
ছবি: সংগৃহীত।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্মৃতিশক্তি কমে যেতে পারে, এমনটাই অনেকে মনে করেন। যুক্তি প্রদানের সক্ষমতাও হ্রাস পেতে পারে। তবে আশার কথা হচ্ছে, সঠিক মানসিক চর্চা ও কৌশল অনুসরণ করলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। নিচে কিছু কার্যকর পদ্ধতি তুলে ধরা হলো, যা মস্তিষ্ককে পুনরায় সক্রিয় ও শাণিত করতে সহায়ক হবে।
১. ব্যায়াম করুন
শরীরচর্চা বা ব্যায়ামের ফলে মস্তিষ্কের স্নায়ুবিক সংযোগ বৃদ্ধি পায়, যা স্মৃতিশক্তি উন্নত করে। ব্যায়ামের মাধ্যমে মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর মধ্যে বৈদ্যুতিক সংকেত বিনিময় বাড়ে এবং অতিরিক্ত কোষ গঠিত হয়। সুস্থ হৃদযন্ত্রের মাধ্যমে শরীর বেশি অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে এবং ক্ষতিকর টক্সিন নির্গত হয়। খোলা জায়গায় ব্যায়াম করলে ভিটামিন ডি শোষণ বাড়ে, যা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করে। নতুন পরিবেশে ব্যায়াম করা কিংবা গ্রুপে অংশ নেওয়া সামাজিক সংযোগ বাড়ায় এবং নতুন তথ্য শিখতে সহায়তা করে। তাই শখের কাজ একা না করে দলগতভাবে করার চেষ্টা করুন, এতে নতুন সম্পর্ক তৈরি হবে এবং মস্তিষ্ক আরও সক্রিয় থাকবে।
২. চলতে পথে মুখস্থ করা
চলতে ফিরতে মুখস্থ করার অভ্যাস স্মৃতিশক্তি উন্নত করতে সহায়ক। গবেষণায় দেখা গেছে, হাঁটার সময় নতুন তথ্য শেখার চেষ্টা করলে তা বেশি মনে থাকে। অভিনেতারা প্রায়শই এই পদ্ধতি অনুসরণ করেন। ভবিষ্যতে কোনো বক্তব্য বা প্রেজেন্টেশন দেওয়ার প্রয়োজন হলে হাঁটতে হাঁটতে সেটি অনুশীলন করুন। এমনকি নাচ বা শারীরিক গতিবিধির মাধ্যমে পড়ার অভ্যাস তৈরি করলেও স্মরণশক্তি বাড়তে পারে।
৩. সঠিক খাবার গ্রহণ করুন
আমাদের গ্রহণ করা শক্তি ও গ্লুকোজের ২০ শতাংশ সরাসরি মস্তিষ্কে যায়। তাই মস্তিষ্কের কার্যকারিতা দেহের গ্লুকোজের মাত্রার ওপর নির্ভর করে। অতিরিক্ত গ্লুকোজের অভাবে মনোযোগের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। আমাদের পছন্দের খাবার গ্রহণের ফলে মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক রাসায়নিক নিঃসরণ ঘটে, যা প্রশান্তি দেয়। তবে শুধু মস্তিষ্ক নয়, দেহের অন্যান্য অংশেরও যত্ন নেওয়া প্রয়োজন।
আমাদের পরিপাকতন্ত্রে থাকা ১০০ ট্রিলিয়ন অণুজীব স্নায়ু ব্যবস্থার মাধ্যমে মস্তিষ্কের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। তাই মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখতে স্বাস্থ্যকর ও বৈচিত্র্যময় খাদ্য গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ। মস্তিষ্কের কোষ চর্বি দ্বারা গঠিত, তাই সম্পূর্ণভাবে চর্বি বাদ দেওয়া উচিত নয়। বাদাম, বীজ, অ্যাভোকাডো, মাছ, রোজমেরি ও হলুদ থেকে প্রাপ্ত ফ্যাটি অ্যাসিড মস্তিষ্কের জন্য উপকারী। এছাড়া একা না খেয়ে দলগতভাবে খাওয়ার অভ্যাস করলে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা আরও উন্নত হয়।
৪. পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও বিরতি নিন
স্বল্প মাত্রার স্ট্রেস জরুরি, কারণ এটি আমাদের জরুরি অবস্থায় দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাতে সহায়তা করে। কর্টিসল নামক হরমোন সাময়িকভাবে মনোযোগ বাড়ায়। তবে দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগ ও মানসিক চাপ মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকর। তাই মাঝে মাঝে বিরতি নেওয়া এবং বিশ্রামের সুযোগ তৈরি করা উচিত।
আমাদের মস্তিষ্কে নিউরাল নেটওয়ার্ক রয়েছে, যা কল্পনার ক্ষমতা বাড়ায় এবং স্মৃতি ধরে রাখতে সাহায্য করে। বিরতির মাধ্যমে আমরা মস্তিষ্কের এই অংশকে সক্রিয় করি। স্ট্রেস কমানোর জন্য ধ্যান বা মেডিটেশনের অভ্যাস গড়ে তোলা যেতে পারে, যা কর্টিসল হরমোনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
৫. নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুন
নতুন কিছু শেখা মস্তিষ্কের স্থিতিস্থাপকতা বাড়ায়। নতুন ভাষা শেখা, আর্ট ক্লাসে অংশ নেওয়া, বা অনলাইন গেম খেলায় যুক্ত হওয়া স্মৃতিশক্তি উন্নত করতে পারে। সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে শেখার অভিজ্ঞতা আরও কার্যকর হয়। পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ে।
৬. গান শুনুন
সঙ্গীত মস্তিষ্ককে অসাধারণ উপায়ে উদ্দীপিত করে। আপনি যদি গান শোনার সময় কিংবা বাদ্য যন্ত্র বাজানোর সময় কারও মস্তিষ্কের চিত্র দেখেন তাহলে দেখবেন যে তার মস্তিষ্কের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। গান সাধারণ বোধশক্তি ও স্মৃতিকে শক্তিশালী করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীরাও সবার শেষে যা ভুলে যায় তা হচ্ছে গান। তাই নিজে গান করুন বা গান শুনুন।
৭. পড়া এবং ঘুম
আপনি যদি দিনের বেলায় নতুন পড়েন তাহলে, আপনার মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলোর মধ্যে এক ধরনের সংযোগ স্থাপিত হয়। আর আপনি যখন ঘুমিয়ে যান তখন ওই সংযোগ শক্তিশালী হয় এবং আপনি যা শিখেছেন তা স্মৃতিতে পরিণত হয়। এ কারণে স্মৃতির জন্য ঘুম খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এ কারণে আপনি যদি কাউকে ঘুমানের আগে কোনো কিছু মুখস্থ করতে দেন তাহলে কারা পরের দিন সকালেও সেটি আরো ভালভাবে মনে করতে পারবেন। কিন্তু কাউকে যদি আপনি সকালে কোনো কিছু মুখস্থ করতে দেন এবং সন্ধ্যায় সেটি মনে করতে বলেন তাহলে তারা সেটি তেমন ভালোভাবে মনে করতে পারবে না। তাই আপনি যদি কোন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন তাহলে ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রশ্নের উত্তরগুলো মাথায় একবার ঝালিয়ে নিন।
আর আপনি যদি কোন বেদনাদায়ক ঘটনার শিকার হয়ে থাকেন তাহলে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সেটি মনে করা থেকে বিরত থাকুন। কারণ তাহলে এটি আপনার ওই স্মৃতিকে শক্তিশালী করতে পারে এবং এ সম্পর্কিত নেতিবাচক আবেগ বাড়তে পারে।
একই কারণে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ভয়ঙ্কর মুভি কিংবা গল্প শোনা থেকে বিরত থাকুন। এর পরিবর্তে দিনের বেলায় আপনি যেসব ভাল বা সুখকর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন সেগুলো মনে করার চেষ্টা করুন। যাতে করে আপনার মস্তিষ্ক ওই ভাল স্মৃতিতে আটকে থাকে।
৮. ভালোভাবে জেগে উঠুন
ঘুম যেমন স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তেমনি আপনি কীভাবে ঘুম থেকে জেগে উঠছেন সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আপনি দিনের বেলায় কতটা সচেতন ও চাঙ্গা থাকবেন তা নির্ভর করবে আপনি কীভাবে ঘুম থেকে জেগে উঠছেন তার উপর।
সাধারণত অন্ধকার ঘরে ঘুমানো উচিত এবং আলো বাড়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে জেগে উঠা উচিত। সাধারণত ভোর বেলা এ ধরণের পরিস্থিতি থাকে। সূর্যের আলো বন্ধ চোখের পাতার ভেতর দিয়ে গিয়ে মস্তিষ্ককে প্রস্তুত করে জেগে উঠার জন্য। যাতে করে কর্টিসল হরমোনের নিঃসরণ পর্যাপ্ত হয়। কারণ আপনার দেহে এই হরমোনের মাত্রাই ঠিক করে যে আপনার মস্তিষ্ক সারাদিন কতটা কার্যক্ষম থাকবে। এক্ষেত্রে আপনি এমন একটি অ্যালার্ম সিস্টেম কিনতে পারেন যেটি ভোর হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে বা ধীরে ধীরে আলো বাড়ায় এবং আপনি স্বাভাবিকভাবেই জেগে উঠতে পারেন।
আর যাদের ঘুম অনেক গভীর হয় তারা এই আলোর সাথে যাতে শব্দ থাকে সেটিও খেয়াল রাখুন।
সায়মা ইসলাম