ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

নারীর জীবন: বৈষম্যের শিকল ভাঙার লড়াই

সাবরিনা শুভ্রা

প্রকাশিত: ১৪:১৬, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪; আপডেট: ১৪:১৭, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪

নারীর জীবন: বৈষম্যের শিকল ভাঙার লড়াই

সাবরিনা শুভ্রা

একটি সন্তান জন্মানোর পর প্রথম প্রশ্ন ওঠে, ছেলে না মেয়ে? এই সাধারণ প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আমাদের সমাজের গভীর বৈষম্য। মেয়ে শিশুর জন্ম অনেকের কাছে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, আর ছেলে সন্তানের জন্ম যেন আনন্দের উৎস। ছেলেকে পরিবারের ভবিষ্যৎ, উপার্জনক্ষম, এবং দায়িত্বশীল উত্তরাধিকারী হিসেবে ভাবা হয়। অন্যদিকে, মেয়েদের কেবল বিয়ের উপযুক্ত করে তোলাই যেন তাদের বড় করার প্রধান উদ্দেশ্য। আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি মেয়েদের মানুষ হিসেবে নয়, বরং বোঝা হিসেবে দেখে। অথচ মেয়েরাও পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারে, জীবনে বড় কিছু করতে পারে—এই ধারণা এখনও অনেকের মননে স্থান পায়নি।

নারী-পুরুষ উভয়েই মানুষ, কিন্তু আমরা তাদের মাঝে বিভেদ তৈরি করি। নারীর ক্ষমতায়ন শব্দটিই যেন অপ্রয়োজনীয়—ক্ষমতায়ন কেন? নারী তো জন্মগতভাবেই সক্ষম, মানুষ হিসেবে। বরং সমাজের উচিত নারীকে মানুষ হিসেবে দেখা এবং তার যোগ্য সম্মান দেওয়া। আমাদের সমাজে, এমনকি উন্নত দেশগুলোতেও, নারীদের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। হিলারি ক্লিনটন বা কমলা হ্যারিসের মতো যোগ্য নেত্রীও সমাজের এই গোঁড়ামির শিকার। কারণ একটা ওরা বিশ্বাস করে না যে একজন নারীর পক্ষে আমেরিকার মতো ক্ষমতাধর রাষ্ট্র চালাতে পারবে। তাই প্রয়োজন নারী-পুরুষের মধ্যে এই বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি দূর করে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার মানসিকতা গড়ে তোলা।

একটা মেয়ে যখন বড় হয়, তার জীবনের সবচেয়ে বড় বাঁধা হয় বিয়ে। মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া মানে যেন মেয়েকে পরিবারের দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে দেওয়া। সমাজের এই চাপ এমন যে, মেয়ে যদি সময়মতো বিয়ে না করে, তাহলে বাবা-মায়ের জন্য সেটা এক বিশাল ব্যর্থতা। অথচ ছেলের ক্ষেত্রে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কতটা সতর্কতা, বিচার-বিশ্লেষণ হয়! ছেলের পরিবার পাত্রীর পরিবারকে নানা প্রশ্ন করে, কিন্তু মেয়ের পরিবারকে অনেক ক্ষেত্রেই এসব সুযোগ দেওয়া হয় না। শুধু ছেলে ভালো উপার্জন করে, বাড়ি-গাড়ি আছে শুনলেই মেয়েকে সঁপে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই ছেলেটি যদি অন্যায় কাজে যুক্ত থাকে, মানুষ হিসেবে খারাপ হয়—এসব নিয়ে খুব একটা চিন্তাভাবনা করা হয় না। টাকা যেন হয়ে দাঁড়ায় একমাত্র যোগ্যতার মাপকাঠি।

আরও দুঃখজনক হলো, বিয়ের পর মেয়েদের জন্য জীবন যেন একটা বন্দিশালা হয়ে যায়। একটা নাটক দেখে যা বুঝলাম, সেই বাস্তবতাই আমাদের সমাজে বিদ্যমান। মেয়ের বিয়ে হলো এমন একজনের সঙ্গে, যিনি ডাক্তার। কিন্তু সেই পরিবার মেয়েকে পড়াশোনা বা চাকরি করার স্বাধীনতা দেয়নি। তাদের কাছে পুত্রবধূ মানে ঘরের কাজ, রান্নাবান্না, এবং সন্তানের দেখভালের জন্য একপ্রকার দাসী। ছেলের শাশুড়ি সোজাসাপ্টা বলে দিলেন, বুয়ার রান্না ছেলে খায় না, তাই সারাদিন রান্না করতে হবে। এমনকি নিজের সন্তানদের পড়াশোনা করানোর দায়িত্বও মেয়েকেই নিতে হবে। মেয়ের বাবা-মা সবকিছু জেনেও মেনে নিয়েছে, কারণ মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেলে সমাজের চোখে অপমানিত হতে হবে।

তবুও বিয়ে ভেঙে গেলে মেয়ের মায়ের কান্না থামে না। সেই শাশুড়িকে অভিশাপ দেওয়া হয়, কিন্তু মেনে নেওয়া হয় না যে, মেয়ের অধিকার ও স্বাধীনতা আগে রক্ষা করা উচিত ছিল। এই অন্ধ সামাজিক চাপ আর বৈষম্য মেয়েদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। অথচ মেয়েদেরও নিজের পছন্দমতো জীবন গড়ার অধিকার রয়েছে। আমাদের সমাজে এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি।

নিজের চোখে দেখেছি, মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সময় কত মিথ্যার মোড়কে মানুষ সত্য লুকিয়ে রাখে। বিদেশে থাকে, বড় চাকরি করে বলে পরিচয় দিলেও পরে জানা যায়, সে ক্লিনারের কাজ করে। ক্লিনারের পেশা সম্মানের, কিন্তু বিয়ের সময় এ সত্য কেন লুকানো হলো? এমনকি দেশের কেউ এই পেশায় থাকলে মেয়ের পরিবার রাজি হতো না। আরেকজনের কথা, পরিচয় দেওয়া হলো, অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্র, পরে জানা গেল, ডিগ্রিও পাশ করেনি। বড় চাকরি, কিন্তু বিয়ের পর স্ত্রীকে বাপের বাড়ি থেকে টাকা এনে দিতে চাপ দেয়—তার অপরাধজগৎ তখন সামনে আসে। এসব দেখেও মেয়ে বিয়ে দেওয়ার আগে কেন একটু যাচাই-বাছাই করা হয় না? মেয়েকে জীবনের অনিশ্চিত গাঙে ভাসিয়ে দেওয়ার আগে খেয়াল করা উচিত, সেখানে লুকিয়ে থাকা কুমিরটি কত ভয়ংকর!

নারীর জীবনের প্রথম বাঁধাটি আসে সেই ঘর থেকেই, যেখানে তার জন্ম। আশ্চর্যের বিষয়, এই বাঁধার উৎস অনেক সময়ই হয় তার নিজের পরিবারের নারীরা। মেয়েটি উচ্চশিক্ষা নিতে চায়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়—তাতেও আপত্তি ওঠে, আর তা অনেক সময়ই আসে ঘরের অন্য নারীদের কাছ থেকে। সমাজের চোখে মেয়ের বিয়ে না হলে সেটা যেন বিশাল অপরাধ, আর এই বোঝাটি বাড়িয়ে দেয় পাশের বাড়ির ভাবী কিংবা আত্মীয়রা। কর্মক্ষেত্রে বা জীবনের প্রতিটি ধাপে নারীদের পেছনে টেনে ধরার জন্য পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও একাংশ দায়ী। নিজের স্বপ্ন পূরণ কিংবা সম্মান রক্ষার জন্য নারীদের প্রতিনিয়ত লড়তে হয় শুধু বাইরের মানুষের সঙ্গে নয়, বরং তাদের নিজেদের ঘর থেকেও।

এই বৈষম্যের শিকড় সমাজের গভীরে প্রোথিত। ঘর থেকে রাস্তায়, কর্মক্ষেত্র থেকে সামাজিক মঞ্চ—প্রতিটি জায়গায় নারীদের সামনে দাঁড়ায় বাধা। একজন মেয়ে কোথাও একা থাকলে, তার দিকে যেন সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। এই দৃষ্টি শুধু তাকে বিচার করে না, বরং তাকে হেয় করে, ছোট করে। আর এই বৈষম্য, অন্যায় আর নিপীড়নের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয় প্রতিটি নারীকে।

পরিবর্তন আনার দায়িত্ব আমাদের সবার। নারীরা যদি একে অপরের পাশে দাঁড়ায় এবং পুরুষরা যদি নারীকে মানুষ হিসেবে দেখতে শেখে, তবে সমাজের এই গোঁড়ামি ভাঙতে সময় লাগবে না। নারীর জীবন সহজ বা সুরক্ষিত করার জন্য শুধু আইন বা নীতি নয়, প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। নারী-পুরুষ সবাই মিলে যদি মানবিক মূল্যবোধে জাগ্রত হয়, তবে হয়ত একদিন এ বৈষম্যের যুগের অবসান ঘটবে।

আর কে

×