
জীবন চলার পথে ভালো, মন্দে চরাই-উতরাই থাকবেই। ভালোবাসা নিরলস পরিশ্রম, ত্যাগ, সাহস আর স্বামীর অনুপ্রেরণা এগিয়ে নিতে সাহায্য করছে গৃহবধূ রাশেদা বেগমকে। বয়স চল্লিশ ঊর্ধ্বে রাশেদা বেগম। ছোট বেলায় বিয়ে হয়েছিল তার। অভাবের সংসার তাদের। মাত্র ১৪ বছরে প্রথম সন্তানের জন্ম। এরপর এক এক করে আরও চারটি সন্তানের মা হন তিনি। সন্তানের জন্মের পর চরম কষ্টে পড়েন রাশেদা। সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত সব কাজ করতে হতে তাকে। পাশাপাশি স্বামীকেও খেত খামারের সহায়তা করতে হয় প্রতিদিন। তার স্বামী অন্যের জমিতে বর্গাখাটা প্রান্তিক চাষি। বিয়ের পর থেকেই প্রতিদিন জীবন যুদ্ধে শ্বশুরবাড়িতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল। মাটি কাটা থেকে ধানের বীজ বপন শুধু নয় শষ্য ঘরে তোলা পর্যন্ত সমস্ত কার্যক্রমের অংশীদার হতে হয় তাকে। অল্প বয়স থেকে জীব সংসারের কাজের ভারে আজ ক্লান্ত হলেও রক্ষা নেই। এখনো চালিয়ে যাচ্ছে কাজ। তবে সময়ের সঙ্গে কাজের ধরন কিছুটা বদলিয়েছে রাশেদা বেগম। এখন বাড়িতে বসে বাঁশের ডালি, কুলাসহ বিভিন্ন বাঁশের সামগ্রী তৈরি করে জীবন চালায়। কুড়িগাম জেলার উলিপুর উপজেলার তবকপুর উনিয়নের মণ্ডলপাড়া গ্রামে তার বাড়ি। তৈরিকৃত এসব বাঁশের সামগ্রী ও জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে খুচরা ও পাইকারি হিসেবে কিনে নিয়ে যায়। ছোট ব্যবসা হলেও এসব বিক্রি করে খরচ বাদে প্রতি মাসে রাশেদা বেগম আয় করেন প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়েই চলে সংসারের যাবতীয় খরচ। সন্তানদের পড়ালেখাসহ অন্যান্য খরচ।
রাশেদা বেগম জানায় তখন আমার পুতুল খেলার বয়স এই বয়সেই স্বামীর সংসারে এসেছি। অভাবের সংসার বলেই চরম কষ্ট করতে হচ্ছে। নিজে পড়া লেখা করতে পারেনি এ কষ্ট আজও তাকে তারা করে। সন্তানদের টাকার অভাবে পড়াশোনা করতে পারছিলাম না। বাধ্য হয়ে স্থানীয় এক বেসরকারি সংস্থার কাছে কিছু টাকা লোন এবং বাঁশের জিনিষ তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়ে বাঁশের কাজ তৈরি শুরু করি। টাকার অভাবে প্রথম দিকে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু থেমে থাকিনি। নতুন করে সকলের সহায়তা নিয়ে আবারও কাজ শুরু করি। একসময় টাকার অভাবে বড় মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। ভীষণ কষ্ট পাই সেই সময়। তারপরও থেমে থাকিনি। ২০২২ সালের শেষের দিকে আরডিআরএস বাংলাদেশ কর্তৃক বাস্তবায়িত চাইল্ড, নট ব্রাইড (সিএনবি) প্রকল্পের জরিপে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুর পরিবারের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত হয় রাশেদার পরিবারের। এরপর ৪ দিনের দ্রুত আয় বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ নেন আর ডি আর এস কাছে। প্রশিক্ষণে পছন্দের ব্যবসার তালিকায় ব্যবসা বাঁশের ডালিসহ অন্যান্য সামগ্রী তৈরি নির্বাচন করেন রাশেদা। তিনি আরও জানান স্বামী দেলদার হোসেন একজন প্রান্তিক চাষি। তিনি তাকে সব সময় সহযোগিতা করেন। বর্তমানে নিজে ৫ সন্তান আর স্বামীসহ বাঁশের সামগ্রী তৈরি করেন। এতে যে আয় হয় তা দিয়ে ভালোই চলছে সংসার। রাশেদা বেগম গ্রামের অসহায় মহিলাদের বিনে পয়সায় প্রশিক্ষণ দেন। তাদেরকেও স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করছেন। তার বড় মেয়ে শান্তনা আক্তার বর্তমানে অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। এছাড়াও দুই ছেলে ও এক মেয়ে নুরানী মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। এক সময় সন্তানদের একবেলা ঠিকমতো দিতে খাবার দিতে না পারলেও বর্তমানে তাদের পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করেন। সপ্তাহে একদিন হলেও মাছ-মাংস খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। রাশেদা বেগম এখন বাড়িতে হাঁস, মুরগি, ছাগল ও গরু লালন পালন করেন। ইতোমধ্যে কয়েক শতক জমিও কিনেছে। তার স্বপ্ন সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত করবেন। এর জন্য যদি আরও পরিশ্রম করতে হয় সেটাও করতে রাজি। তার মতে নিষ্ঠা সততা আর পরিশ্রম করলে একদিন সে সাফল্য পাবেই। রাশেদা বেগম এলাকায় নারী ব্যাপারি হিসেবে পরিচিত। এতে ভীষণ খুশি। তার ইচ্ছে জীবনের শেষ দিনে পর্যন্ত অসহায় মানুষের সেবা করে যেতে পারেন।