যে সন্নিবেশিত থাকে সেটাও এই বরেন্দ্র ভূমির অপরিহার্য কর্মদ্যোতনা। তার উপর উৎসবপ্রিয় জাতি আমরা। উৎসব আয়োজনে ধর্মীয়, জাতীয় অনুষ্ঠান পালন আমাদের ঐতিহ্যিক এক পার্বন বলাই যায়। বর্তমানে শুধু গৃহিণী নারীর কর্মব্যস্ততা নয় বরং হরেক রন্ধনশিল্পী ও ইবাদতের এই মাসে ইফতারির পসরা সাজিয়ে গ্রাহকদের উদ্বুদ্ধ করে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থাকের সাজিয়ে গুছিয়ে সংসারে অবদান রেখে যাচ্ছেন। এমন উদ্যোক্তার সংখ্যাও আজ আর হাতের গোনার অবস্থায় নেই।
অপরাজিতা প্রতিবেদক