অপরিণত নবজাতকের মৃত্যু। দুঃসহ বাতাবরণের করুণ আখ্যান। সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন থাকেন গর্ভধারিণী মা। দেশে অকাল মাতৃত্বের নির্মম পরিণামও বহুবার আলোচিত এক অসহনীয় বিষয়। শিশু মৃত্যু ও মায়ের স্বাস্থ্য নিবিড়ভাবে একীভূত। সঙ্গত কারণে সবার আগে এসে যায় জন্মদাত্রী মায়ের জীবনাচরণ, সংস্কার, মূল্যবোধ আর প্রচলিত বিধি তো বটেই। যে সমাজে আজও বাল্যবিয়ে কমানো গেল না তেমন পশ্চাৎপদ কাঠামোর গভীরে জিইয়ে থাকে নানাবিধ অনাসৃষ্টিও। আর বাল্যবিয়ের অপরিণামদর্শিতায় ঠেকানোই যায় না অকাল মাতৃত্বের চরম প্রকোপও। যা আমাদের মতো উন্নয়নশীল সমাজের অবধারিত দুর্ভোগ। একজন শিশু কিংবা কিশোরী কন্যার বালিকা বয়সে বিয়ে হয় সেখানে ঘাত-প্রতিঘাত তো পদে পদে। পুতুল খেলার স্বাচ্ছন্দ্যময় বয়সে তাকে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। পরিণামে যা হওয়ার তা ঠেকানোর উপায় না থাকাও আর এক অকাল বোধন বলাই যায়। নতুন সময় ও যুগের নব আঙ্গিক তো নয়ই। বহু যুগ ধরে চলে আসা এক চিরায়ত অপসংস্কারের প্রবল অপঘাত। শরীর ও মনের স্বাভাবিক পরিপক্বতা, মানসিক গড়ন, বোধ-বুদ্ধি জেগে ওঠা সবই এক সুতায় গাঁথামালা। অকাল মাতৃত্বে অপরিণত শিশু জন্ম আর এক দুর্বিষহ নাকাল সময়। যথা সময়ের আগে কন্যা শিশুর গর্ভে যখন আর একটা নতুন ভ্রƒণ তৈরির সম্ভাবনা থাকে মায়ের জন্য শুভ সংকেত তো নয়ই। নতুন প্রজন্মও মায়ের গর্ভে স্বস্তি আর নিশ্চিন্তে বেড়ে উঠতেও হোঁচট খেতে হয়। এখানেই শেষ নয় কিন্তু। পরের সময়ও নিরাপত্তার বেষ্টনী বিঘ্নিত হলে মা-সন্তান উভয়েই পড়ে চরম বিপাকে। জন্ম যখন চরম দুঃসময়ের আবর্তে মৃত্যুও যেন হাতছানি দেওয়ার দুরবস্থায়।
‘বাংলাদেশে অপরিণত শিশুর বোঝা, গৃহীত পদক্ষেপ ও উত্তরণ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় সম্প্রতি এমন তথ্য উঠে আসে। বলা হচ্ছে দেশের ১৬ শতাংশ শিশুর জন্ম অকালে, শারীরিক ও মানসিক অপরিপক্বতায়। প্রতি ঘণ্টায় অন্তত কম ওজনের ৩ সদ্যভূমিষ্ঠ শিশু অসময়ে চলে যাওয়া পারিবারিক এক দুঃসহ পরিস্থিতি। প্রতিরোধ কিংবা চিকিৎসাহীনতা সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ। তবে সম্মুখ সমরে মা ও শিশুকে লড়াই করতে হয় বাঁচার তাগিদে। আইসিডিডিআরবি আর পিজির যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় মা ও সদ্যজাত শিশুর ওপর এক সময়োপযোগী কর্মশালা। গবেষক, বিশ^বিদ্যালয়ের চিকিৎসক ছাড়াও সরকারি কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে কর্মশালার বিরাট আয়োজনে মা ও শিশুর ওপর প্রাসঙ্গিক তথ্য-উপাত্ত উঠে আসে। এমন সম্মিলন সভায় বলা হয় চিকিৎসা যা আছে তাও ব্যবহার হচ্ছে না। এটাই নিরেট বাস্তবতা। মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক গবেষক ও বিজ্ঞানীদের প্রাসঙ্গিক আলোচনায় হরেক দিকনির্দেশনাও তুলে ধরা হয়। মাতৃগর্ভে ভ্রƒণের অবস্থান, সময়, বেড়ে ওঠার পরিবর্তনও দর্শক-শ্রোতাদের অবহিত করা হয়। মাকে কততম সপ্তাহে অত্যন্ত সতর্ক, সাবধানতায় চলাফেরা করতে হয় তাও নির্দিষ্টভাবে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ২৮ সপ্তাহ পূর্ণ না হলে শিশুর শরীর-স্বাস্থ্য অপরিপক্বই থাকে। গর্ভপাত হওয়ার আশঙ্কাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শিশু মায়ের জঠরে নিরাপদ বেষ্টনীতে থাকার সময় মোট ৪০ সপ্তাহ। তার আগে জন্ম মা ও শিশুর জন্য অমঙ্গল ডেকে আনার দুর্বিপাক। একজন সুস্থ, সবল মা-ই পারেন দেশের আগামীর প্রজন্মকে সুন্দর পৃথিবীর আলো দেখাতে। মায়ের স্বাস্থ্যই যদি বিপন্নতার আবর্তে পড়ে তা হলে গর্ভজাত সন্তানের নিরাপত্তার বলয় কোথায়? প্রশ্ন উঠতেই পারে। সঙ্গত কারণে অপরিণত শিশু ও মাতৃগর্ভ থেকে কিছু রোগ-বালাই নিয়ে আসে। শ^াসকষ্ট, জন্ডিস এবং রক্তস্বল্পতার আকালে পড়তেও সময় লাগে না। তার সঙ্গে যুক্ত হয় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চাইতে কম থাকা। যা সদ্যজাত শিশুর জন্য নিরাপদ কিংবা স্বস্তিদায়ক হয়ই না। ফলে সহজাত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও ঝুঁকির আবর্তে পড়ে। বিভিন্ন রোগ সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার দুরবস্থাও ঠেকানো মুশকিল। সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া, মৃগি রোগ এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিকতার সমস্যাও মাথাচাড়া দেয়। সব মিলিয়ে শরীর যেমন আক্রান্ত থাকে পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যও বিগড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় পড়ে যায় নবজাতক। এমন শরীর ও মনের বিপন্নতা নিয়ে শিশু জন্ম হার নাকি বাংলাদেশেই বেশি। বিশে^র ১০৩টি দেশ নিয়ে করা গবেষণা তথ্যে এমন বিপন্ন চিত্র বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মের অশনি সংকেত। শুধু কি তা-ই? সন্তান ভূমিষ্ঠ করা মায়ের স্বাস্থ্য অনিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা দেশের জন্য ভালো কিছু নয়। আর এমন কম ওজন আর স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে জন্ম নেওয়া নবজাতকরা পরিবার থেকে সার্বিক সামাজিক পরিসীমায় এক প্রকার আশঙ্কার মধ্যেই জীবন কাটানো সংশ্লিষ্টদের জন্য মারাত্মক দুরবস্থা। স্বাস্থ্য আর মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে থাকা কষ্টকর এবং জীবন প্রবাহ। যাতে শুধু মা-শিশুই নয় পারিবারিক নির্মল আঙিনাও বেসামাল হতে সময় লাগে না। বিশে^র বিভিন্ন দেশে এমন ঝুঁকিপূর্ণ বিপন্ন শিশুদের নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন থেকে স্বাস্থ্য বিষয়ক সুরক্ষা ছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ রোগ-বালাই চিহ্নিত করে সমাধানের পথও নির্দেশ করা হয়েছে। এমন বিপন্ন নবজাতকের মধ্যে কন্যার চাইতে পুত্রের সংখ্যা বেশি বলে গবেষণা প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশে বিশেষ জ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে নবজাতকের শারীরিক দৌর্বল্য ও মৃত্যু ঠেকানো যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা অভিমত ব্যক্ত করছেন। বিশেষ করে আপাতত দীর্ঘকাল চলে আসা কিছু অপসংস্কার দূর করতে পারলে সার্বিক না হোক আংশিক সমাধান বিপন্ন প্রতিবেশের ন্যায্যতা। বাল্যবিয়ে, নারী নির্যাতন, পরিবেশ দূষণ থেকে মা-শিশুকে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে আসতে পারাও সময় ও আকাল পরিস্থিতির ন্যায্যতা। আর বিভিন্ন হাসপাতালে স্বাস্থ্য ঝুঁঁকির বিপন্নতায় আক্রান্ত নবজাতকের জন্য দেশে সুচিকিৎসা আছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত হলেও যা আছে তাই দিয়ে নবজাতকের সযত্ন পরিচর্যা দরকার।
অপরিপক্ব নবজাতক
শীর্ষ সংবাদ: