আমরা প্রায়ই অলসতাকে উৎপাদনশীলতার অভাবের সঙ্গে তুলনা করি। তবে এটি শুধু নিস্ক্রিয় থাকা নয়।
অনেক সময়, অপ্রোডাক্টিভ মানুষ বুঝতেই পারে না যে তারা কি ধরনের অভ্যাসে আটকে গেছে। এই অজ্ঞানতা তাদের অলসতার চক্র থেকে বেরিয়ে আসাকে আরও কঠিন করে তোলে।
অলসতা কাটিয়ে ওঠার মূলমন্ত্র হলো এই আচরণগুলোকে প্রথমে চেনা, যা এর জন্য দায়ী। আমি এমন কিছু সাধারণ অভ্যাস পর্যবেক্ষণ করেছি এবং চিহ্নিত করেছি, যা অজান্তেই মানুষকে একই স্থানে আটকে রাখে।
আসুন, জেনে নিই এমন ১০টি অভ্যাসে, যেগুলো অলস এবং অপ্রোডাক্টিভ মানুষ প্রায়ই নিজেদের অজান্তে অনুসরণ করে।
১) ক্রমাগত বিলম্ব বা সর্বদা কাজ ফেলে রাখা
কাজ ফেলে রাখা হলো উৎপাদনশীলতার সবচেয়ে বড় শত্রু।
আমরা সবাই এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হই-যে কাজটি আজ করতে হবে তা আমরা বারবার পিছিয়ে দিই। কিন্তু এই "পরে" আর কখনোই আসতে চায় না। “ক্রমাগত বিলম্ব” এমন একটি অভ্যাস, যা ধীরে ধীরে আপনার দৈনন্দিন কাজে প্রবেশ করে এবং একটি ঘণ্টায় শেষ হওয়ার মতো কাজকে সপ্তাহব্যাপী সমস্যা করে তোলে।
এটি এমনভাবে কাজ করে যে, আমরা অনেক সময় বুঝতেই পারি না যে আমরা সময় নষ্ট করছি। আমরা মনে করি, হয়তো নিজেকে “বিরতি” দিচ্ছি বা “সঠিক সময়ের” জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু বাস্তবে, কাজ জমে যাচ্ছে এবং চাপ আরও বাড়ছে।
এই অভ্যাস চিহ্নিত করা হলো প্রথম পদক্ষেপ। এটি স্বীকার করে সচেতনভাবে এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মনে রাখবেন, এটি সময় থাকার বিষয় নয়; বরং সময় তৈরি করার বিষয়।
২) সকালের রুটিন বাদ দেওয়া
আমি একসময় এমন মানুষ ছিলাম যে বিছানা থেকে উঠে সরাসরি কাজ শুরু করতাম । না কোনো নাস্তা, না কোনো ব্যায়াম- সরাসরি কাজ।
কিন্তু পরে বুঝলাম, সারা দিন ধরে কেন আমি এত ধীরগতি আর অপ্রোডাক্টিভ থাকতাম। সকালের কোনো রুটিন না থাকা আমাকে অলস করে দিচ্ছিল।
সকালের রুটিন আমাদের মস্তিষ্ক জাগিয়ে তোলে, ইতিবাচক শক্তি দেয়, এবং দিন শুরু করার জন্য প্রস্তুত করে। যখন আমরা এগুলো বাদ দিই, তখন পুরো দিনের জন্য পিছিয়ে পড়ি।
আমি যখন নাস্তা, ব্যায়াম এবং বই পড়ার মতো অভ্যাস শুরু করলাম, তখন থেকেই আমি দিনটিকে অনেক বেশি কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারলাম।
আপনি যদি অলস অনুভব করেন, তাহলে আপনার সকালের রুটিনে নজর দিন। এটি হয়তো আপনার উৎপাদনশীলতার গুরুত্বপূর্ণ অনুপস্থিত টুকরো।
৩) একসঙ্গে অনেক কাজ করার চেষ্টা
একসঙ্গে অনেক কাজ বা “মাল্টিটাস্কিং” প্রাথমিকভাবে স্মার্ট সমাধান মনে হতে পারে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ২% মানুষই এটি সফলভাবে করতে পারে। বাকিদের জন্য এটি উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয়।
যখন আমরা একই সময়ে একাধিক কাজ করার চেষ্টা করি, তখন আমরা কোনো কাজেই পুরো মনোযোগ দিতে পারি না। এর ফলে অর্ধসমাপ্ত কাজ, ভুল এবং অপ্রয়োজনীয় চাপ সৃষ্টি হয়।
যদি আপনি এই অভ্যাসে আটকে যান, তবে একসঙ্গে একটির বেশি কাজ না করার চেষ্টা করুন। দেখবেন, আপনার উৎপাদনশীলতা বাড়ছে এবং মানসিক চাপ কমছে।
৪) শারীরিক স্বাস্থ্যের অবহেলা
আমাদের শারীরিক স্বাস্থ্য এবং উৎপাদনশীলতার মধ্যে সম্পর্ক সহজেই উপেক্ষিত হয়।
যখন আমরা আমাদের শরীরের যত্ন নিই না-যেমন সময়মতো খাওয়া, পর্যাপ্ত ঘুম না নেওয়া বা ব্যায়াম এড়ানো—তখন এটি অলসতা এবং অপ্রোডাক্টিভতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
শারীরিক অবস্থা খারাপ থাকলে আমরা মানসিকভাবে তীক্ষ্ণ এবং সক্রিয় থাকতে পারি না। তাই আপনার জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনুন এবং দেখুন কিভাবে এটি আপনার উৎপাদনশীলতাকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।
৫) স্পষ্ট লক্ষ্য না থাকা
লক্ষ্যহীনভাবে চললে যেকোনো কাজ অর্থহীন মনে হতে পারে।যাদের কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই, তারা প্রায়ই অলস হয়ে পড়ে। কারণ তাদের কাছে কাজের জন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকে না।
সুস্পষ্ট এবং অর্জনযোগ্য লক্ষ্য নির্ধারণ আপনাকে একটি দিকনির্দেশনা দেয়। এটি আপনাকে কাজে মনোযোগী হতে এবং এগিয়ে যেতে সহায়তা করে। অলসতার এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সচেতন হওয়া এবং নিজের উপর বিশ্বাস রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি বদলানোর জন্য আজ থেকেই পদক্ষেপ নিন। আপনার অভ্যাস বদলালেই জীবন বদলে যাবে।
৬)ব্যর্থতার ভয়
ব্যর্থতার ভয় খুবই শক্তিশালী হতে পারে, যা আমাদের অচল করে ফেলে এবং আমাদের স্বাচ্ছন্দ্যের জোনে আটকে রাখে। এটি আমাদের ঝুঁকি নিতে বা নতুন কিছু চেষ্টা করতে বাধা দেয়।
আমি অনেক অবিশ্বাস্য মানুষকে দেখেছি যারা তাদের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ব্যর্থ হওয়ার ভয়ে পিছিয়ে গেছে। তারা সেই প্রকল্প শুরু করতে পারে না, সেই কোর্স নিতে পারে না বা তাদের স্বপ্নের পেছনে যেতে পারে না, কারণ তারা ভয় পায় যে তারা সফল হতে পারবেনা।
কিন্তু সত্যিটা হলো,ব্যর্থতা জীবনের অংশ। এটা আমাদের শেখার এবং বেড়ে ওঠার উপায়। প্রায়ই, ব্যর্থতার ভয় আসল ব্যর্থতার চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর হয়।
আপনি যদি অপ্রোডাক্টিভ অনুভব করেন, আপনার ভয়গুলো খতিয়ে দেখুন। কি সেগুলো আপনাকে আটকে রেখেছে? মনে রাখবেন, প্রতিটি বড় অর্জন একটি ছোট পদক্ষেপ দিয়ে শুরু হয়। ব্যর্থতার ভয় আপনাকে সেই পদক্ষেপ নিতে বাধা দেবে না।
৭)পারফেকশনিজম
পারফেকশনিজম একটি দ্বৈত প্রকৃতি সম্পন্ন বিষয়। একদিকে, এটি আমাদের উচ্চ মানের কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে, তবে অন্যদিকে এটি আমাদের শেষ না হওয়া কাজ, প্রোকাস্টিনেশন এবং অবশেষে, অপ্রোডাক্টিভিটি সৃষ্টি করে।
আমি একটি প্রোজেক্টে কাজ করার সময় প্রতিটি বিস্তারিত ত্রুটি ঠিক করার চেষ্টা করছিলাম। আমি এটি ছেড়ে দিতে পারছিলাম না, এবং ফলস্বরূপ, আমি সময়সীমা মিস করলাম এবং পরিণতি স্বীকার করতে হলো।
পারফেকশনিস্ট হওয়া স্বাভাবিকভাবে খারাপ কিছু নয়। তবে যখন এটি আমাদের উৎপাদনশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করে এবং মানসিক চাপ তৈরি করে, তখন আমাদের পদ্ধতিটি পুনরায় মূল্যায়ন করা উচিত। মনে রাখবেন, শেষ করা সবসময় পারফেক্ট হওয়ার চেয়ে ভালো।
৮)অতিরিক্ত পরিকল্পনা
পরিকল্পনা করা উৎপাদনশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে অতিরিক্ত পরিকল্পনা করা উল্টো কাজের হতে পারে।
যখন আমরা অতিরিক্ত পরিকল্পনা করি, তখন আমরা “বিশ্লেষণ প্যারালাইসিসে” পড়ে যাই – এত বেশি সময় পরিকল্পনা ও সংগঠনের মধ্যে ব্যয় করি যে আমরা কিছুই কার্যকরভাবে করি না। এটি একটি ম্যারাথনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার মতো, কিন্তু প্রথম পদক্ষেপটিও কখনো নেওয়া হয় না।
পরিকল্পনা অবশ্যই থাকতে হবে, কিন্তু মনে রাখবেন এটি খোদ নিয়ম নয়। এটি একটি নির্দেশিকা, একটি বিধি নয়। আপনার পরিকল্পনা আপনাকে বাধাগ্রস্ত করতে না দেওয়ার চেষ্টা করুন। কখনও কখনও, সবচেয়ে ভালো কাজ করা হচ্ছে শুধু শুরু করা।
৯)চ্যালেঞ্জ এড়ানো
চ্যালেঞ্জগুলি ভয়ঙ্কর হতে পারে। তারা আমাদের কমফোর্ট জোন থেকে বের করে দেয় এবং আমাদের দুর্বলতাগুলোকে সামনে এনে দেয়। তবে চ্যালেঞ্জ এড়ানো অপ্রোডাক্টিভ মানুষের মধ্যে একটি সাধারণ আচরণ।
যখন আমরা চ্যালেঞ্জ থেকে পালিয়ে যাই, তখন আমরা নতুন কিছু শেখার এবং বাড়ানোর সুযোগ মিস করি। আমরা স্থির থেকে যাই, অগ্রগতি করতে পারি না।
অন্যদিকে, চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করলে আমরা নতুন দক্ষতা, জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করি। এই চ্যালেঞ্জগুলির মাধ্যমে আমরা বেড়ে উঠি এবং আরো উৎপাদনশীল মানুষ হয়ে উঠি।
যখন আপনি একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হোন, তখন পালিয়ে যাবেন না। এটি গ্রহণ করুন। আপনি যে কি করতে পারেন, তা দেখে অবাক হবেন।
১০)আত্মবিশ্বাসের অভাব
নিজের উপর বিশ্বাস রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর অভাবে, এমনকি সবচেয়ে ছোট কাজও আমাদের জন্য পাহাড়ের মতো মনে হতে পারে।
আত্মবিশ্বাসের অভাব আমাদের অপ্রোডাক্টিভিটি এবং অলসতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। যখন আমরা নিজের উপর বিশ্বাস করি না, তখন আমরা নতুন কাজ বা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে আগ্রহী হই না, যা আমাদের বিকাশ এবং উৎপাদনশীলতা বাধাগ্রস্ত করে।
নিজের ক্ষমতায় বিশ্বাস রাখুন। আপনার দক্ষতার উপর আস্থা রাখুন। আপনার সম্ভাবনার উপর বিশ্বাস রাখুন। এই আত্মবিশ্বাস আপনার উৎপাদনশীলতা এবং সফলতার ইঞ্জিন হতে পারে। শেষে, যদি আপনি নিজে বিশ্বাস না করেন, তবে আর কেউ করবেন কেন?
যাই হোক, মানব আচরণ বোঝা একটি জটিল বিষয় হতে পারে, বিশেষ করে যখন এটি উৎপাদনশীলতা বা এর অভাবের সাথে সম্পর্কিত।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখা হচ্ছে, অলসতা এবং অপ্রোডাক্টিভিটি জন্মগত বৈশিষ্ট্য নয়; এগুলি আচরণ, যা প্রায়শই অভ্যাস এবং মানসিকতার কারণে তৈরি হয়, যেগুলি সময়ের সাথে বিকশিত হয়।
এটি সহজ হতে পারে যে আপনি নিজেকে অলস বা অপ্রোডাক্টিভ হিসাবে চিহ্নিত করুন, তবে এই লেবেলগুলি আপনাকে সংজ্ঞায়িত করে না। আপনি যে আচরণগুলি চিহ্নিত করেছেন এবং পরিবর্তন করতে সচেতন পদক্ষেপ নেবেন তা আপনাকে সংজ্ঞায়িত করবে।
পরিবর্তনের প্রথম পদক্ষেপ হল আত্মসচেতনতা। এটি হল আপনার সামনে একটি প্রতিবিম্ব দেখার এবং আপনার বাধাগ্রস্ত করার আচরণগুলি চিহ্নিত করা।
একটি মুহূর্ত সময় নিন এবং চিন্তা করুন। এই আচরণগুলির মধ্যে কোনটি আপনার সাথে সম্পর্কিত? যদি হ্যাঁ, তবে নিরাশ হবেন না। পরিবর্তন সম্ভব। এটি সবই সচেতনতা দিয়ে শুরু হয়। আত্মসচেতনতা সহ, আপনি আপনার অভ্যাস, উৎপাদনশীলতা এবং শেষমেশ আপনার জীবন পরিবর্তন করার ক্ষমতা লাভ করবেন।
আফরোজা