
সঙ্গীর বিশ্বাসঘাতকতা আবিষ্কার করা মানসিকভাবে এক কঠিন ধাক্কা হতে পারে।একসঙ্গে ধাক্কা, রাগ, বিশ্বাসভঙ্গ এবং হৃদয়ভঙ্গের অনুভূতি আসতে পারে।যদি সন্দেহ থেকেও থাকে, প্রকৃত সত্য সামনে এলে সেটার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা কঠিন।
কাউন্সেলিং সেশনে অনেককেই চোখের জল মুছতে দেখা যায়, হতাশ কণ্ঠে প্রশ্ন করতে শোনা যায়, “এখন আমি কী করবো?”একজন সম্পর্ক বিশেষজ্ঞের মতে, প্রতারণার পর দ্রুত সেরে ওঠার নির্দিষ্ট কোনো ফর্মুলা নেই, তবে কিছু সাধারণ ভুলের কারণে কষ্ট আরও বেড়ে যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, এই ভুলগুলো এমনভাবে পরিস্থিতি জটিল করে তোলে যে সম্পর্ক রক্ষা করা বা বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে শান্তি খোঁজা-দুটোরই সম্ভাবনা কমে যায়।
প্রতারণার পর যে প্রধান ভুলগুলো মানুষ করে থাকে, তা তুলে ধরা হলো,প্রতিশোধ নেওয়ার তাড়নায় ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া।বিশ্বাসঘাতকতার পর রাগ ও হতাশা অনুভব করা স্বাভাবিক। অনেকে তখন প্রতিশোধ নিতে চায়-সঙ্গীকে অপমান করা, তৃতীয় ব্যক্তিকে হেনস্তা করা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্য ফাঁস করা ইত্যাদি করে বসেন। ক্ষণিকের জন্য এসব হয়তো স্বস্তি দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
উদাহরণস্বরূপ, কারো ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইনে ছড়িয়ে দিলে তা শুধুমাত্র দোষারোপের খেলা শুরু করে এবং কোনো গঠনমূলক সমাধান পাওয়া যায় না। এমনকি যদি সম্পর্ক শেষ করতেও হয়, প্রতিশোধের পথ বেছে নেওয়া ভবিষ্যতে লজ্জা বা অনুশোচনার কারণ হতে পারে। একজন বিশেষজ্ঞের মতে, প্রতিশোধ কখনোই আসল সমাধান নিয়ে আসে না; বরং এটি সমস্যা আরও বাড়িয়ে তোলে।
নিজের আবেগকে উপেক্ষা করা
প্রতারণা ধরা পড়ার পর বেশিরভাগ মানুষ প্রতারক সঙ্গীর আচরণ বিশ্লেষণে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে নিজের আবেগ ও মানসিক অবস্থার দিকে খেয়ালই রাখেন না। কেন প্রতারণা করলো, কতদিন ধরে করছিল-এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করতে গিয়ে অনেকে নিজের অনুভূতির যত্ন নিতে ভুলে যান।
মানসিক সুস্থতার জন্য এই সময়ে নিজের অনুভূতিগুলোর সম্মান দেওয়া জরুরি। কাউন্সেলিং নেওয়া, কাছের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা, মেডিটেশন বা লেখালেখির মাধ্যমে আবেগ প্রকাশ করা সহায়ক হতে পারে। নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন না নিলে সুস্থ সম্পর্ক বা ব্যক্তিগত শান্তি,কোনোটাই সম্ভব হবে না।
অতি দ্রুত ক্ষমা করা বা সম্পর্ক ঠিক করার চেষ্টা করা
ক্ষমা একটি শক্তিশালী পদক্ষেপ হতে পারে, তবে এটি তাড়াহুড়া করে করলে কার্যকর হয় না। অনেক সময় প্রতারণাকারী সঙ্গী দ্রুত ক্ষমা চাইতে চায় বা প্রতারিত ব্যক্তি নিজেও সামাজিক চাপের কারণে বিষয়টি মেনে নিতে চান।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আবেগগত প্রক্রিয়াগুলোর জন্য সময় দেওয়া জরুরি। প্রতারণার কারণ বোঝা, বিশ্বাস পুনর্গঠন করা এবং সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করা ছাড়া তাড়াহুড়ো করে ক্ষমা করা শুধুমাত্র চাপা দেওয়া ক্ষতকে আরও গভীর করতে পারে।
নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা
অনেকে প্রতারণার পর এতটাই লজ্জা ও হতাশায় ভোগেন যে কাছের মানুষদের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন। কেউ যদি সঙ্গীকে সুযোগ দিতে চান, তবে তারা ভাবতে থাকেন যে অন্যরা তাঁদের বিচার করবে। আবার কেউ কেউ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও তা নিয়ে কথা বলতে সংকোচ বোধ করেন।
কিন্তু মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য এই সময়ে সামাজিক সহায়তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার, বন্ধুবান্ধব বা কাউন্সেলরের সাহায্য নেওয়া মানসিক চাপ কমাতে পারে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
ফাঁকা হুমকি দেওয়া কিন্তু বাস্তবে কার্যকর না করা
“তুমি যদি আবার কথা বলো, তাহলে আমি চলে যাবো!”, “এটা শেষ, আমি আর সম্পর্ক রাখবো না!”-এমন অনেক হুমকি প্রতারণার পর দেওয়া হয়, কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর হয় না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি কেউ সঙ্গীর কাছে শর্ত আরোপ করেন, তবে তা মানার মানসিক প্রস্তুতিও থাকতে হবে। যদি সম্পর্ক চালিয়ে যেতে হয়, তবে সুস্পষ্ট সীমারেখা নির্ধারণ করাই উত্তম। অন্যথায়, বারবার দেওয়া হুমকিগুলো অবশেষে গুরুত্বহীন হয়ে যায় এবং আত্মসম্মানবোধও কমে যেতে পারে।
তৃতীয় ব্যক্তিকে পুরোপুরি দোষ দেওয়া এবং সম্পর্কের প্রকৃত সমস্যাগুলো এড়িয়ে যাওয়া
অনেকে বিশ্বাস করেন, যদি ‘অন্য কেউ’ না থাকতো, তবে তাঁদের সম্পর্ক ঠিক থাকতো। কিন্তু প্রতারণা করার সিদ্ধান্ত মূলত প্রতারক সঙ্গীরই।বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতারণার কারণ অনুসন্ধান করা গুরুত্বপূর্ণ। এটা মানে এই নয় যে প্রতারণাকে জায়েজ করা হচ্ছে, বরং সম্পর্কের গভীর সমস্যা শনাক্ত করা দরকার। যদি সম্পর্ক চালিয়ে যেতে হয়, তবে বিশ্বাস পুনর্গঠন করা প্রয়োজন। আর যদি সম্পর্ক শেষ হয়, তবে সঠিক শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য আরও ভালো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব।
ঘটনাটি এড়িয়ে যাওয়া ও স্বাভাবিকভাবে চলার চেষ্টা করা
অনেকেই প্রতারণার ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পরও কঠিন আলোচনা এড়িয়ে চলতে চান। তাঁরা স্বাভাবিক থাকার ভান করেন এবং আশা করেন যে সময়ের সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু বাস্তবে, প্রতারণার পর সম্পর্ক আগের মতো হয় না। নতুন করে বিশ্বাস অর্জন করতে চাইলে খোলাখুলি আলোচনা এবং পরস্পরের প্রয়োজন বোঝার চেষ্টা করা দরকার। যদি সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া হয়, তবে এটি হতে হবে বাস্তবসম্মত ভিত্তির ওপর। আর যদি আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তবে সেটাও হতে হবে সুস্থ মানসিক অবস্থার ভিত্তিতে।
সঙ্গীর প্রতারণার পর অনেকেই কেবল এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকেন“সে কেন করল? কাদের সঙ্গে করল? কতদিন ধরে চলছে?”এই অনুসন্ধানের মাঝে নিজের আবেগিক প্রয়োজনকেই উপেক্ষা করেন।
সঙ্গীর প্রতারণা ধরা পড়া সম্পর্কের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হতে পারে। এতে আবেগপ্রবণ হয়ে প্রতিশোধ নেওয়া, তাড়াহুড়ো করে ক্ষমা করা বা একেবারে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।কিন্তু বাস্তবতা হলো, সুস্থভাবে সামনের দিকে এগোনোর জন্য ধৈর্য, আত্মবিশ্বাস এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। নিজের আবেগের যত্ন নেওয়া, প্রয়োজন হলে পেশাদার সহায়তা নেওয়া, এবং সময় নিয়ে চিন্তাভাবনা করাই দীর্ঘমেয়াদে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হতে পারে।
যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক না কেন, আত্মসম্মানবোধ এবং মানসিক শান্তিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। সময় লাগবে, তবে সঠিক পথে এগোলে ভবিষ্যৎ আরও সুস্থ ও নিরাপদ হয়ে উঠতে পারে।
সূত্র:https://tinyurl.com/2avt5tm4
আফরোজা