
ছবি: সংগৃহীত
“সময় সব কিছু ঠিক করে দেয়” – অনেকে এমনটাই বলে। কিন্তু আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, এটা পুরোপুরি সত্য নয়।
এটি আমাদের হৃদয়ভঙ্গ ও হতাশার থেকে দূরত্ব তৈরি করতে পারে। কিন্তু সময় নিজে থেকেই আমাদের ক্ষত নিরাময় করে না বা সমস্যার সমাধান নিয়ে আসে না। এটি শুধু চলতে থাকে, আমরা অগ্রসর হই বা না হই।
আমি এই সত্যটি কঠিনভাবেই শিখেছি।
আমার শিক্ষা: শুধুমাত্র সময় নিরাময় করে না
বছর কয়েক আগে এক বিচ্ছেদের পর, আমি নিজেকে বলতাম যে শুধু সময় পার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। “সময় দাও,” লোকজন বলতো।
কিন্তু সময় পেরিয়ে গেল, আর আমি একই জায়গায় আটকে রইলাম। তখনই বুঝতে পারলাম: আমার নিরাময়ের চাবিকাঠি সময় নয়, বরং আমি সেই সময় কিভাবে কাজে লাগাই।
অর্থাৎ, প্রতিদিনের ছোট ছোট অভ্যাস। এই সামান্য কিন্তু ধারাবাহিক কাজগুলোই আমাকে সামনে এগোতে সাহায্য করেছে, আত্মবিশ্বাস পুনর্গঠন করতে এবং নতুন অর্থ খুঁজে পেতে, যেখানে আগে কখনও ভাবিনি।
আমার মোড় পরিবর্তনের মুহূর্ত: যখন বুঝলাম সময় একা কিছু ঠিক করতে পারে না
আমি স্পষ্টভাবে মনে করতে পারি যেদিন এটি বুঝতে পারলাম। একদম সাধারণ একটা মঙ্গলবারের বিকেল ছিল, আমি সকালটা অলসভাবে কাটিয়েছিলাম, কোনো অলৌকিক আবেগগত পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম যা আসেইনি।
বরং আমি আরও খারাপ অনুভব করলাম—কারণ বুঝতে পারলাম আমি শুধু ধরে নিয়েছিলাম যে কিছুদিন অপেক্ষা করলেই আমি হঠাৎ সুস্থ হয়ে যাব।
কিন্তু নিরাময় এমন কিছু নয় যা হঠাৎ দরজায় এসে কড়া নাড়বে। এটি একটি অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া, যা দৈনন্দিন সচেতন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ঘটে।
আমি প্রথম যে পরিবর্তন আনলাম, তা হলো ঘড়ির ওপর নির্ভর করা বন্ধ করা। প্রতিদিন অন্তত একটি ছোট কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলাম, যা আমাকে ভালো অনুভব করতে সাহায্য করবে—হয়তো ২০ মিনিট হাঁটাহাঁটি করা, অথবা শুধু শান্ত হয়ে বসে শ্বাস-প্রশ্বাস পর্যবেক্ষণ করা।
এই মানসিক পরিবর্তন—আমার নিরাময় নিজের হাতে নেওয়া—সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমি আর সময়ের ওপর ভরসা করে বসে থাকলাম না, বরং প্রতিদিন ছোট ছোট অভ্যাস তৈরি করতে লাগলাম যা ধীরে ধীরে আমাকে গড়ে তুলেছে।
মাইন্ডফুলনেস ও মেডিটেশনের শক্তি
আমাকে সাহায্য করা প্রথম অভ্যাসগুলোর মধ্যে একটি ছিল দৈনিক মনোযোগ অনুশীলন (মাইন্ডফুলনেস)।
না, আমি কোনো পাহাড়ের চূড়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ্যান করার কথা বলছি না। বরং প্রতিদিন মাত্র কয়েক মিনিট—হয়তো পাঁচ মিনিট—শুধু আমার চিন্তাগুলো পর্যবেক্ষণ করতাম, কোনো বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই।
বিখ্যাত ভিয়েতনামী বৌদ্ধ সন্ন্যাসী থিচ নাট হান বলেছেন: “বর্তমান মুহূর্তই একমাত্র সময় যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে।”
আমি এই কথাটি অন্তরে গেঁথে নিয়েছিলাম। যখন আমরা নিজেদের বর্তমান মুহূর্তে ফিরিয়ে আনতে পারি, তখন আর অতীতের অনুশোচনা বা ভবিষ্যতের ভয়ের মধ্যে হারিয়ে যাই না।
বৈজ্ঞানিক গবেষণাও এটি প্রমাণ করে। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে নিয়মিত মাইন্ডফুলনেস অনুশীলন মানসিক চাপ ও উদ্বেগ উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারে।
ব্যক্তিগতভাবে, যখনই আমি ক্লান্ত বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতাম, কয়েকটি গভীর শ্বাস নিতাম, এবং দেখতাম আমি কম প্রতিক্রিয়াশীল, আরও শান্ত।
সময়ের সাথে সাথে, এই ছোট ছোট ধ্যানের মুহূর্তগুলো আমার দৈনন্দিন থেরাপির মতো হয়ে গিয়েছিল—একটি মানসিক রিসেট বাটনের মতো।
ছোট অভ্যাস কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
আপনি যদি ভাবেন কেন দৈনিক অভ্যাস এত কার্যকর, এর কারণ হলো এই অভ্যাসগুলো ধীরে ধীরে সংযোজিত হয় এবং এক সময়ে বিশাল পরিবর্তন আনে।
লেখক জেমস ক্লিয়ার বলেছেন: “আমরা আমাদের লক্ষ্য অনুযায়ী উন্নতি করি না, বরং আমাদের সিস্টেম অনুযায়ী এগোই।”
অর্থাৎ, বড় বড় পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করা নয়, বরং ছোট ছোট অভ্যাস তৈরির মধ্যেই আসল সাফল্য লুকিয়ে আছে।
উদাহরণস্বরূপ, আমি এক সময় ভাবতাম ফিট থাকার জন্য কঠিন ব্যায়াম বা দৌড়ানোর কঠোর রুটিন দরকার।
কিন্তু পরে বুঝলাম, আসল পরিবর্তন আসে ছোট কিন্তু ধারাবাহিক অভ্যাস থেকে—প্রতিদিন কিছু না কিছু শারীরিক কাজ করা, হোক তা জগিং, শরীরচর্চা, বা শুধু দ্রুত হাঁটা।
একই ব্যাপার মানসিক ও আবেগগত সুস্থতার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
প্রতিদিন মাত্র ১০ মিনিটের আত্মজিজ্ঞাসা বা প্রিয়জনের সাথে একটি ছোট আলাপচারিতা আপনার সুস্থতার ওপর অনেক বড় ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যা শুধু অপেক্ষা করে কখনও সম্ভব নয়।
(আরও গভীরভাবে জানতে চাইলে জেমস ক্লিয়ারের "Atomic Habits" বইটি পড়তে পারেন। এটি দেখায় কীভাবে ছোট অভ্যাস বড় পরিবর্তন আনে।)
প্রতিদিনের প্রতিফলন (রিফ্লেকশন) ও জার্নালিংয়ের অভ্যাস
আমার জন্য আরেকটি কার্যকর অভ্যাস ছিল দৈনিক প্রতিফলন করা।
আমি প্রতিদিন পাঁচ থেকে দশ মিনিট একটি নোটবুকে লিখতাম—আমার অনুভূতি, চ্যালেঞ্জ, বা ছোট ছোট অর্জনগুলো।
লেখার মাধ্যমে নিজের ভাবনাগুলো প্রকাশ করা অবিশ্বাস্য রকমের থেরাপিউটিক। এটি যেন নিজের মন থেকে বেরিয়ে এসে পরিষ্কারভাবে চিন্তা করার সুযোগ দেয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত জার্নালিং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়, এমনকি শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলছে, এটি আবেগের প্যাটার্ন বুঝতে, ট্রিগার চিহ্নিত করতে এবং অগ্রগতি উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে।
সময় নয়, ধারাবাহিকতাই আসল নিরাময়ের চাবিকাঠি
অনেকেই বলেন, “আমার অভ্যাস গড়তে অনুপ্রেরণা নেই।”
কিন্তু অনুপ্রেরণা ক্ষণস্থায়ী। আসল শক্তি হলো নিয়মিত চর্চায়।
আপনি যদি প্রতিদিন মাত্র দুই মিনিটও ধ্যান করেন, তাও অনুশীলন না করার চেয়ে অনেক ভালো।
যদি শুধু দুই-একটি বাক্যও লিখতে পারেন, সেটাও কিছু না করার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর।
শেষ কথা: সময় নিজে থেকে কিছু ঠিক করবে না
যদি আপনি মনে করেন সময়ই আপনাকে সারিয়ে তুলবে, তাহলে হয়তো দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে।
বাস্তবতা হলো, নিরাময় একটি সক্রিয় প্রক্রিয়া—যা সচেতন, ধারাবাহিক অভ্যাসের মাধ্যমে ঘটে।
ছোট ছোট পদক্ষেপ নিন, নিজেকে প্রতিদিন বিনিয়োগ করুন, এবং দেখবেন ধীরে ধীরে কীভাবে পরিবর্তন আসছে।
সময় নয়, বরং আমরা সময়ের সাথে কী করি—তাই আমাদের নিরাময় করে।
রাকিবুল