উন্নয়নশীল আধুনিক ও প্রযুক্তির বাংলাদেশ
উন্নয়নশীল আধুনিক ও প্রযুক্তির বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে নিত্যনতুন কর্মদ্যোতনায়। পাশাপাশি হরেক বিপর্যয়ও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে সময় নিচ্ছে না। আবার ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে বদলে যাওয়া নতুন বাংলাদেশও হিতে-বিপরীতে সামনের দিকে চলমান থাকা ও পরিবেশ পরিস্থিতির অনিবার্যতা। বিজ্ঞানী নিউটন সুচিন্তিত গবেষণায় অনুধাবন করলেন প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া বিদ্যমান সমাজ আর বিজ্ঞানকে এক সঙ্গে মেলানো কঠিন। বিজ্ঞান চিরস্থায়ী গবেষণালব্ধ জ্ঞান।
আর সমাজ আপেক্ষিকই শুধু নয় নিয়ত পরিবর্তনের ধারায় সতত ক্রিয়াকলাপের রূপান্তরিত পর্যায়। তাই সমাজ ও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব-উপাত্ত অবিমিশ্র কোনো মিলবে আর মেলাবের মতোই নয়। আলোচনা করছিলাম পরিবেশ দূষণ নিয়ে যা সামাজিক এক অশান্ত বলয়। আবার অবিমিশ্র হয়ে আছে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায়।
শান্ত, স্নিগ্ধ সবুজ প্রকৃতি একসময় বিশ্বব্যাপী সুশীতল ছায়ার এক নির্মল আচ্ছাদন ছিল বলে বিজ্ঞানী ও সমাজবিদদের ধারণা। কিন্তু বিশ^ব্যাপী এক দুঃসময়ে উপলব্ধি করে সবুজ নৈসর্গ কেমন যেন তার লাবণ্য আর সহজাত রূপ শৌর্য থেকে ক্রমশ অপসৃত হচ্ছে। যেখানে সবার আগে হুমকিতে ষড়ঋতুর নানামাত্রিক বৈচিত্র্যিক সম্ভার আর সম্ভাবনা।
তেমন দুঃসহ আলামত প্রত্যক্ষই শুধু নয় বুঝতেও এক শতক পেরিয়ে যাওয়া বিশ্ববাসীর জন্য আর এক অজানা বিস্ময় তো বটেই। আমরা জানি ১৭৬০ সালে জেমস ওয়াট কর্তৃক আবিষ্কৃত ইস্টিম ইঞ্জিনের আবিষ্কার বৈজ্ঞানিক গবেষণার নবদ্যুতি তো বটেই। অতি বাল্যকাল থেকে পাঠ্যবইয়ে পড়ে এসেছি বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ বা গতি কেড়ে নিয়েছে আবেগ।
সেটা যথেষ্টভাবে বুঝতে শৈশব পার করে কৈশোরের পালাক্রমের ধারায় যখন বয়সের ভারে অবনত পর্যায়ে হৃদয়ঙ্গম করাও পরিবেশ পরিস্থিতিকে দীর্ঘমেয়াদি ধারায় বুঝতে পারার আর এক বিপন্নতার শিকার। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যাহ্নে যে নতুন শিল্পবিপ্লব তার ছায়া সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলেও অপছায়া অনুধাবন করতে এক শতক পার করতে হয়। ঊনবিংশ শতকের ক্রান্তিলগ্নে নৈসর্গ বিজ্ঞানীরা আওয়াজ তুললেন ‘ধরিত্রী বাঁচাও’ এক মহাকর্ম প্রকল্পে।
অর্থাৎ শিল্প প্রযুক্তিতে যে কার্বন নিঃসরণ হয় তা বাতাসের অক্সিজেনের মাত্রাকে ক্রমান্বয়ে কমিয়ে দেয়। ফলে সহজাত নৈসর্গ তার প্রাকৃতিক রূপময়তা থেকে সরে যাওয়াই নয় বরং বিপরীত আর এক দূষণ আবহে শ্যামল প্রকৃতিকে নয়-ছয় করে দিতে যেন মরিয়া। আর তখন থেকেই পরিবেশবিদরা নতুন করে জোরালো কণ্ঠে আবেদন জানাতে কসুর করলেন না। শ্যামল প্রকৃতি যদি ক্রমান্বয়ে তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারাতে বসে তা হলে আগামীর প্রজন্ম একটি বাসযোগ্য ধরণীই পাবে না। তাই বৈজ্ঞানিক শিল্প প্রযুক্তির লাগাম টেনে ধরা বিশ্ব আর জনস্বার্থেই জরুরি।
প্রকৃতি সহায়ক আধুনিক নব আবিষ্কার বিশ্বব্যাপী। যে নতুন সহনশীল প্রতিবেশ তৈরি করবে সেটাই নিয়ে আসা নিতান্ত জরুরি আর আবশ্যকতা। আমরা এখন শীতকালের পৌষ মাস অতিক্রম করে মাঘের কনকনে ঠান্ডাকে অনুভব করার পরিবর্তে কেমন যেন এক নাতিশীতোষ্ণ আবহকে আলিঙ্গন করছি। সেটা অতি অবশ্যই সহনীয় এক আবহ। কিন্তু প্রত্যাশিত মাঘ মাসের মৌসুমই নয়। যা অনিবার্য এবং নৈসর্গিক চিরায়ত শীতল আবহ কাক্সিক্ষতই শুধু নয় জরুরিও বটে। কেন এমন হচ্ছে?
প্রথম শিল্পবিপ্লবের উষ্ণতাকে সামাল দেওয়ার পরিবর্তে আরও প্রখরতায় আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চরম দাবানলে উপনীত। এক সময় প্রযুক্তির আবিষ্কারের পূর্বে বন-বনান্তর দাবানলে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়েছে। সেটা ছিল সে সময়ের প্রকৃতিনির্ভর বিশে^ নৈসর্গিক ল-ভ-। তেমন অগ্ন্যুৎপাত থেমে গেছে প্রকৃতির নিয়মনীতিতে। সৃষ্টির সেরা মানুষের যেখানে কোনো হাতই ছিল না।
সে অসময়টা ছিল দীর্ঘকালীন এক পশুপালন এবং বন্য দশার লাগাতার বিপর্যয়। ১৭৬০ সালে শিল্পবিপ্লবে মানুষের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের যে নতুন যাত্রার অভ্যুদয় তার মধ্যাহ্নে আমরা বিপরীত আবহে আর এক দাহ্য বিশে^র দ্বারপ্রান্তে নিজেদের দাঁড় করাই। শুধু কি তাই? দূষণে-দূষণে সয়লাব বিশ^ময় আজ এক জ্বলন্ত অগ্নিদাহের কোপানলে। শুধু পরিবেশ প্রদাহ নয় কোলের সন্তানদের জীবনও অভিশপ্ত করে দিতে মরিয়া। আবার যে কোনো বিপদ-বিপর্যয়ে কোমলমতি শিশু ও সমসংখ্যক নারীই দুর্ভোগ-দুর্যোগে আক্রান্ত হয় বেশি। অতি আশ্চর্যজনকভাবে এখানেও তেমনটাই।
পরিবেশ বিপন্নতায় সবার আগে আক্রান্ত হচ্ছে মা ও শিশু। তার চেয়েও বেশি একজন গর্ভবতী জননী তার জঠরে লালন করছেন আগামীর প্রজন্মকে। যেখানে মা-ই সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশের বিপরীতে দূষণ প্রকৃতিতে শ^াস- প্রশ্বাস ফেলছেন। সেখানে জঠরে বেড়ে ওঠা ক্ষুদ্র ভ্রƒণ কি নিরাপদ, সহনশীল পরিবেশ আদৌ পাচ্ছে? ফলে বলা হচ্ছে মাতৃজঠর থেকেই শিশুর জন্ম হচ্ছে দূষণ বিষণ্ণতায়। আবার সদ্য পৃথিবীর আলো দেখা শিশুটিও বেড়ে উঠবে আর এক পরিবেশ বিঘ্নতার দারুণ কোপানলে।
প্রকৃতি দূষণতায় মা-শিশুই নয় বৃদ্ধরাও পড়ছেন চরম বিষণ্ণ আবহে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে আসছে বাংলাদেশ সেভাবে কার্বন নিঃসরণ করে না উন্নত বিশ্বের মতো। যেখানে যন্ত্র সভ্যতার আবিষ্কার আকাশ ছোঁয়া। আজ আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কম্পিউটারের সুবর্ণ সময় অতিক্রম করছি। উল্টো রথে নৈসর্গিক দুরবস্থাকেও তার প্রান্তসীমায় বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
যন্ত্র উন্মক্ত বিশ্ব নব আবিষ্কারের যাত্রাপথকে থামানোর বিপরীতে নিয়তই চক্রাকারে তা বৃদ্ধির চরম আয়োজনে মত্ত। তবে গবেষণা প্রতিবেদন বলছে বাংলাদেশ কার্বন নিঃসরণ কম করেও বিপর্যয়ের মাত্রাকে আলিঙ্গন করছে মারাত্মক আকারে। যার বিষময় কোপানলে সর্বাধিক আক্রান্ত সর্বংসহা জননী আর অবোধ, নিষ্পাপ অগণিত শিশু।
জন্মদাত্রী মাকেই যদি আমরা আগামীর প্রজন্মের জন্য সুস্থ, স্বাস্থ্যসম্মত আর সবল অবস্থায় দাঁড় করাতে ব্যর্থ হই তা হলে ধরিত্রী কি সহজ-স্বাভাবিক আর নিরাপদ যাত্রাপথের অংশীদার হতে পিছু হটবে না? গবেষণা প্রতিবেদন আশঙ্কা প্রকাশ করছে তীব্র বায়ু সংকটে বাংলাদেশ। প্রতি বছর পরিবেশ বিষণœতায় ৫২৫৮ শিশুসহ মোট এক লাখ দুই হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। শুধু তাই-ই নয়, ৯ লাখ মায়ের অকাল প্রসবে শিশু মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়াও এক অসহনীয় প্রতিবেশ।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভয়াবহ চিত্র উঠে আসার কারণ গ্রামনির্ভর উর্বর পলিমাটির বরেন্দ্র অঞ্চলটি প্রযুক্তির ছোঁয়া পেলেও সিংহভাগ নারী এখনো গ্রামীণ পরিবেশে গর্ভধারণ, সন্তান জন্ম, লালন-পালন সবই করেন। আর সেখানেই পড়ে যাচ্ছেন বায়ু দূষণের নির্মম শৃঙ্খলে।