ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৪ মার্চ ২০২৫, ১৯ ফাল্গুন ১৪৩১

বাবা-মার যে ৭টি ভুল অভ্যাসের কারণে সন্তানেরা অবাধ্য ও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে

প্রকাশিত: ২৩:৪৭, ৩ মার্চ ২০২৫

বাবা-মার যে ৭টি ভুল অভ্যাসের কারণে সন্তানেরা অবাধ্য ও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে

ছবিঃ সংগৃহীত

সন্তান লালন-পালন করা সহজ কাজ নয়। প্রতিটি বাবা-মা চান তাদের সন্তান যেন সুখী, শৃঙ্খলাপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল হয়। তবে কখনো কখনো, অজান্তেই কিছু ভুল অভ্যাস শিশুদের অবাধ্য ও বিদ্রোহী করে তুলতে পারে।

মনোবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, কিছু অভ্যাস শিশুর মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা পরবর্তীতে তাদের নিয়ম ভাঙতে, কর্তৃপক্ষকে চ্যালেঞ্জ করতে এবং সীমা অতিক্রম করতে উদ্বুদ্ধ করে।

ভালো খবর হলো, এই অভ্যাসগুলো চিহ্নিত করা গেলে, আমরা সঠিক পরিবর্তন আনতে পারি। নিচে এমন ৭টি সাধারণ ভুল অভ্যাস তুলে ধরা হলো, যা শিশুদের বিদ্রোহী করে তুলতে পারে:

১) অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণমূলক হওয়া

শিশুর কল্যাণের কথা ভেবে অনেকে তাদের ওপর অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। তবে গবেষণা বলছে, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ শিশুদের স্বাধীনতা হারানোর অনুভূতি দেয়, যা পরে বিদ্রোহী মনোভাব গড়ে তোলে।

যদি বাবা-মা প্রতিটি বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন—যেমন কী পরবে, কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে, অবসর সময় কীভাবে কাটাবে—তাহলে সন্তান নিজেকে বন্দি মনে করতে পারে।

ফলাফলঃ শিশুরা নিয়ম ভাঙতে শুরু করে, লুকিয়ে কাজ করে বা উগ্র আচরণ দেখায়, কেবলমাত্র নিজের ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য।

২) সন্তানের অনুভূতিগুলো না শোনা

অনেক বাবা-মা মনে করেন, সমস্যার সমাধান দেওয়া শ্রবণের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

একটি উদাহরণ দেওয়া যাক—একদিন একটি শিশু স্কুল থেকে এসে কষ্ট পাচ্ছিল বন্ধুর আচরণে। বাবা-মা হয়তো বললেন, "এটা তেমন বড় কিছু না, এসব এড়িয়ে যাও"।

কিন্তু শিশুর কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এভাবে তার অনুভূতি উপেক্ষা করা হলে, সে মনে করবে তার আবেগের মূল্য নেই।

যার ফলাফল হতে পারে—
🔹 কঠিন পরিস্থিতিতে রাগ ঝাড়া
🔹 নিয়ম ভাঙার মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণ করা
🔹 অভ্যন্তরীণভাবে নিজেকে গুটিয়ে ফেলা

কখনো কখনো, শিশুর অনুভূতিগুলো শুধুমাত্র স্বীকৃতি পেলেই যথেষ্ট।

৩) অতিরিক্ত কঠোর শাস্তি দেওয়া

অনেক বাবা-মা রাগের বশে শিশুদের উপর কঠোর শাস্তি প্রয়োগ করেন, যেমন—চিৎকার করা, অপমান করা, বা ভয় দেখানো।

কিন্তু গবেষণা বলছে, ভয় দেখিয়ে শৃঙ্খলা শেখানো কার্যকর নয়। বরং এটি শিশুদের আরও বিদ্রোহী করে তোলে।

যার ফলাফল হতে পারে—

🔹 শিশুরা নিয়ম মানার পরিবর্তে সেগুলো লুকিয়ে রাখা শিখে ফেলে।
🔹 কঠোর শাস্তির ফলে তারা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে গোপনে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
🔹 শিশুর আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়।

সঠিক পদ্ধতি হলো শাস্তির পরিবর্তে সংযোগ তৈরি করা—শিশুকে বোঝানো কেন কিছু ভুল, এবং তার পরিণতি কী হতে পারে।

৪) শাস্তির হুমকি দিয়ে তা কার্যকর না করা

অনেক বাবা-মা শিশুকে বলেন, "রুম পরিষ্কার না করলে কাল স্ক্রিন টাইম পাবা না!" কিন্তু পরের দিন ক্লান্ত হয়ে গেলে হয়তো শাস্তি প্রয়োগ করেন না।

সমস্যা হলো, শিশুরা দ্রুত বুঝে ফেলে কোন নিয়ম আসলে কার্যকর, আর কোনটি শুধু হুমকি।

বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী আলবার্ট বান্দুরা বলেন, "মানুষ তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে যে বিশ্বাস রাখে, তা তাদের আচরণকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।"

যার ফলাফল হতে পারে—

🔹 যদি শিশুরা মনে করে তাদের কাজের আসল কোনো পরিণতি নেই, তাহলে তারা নিয়ম মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে না।
🔹 পরিণামের ক্ষেত্রে স্থির ও ধারাবাহিক হতে হবে—কিন্তু তা কঠোর না হয়ে সুবিবেচনাপ্রসূত হওয়া উচিত।

৫) শিশুকে খুব বেশি স্বাধীনতা দেওয়া

শিশুরা স্বাধীনতা চায়, তবে অতিরিক্ত স্বাধীনতা তাদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

যার ফলাফল হতে পারে—

🔹 যদি শিশুদের বয়স অনুযায়ী সীমা নির্ধারণ করা না হয়, তাহলে তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হতে পারে।
🔹 অনেক সময় শিশুরা বিদ্রোহী আচরণ করে শুধুমাত্র জানার জন্য যে আসলে সীমানা কোথায়।

সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি হলো, সুষম নিয়ন্ত্রণ—যেখানে শিশু স্বাধীনতা পাবে, তবে নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে থেকে।

৬) নিজের ভুল স্বীকার না করা

অনেক বাবা-মা মনে করেন, তাদের সবসময় সঠিক হতে হবে, নইলে শিশুরা শ্রদ্ধা করবে না।

কিন্তু বাস্তবে ঘটে ঠিক উল্টোটা।

যার ফলাফল হতে পারে—

🔹 শিশুরা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে বাবা-মায়ের ভুল।
🔹 যদি আমরা নিজের ভুল স্বীকার না করি, তাহলে শিশুরাও নিজেদের ভুল কখনো স্বীকার করবে না।
🔹 এর ফলে তারা দায়িত্বশীল হওয়ার বদলে, অন্যদের দোষারোপ করা শিখে ফেলে।

তাই যখন বাবা-মা ভুল করেন, তখন "আমি ভুল করেছি, আমি দুঃখিত" বলার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। এতে শিশুরা সত্যিকারের শ্রদ্ধাশীল হতে শিখবে।

৭) যথেষ্ট ভালোবাসা না দেখানো

শুধু খাবার, আশ্রয় এবং শিক্ষা দেওয়া যথেষ্ট নয়—সন্তানদের জন্য আবেগিক ভালোবাসাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যেসব শিশুরা পর্যাপ্ত ভালোবাসা ও মানসিক সমর্থন পায় না, তারা বেশিরভাগ সময় মনোযোগ আকর্ষণের জন্য অবাধ্য আচরণ করে।

যার ফলাফল হতে পারে—

🔹 শুধু শৃঙ্খলা ও নিয়ম নয়, উষ্ণতা ও নিরঙ্কুশ ভালোবাসাও দিতে হবে।
🔹 "আমি তোমাকে ভালোবাসি" বলা, শিশুকে আলিঙ্গন করা, এবং তার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যখন শিশুরা আত্মবিশ্বাসী ও নিরাপদ বোধ করে, তখন তারা বিদ্রোহী আচরণের পরিবর্তে ইতিবাচক পথে এগিয়ে যায়।

উপসংহার

শিশুদের বিদ্রোহী ও অবাধ্য হয়ে ওঠা বাবা-মায়ের ভুল অভ্যাসের ফল হতে পারে।

তবে ভালো দিক হলো—যখন আমরা আমাদের ভুলগুলো বুঝতে পারি এবং পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট হই, তখন শিশুরাও ধীরে ধীরে ইতিবাচক পরিবর্তন দেখাতে শুরু করে।

সন্তান লালন-পালনে শৃঙ্খলা ও ভালোবাসার মধ্যে ভারসাম্য রাখা জরুরি। তবেই তারা দায়িত্বশীল, শ্রদ্ধাশীল ও মানসিকভাবে শক্তিশালী হয়ে গড়ে উঠবে। 

সূত্রঃ https://geediting.com/dan-behaviors-of-parents-who-raise-disobedient-and-rebellious-children-according-to-psychology/

ইমরান

×