ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২ পৌষ ১৪৩১

অর্জনই কি সাফল্যের নির্ণায়ক?

প্রকাশিত: ১২:০৩, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪; আপডেট: ১২:০৭, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪

অর্জনই কি সাফল্যের নির্ণায়ক?

ছবি: সংগৃহীত

যেকোনো অর্জন আমাদের জীবনে বিশাল গুরুত্ব বহন করে। তবে প্রশ্ন হলো, এগুলো কি আমাদের প্রকৃত মূল্যবোধ শিক্ষা দেয়, নাকি শুধুমাত্র সাময়িক স্বীকৃতি এনে দেয়? আমাদের প্রতিদিনের প্রচেষ্টা আর জীবনের লক্ষ্যগুলো কীভাবে নির্ধারিত হয়— এটাই আমাদের সাফল্যের প্রকৃত অর্থ নির্ধারণ করে।

মনোবিজ্ঞানী ড. কার্ল নাসার বলেন, “আপনার শৈশবের কথা ভাবুন। আপনার বাবা-মা কোন অর্জনগুলোকে বেশি উদযাপন করতেন? এটি কি ছিল পরীক্ষার ভালো ফলাফল, খেলাধুলার জয়লাভ, নাকি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জয়?”

তিনি তার নিজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, “ছোটবেলায় যখন পরীক্ষায় এ-প্লাস পেতাম, তখন আমার পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। আমার জন্য তারা বিশেষ কিছু করতেন—গভীর ভালোবাসার হাসি, গল্পগুজব, বা প্রিয় বই কেনার জন্য দোকানে নিয়ে যাওয়া। সেই মুহূর্তগুলো আমাকে বোঝাত, আমি পরিবারের আশা ও ভরসার প্রতীক। আমার মনে এমন অনুভূতি তৈরি হতো, যেন আমি সত্যিই মূল্যবান। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, শুধুমাত্র পরীক্ষার ফলাফলই কি আমাদের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করতে পারে?”

তিনি বলেন, “এই ছোট ছোট উদযাপনগুলো আমাদের ব্যক্তিত্বের ভিত্তি তৈরি করে। এগুলো আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং বড় স্বপ্ন দেখতে উত্সাহিত করে। কিন্তু একই সঙ্গে, এই অর্জনগুলো আমাদের জীবনে একধরনের চাপ তৈরি করে। আমরা নিজেদের অর্জনের মাধ্যমে প্রমাণ করার প্রবণতায় আটকে যাই। গবেষণায় দেখা গেছে, এই ধরণের প্রভাব কখনও কখনও এমন এক সমাজব্যবস্থা তৈরি করে যেখানে আমরা শুধুমাত্র অন্যদের মূল্যায়ন পেতে কাজ করে যাই। এটি দীর্ঘমেয়াদে আমাদের আত্মমূল্যায়ন এবং অন্যদের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।”

ড. নাসার ইতিহাসের দৃষ্টান্ত টেনে বলেন, “২০,০০০ বছর আগের একটি ছোট্ট গ্রামের কথা কল্পনা করুন। সেখানে একটি মেয়ে, তারি। সে এমন এক সমাজে জন্ম নিয়েছে, যেখানে তার আশেপাশের ৪০ জন তাকে ভালোবাসা আর যত্ন দিয়ে বরণ করেছে। ছোটবেলা থেকেই তারি অনুভব করত, সে এই পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তার মূল্য অন্তর্নিহিত এবং তা প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই।”

তারির প্রতিভাগুলো সময়ের সঙ্গে প্রকাশ পায়। তারি মুগ্ধকর বাঁশি বাজাতে পারত, ছিল নির্ভুল নিশানার দক্ষতা, এবং ওষধি গাছ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান। গ্রামের মানুষ তার প্রতিভাগুলোকে সমর্থন দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেত। তারা তার প্রতিটি অর্জন উদযাপন করত। এই সমর্থনের ফলে তার প্রতিভাগুলো তার আত্ম-প্রকাশের মাধ্যম হয়ে ওঠে। তার সংগীত মানুষের মনকে ছুঁয়ে যেত এবং সমাজকে আরও ঘনিষ্ঠ করে তুলত। কিন্তু আধুনিক সমাজে দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন।

“আজকের সমাজে আমরা ছোটবেলা থেকেই এক ভিন্ন বাস্তবতায় বেড়ে উঠি,” তিনি বলেন। “আমাদের বাবা-মা, শিক্ষক এবং কোচ—তারা হয়তো আমাদের ভালোবাসেন, তবে সেই ভালোবাসা প্রায়শই আমাদের অর্জনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কল্পনা করুন একজন শিক্ষক, যিনি ২৫ জন শিক্ষার্থীর ক্লাস পরিচালনা করছেন। বা একজন কোচ, যিনি ১৬ জন ছোট খেলোয়াড়কে খেলার নিয়ম শেখানোর চেষ্টা করছেন। এমন পরিস্থিতিতে তারা অনেক সময় আমাদের অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ বা প্রতিভাগুলো দেখতে পান না।”

তিনি আরও যোগ করেন, “এই ঘাটতির ফলে আমরা একটি বার্তা পেয়ে বড় হই—আমাদের মূল্য আমাদের অর্জনের উপর নির্ভরশীল। ভালো নম্বর পাওয়া, পুরস্কার জয় করা বা প্রতিযোগিতায় সেরা হওয়া—এসবই যেন আমাদের গুরুত্ব নির্ধারণ করে। এভাবে আমরা একসময় অর্জনের ফাঁদে আটকে যাই। আমরা মনে করি, যত বেশি অর্জন করব, তত বেশি মূল্যবান হব। কিন্তু আসলে কি হয়? আমরা পরিশ্রম করি, পুরস্কার আর স্বীকৃতি অর্জন করি, তবে শেষ পর্যন্ত এটি আমাদের ভেতরে এক শূন্যতা রেখে যায়।”

তিনি বলেন, “কল্পনা করুন আমাদের স্কুলের গ্রেডিং পদ্ধতি। এটি কেবল আমাদের নির্ধারণ করে আমরা কত ভালোভাবে পড়া শেষ করেছি বা পরীক্ষায় কত নম্বর পেয়েছি। কিন্তু এটি কখনও আমাদের কৌতূহল, সহানুভূতি বা সমাজের প্রতি অবদানের মানকে মাপে না।"

ড. নাসার মনে করেন, অর্জনের প্রকৃত শক্তি তখনই প্রকাশ পায়, যখন এটি আমাদের নিজস্ব প্রতিভা আর ভালোবাসার সঙ্গে মিলে যায়। তিনি বলেন, “তারি যেমন তার সংগীত দিয়ে সমাজকে একত্রিত করত, তেমনই আমাদের অর্জনও যদি অন্যদের কল্যাণে নিবেদিত হয়, তবেই তা অর্থপূর্ণ হয়। তবে অর্জন যদি শুধুমাত্র আমাদের নিজের মূল্য প্রমাণের জন্য হয়, তাহলে তা কখনোই আমাদের সত্যিকারের সুখ দিতে পারে না।”

তাই, তিনি পরামর্শ দেন, “যখন আপনি কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করবেন, নিজেকে একটি প্রশ্ন করুন: ‘আমি এটি কেন করছি?’ আপনার অর্জনের উদ্দেশ্যই নির্ধারণ করবে এটি আপনাকে সত্যিকারের সাফল্য এনে দেবে কিনা।”

অর্জন তখনই অর্থবহ হয়, যখন তা আমাদের আত্মপ্রকাশ এবং অন্যদের প্রতি ভালোবাসার প্রতিফলন হয়ে ওঠে।

মেহেদী কাউসার

×